Saturday, September 28, 2019

সাংসারেক মান্দিরাংনি ওয়ান্না


সাংসারেক মান্দিরাংনি ওয়ান্না গ্রন্থটি এখন থেকে রকমারি থেকেও সংগ্রহ করা যাবে। এছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটের বাতিঘর ও আজিজ সুপার মার্কেটের সন্ধি পাঠ - এ পাওয়া যাচ্ছে। আপসানের( Apsan)  মাধ্যমেও অনলাইনে বইটি সংগ্রহ করা যাবে।
রকমারির লিংক
https://www.rokomari.com/book/189722
বইটি প্রকাশিত হয়েছে থকবিরিম প্রকাশনী থেকে।

Monday, February 18, 2019

প্রথাগত গাঁজায়িত খাদ্য ও পানীয় ঃ বহুজাতিকের খাদ্য-পানীয় বাণিজ্যের বিপরীতে আমাদের লড়াকু খাদ্যাভ্যাস

জুয়েল বিন জহির

.
“ফয় সা, ফয় গিনি, ফয় গিত্তাম
ফয় বংআ, ফয় দক, ফয় সিন্নি
ফয় চেত,ফয় স্কু,ফয় চিথিং
ফয় স্রাং। আঃ...

বাগিপ্পাখো হনগিপ্পাখো ফাথি গিপ্পাখো অং

আৎগিপ্পাখো বাআংগিপ্পাখো জাল্লেৎগিপ্পাখো
থম্মিদন গিপ্পানা রাক্ষিগিপ্পানা সালাম দাক্কেংজক 
গালাম অন্নেংজক।*

চিংআদে নরমান্দেদে দেমাঋষিদে ইয়

সকগিপ্পা ইয় নাগিপ্পা উমুক আসংনি উমুক
চিগানি গিমিক রাংজক ওয়াকিয়াংজক...

ভাবানুবাদঃ

প্রথম বন্দনা, দ্বিতীয় বন্দনা, তৃতীয় বন্দনা
চতুর্থ বন্দনা,পঞ্চম বন্দনা, ষষ্ঠ বন্দনা
গপ্তম বন্দনা, অষ্টম বন্দনা নবম বন্দনা
দশম বন্দনা করি।

পুণঃ বন্দনা করি। আঃ...
জন্মদাতা,দানকারী, পরিবেশ সৃষ্টিকারী,সম্প্রসারণকারী,ফল দানকারী, ফসল বৃদ্ধিকারী
সম্মানদানকারী, প্রাণরক্ষাকারী এবং ধনজন রক্ষাকারী দেব-দেবীদের উদ্দেশ্যে সালাম জানাই, প্রণাম জানাই। আমরা নরমানব, যুবঋষি উমুক গ্রামের বাসিন্দা, উমুক নদীর তীরবর্তী স্থানে বসবাসকারী আমরা তোমাদের স্তব করি, পূজা করি।

[সাংসারেক মান্দিদের রুগালার মন্ত্র]

সাংসারেক মান্দিদের বিশ্বাস মতে, মিদ্দি বাগবা হলেন সকল প্রাণের জন্মদাত্রী। মানুষ-পশু-পাখি-সাপ-ব্যাঙ-লতা-পাত-বৃক্ষ-গুল্ম সকল প্রাণই তাঁর গর্ভজাত সন্তান। সেই হিসেবে আমরা প্রত্যেকেই একে অপরের সাথে নাড়ীর সম্পর্কে সম্পর্কিত। আর তাই বিনা প্রয়োজনে সেগুলোর ধবংস মারাং বা দূষণীয়। সেগুলোর লালন-পালন তাই অতিযত্সাথেই করতে হয়।  মান্দিরা তাদের বিভিন্ন আমুয়াতে গুরিরুয়া করে থাকেন। গুরিরুয়াতে কোন অসুস্থ ব্যক্তির অসুস্থতা নিরাময়ের জন্য সংশ্লিষ্ট মিদ্দির (দেবতার) আমুয়ার সময় নারীরা  গুরিরুয়ার  অংশ গ্রহণ করে থাকেন। ৫/৭/১১ অর্থ্যাৎ বিজোড় সংখ্যক নারীরা বারা জাঙ্গি  পরিধান করে বুকে ফং ভর্তি চু বা রংজাঙ্গি  নিয়ে দেবতাদের উদ্দেশ্যে ধীর লয়ে ঘুরে ঘুরে নৃত্য-গীত পরিবেশন করে থাকেন। অসুস্থ ব্যক্তির আত্মাকে রংজাঙ্গিতে নিয়ে দেবতাদের সন্তুষ্টির নিমিত্তে নাচ-গানের মাধ্যমে অসুস্থ আত্মা বা প্রাণকে সুস্থ করে তোলা এবং জগতের সকল প্রাণের মঙ্গল কামনা করেই এই গুরিরুয়া করা হয়।  প্রাণ ও প্রকৃতির সাথে মান্দি দাকবেওয়ালের(সংস্কৃতির) যোগাযোগ কতটা গভীর তা সহজেই অনুমেয়। কেবল মান্দিই নয় বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসরত বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যেই প্রাণ ও প্রকৃতি সাথে তাদের লোকায়ত জীবন ধারার বিশ্বাসী চর্চা তাদের আপন আপন প্রথাগত জ্ঞান কাঠামোকে ঋদ্ধ করে তুলেছে। প্রাণ-প্রকৃতির সাথে তাদের প্রথাগত সম্পর্ক বাস্তুতন্ত্রের বিভিন্ন ফুড চেইন বা খাদ্য শৃঙ্খলকে যুগ যুগ ধরে সজীব ও বহমান রাখতে সহায়ক ভূমিকা রেখে চলেছে। জাতিগোষ্ঠীসমূহের আপন আপন খাদ্যাভ্যাস তাদের পারিপার্শ্বিক বাস্তুতান্ত্রিক জগতের অপরাপর উপদানের সাথে সহাবস্থান নিশ্চিত সাপেক্ষে গড়ে উঠেছে। আমাদের মান্দি,চাকমা, মারমা, মান্দি, মণিপুরী, ত্রিপুরা,সাঁওতাল, মুন্ডা, মাহাতো প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর,এমনি বাঙালির খাদ্যাভাস লক্ষ্য করলেই ব্যাপারটা বেশ সহজে বুঝা যায়। এখানে প্রাণ-প্রকৃতির কোন উপাদনেরই কোন অপচয়ের জায়গা নেই, আধিপত্য বিস্তারের মনোবাসনা নেই, বাণিজ্যিক মনোপলির কোন বিষয় নেই আছে কেবল আপন আপন লোকায়ক জ্ঞান কাঠামোর সাহসী চর্চার ভেতর দিয়ে প্রাণ-প্রকৃতি সংরক্ষণের নানাবিধ কৌশলের প্রয়োগ। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের মধ্যে যুগ যুগ ধরে ফার্মেন্টেড বা গাঁজায়িত খাদ্য ও পানীয়ের প্রচলন তেমনই একটা চর্চা বা কৌশল যা প্রাণ-প্রকৃতির সাথে তাদের সহজ, সরল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আমাদের সামনে হাজির করে। ফার্মেন্টেডেড বা গাঁঁজায়িত খাদ্য ও পানীয় একদিকে যেমন তাদের প্রথাগত খাদ্যাভ্যাসকে  সহজ করেছে, প্রাণ-প্রকৃতি বান্ধব করেছে তেমননি তাদের আপন আপন জাতিগত পরিচয় তুলে ধরার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ পালন করে চলেছে। যেমনঃ সুইবাম এর কথা বললে যেমন মৈতৈ মণিপুরি, মিয়া মিচেং বা চু বা নাখাম বললে যেমন মান্দি জাতির বা কাঞ্জির ভাত, পান্তা ভাত বললে যেমন বাঙালির জাতির পরিচয় সামনে চলে আসে। বর্তমান কর্পোরেট সংস্থা সমূহ মারদাঙ্গা চুরি/লুষ্ঠনের মধ্যদিয়ে বিশ্বজুড়ে যে বায়োকলোনিয়াল ব্যবস্থাকে কায়েম করেছে তার বিপরীতে জাতিগোষ্ঠীসমূহের আপন আপন খাদ্যাভ্যাসের ভেতর দিয়ে নিজেদের লড়াকু অবন্থান জারি রেখেছেন।

২.
গাঁজায়িত খাদ্য ও পানীয় হচ্ছে প্রাণীজ বা উদ্ভিজ্জ উৎসের সে সকল খাদ্য বা পানীয়, যা লেক্টোফার্মেন্টেশন পদ্ধতিতে উৎপাদিত হয়; যেখানে প্রাকৃতিকভাবে বিরাজমান ব্যাকটেরিয়া, চিনি ও শর্করা জাতীয় খাদ্যের উপর নির্ভর করে এবং ল্যাকটিক এসিড উৎপাদন করে; অথবা ফার্মেন্টেশন বা গাঁজায়ন হচ্ছে অবাত পরিবেশে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি যা অনুজীব, ঈস্ট বা ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে শর্করাকে ভেঙ্গে এ্যালকোহল বা জৈব এসিডে পরিণত করে। গাঁজায়িত খাদ্য ও পানীয়তে বৈচিত্রপূর্ণ ও প্রচুর পরিমাণে রোগ-প্রতিরোধকারী ও উপকারী ব্যাকটেরিয়া ও অধিকতর অণুপুষ্টি (Micronitrients) পাওয়া যায়। তাছাড়া অনেক টাটকা খাদ্য ও পানীয়তে বিরাজমান অণুপুষ্টি সমূহ আবদ্ধ(Bio-unavailabe) অবস্থায় থাকে, যা দেহ কৃর্তক শোষণ উপযোগি থাকে না। কিন্তু গাঁজন প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত খাদ্য ও পানীয়সমূহ এসব অণুপুষ্টি সমূহকে মুক্ত করে দেয় ফলে মানবদেহ কর্তৃক সেগুলো সহজে শোষিত হতে পারে।
গাঁজায়িত খাদ্য ও পানীয় নিয়ে বর্তমানে বেশ গবেষণা চলছে। বিভিন্ন গবেষণালব্ধ ফলাফলে গাঁজায়িত খাদ্য ও পানীয়ের যেসকল উপকারি দিকগুলো আমাদের সামনে চলে এসেছে, সেগুলো হলো -

ক. প্রোবায়োটিকস ঃ

একে জীবন্ত অণুজীব হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। গাঁজায়িত খাদ্য ও পানীয়তে প্রচুর পরিমাণে প্রোবায়োটিকস থাকে যা ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স বৃদ্ধিতে, মহিলাদের মূত্রনালীর সংক্রমনে,অন্ত্রের ক্রিয়াকলাপে, ভ্রমণকারীদের ডায়রিয়া প্রতিরোধে, প্রদাহজনিত রোগে সর্বোপরি মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। গাঁজায়িত খাদ্যের মাধ্যমে প্রোবায়েটিক মানুষের অন্ত্রে প্রবেশের সাথে সাথেই তার কাজ শুরু করে দেয়।

খ. খাদ্য সংরক্ষণে ঃ

সেই প্রাচীনকাল থেকেই গাঁজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খাদ্য সংরক্ষণ করে আসছে মানুষ। মান্দিদের নাখাম, চাকমা-মারমা-ত্রিপুরাদের নাপ্পি, মণিপুরিদের সৈবাম প্রথাগত খাদ্য সংরক্ষণের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

গ.খাবারের গন্ধ পরিবর্তণেঃ

খাবারের গন্ধ পরিবর্তনে গাঁজায়িত খাদ্যের বেশ ভালো ভূমিকা রাখে। নাপ্পি, নাখাম, সিঁদল দিয়ে রান্না করা বিভিন্ন তরকারি গন্ধে আলাদা বিশেষত্ব থাকে।

ঘ.পুষ্টি উপাদানের গুণগত মান বৃদ্ধিতে ঃ

গাঁজায়িত খাদ্যে অ-গাঁজায়িত খাদ্যের চাইতে পুষ্টি উপাদান অনেক বেশী থাকে। গাঁজায়িত খাদ্যে যে অণুজীবসমূহ থাকে তারা শুধু ক্যাটাবোলিক হিসেবে খাদ্যের যৌগ উপাদানকে ভেঙ্গে সরল উপাদানেই পরিণত করে না, তারা কিছু ভিটামিন ও শরীরের বৃদ্ধির জন্য সহায়ক বিভিন্ন উপাদান তৈরি করে। গাঁজায়িত খাদ্যের অণুজীবসমূহ উদ্ভিজ্জ খাদ্যে যে সকল পুষ্টি উপাদন আবদ্ধ অবস্থায় থাকে যা সরাসরি দেহ কর্তৃক শোষিত হতে পারে না, সেগুলোকে মুক্ত করে দেহের শোষণ উপযোগী করে তোলে। গাঁজায়িত খাদ্যের অম্লত্ব উপযোগী তাপমাত্রায় মাইক্রোবিয়াল এনজাইমের কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এমাইলেজ, প্রোটিয়েজ, ফাইটেজ ও লাইপেজ প্রভৃতি এনজাইম পলিস্যাকারাইড, প্রোটিন,ফাইটিন ও লিপিড এর হাইড্রোলাইসিস ঘটিয়ে খাদ্যের রাসায়নিক গঠনকে পরিবর্তিত করে। ফলে গাঁজন শুধু খাদ্যে এনজাইমের ক্রিয়াকলাপই বৃদ্ধি করে না, এটা খাদ্যের মধ্যকার ফাইটিক এসিড ও ট্যানিনের মত ক্ষতিকর এন্টিনিউট্রিয়েন্টের মাত্রা কমিয়ে আনে, খাদ্যের মধ্যকার বিভিন্ন খনিজ  যেমনঃ আয়রন, প্রোটিন প্রভৃতি দেহ কৃর্তক সহজে শোষিত হতে পারে।

ঙ. মাইকোটক্সিন থেকে দেহকে রক্ষা ঃ

ছত্রাক কৃর্তক কিছু মাইকোটক্সিন যা উদ্ভিজ্জ ও প্রাণীজ খাবার গ্রহণের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করে থাকে। গাঁজায়িত খাদ্যের বিভিন্ন এনজাইম এইসব মাইকোটক্সিনের হাত থেকে দেহকে রক্ষা করে থাকে।

৩.
বর্তমান বিশ্বে খাদ্য নিরাপত্তার মহাযজ্ঞের মধ্যেও নিরাপদ খাদ্য বিষয়টা মানুষকে ভাবাচ্ছে বেশ, এ নিয়ে মানুষের মধ্যে নানামুখী আলাপ জারি রয়েছে। অবশ্য এইসব ভাবনা ও আলাপের যথেষ্ট কারণও আছে বৈকি। প্রাণ বাাঁচানের জন্য গৃহীত খাদ্য যখন প্রাণের হানির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তখন সেই ভাবনা থেকে চাইলেও নিজেদের দূরে রাখা সম্ভব নয়। হাইব্রীড বা শংকর বীজের মাধ্যমে খাদ্য বাণিজ্যের হোমরা চোমরারা প্রথমে খাদ্যের পর্যাপ্ত যোগানের জন্য উঠে পড়ে মুনাফা পকেটে ভরতে পারলেও বা  মানুষনের সাময়িক বাহবা কুড়াতে সমর্থ হলেও বর্তমানে নিরাপদ খাদ্যের ভাবনা তাদের একচেটিয়া কু-মতলবকে কিছুটা প্রশ্নের মুখে ফেলেছে বলা যায়। সার ও কীটবিষ নির্ভর জিএম ফুড বা হাইব্রিড খাদ্যসমূহের কারণে প্রাণ ও প্রকৃতির ক্ষতির ব্যাপারটা এখন আর রাখঢাকের মধ্যে নেই।  যদিও এরই মধ্যে বিশ্বায়িত অর্থনীতির উন্নত দেশগুলোর বহুজাতিক কোম্পানির সৃষ্ট বায়োকলোনিয়ালজমের ভেতর বাংলাদেশ, ভারত, এশিয়া-আফ্রিকা বা আমেরিকা মহাদেশের সিংহভাগ মানুষ আটকা পড়ে গেছি। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এই সমস্ত দেশগুলোতে বসবাসরত বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর লোকায়ত জ্ঞান কাঠামোকে নানান মুখী ছলাকলার ভেতর দিয়ে কুক্ষিগত করে বা চুরি করে প্রাণ ও প্রকৃতির উপর নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে তৎপর রয়েছে এবং বেশ সফলও হয়েছে। আর তাদের এইসব ছলাকলা বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা  যেমনঃ ডব্লিওটিও, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ প্রায় সকলেই গাটছাড়া বেঁধে নেমেছে একচেটিয়া বাজারি অর্থনীতির নানান কৌশলপত্র নিয়ে। বহুজাতিকেরা শুধু আমাদের প্রাণ ও প্রকৃতিকেন্দ্রিক নিজস্ব জ্ঞানকাঠামোকে চুরি করেই ক্ষ্যান্ত থাকেনি, একে একে ধ্বংস করে দিয়েছে আমাদের প্রাণবৈচিত্র্যের আধার জলা-জঙ্গল,পাহাড়-নদী তথা পুরো বাস্তুতন্ত্রকেই। প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকা গুটি কয়েক দেশগুলোর বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থার মাধ্যমে প্রাণবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ দেশগুলোর হাজার হাজার বছরের লোকায়ত জ্ঞান কাঠামো, যে জ্ঞান কাঠামোর অবিরাম চর্চার ভেতর দিয়ে পৃথিবীর জেনেটিক সম্পদগুলোকে রক্ষা করে চলেছে সেইগুলোর নিরন্তর দখল/লুণ্ঠন প্রচেষ্টার ভেতর দিয়ে তারা তাদের বায়োকলোনিয়ালিজমকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। ১৯৬০ সালে সবুজ বিপ্লবের বিপ্লবী জোয়ারে আমাদের এই ভূখন্ডের ধানের জাত ১৮,০০০ থেকে নেমে এসেছে একশতে। আমাদের জুমিয়া-কৃষকদের মি.সারাং, মি.খচ্চু,মি.মা মিশি, সারেংমা রংথাম্ব্রেং, দেমব্রা জাগেদেং, আলাংজাসি,তুলসী মালা, কটকতারা, সূর্যমুখী, বাগুনবিচি ধানের জাতগুলো নেই হয়ে গেছে। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশের বাজারে বহুজাতিকের হাইব্রিড বীজ বাণিজ্য প্রবেশ করার তিনদশকের মধ্যেই কৃষকের গোলাঘরে আর কোন বীজ নেই। সবই এখন বহুজাতিক কোম্পানীর বাহারি মোড়কে বাজারের মোড়ে মোড়ে সার-বীজের দোকানে ঠাঁই করে নিয়েছে। বহুজাতিকের মুনাফা নিশ্চিত করতে একচেটিয়া বাজারি ব্যবস্থাকে রমরমা রাখতে আমাদের মান্দি, মারমা, চাকমা,বাঙালি জুমিয়া-চাষীদের ঘরে যুগ যুগ ধরে নিজস্ব ধানের, বেগুনের, তুলার বা অন্যান্য ফসলাদির বিভিন্ন জাতের বিশাল মজুদ ছিল তা নেই হয়ে গেছে, আমাদের জেনেটিক রিসোর্সগুলো লুট হয়ে গেছে। জানা যায় এক বিটি বেগুনের গবেষণার নাম করে বিশ্বের বীজ-কীটনাশকের অন্যতম শক্তিশালী মনসান্তো আমাদের দেশের নয়টি দেশি বেগুনের জাতকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে।  শুধু বাংলাদেশই নয়, তৃতীয় বিশে^র নানান প্রান্ত থেকেই তারা জেনেটিক্যাল রিসোর্সগুলো হয় চুরি করছে নয়তো ছিনতাই করছে। জিন গবেষণার মাধ্যমে বহুজাতিকেরা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চুরি/ছিনতাই করা নানান জাতের খাদ্যশস্য বীজের জিনোম সিকোয়েন্স নির্ণয় করে যে জিনটি কোন একটি শস্যের বিশেষ বৈশিষ্টের জন্য দায়ী তা সনাক্ত করে নিজেদের নামে তারা পেটেন্ট করে নিচ্ছে। জিন রিকম্বিনেশনের মাধ্যমে তারা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এমন জাতের বীজ বাজার ছাড়ছে যা ফসলের জন্য ক্ষতিকর পোকামাকড় সংবেদনশীল। অর্থ্যাৎ জিন রিকম্বিনেশনের মাধ্যমে উদ্ভাবিত জাত জমিতে লাগালে এমন কিছু পোকামাকড় তার প্রতি আকৃষ্ট হবে যেগুলো দমন করতে আবার বহুজাতিকের কীটনাশকের শরাণাপন্ন হতে হবে কৃষক-জুমিয়াকে। এর ফলে আমাদের মান্দি, সাঁওতাল, কোচ,বর্মণ,মুন্ডা, মাহাতো, ত্রিপুরা, মণিপুরী, পাহান, সিং ও বাঙালি কৃষক-জুমিয়ারা কার্যত এইসমস্ত বায়োকলোনিয়ালিস্টদের শ্রমদাসে পরিণত হয়েছে। এইসমস্ত বায়োকলোনিয়াস্টরা একদিকে বীজের প্রথাগত সংরক্ষণাগারকে তছনছ করে নিজেদের সীড ব্যাংককে উন্নত করছে অন্যদিকে জিন রিকম্বিনেশন বা মোডিফিকেশনের মাধ্যমে সার-বিষ-হরমোন নির্ভর শস্য-ফসলাদির মাধ্যমে মানুষের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির মাত্রা দিনকে দিন বাড়িয়ে চলেছে। এর সাথে আছে স্থানীয় অসাধু ব্যবসায়ীদের তৎপরতা; দীর্ঘমেয়াদে খাদ্য সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত ফরমালিনসহ নানান রাসায়নিকের যথেচ্ছ ব্যবহার। ফলে নিরাপদ খাদ্যের যে ধারণা এই ভূখন্ডের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষজনেরা তাদের লোকায়ত জ্ঞান কাঠামোর মাধ্যমে প্রাত্যহিক জীবনধারার ভেতর দিয়েই বাস্তবায়ন করে চলেছিলেন সেখানে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটে চলেছে। এছাড়াও ফাস্ট ফুড কালচার আমাদের এই ভূখন্ডের প্রচলিত খাদ্যভ্যাসে বিশেষকরে তরুণ প্রজন্মের খাদ্যাভ্যাসে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন নিয়ে আসছে। উচ্চ ক্যালরিযুক্ত ফাস্টফুডের স্বাস্থ্যগত ঝুকির কথা বিভিন্ন গবেষণায় উঠে আসছে। বিএফসি, কেএফসি বা ম্যাকডোনাল্ডস এর মতন কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের শহরগুলোতে আস্তানা গেড়ে বসেছে। ২০১৭ সালে ম্যাকডোলান্ডস এর গ্লোবালি নীট আয়ের পরিমাণ ছিল প্রায়  ৫.১৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বিভিন্ন রকমের শরবত, ঘোল, মাঠা, তাড়ি, ভাং, ডাবের পানি, চু, হাড়িয়া, নিয়ে আমাদের  এই ভ’খ-ের বিশাল  বৈচিত্র্যময় পানীয় সংস্কতি। যুগ যুগ ধরে এই বিশাল ও বৈচিত্র্যময় পানীয় সংস্কৃতি, যা জুমিয়া-কৃষক থেকে সকল শ্রেণী পেশার মানুষের ক্লান্তি দূরীকরণে প্রচলিত। কিন্তু গত কয়েক দশকে এইসমস্ত প্রথাগত পানীয়ের বিপরীতে বাজারি সংস্কৃতির আগ্রাসনে কোকাকোলা, পেপসির পানীয় আজ বাংলাদেশের প্রতিটি আনাচে-কানাছে। বাংলাদেশে এমন কোন পরিবার পাওয়া যাবে না যারা এইসব পানীয় থেকে পরিবারের সদস্যদের দূরে রাখতে পেরেছে। উচ্চ বিত্ত থেকে নি¤œবিত্ত, বাঙালি থেকে চাকমা, মারমা,খুমী, মান্দি, ওঁরাও, ভূমিজ, মুন্ডা প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে পেপসি, কোকাকোলাসহ  নানান কিসিমের এনার্জি ড্রিংকস। এই সমস্ত কোমল পানীয় বা এনার্জি ড্রিংকসের ক্ষতিকর বিষয়গুলো আজ আর কারো অজানা নয়। একচুমুক কোলা এক ঘন্টা ধরে মুখে রাখলে দাঁত হলুদ বর্ণ ধারণ করে, টয়লেট পরিষ্কারে কোক ঢেলে এক ঘন্টা পর ওয়াস করলে তা রেগুলার ক্লিনারের চাইতে ঝকঝকে ফলাফল দেয়- কোমল পানীয় সম্পর্কে এমনই মত দেন বিশেষজ্ঞরা।  তাহলে কি উপাদান থাকে এই সব কোমল পানীয়ে? ২০০৩ সালে ভারতের সেন্টার ফর সাইন্স এন্ড এনভায়রনমেন্ট (Centre for Science and Environment-CSE) ১২ টি কোমল পানীয়ের নমুনা পরীক্ষায়  লিনডেন, ডিডিটি, ম্যালাথিয়ন, ক্লোরপাইরিফস এই পাঁচ ধরণের কীটনাশকের অস্তিত্ব পান। ইউরোপীয় ইকোনমিক কমিশন (European Economic Commission-EEC)কোন পানীয়ে  কীটনাশকের পরিমাণ প্রতি লিটারে .০০০৫ মিগ্রা. সহণীয় মাত্রা নির্ধারণ করলেও পেপসির নমুনায় তা ৩৭ গুণ ও কোকাকোলার নমুনায় তা ৪৫ গুণ বেশি পাওয়া গেছে বলে সিএসই’র বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন।  কিন্তু তারবাদেও এদের  ব্যবসা থেমে থাকে না। ২০১৭ সালে পেপসিকোর গ্লোবালি নিট ইনকাম ছিল ৪.৮৫৭ বিলিয়ন ইউএস ডলার আর কোকাকোলার ছিল ১.২৪৮ বিলিয়ন ইউএস ডলার।


৪.
বহুজাতিকের উদ্ভাবিত ও বাজারজাতকৃত নানান জাতের শস্য-ফসলাদি ও পানীয় যেখানে আমাদের বিষ গ্রহণে বাধ্য করছে, আমাদের জাতিগোষ্ঠীসমূহের প্রথাগত জ্ঞানকে প্রতিনিয়ত চুরি/লুণ্ঠণ করে চলেছে, তার বিপরতীতেও আমাদের এই ভূখন্ত্ত্বা সমবিদ্যমান প্রথাগত জ্ঞানঋদ্ধ গাঁজায়িত খাদ্যাভ্যাস লড়াইয়ের প্রেরণা যোগায়।

ক.পান্তা, কাঞ্জি, বগ্নি ভাত, ক্ষারি, মিআ মিচেং, সুইবাম,দই, ঘি, নাখাম/সিঁদল/নাপ্পি/হিদল, জিলাপি ঃ আমাদের প্রথাগত প্রাণ-প্রকৃতি বান্ধব গাঁজায়িত খাদ্য

পান্তার জল, তিন পুরুষের বল”

বর্তমান সময়ে পান্তার কথা বললে অনেকেই পহেলা বৈশাখের পান্তা-ইলিশের কথাই প্রথমে বলবে; যদিও বৈশাখের সাথে বাঙালির পান্তা-ইলিশের সর্ম্পকটা খুব বেশি পুরনো নয়। কিন্তু পান্তার সাথে বাঙালির সর্ম্পক বেশ পুরনো এব এর প্রচলন নি¤œবিত্ত বা নি¤œমধ্যবিত্তর মধ্যেই অধিক প্রচলিত ছিল। পান্তা হলো রাতের খাবারের পর বেঁচে যাওয়া ভাত পানি দিয়ে রেখে দিয়ে সকালে সেই ভাত খেলে তখন তাকে পান্তা ভাত বা পানি ভাত বলে। ভারতবর্ষে এক সময় বাঙালি, হাজং, চাকমা, ভূমিজসহ উত্তর ভারতের বিভিন্ন জাতিগোষ্টীর মধ্যে এই পান্তা বা পানি ভাতের বেশ প্রচলণ থাকলেও তা বর্তমানে অনেক কমে গেছে। কিন্তু পান্তা ভাতের উপকারিতা নিয়া বর্তমানে বেশ আলাপ চলছে, এর পেছনে রয়েছে সাম্প্রতিক কালে পান্তা নিয়া গবেষণার ফলাফল। ভাত আমাদের শক্তি ও পুষ্টি যোগায়, কিন্তু অলিগোস্যাকারইড থাকায় রান্না করা হলে মানব দেহ তা পুরোপুরি হজম করতে পারে না বা হয় না। এছাড়া ভাতসহ দানাদার জাতীয় খাবারে থাকা ফাইটিক এসিড ভাত হতে প্রাপ্ত অনুপুষ্টি সহ অন্যান্য খনিজ, যেমনঃ আয়রণ,ক্যালসিয়াম,ম্যাগনেসিয়াম এগুলোকে আবদ্ধ অবস্থায় রাখে, অর্থ্যাৎ শোষণে বাধা দেয়। ভাত ভিজিয়ে রাখলে গাঁজন প্রক্রিয়ায় ফাইটিক এসিড হাইড্রোলাইসিসের মাধ্যমে ল্যাকটিক এসিড ব্যাকটেরিয়া উৎপন্ন হয়, যা আবদ্ধকৃত অণুপুষ্টিসমূহকে মুক্ত বা দেহ কর্তৃক সহজে শোষণযোগ্য করে তোলে।  গবেষণায় দেখা যায়, ১০০ গ্রাম পান্তা ভাতে(১২ ঘন্টা ভিজানোর পর) ৭৩.৯১ মিগ্রা আয়রন,৮৩৯ মিগ্রা. পটাশিয়াম, ৮৫০ মিগ্রা.পটাশিয়াম থাকে, যেখানে গরম ভাতে থাকে মাত্র ৩.৪ মিগ্রা. আয়রন, ২১ মিগ্রা. ক্যালশিয়াম ও  ৩৫ মিগ্রা পটাশিয়াম। পান্তা ভাত ভিটামিট বি-৬ ও বি-১২ এর ভাল উৎস।


চৈতে গিমা তিতা.
বৈশাখে নালিতা মিঠা,
জৈষ্ঠ্যে অমৃতফল, আষাঢ়ে খৈ।
শায়নে দৈ
ভাদরে তালের পিঠা,
আশ্বিণে শসা মিঠা,
কার্তিকে খৈলসার ঝোল, 
অগ্রাণে ওল
পৌষে কাঞ্জি, মাঘে তেল
ফাল্গুনে পাকা বেল।
                          (খনার বচন)


বাঙালির আরেকটি গাঁজায়িত খাবার হলো কাঞ্জির ভাত। ভাত রান্না করার সময় ধোয়া চাল থেকে সাধারণত একমুঠো বা দুইমুঠো বা পরিমাণ চাল নিয়ে চুলার পাশেই রাখা একটি মাটির ঘটিতে পানির মধ্যে জমা রাখা হয়। মাটির ঘটিটি এমন ভাবে চুলার পাশে রাখা হয় যাতে আগুনের তাপ মাটির ঘটিতেও লাগে। এভাবে সাতদিন জমা করার পর ঘটির চাল ভাতমতন ধুয়ে যে ভাত রান্না করা হয় তাকে কাঞ্জির ভাত বলে। আগুনের তাপে ভিজিয়ে রাখা চাল গাঁজন প্রক্রিয়ায় সাতদিনে সামান্য ফুলে ওঠে এবং টক স্বাদ যুক্ত হয়। অনেক সময় গাঁজন প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করতে নতুন করে বসানো কাঞ্জির ঘটিতে পুরনো কাঞ্জির পানি দেওয়া হয়।  কাঞ্জির ভাত সাধারণত শুটকি, কালিজিরাসহ বিভিন্ন রকমের ভর্তা দিয়ে খাওয়া হয়। নারায়ণগঞ্জের কাশীপুর, সোনারগাঁও, মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা ছাড়াও ফরিদপুর, মাদারীপুর ও বরিশালের বিভিন্ন এলাকায় এই কাঞ্জির ভাত বেশ প্রচলিত। তবে সেসব এলাকায় এটি কাজির ভাত হিসেবেই পরিচিত। নারায়ণগঞ্জে কাঞ্জির চাল দিয়ে ঝাউ ও বেশ প্রচলিত। এক্ষেত্রে কাঞ্জির চালের সাথে কাঞ্জির পানি দিতে হয়। ফলে ঝাউ  বেশ কিছুটা টক স্বাদের হয়। শুটকি র্ভতা, বিভিন্ন পাতার ভর্তা, কালিজিরা  ভর্তা, শুকনো মরিচ ভর্তা দিয়ে কাঞ্জির ঝাউ খাওয়া হয়। কাঞ্জির চাল বেটে চাপটি/চাপতি বানানোর রীতিও প্রচলিত রয়েছে নারায়ণগঞ্জে। কাঞ্জিতে গাঁজন প্রক্রিয়ায় প্রচুর পরিমাণে ল্যাকটিক এসিড উৎপন্ন হয় যা দেহের জন্য অত্যন্ত উপকারী।

আষাঢ় মাসনি
বুুড়া বুড়িলা মুখ,
খারপানি, বাঙস গিজা
মাছ লিবা খাওয়া সুখ।
বাখার গদলা বেলা
খাওয়া মুজা বিসি ভাত
আমাতি ছাতা বেলা
খাবা চায় বুকনি ভাত।”


অনুবাদ ঃ

আষাঢ় মাসেতে-
বুড়া বুড়িদের মুখ,
খারপানি, বাঙস গিজা,
মাছ লিবা খেতে সুখ
ভরা বাদলের দিনে
খেতে মজা বিশিভাত
আম্বুবাচীর ছাতা ক্ষণে
খেতে চায় বুকনি ভাত।

[ খারপানি= ক্ষার বা সোডা, বাঙস গিজা= বাঁশের কচি কোড়ল, লিবা= চাউলের পিঠালি দিয়ে রান্না করা, বিসি ভাত=ভাপে সিদ্ধ করা বিন্নি চাউলের ভাত, বুকনি ভাত=অংকুরিত ধানের চাউল দিয়ে তৈরী ভাত, আমাতি ছাতা= আষাঢ় মাসের সপ্তম দিবস থেকে ধরনীর ঋতু¯্রাব শুরু হয় বলে হাজংরা বিশ্বাস করে। এসময়টাতে হাজংরা শুভ কাজ থেকে বিরত থাকে। এসময়টাতে আমাতি ছাতা অর্থ্যাৎ আম্বুবাচির অশুচি সময় বলা হয়।]

হাজংদের মধ্যে বুকনি/বগ্নি ভাত নামে একটা খাবারের প্রচলন রয়েছে। আউশ ধান ভিজিয়ে রাখলে ধানভাত অংকুরিত হলে সেই চাল থেকে যে ভাত রান্না করা হয় তাকে বগ্নি ভাত বলে। এখানে  ধানের জার্মিনেশন ও আংশিক ফার্মেন্টেশনের ফলে কারণে ভাতের পুষ্টি উপাদান বেড়ে যায়। এই ভাত খেতে মিস্টি স্বাদের হয়; তবে অধিক পরিমাণে খেলে আংশিক গাঁজনের কারণে কিছুটা নেশা ভাব আসে।


মিআ মিচেং হলো বাঁশের কোড়ল (Bamboo shoots) গাঁজায়িত করে মান্দিদের যে নিজস্ব খাদ্য উপকরণ তৈরি হয় তার নাম। সাধারণত তল্লা বাঁশের কচি কোরল নিয়ে সেগুলো খুলে ভাল মতন ধুয়ে ছোট ছোট টুকরো করে একটা বাঁশের চোঙা বা কোন বাযুরোধী জারে রাখা হয়। কেটে রাখা বাঁশের কোড়লে সামান্য পানি ছিটিয়ে তা বাযুরোধী অবস্থায় সপ্তাহ খানেক রেখে দিলে সেখানে গাঁজন প্রক্রিয়ায় মিআ মিচেং তৈরি হয়ে যায়। মাছ, মাংস বা অন্য কোন তরকারিতে মিআ মিচেং মিশিয়ে রান্না করলে খাবারের স¦াদ ও গন্ধ পরিবর্তিত হয়।  মৈতৈ মণিপুরীদের মধ্যেও গাঁজায়িত বাঁশের কোড়ল বেশ জনপ্রিয়, মৈতৈ ভাষায় এর নাম সৈবাম। মৈতৈ মণিপুরীদের সৈবাম তৈরি জন্য মাটিতে একটি গর্ত খুড়ে গর্তের সাইজ অনুযায়ী একটি বাঁশের তৈরি ঝুড়ি বানিয়ে গর্তের মধ্যে তলদেশ থেকে সামান্য উপরে তুলে স্থাপন করা হয়। উঁচুতে তুলে স্থাপন করা হয় এজন্য যে গাঁজন প্রক্রিয়ার সময় বাঁশ কোড়লের অতিরিক্ত পানি যাতে বেরিয়ে যেতে পারে। অবশ্য বাঁশের ঝুড়ির তলদেশে এবং চারপাশে ২-৩ পুরত্বের বন্য কচুর পাতা দিয়ে জড়ানো থাকে। পরবর্তী বাঁশ কোড়লের ছোট ছোট টুকরা ঝুড়িতে রেখে বায়ুরোধী অবস্থায় ৩-৫ দিন রেখে দিলে সৈবাম তৈরি হয়ে যায়। মাটির গর্ত ছাড়াও সৈবাম বন্য কচুর পাতায় পেঁচিয়ে খোলা অবস্থায়, মাটির পাত্রে বা পানিতে ডুবিয়েও প্রস্তত করা হয়। সৈবাম যখন রোদো তাপে বা চুলার আগুনের তাপে শুকিয়ে ব্যবহার করা হয় তখন তাকে ঙাথান (ngathan) বলে।

গাঁজায়িত দুগ্ধজাত খাদ্যের মধ্যে দই অতি পরিচিত একটি নাম। ভারতবর্ষে বাঙালিসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেই দুগ্ধজাত গাঁজায়িত খাদ্য হিসেবে এর প্রচলন রয়েছে। দুধের সাথে পরিমাণ মতন চিনি মিশিয়ে ভালমত জ¦াল দিয়ে প্রথমে ঠান্ডা করা হয়। ঠান্ডা করা দুধ মাটির হাড়িতে ঢেলে ৮-১২ ঘন্টা রেখে দিলে গাঁজন প্রক্রিয়ায় দই তৈরি হয়ে যায়। গাঁজন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে মাটির হাড়িতে দুধ ঢালার আগেই তাতে সামান্য দই মাখিয়ে নিতে হয়। এই মাখানো দইয়ে উপস্থিত ল্যাকটিক এসিড ব্যাকটেরিয়া দুধের গাঁজন ঘটিয়ে দই প্রস্তুত করে থাকে। দই হজমে সহায়তা কওে এবং দেহে বিভিন্ন পুষ্টি ও ভিটামিনের যোগান দিয়ে থাকে।

পদ্মার ইলিশ আর পাবনার ঘি
জামাইয়ের পাতে দিলে আর লাগে কি?

ভারতবর্ষের একটি জনপ্রিয় দুগ্ধজাত গাঁজায়িত খাদ্য উপকরণ হলো ঘি। দুধ থেকে প্রস্তুতকৃত ননী জ¦াল দিয়ে ঘি তৈরি করা হয়। প্রাচীনকাল থেকেই ঘি এর ব্যবহার ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মধ্যেই প্রচলিত। ঘিতে ওমেগা থ্রি ও ওমেগা সিক্স চর্বি থাকে যা দেহের প্রদাহের মাত্রা কমাতে সহায়ক। এই চর্বি দ্রুত ভাঙ্গে ও সহজে হজম হয় বলে গলব্লাডার, কোষের স্বাভাবিক কার্যাবলী বজায় রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ঘি এ প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন-এ, লাইনোলেক এসিড ও বিউটারিক এসিড থাকে। এছাড়া সামান্য পরিমাণে ভিটামিন-কে, ই, ও বি-১২ থাকে। ঘি এন্টি অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। ঘিয়ের ভিটামিন-কে ক্যালসিয়ামের সাথে মিলে হাড়ের স্বাস্থ্য ও গঠণ বজায় রাখে।  ঘি তৈরিতে ল্যাকটিক এসিড ব্যাকটেরিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি গ্রাম ও শহরের মানুষজনের নিকট জিলাপি অতি জনপ্রিয় একটি মিষ্টান্ন। বাঙালিসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের খাদ্যাভ্যাসে ঠাঁই কওে নিয়েছে এই জিলাপি। গাঁজায়িত এই খাদ্যটি তৈরিতে ময়দা, দই, পানি দিয়ে মিশিয়ে কাই তৈরি করে ৮-১০ ঘন্টা ঘরের ভেতর স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রেখে দিলে তাতে গাঁজন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। গাঁজন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে ঐ কাই একটি ৪ মিমি ছিদ্রযুক্ত সূতি কাপড়ে নিয়ে হাত দিয়ে চেপে গরম তেলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ছাড়া হয়। তেলে ভাঁজা হয়ে গেলে তা চিনির ঘন মিশ্রণে কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রাখলেই তৈরি হয়ে যায় এই মুখরোচক মিষ্টান্ন। Lactobacillus fermenter, Lactobacillus bulgaris, Streptococcus lactis নামক ল্যাকটিক এসিড ব্যাকটেরিয়া এবং Saccharomyces bayanus, Saccharomyces cerevisiae নামক ইস্ট জিলাপিতে গাঁজন প্রক্রিয়া ঘটিয়ে থাকে।

গাঁজায়িত মৎসজাত খাদ্য উপরণ তৈরির  প্রাচীন পদ্ধতির প্রচলন রয়েছে আমাদের মান্দি, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে। বানানোর উপকরণে ও পদ্ধতিতে পার্থক্য থাকলেও এই ভূখ-ের  বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মধ্যকার আন্তঃসাস্কৃতির এক বলিষ্ট যোগাযোগ বেশ লক্ষ্যণীয়। মান্দি ও হাজংদের মধ্যে গাঁজায়িত নাখামের প্রচলন বেশ পুরনো। বিভিন্ন ধরণের ছোট মাছের বিশেষ করে পুটি মাছের শুটকি ঢেঁকিতে গুড়ো করে তার সাথে সামান্য হা.দিবু  মিশিয়ে তা বাঁশের চোঙায় সংরক্ষণ করা হয়। চোঙার মুখ কলাপাতার দিয়ে ছিপির মতন করে আটকানো থাকে। এখানে হা.দিবু শুটকিতে গাঁজন প্রক্রিয়া ঘটিয়ে বিভিন্ন অণুপুষ্টিকে শরীরের শোষণোপযোগী করে তোলে। মান্দিরা যে কোন তরকারিতেই এই নাখাম মিশিয়ে নাখাম ক্ষারি রান্না করে থাকেন। নাখাম ক্ষারি মান্দিদের মধ্যো বেশ জনপ্রিয়। নাখামে ফার্মেন্টার ক্ষার মাছের রাসায়নিক গঠন বিশেষ করে প্রোটিনকে ভেঙ্গে সরল যৌগ উৎপন্ন করে।

“বিশি ভাত কাৎচুয়া মাচাং
হিদল পুতে লেহাবাক
গোষ্ঠীবাড়ীর বগনি ভাত।”

[নিজেদের প্রিয় খাদ্যের বর্ণনায় হাজংদের মধ্যে প্রচলিত একটা কথা]

ভাবানুবাদঃ

বিন্নিভাত কাছিমের মাংস
হিদল দিয়া লেহাবাক
কুটুম্ববাড়ীর বগ্নি ভাত।


সিঁদল/হিদল বা চ্যাপা শুটকি বাঙালি,মান্দি, হাজং, সাঁওতাল, মু-া, চাকমা, মাহাতোসহ বাংলাদেশের অপরাপর জাতিগোষ্ঠীর মানুষজনদের প্রথাগত খাদ্যাভ্যাসে ঠাই করে নিয়েছে অনেক আগেই। সিঁদল বা চ্যাপা শুটকি বানানোর জন্য প্রথমে মাছের নাড়িভ’ড়ি বের করে ভালমত ধুয়ে ৭-১০ দিন রোদে শুকানো হয়। সিঁদল বা চ্যাপা শুটকি বানানোরজন্য মাটির কলসি বা মটকি ব্যবহার করা হয় যার ভেতর-বাহিরে অন্য মাছের তেল দিয়ে মেখে আগেই রোদে ভালমত শুকিয়ে নেওয়া হয় যাতে মটকিতে রাখা মাছ থেকে তেল শোষণ করতে না পারে। মটকিতে ভরাব আগে শুকানো মাছ আবার পানিতে ধুঁয়ে বাঁশের চালুনিতে কয়েক ঘন্টার জন্য রেখে পানি ঝরানো হয়। পানি ঝরে গেলে ঐ মাছ মাটির মটকিতে ঠেঁসে ঠেঁসে ভর্তি করা হয় যাতে ভেতরে কোন বাতাস না থাকে। মটকির মুখ ভালমতন বায়ুরোধী করে বন্ধ করে ৪-৬ মাস মটকির গলা পর্যন্ত মাটির নিচে পুঁতে রাখা হয়। চ্যাপা শুটকি প্রোটিন ও খনিজ লবন এর একটি সমৃদ্ধ উৎস এবং এটি সুষম এ্যামাইনো এসিড বহন করে যা মানব দেহের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এত কম-বেশী স্থিতিশীল লিপিড রয়েছে যার কোন মিউটাজেনিক ক্রিয়া নেই এবং গুণগত মান স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ বলে বিবেচনা করা হয়। এই শুটকি নানাবিধ রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। হাজংরা হিদল দিয়ে চালের গুড়া, সোডা মিশিয়ে হালুয়ার মতন একধরণের খাবার তৈরি করেন, যার নাম লেহাবাক ।
পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা,মারমা,ত্রিপুরা,লুসাই,বম, ¤্রাে,খুমী প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে নাপ্পির প্রচলন রয়েছে। নাপ্পিও গাঁজায়িত মৎসজাত খাদ্য উপকরণ। নাপ্পি সাধাররণত চিংড়ি মাছের গুড়া, কিছু সামুদ্রিক মাছের গুড়া ও ভেষজ উপদান দিয়ে তৈরি করা হয়। এতে প্রচুর পরিমাণে খনিজ লবন থাকে। নাপ্পির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও অসাধারণ।
নোনা ইলিশ বাংলাদেশের আরেক জনপ্রিয় গাঁজায়িত খাদ্য। প্রায় শতবছর আগে থেকেই ইলিশ মাছ সংরক্ষণের এই পদ্ধতি এই অঞ্চলে প্রচলিত। ইলিশ মাছ রোদে শুঁকিয়ে তাতে লবন মাখিয়ে মাটির পাত্রে ৩-৪ মাস রেখে দিলে তাতে গাঁজন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। নোনা ইলিশের গাঁজন প্রক্রিয়ার সাথে যেসকল অণুজীবের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় সেগুলো হলো-ইধপরষষং ংঢ়ঢ়., গরপৎড়পড়পঁং ংঢ়ঢ়.

খ. ‘চু’, ‘তাড়ি,’ ‘মাঠা’ ‘হাড়িয়া’, ‘খড়’, ‘ইয়্যু’ ঃ বাণিজ্যিক পানীয়ের বিপরীতে আমাদের আপন আপন নির্ভেজাল ক্লান্তি নাশক পানীয়


“ভূমিষ্ট হবার সাথে সাথে
আমি ‘চু’জাঙ্গির স্বাদ পেলাম
‘চু’জাঙ্গি মানে জীবনমদ
জীবনই মদ,মদই জীবন
প্লিজ মদ ছাড়তে বলো না।”

[কবি বচন নকরেক এর ইচ্ছে বন ইচ্ছে পাহাড় কাব্যগ্রন্থের ‘চু জাঙ্গি ও কবিতা’ এর অংশ বিশেষ]

চু মান্দিদের নিজস্ব ক্লান্তিনাশক পানীয়। ভাতের গাঁজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই চু প্রস্তুত করা হয়। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি এই পানীয় আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। মান্দিদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রায় সকল ক্ষেত্রেই এই চু এর ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। মান্দিদের চু তৈরিতে ফার্মেন্টার হিসেবে কাজ করে চু মান্থি। বিভিন্ন গাছপালার ডগা, লতা-পাতা-কান্ড ইত্যাদি ঢেঁকিতে গুড়ো করে চালের গুড়া ও আগে তৈরি চুমান্থিও সামান্য গুড়া পানি দিয়ে মিশিয়ে প্রথমে ছোট্ট ছোট্ট বলের মতন তৈরি করা হয়। এই বল গুলোকে দুই হাতের তালুতে চেপে চেপে চ্যাপ্টা গোলাকৃতির পিঠার মতন বানানো হয়। এই চ্যাপ্টা পিঠা গুলোকে কুলোর উপরে খড় বিছিয়ে রোদে রেখে ৫-৭ দিন শুকিয়ে নিলে চুমান্থি ব্যবহার উপযোগী হয়ে যায়। তৈরিকৃত চু মান্থি সাধারণত নকমান্দির ভেতরে অঙ্গারির উপরে রেখে সংরক্ষণ করা হয় সময় মতন ব্যবহারের উদ্দেশ্যে। চুমান্থি তৈরীতে সাধারণত নাকদানা গাছের পাতা, থি বং এর পাতা, শুকনা জালিক, থাবলচু গুঁড়া,  আচেত্রা পাতা, আখের কচি পাতা,  কাঠালের  কচি পাতা, সামাখ্যি গাছের কচি পাতা ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। চু বানানোর জন্য ভাত রান্না করে বাঁশের চালুনিতে মার ঝরিয়ে নেওয়া হয়। গরম  ভাত পাটিতে ছড়িয়ে দিয়ে হালকা শুকনা ও ঝরঝরে হলে তার উপর চু মান্থির গুড়া ভালমতন মেশানো হয়। এদিকে চু যে পাত্রে তৈরি করা হবে সেই পাত্র অর্থ্যাৎ দিখ্যা, দিকথম ইত্যাদি ধুঁয়ে পরিষ্কার করার ভালভাবে শুকানো হয়। সাধারণত  দিখ্যা-দিকথমের মুখ উল্টো করে উনুনের উপর বসিয়ে জ¦লন্ত কয়লার আঁচে শুকানো হয়, একে বলে হিম্মা। ভালমত হিম্মা করা দিখ্যা-দিকথমের মাঝখানে জান্থি খাঁড়া করে বসানো হয়। এবার জান্থির বাইরের চারপাশে অল্প অল্প করে চু মান্থি মেশানো ভাত রেখে পাত্র টিকে জান্থির উপরের মাথার দুই তিন ইঞ্চি নিচ পর্যন্ত এমন ভাবে ভরানো হয় যাতে জান্থির ভেতরে কোন ভাত না পড়ে। দিখ্যা বা দিকথমের কাজ শেষ হলে দিখ্যা-দিকথমের মুখ শুকনা কাপড় দিয়ে মুছে পরিষ্কার করে কলাপাতা বা আজুগি পাতা দিয়ে পাত্রের মুখ ঢেকে কলাগাছের কান্ডের আঁশ দিয়ে দেওয়া হয়, যাতে চু পাত্রের ভেতরে বাতাস প্রবেশ করতে না পারে। এভাবে সপ্তাহ খানেক রেখে দিলে চু মান্থির কারণে ভাতে ফার্মেন্টেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চু প্রস্তত হয়ে যায়। গরমকালে ফার্মেন্টেশন দ্রুত সম্পন্ন হলেও শীতকালে একটু বেশি সময় নেয়। এভাবে বায়ুরোধী অবস্থায় চু যত বেশি সময় রাখা হবে জান্থির মধ্যে চু বিচ্চিও তত বেশি জমা হবে।

শুধু মান্দি নয় বাংলাদেশসহ দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেও ভাতের গাঁজনে নিজস্ব পানীয় তৈরির রীতি প্রচলিত রয়েছে। পাত্র জাতির ‘খড়’, সাঁওতাল-ওঁরাও-মাহাতোদের হাড়িয়া,চাকমাদের ‘দোচুয়ানি’, মৈতৈ মণিপুরীদের ইয়্যু, ভারতের বোডো জাতির ‘জৌ’,রাভাদের ‘চেকো’ উল্লেখযোগ্য। ভাত থেকে তৈরি এই পানীয় বিশ^ব্যাপী রাইস বিয়ার নামে পরিচিত। ভারতের উত্তর-পূর্ব ভারতের আদিবাসীদের ভাতের গাঁজন প্রক্রিয়ায় প্রস্তুত এই প্রথাগত পানীয় নিয়ে এক গবেষণা ফলাফলে দেখা যায় তাতে এ্যালকোহলের পরিমাণ ১২-১৩%,  বিভিন্ন খনিজ যেমন-ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাস, আয়রন এর পরিমাণ ছিল ৭৮.১০৮ মিগ্রা/১০০ মিলি। এছাড়া দ্রবীভূত প্রোটিন ও ভিটামিন-সি এর উপস্থিতি রয়েছে এইসব পানীয়তে। দেহের জন্য উপকারী ল্যাকটিক এসিড ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্বও পাওয়া যায়।  ক্লান্তিনাশক এই সকল পানীয় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর পুষ্টি চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি অবসাদ, মাথা ব্যথা, প্রদাহ, কলেরার বিপরীতে বেশ উপকারী।  এছাড়া এই সকল পানীয় অনেক সময় ব্যথা নাশক ও শরীর-মন চাঙ্গা করে তুলতে ব্যাপক কাজে দেয়। সন্তান ভূমিষ্টের পর মান্দিরা যে চু নবজাতকের জন্য তৈরি করে তাকে বলে চুজাঙ্গি। এই চুজাঙ্গি প্রসূতি মাকে পান করানো হয় ব্যথানাশক ও শরীর চাঙ্গা করে তোলার জন্য।

বাংলাদেশে বাঙালিদের নিকট আরেকটি জনপ্রিয় গাঁজায়িত পানীয় হলো তাড়ি। তালের রস কয়েক ঘন্টা রেখে দিলে তাতে ফার্মেন্টেশন ঘটে তাড়ি নামের পানীয় তৈরি হয়। পরিমিত মাত্রায় তাড়ি পান দেহের জন্য অত্যন্ত উপকারী।

মাঠা পানের প্রচলন বাংলাদেশের প্রায় সকল অঞ্চলেই রযেছে। ঘি উৎপাদনের সময় প্রাপ্ত অতিরিক্ত তরল থেকেই এই মাঠা প্রস্তুত করা হয়। ক্লান্তি দূর করতে মাঠার জুড়ি মেলা ভার। বিভিন্ন ল্যাকটিক এসিড ব্যাকটেরিয়া মাঠা তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে- Lactobacillus alimentarius, Lactococcus llactis এবং নামক Saccharomycopsis spp., Candida spp. ইস্ট।


৫.

“দিং দিং আপফাদে দিং দিং
দিং দিং ছালাংদে দিং দিং
গোয়েরা আছাক সিঃ এ্আং দিং দিং
ফিংগিরা দোঃগি সিকগেংআ দিং দিং
আঃখি আঃ উৎগ¦াদে দিং দিং
অকগিল ছিদিং গ¦াদে দিং দিং...”

ভাবানুবাদঃ

সটান হয়ে দাঁড়াও বাবা সটান হও বীর, দিং দিং
শালবৃক্ষের মতো তোমার ঊর্ধ্ব তোলো শির, দিং দিং।
তেজি কুকুর চেঁচাচ্ছে আর গাইছে ফিঙের ছানা, দিং দিং
অক্কা ধ্বনি দিয়ে ষাড়ের বাড়ে উত্তেজনা দিং দিং


আমাদের এই ভূখন্ডে বহুজাতিকের খাদ্য-পানীয় বাণিজ্য প্রতিনিয়ত আমাদের প্রথাগত জ্ঞানকে,আমাদের প্রথাগত খাদ্যাভ্যাসকে নিজেদের আয়ত্বে নেবার জন্য বা বিনাশ করার জন্য হণ্যে হয়ে উঠে পড়ে লেগেছে। এদের প্রচ- প্রতাপে আমরা মান্দি, বাঙালি, চাকমা, মারমা, সাঁওতাল, সিং, পাত্র, ওঁরাও, ত্রিপুরা, রাখাইন, বম, লুসাই, ¤্রােসহ বিভিন্ন জাতির মানুষজনেরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছি। আমাদের প্রথাগত খাদ্যাভ্যাস, প্রাণ-প্রকৃতির সাথে আমাদের বাস্তুতান্ত্রিক সর্ম্পককে টিকিয়ে রাখতে হলে আমাদের আপন আপন বৈচিত্র্যময় খাদ্য-পানীয় ভান্ডারকে নিয়ে আমাদের যাপিত জীবনের যে লড়াই জারি রেখেছি তা বহমান রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে। একেকটি প্রথাগত খাদ্য-পানীয় আমাদের একেকটি জাতিগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়কে তুলে ধরতে সক্ষম দারুনভাবেই। আমাদের আপন আপন খাদ্য-পানীয় আর আমাদের অস্তিত্ব যেখানে একাকার, সেখানে আপন আপন খাদ্য-পানীয়ের  যেকোন ধরণের বিনাশ প্রকারান্তরে আমাদেরই বিনাশ।








  

Thursday, August 30, 2007

সাংসারেকদের রংচুগালা আসছে, অরুন লেইব্রেস আপনি কি আসবেন না?

জুয়েল বিন জহির


জিসি দা.সালদেম দা.জাদেম
রংচুগালেঙা বিজাকসতেঙ্গা
আমানিগ দগ্রিসিয়ানা
আম্বিনি নাচিলগ্রি বন্নানা
দিশা দক মি,মারিমং মাংমিচ্ছিবিমং
খ্রাম দুখখং দগ্গি
আদুরি বংগিসকি...
(আজকে এই মাসে/ রংচুগালা করছি, পাতা কাটছি/ মা মুরগীর বাচ্চাহীন মৃতূ্যর কারণে/ নানীর নি:শব্দ মৃতূ্যর কারণে/এইভাবে বাজিয়ে/খ্রাম বাজিয়ে/আদুরি বাজিয়ে...)

৭ সেপ্টেম্বর ২০০৬ । সাংসারেক (মান্দিদের নিজস্ব ধর্ম) খামাল (পুরোহিত) দীনেশ নকরেক আদুরি, দামা, খ্রাম এর তালে তালে সুর করে করে খ্রিতা (মন্ত্র) পড়ে রংচুগালার রুগালার কাজ শেষ করেছেন। রংচুগালা হলো মান্দিদের ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব; ওয়ান্নার ঠিক আগের একটা কৃত্যের নাম। হাবা বা জুম ক্ষেত থেকে ধান তোলার পর তা মাড়াইসহ অন্যান্য কাজ সমাধার পরই মান্দিরা আয়োজন করতেন রংচুগালার। রংচুগালা না করে অর্থাৎ দেবতা মিসি আর সালজং এর উদ্দেশ্যে রংচু বা চিড়া উৎসর্গ না করে নতুন ধানের ভাত রান্না করে খাওয়া সাংসারেক ধর্মীয় মতে নিষিদ্ধ। হাবাহুয়া বা জুম চাষ নিষিদ্ধ হয়েছে সে অনেক আগেই আর বর্তমানে প্রায় ৯৯ শতাংশ মান্দিই যিশুকে প্রভু হিসেবে মেনে নিয়েছেন, কিন্তু তারপরেও গুটিকয়েক সাংসারেকদের হাত ধরে মধুপুরে আজও টিকে আছে রংচুগালা, ওয়ান্নাসহ সাংসারেক ধর্মের অনেক কিছুই। যাই হোক, চুনিয়া গ্রামের অন্যান্য বাড়ির ন্যায় রংচুগালার অনুষ্ঠানিকতা শেষে বড়বাড়ির বারান্দায় (হাবিমার মান্দি রাজা বলে খ্যাত প্রয়াত পরেশ মৃ-র বাড়িতে) আমি, বচনদা (কবি বচন নকরেক) আর মৃত্তিকা কর্মী উক্যেনু মারমা অন্যান্যদের সাথে বসে আলৎ ফলের খাজি খাচ্ছি আর চু এর গ্লাসে ঠোঁট ছোয়াচ্ছি। আমাদের পান পর্ব যখন শেষের দিকে তখনই নেবুলদির ( নেবুল দারু-পরেশ মৃ-র ছোট মেয়ে) সাথে সাথে একদল মানুষ বড়বাড়িতে প্রবেশ করল। আগত দলের অধিকাংশই ছিলেন তরুণ-তরুণী। তাদের পোষাক পরিচ্ছদের বৈচিত্র্যই বলে দিচ্ছিল তারা বিভিন্ন জাতির লোকজন একত্রে জড়ো হয়েছেন বিশেষ কোন উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। নেবুল দারুই তাদেরকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। জানতে পারলাম উনারা পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে এসেছেন ঢাকার একটা এনজিওর আমন্ত্রণে। ময়মনসিংহে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষে এরা আজ পীরগাছা মিশনের আমন্ত্রণে থমথমা নামক জায়গায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেছে। আর ঐ দিনেই যেহেতু রংচুগালা চলছে তাই সমতলের অন্য একটি আদিবাসী জাতির নিজস্ব সংস্কৃতির একটা অংশ দেখার লোভ সামলাতে পারেননি। রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি থেকে আগত দলের তরুণ-তরুণীদের সাথে আমাদেরও কুশল বিনিময় হলো। উক্যেনুর বাড়ি বান্দরবান হওয়াতে কাজটা বেশ সহজ হয়ে গেল। বিভিন্ন জনের সাথে কথাবার্তা বলার পরে পরিচিত হলাম এক দীর্ঘদেহী লোকের সাথে। উনার সাথে আলাপ করার পরে টের পেলাম দারুন এক ভদ্রলোক তিনি। পঞ্চাশ পেরোনো মানুষ হলেও মনের জোরটা ছিল তরুণদের মতই। উনাকে মৃত্তিকার নতুন-পুরনো কয়েকটা সংখ্যা দিলাম, উনিও সানন্দে গ্রহণ করলেন। আমার নোটবুকে উনি উনার ঠিকানা মোবাইল নাম্বার লিখে দিলেন। আমারটা চাইলে বললাম মৃত্তিকার ঠিকানায় যোগাযোগ করলেই হবে। বড়বাড়িতে বেশ কিছুক্ষণ কাটানোর পর জনিক আচ্চু পুরো দলকে নিয়ে গেলেন তাঁর বাড়ির নকমান্দি দেখাতে। নকমান্দি হলো মান্দিদের ঐতিহ্যবাহী ঘর। পুরো মধুপুরের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি বাড়িতেই দেখা মেলে এই নকমান্দির। সাংস্কৃতিক দলের ঢাকা যাওয়ার তাড়া ছিল বিধায় উনারা আর দেরি করলেন না। অরুন লেইব্রেসকে বিদায় জানালাম, বললাম পরে যোগাযোগ করব। কিন্তু সেই পরে আর যোগাযোগ করাটা হয়নি। ভেবেছিলাম এবারের ৯ আগস্ট আদিবাসী দিবসে হয়তো দেখা হবে খিয়াং জাতির অরুন লেইব্রেসের সাথে। কিন্তু আদিবাসী দিবস উপলক্ষে সুখেন চাম্বুগং, হেমার্শন হাদিমাদের দাওয়াতে আমরা (পরাগ রিছিল ও আমি) চলে যাই শেরপুরের নালিতা বাড়িতে। জানি না এবারের আদিবাসী দিবসে অরুন বাবু এসেছিলেন কি না। আগের মত প্রাণবন্ত ছিলেন কি না।

১৫ আগস্ট ২০০৭। প্রতিদিনের ন্যায় ঘুম জড়ানো চোখেই দৈনিক পত্রিকা নিয়ে বসে পড়লাম। প্রথম পৃষ্টায় বঙ্গবন্ধু নিয়ে লেখা গুলোয় চোখ বুলিয়ে ভেতরের দিকে যেতেই একটা সংবাদে এসে চোখ আটকে গেল। হ্যাঁ, অরুন লেইব্রেস, ছবির নিচে ছাপানো অক্ষরে তাঁর নাম। অনেকদিন পর অরুন লেইব্রেসের খবর পেয়ে মনটা ভালো হয়ে যাওয়ারই কথা, কিন্তু কেমন যেন অন্যরকম একটা অনুভূতির সৃষ্টি হচ্ছে আমার মগজে। চুনিয়ার প্রতিটি দৃশ্য কয়েক গুণিতক হারে বেড়ে মাথার ভেতর কিলবিল কিলবিল শুরু করে দিয়েছে। অরুন বাবুর সাথে আমারতো মাত্র কয়েক মিনিটের আলাপ-পরিচয় মাত্র, কিন্তু তার পরও ওনার জন্য মনটা অন্যরকম লাগছে কেন। সংবাদের শিরোনাম আমাকে পুরো খবর পড়ার জন্য তাড়া দিচ্ছিল -সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে চলে গেলেন খিয়াং নেতা। প্রথম দুটো লাইন ( কিছুই করে যেতে পারলাম না, আমাকে সবাই ক্ষমা করবেন। নিজ সমপ্রদায়ের কাছে একটি চিরকুটে এভাবে ব্যর্থতা স্বীকার করে আত্মহনণের পথ বেছে নিলেন বাংলাদেশ খিয়াং কল্যাণ সমিতির সভাপতি অরুন লাইব্রেস।) পড়ে কিছুই পরিষ্কার হচ্ছিল না। কিসের ক্ষমা? কিসের ব্যর্থতার দায়ভার একাই বহন করতে চেয়েছেন অরুন লেইব্রেস? মাথা কিঞ্চিত ঠান্ডা রেখে সংবাদ পুরোটা শেষ করলাম। কিছূতেই কিছু মেলাতে পারছিলাম না। নিজের জাতির জন্য অনেক কিছু করতে চেয়েছিলেন অরুন, রাজস্থলীতে খিয়াং ছেলে-মেয়েদের জন্য পরিচালনা করতেন নিজের গড়া খিয়াং হোস্টেল। রাষ্ট্রের সুবিধা বঞ্চিত খিয়াং ছেলে-মেয়েদের থাকা-খাওয়াসহ পড়শোনার দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন নিজের কাঁধেই। ধনুছড়ি, কুক্যাছড়ি মৌজার খিয়াংরা যখন একে একে ভূমি হারানো সহ নানান সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছিলেন তখন তিনিই হয়ে উঠেছিলেন প্রতিটি শো (খিয়াং জাতির লোকজন নিজেদের পরিচয় দেন শো হিসেবে) নারী-পুরুষের ভরসার জন। সরকারি-বেসকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সুশীল সমাজের দ্বারে দ্বারে অরুন নিজেদের ভূমি, নিজেদের সাংস্কৃতিক তথা জাতিগত ঐতিহ্য রক্ষার কথা তুলে ধরেছিলেন বলিষ্ট ভাবে। হয়ত অনেক অপ্রাপ্তি ছিল, কিন্তু প্রাপ্তি কি কিছুটাও ছিল না। জীবনে অপ্রাপ্তি থাকলেই কি মানুষ ব্যর্থ হয়ে যায়? না, আমি কিছুই চিন্তা করতে পারছি না, গত বছর যেই তারুণ্যদীপ্ত অরুন লেইব্রেসের সাথে কথা হয়েছিল সে ব্যর্থ হতে পারেন না। আর ব্যর্থ হলেই বা কি, জীবন যুদ্ধে আমরা ছোট-বড় কেউই কি আসলে ব্যর্থতাকে পাশ কাটিয়ে চলতে পারি। আর এই ব্যর্থতার দায় আপনিই বা কেন নিজের করে নিলেন অরুন? কেউ তো আপনার স্বপ্নের প্রতি আপনার আন্তরিকতা নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলেনি, এর জন্য কোন খিয়াং নারী-পুরুষতো আপনাকে তাদের ভালোবাসার বন্ধন থেকে দূরে ঠেলে দেয়নি। আর যে ব্যর্থতার কথা আপনি বলেছেন সেই ব্যর্থতার দায়তো আপনার নয়। এ দায় কি এই রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রশাসন, ডান-বাম নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সাম্রাজ্যবাদী বিভিন্ন সংস্থা বা আমরা কেউই এড়াতে পারি? না, আমরা কেউই তা পারি না। এই রাষ্ট্র স্বাধীনতার ৩৬ বছরেও তার ভৌগোলিক সীমানার ভেতরে বসবাসরত সকল জাতির অস্তিত্ব পবিত্র সংবিধানে তুলে ধরতে পারেনি, পারেনি বাঙালি ভিন্ন অন্যান্য যে ৪৫ টি বা তারও অধিক জাতিসত্ত্বা রয়েছে তাদের আপন আপন ভূমি-সংস্কৃতি নিয়ে আপন আপন জাতিগত ঐতিহ্যকে ধরে রাখার কার্যকর কোন পদক্ষেপ নিতে। এই রাষ্ট্র পারেনি বাঙালি বাদে অপরাপর জাতির শিশুদের জন্য তাদের নিজ মাতৃভাষায় পড়াশোনার ব্যবস্থা নিতে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শান্তিচুক্তি হলেও পারেনি পাহাড়ের সেই কাঙ্ক্ষিত জলপাই রংহীন শান্তি ফিরিয়ে আনতে। সাম্রাজ্যবাদী সংস্থা সমূহের কোটি কোটি ডলারের উন্নয়ন সন্ত্রাসে লক্ষ লক্ষ মানুষকে ভিটে-মাটি ছাড়া হতে হয়েছে, সামাজিক বনায়ন-উডলট-রাবার বাগানের নামে পাহাড় ন্যাড়া হয়েছে-দখল হয়েছে, সমতলের বনাঞ্চলগুলো হয়েছে প্রায় প্রাণবৈচিত্র শূণ্য। আমরা সমতলের বৃহত্তর জাতির শিক্ষিত লোকজনেরা আপনাদের নিয়ে ভাবার কথাতো কখনো চিন্তাই করতে পারি না। আমাদের কত কাজ! কত ব্যস্ততা! কত কত ধান্দা! তারপরেও আপনারা আমাদেরকে বারে বারে বিশ্বাস করেছেন, বন্ধু হিসেবে কাছে পেতে চেয়েছেন। কিন্তু তার মর্ম আমরা বুঝিনি বা ইচ্ছে করেই বুঝতে চাইনি, কিছু করাতো দূরে থাক। আমরা নাট্যব্যক্তিত্বরা আপনাদের সাথে মেশবার ভান করেছি যাতে রাজধানীর বুকে আদিবাসী নাট্য উৎসবের আয়োজন করে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির একটা অংশ নিজের পকেটে তুলতে পারি। আমরা উন্নয়ন কর্তা-কর্মীরা মেশার চেষ্টা করেছি যাতে আপনাদের উন্নয়নের কথা বলে-আজগুবি সব প্রকল্প হাজির করে-সেমিনার আয়োজন করে-আদিবাসী উৎসব পালন করে দাতা সংস্থার কাড়ি কাড়ি টাকা-পয়সা বাগিয়ে নিতে পারি এই আশায়। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আপনাদের আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিভিন্ন জায়গায় আপনাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জান কবুল করার ভান করেছি ভবিষ্যতে আদিবাসীদের অধিকার-আন্দোলনের কথা বলে এনজিও খুলে বসার ধান্দায়। আমরা বুদ্ধিজীবিরা আদিবাসী দরদী সেজেছি আমাদের জানা-বুঝা-বুদ্ধি দিতে পারার ক্ষমতা কত বেশি তা প্রকাশ করার জন্য। আমরা গবেষকেরা বিভিন্ন সেমিনারে গবেষণা প্রবন্ধ পাঠ করেছি নিজের ক্যারিয়ারকে আরো মজবুত করার আশায়। আমরা ফটোগ্রাফাররা আদিবাসী নারীর নানান ভঙ্গিমার ছবি তুলে প্রদশর্ণী করেছি ফটোগ্রাফার হিসেবে নিজেদের জাহির করার জন্য। আমরা রাজনৈতিক নেতারা আপনাদের জন্য গলাবাজি করেছি নিজেদের অক্ষমতা ঢেকে রাখার জন্য, ইত্যাদি আরো কত কি! কিন্তু কই, এসবের জন্যতো আমাদের কারো কোন অনুশোচনা নেই, লজ্জা নেই, আমরা কেউইতো মানুষের জন্য কিছু করতে না পারার যন্ত্রনায় সামান্যতম কাতর হইনি; আত্মহনন সে তো অনেক দূর। কিন্তু এই রাষ্ট্র, সাম্রাজ্যবাদী সংস্থা সমূহ, এত এত মানুষ জনের ব্যর্থতার দায়ভার আপনি কেন নিবেন? আপনিতো তাও অনেক কিছু করেছেন, আরো বেশি বেশি করার আকাঙ্খাকে ধারণ করেছিলেন। আপনিতো নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে নেমেছিলেন, তাহলে কেন এতটা অভিমানী হয়ে উঠলেন অরুন ? আপনিতো বেশ ভালো করেই টের পেয়েছিলেন এই রাষ্ট্র, সাম্রাজ্যবাদী সংস্থা ও এর দালাল রাষ্ট্রের সুশীল সমাজ-রাজনীতিক-শিক্ষিত- বুদ্ধিজীবি- শিল্পী- সাহিত্যিকসহ নানান ঘরানার মানুষজনের নানানমুখী স্বার্থবাদীতার বিষয়গুলো। এই স্বার্থবাদীতার জাল ছিঁড়ে ফেলার জন্য আপন আপন জাতির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে আপনার এগিয়ে চলায় কি শক্তি পেতেন না খিয়াং জাতির লোকজনেরা। আপনি কেন এত অভিমান করে মুখ লুকোলেন? শো নারী-পুরুষেরা কার কাছে রুখে দাঁড়াবার, লড়াই করার প্রেরণা খুঁজবেন ? আমি জানি না অরুন, বিশ্বাস করেন আমি কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারছি না। আমি বিশ্বাস করতে চাই, অরুন লেইব্রেস মারা যাননি, সংগ্রামী মানুষের কোন মরন হতে পারে না। আর কিছু দিন পরেই মান্দি গ্রামগুলোতে শুরু হচ্ছে রংচুগালা। জনিক আচ্চু হয়ত সেপ্টেম্বরের শুরুও দিকের কোন ভোরে মোবাইল করে রংচুগালার তারিখ জানাবেন। আমিও হয়ত এক সকালে মায়ের কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিয়ে নারায়ণগঞ্জ থেকে রওনা দিয়ে রংচুগালার আগের সন্ধ্যায় হাজির হব চুনিয়াতে। রংচুগালার দিন খামাল আসবেন। আদুরি, দামা, রাং এর তালে তালে বাড়ি বাড়ি রুগালা হবে। বচনদাকে নিয়ে বড়বাড়ির বারান্দায় চু খেতে খেতে পথ চেয়ে থাকব কোন আগত অতিথি দলের আশায়। আবার মুখরিত হবে শালবনের কোড়কে প্রয়াত পরেশ মৃ-র পুরো নানান প্রজাতির ফুলে ফুলে ভরা উঠোন। অতিথি দলের তরুণ-তরুণীদের সাথে পরিচিত হতে হতে দেখা পাব অরুন লেইব্রেসের। সেই প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা হাসি মাখা মুখে আপনি বলে উঠবেন- না, আমি আত্মহনন করিনি, আমি তা পারি না, কেননা আমি সংগ্রামী, আপন জাতির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে আমি আছি, সর্বদাই থাকব।


Tuesday, August 21, 2007

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতিগত ভাবনা ও বাস্তবতার সহজ পাঠ

জুয়েল বিন জহির


১. রাষ্ট্র তুমি কার ?
রাষ্ট্র তুমি কার ?? রাষ্ট্র তুমি কার ???...


একটা কাগজে কলমে স্বীকৃত বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্রে বসবাসরত বেবাক সচেতন নাগরিকের পক্ষেই কাগুজে ভাষারীতিতে এর উত্তর দিতে পারা তেমন কোন কঠিন বিষয় না। যে কেউ, যে কোন প্রান্ত থেকে সমস্বরে গলা মেলাবেন‌‌ -জনগণের। এখন এই জনগণের ভেতর কারা পড়েন ? রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমানার ভেতরে লিঙ্গ, বয়স, ধর্ম-বর্ণ, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিগত দিক নির্বিশেষে সকল মানুষই এর আওতাভূক্ত; এই বিষয়েও কারো কোন অস্পষ্টতা নেই। তবে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অস্পষ্টতা অবশ্যই রয়ে গেছে অথবা বলা যেতে পারে অবচেতন বা সচেতন ভাবেই এই দিকটির প্রতি গুরুত্ব দিতে নারাজ এই রাষ্ট্রের প্রায় পচাঁনব্বই ভাগেরও অধিক মানুষ যার ভেতরে রয়েছেন প্রগতিশীল-বুর্জোয়া-প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক সচেতন শাসকগোষ্ঠী-শিল্পী-সাহিতি্যক-বুদ্ধিজীবি-সুশীল সমাজ সহ হরেক অভিধার হরেক ঘরানার মানুষজন। আর এই বিষয়টি হচ্ছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতিগত পরিচয়। ব্যাপারটা একটু খোলসা করে বলা যাক। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মালিক বলা হয়ে থাকে জনগণকে। সেই হিসেবে-বাংলাদেশ-নামক রাষ্ট্রের মালিকও হবেন জনগণ, অতি সহজ সাধারণ একটা ব্যাপার। এখন যদি প্রশ্ন করা হয়, কোন জনগণের বা জনগণের জাতিগত রূপটা কি? উত্তর আসবে বাঙালির, রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে কেউবা বলবে বাংলাদেশী। হ্যাঁ, একদম সত্যি কথা, সংবিধান বিশেষজ্ঞ থেকে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, শাসকগোষ্টী থেকে শোষিত সমাজের প্রতিনিধি, ডান-বাম-আধাবাম-বুর্জোয়া-প্রতিক্রিয়াশীল নির্বিশেষে বেবাকই গর্ব ভরে একই উত্তর দিতে অভ্যস্ত। আমরা সকলেই জানি বাঙালি জাতি কয়েকশত বছর ধরে নানান আত্মত্যাগের ভেতরে নির্মাণ করেছে কাঙ্খিত এক জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের। দেশের যেকোন নাগরিকেরই এ এক বুক ফুলানো ব্যাপার। একে খাটো করে দেখার মতন কোন ব্যাপার নেই। কিন্তু সমস্যা তারপরেও রয়ে যায়, আসলেই কী বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির মালিক কেবলই এদেশের বাঙালি জাতিভূক্ত জনগণ ? যদি তা না হয় তাহলে বাঙালি বাদে অপরাপর জাতি সমূহের অস্তিত্ব নেই কেন সংবিধানের কোন একটি পৃষ্ঠার কোন একটি লাইনে, পচাঁনব্বই ভাগ জনগণের মগজে, তাদের উপস্থাপন রীতিতে ? কেবল সংখ্যার বিবেচনাতেই কী আধুনিক এই রাষ্ট্র তার জাতিগত পরিচয় দেওয়ার ক্ষেত্রে কোন একক জাতির একক আধিপত্যকেই বৈধ করে তুলবে, প্রতিষ্ঠিত করে তুলবে ? মিথ্যার বেসাতি দিয়ে আড়াল করে ফেলবে ওঁরাও, সাঁওতাল, মুণ্ডা, রাজোয়ার, লহরা, হাড়ি, দোসাত, পাহাড়িয়া, রবিদাস, চাকমা, মাংতা, রাখাইন, শিং, মাহাতো, মৈতৈ, লালেং, বিষ্ণুপ্রিয়া, রাজবংশী, বর্মণ, খাসিয়া, ত্রিপুরা, ডালু, কোচ, মান্দি, খিয়াং, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, খুমী, চাক, হাজং প্রভৃতি জাতিসমূহের অস্তিত্ব? একক জাতির একক আধিপত্য পাকাপোক্ত করতে আর সব জাতি সমূহকে -উপজাতি- বানিয়ে ফেলতে হবে? ইসলামকে যখন সংসদে আইন পাসের মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হলো তখন কী একবারের তরেও চিন্তুা করা হয়েছিল সাংসারেক, সারণা, ক্রামা, বৌদ্ধসহ একেক জাতির আপন আপন ধর্মের কথা, তাদের আপন আপন বিশ্বাসের কথা? এই রাষ্ট্র বৃহত্তর জাতির (সংখ্যার বিবেচনায়) প্রার্থণালয়ের জাতীয় স্বীকৃতি (জাতীয় মসজিদ-বায়তুল মোকারম) দিলেও অপরাপর জাতি সমূহের সারণা, মিদ্দি আসং, গোয়ারি, জাহের থান, চিগা সমূহকে জাতীয় স্বীকৃতি দূরের কথা এদের অস্তিত্বের খবরই রাখেনি বা রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি। বরং এই রাষ্ট্রের অধিপতি জাতির আরাম-আয়েশ সহ নানান প্রয়োজনে নানান প্রকল্পের ভেতরে রাষ্ট্রের অনুচ্চারিত হদি, মাহালি, ভূইমালি, ওঁরাও, সাঁওতাল, মুণ্ডা, রাজোয়ার, হাড়ি, দোসাত, পাহাড়িয়া, রবিদাস, চাকমা, মাংতা, রাখাইন, শিং, মাহাতো, মৈতৈ, লালেং, খাসিয়া, ত্রিপুরা, ডালু, কোচ, বিষ্ণুপ্রিয়া, মান্দি, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, খুমী, খিয়াং, চাক জাতিসমূহের বসতভিটা-হাবা-জুম-জাহেরথান-সারণা-গোয়ারি-মিদ্দি আসং-চিগা কখনো তলিয়ে যায় উন্নয়নের বিশাল জলরাশিতে, বন্দি হয়ে যায় ইটের দেয়ালে-চিড়িয়াখানায়-কাঁটাতারের বেড়ায়, কখনোবা পুড়ে ছারখার হয়ে যায় উন্নয়নের দাবানলে, দখল হয়ে যায় প্রভাবশালীদের মারদাঙ্গা প্রভাবের কাছে। এই রাষ্টের নগরে-বন্দরে-শহরে-বিদ্যাপীঠের ভাস্কর্য হিসেবে ফুটে উঠে কত সংগ্রামী যোদ্ধাদের মুখ; কেবল ভেসে ওঠে না রাশিমনি হাজং, কল্পনা চাকমা, পীরেন স্নাল, গীদিতা রেমা কিংবা আলফ্রেড সরেনদের তেজস্বী চাহনিগুলো। এই রাষ্ট্র কত ভাবেই না একক জাতির নিরঙ্কুশ দাপটকে বজায় রাখতে সচেষ্ট। গতবছরের (২০০৬) ১২ এপ্রিল খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক হুমায়ুন কবির কতৃক খাগড়াছড়ি ২০০১-২০০৫ শিরোনামের পুস্তিকাতে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাদের খাগড়াছড়িতে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে বলার মতন উদ্ধত্য দেখানোর পরও রাষ্ট্রযন্ত্রের নিশ্চুপতা কী একেবারেই বিচ্ছিন্ন কোন ব্যাপার? রাষ্ট্রের এই নিশ্চুপতায় কেবলই সংশয় জাগে, প্রশ্ন জাগে মনে - রাষ্ট্র তুমি কার? শুধুই বাঙালি জনগণের?

২.সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার ঠিকাদার রাষ্ট্রের উন্নয়ন সন্ত্রাস ও বিপন্ন জাতির মানুষেরা

আমার ঘরের চাবি পরের হাতে
আমি কেমনে খুলিয়ে সে ধন
দেখব চক্ষেতে;
আপন ঘরে বোঝাই সোনা
পরে করে লেনাদেনা...।
ফকির লালন শাহ্‌

তামাম দুনিয়া জুড়ে কেবলই একই ধুয়া-উন্নয়ন (!), উন্নয়ন (!) আর কেবলি উন্নয়ন (!)। উন্নয়নের তাণ্ডব দাবড়ে বেড়াচ্ছে ধনী-গরীব, ছোট-বড় নির্বিশেষে দুনিয়ার সকল দেশের সকল জনপদের, আকাশ-মাটি, পাহাড়-সমতল, বনাঞ্চল, মরুভূমিসহ সকল প্রতিবেশের সকল কিছুকেই; বিশেষ করে ৯০ এর দশকের পর ভারতবর্ষসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশে মার্কিন শাসিত নয়া অর্থনীতি প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকে। মার্কিন শাসিত এই নয়া অর্থনীতি বাজারের উন্মুক্তকরণ, সম্পদের বেসরকারিকরণ ও পণ্য সংস্কৃতির বিশ্বায়ন অপেক্ষাকৃত দূর্বল দেশগুলোর উপর চাপিয়ে নিজের এককাধিপত্ব বজায় রেখেছে মূলত উন্নয়নের মূলো ঝুলিয়েই। এই উন্নয়ন হুজুগে সাড়া দিয়ে বা সাড়া দিতে বাধ্য হয়ে আমাদের মত গরীব দেশগুলো বিশ্বব্যাপী পূঁজি সঞ্চয়ের একমুখীনতাকেই নিশ্চিত করেছে। আর পূঁজির এই একমুখীনতা যে মানুষের অধিকারচ্যুতির মধ্য দিয়েই সম্পন্ন হয় তা আজ আর কারও অজানা নয়। মার্কিন শাসিত এই নয়া অর্থনীতিতে পূঁজির যে একচেটিয়া ব্যবস্থা তার সাথে ঘনিষ্ট লেনাদেনা গড়ে ওঠে কর্পোরেট পূঁজির। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের উন্নত দেশগুলো গরীব ও কম উন্নত দেশ সমূহের অর্থনীতি ও রাজনীতির উপর নিজেদের দাপুটে অবস্থানকে টিকিয়ে রাখতে বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন নতুন কৌশল বাতলানোর দায়িত্ব তুলে দেয় কর্পোরেট সংস্থাসমূহের উপর। সারাবিশ্বের তালিকাভূক্ত বাঘা বাঘা ৫০০ কর্পোরেট সংস্থার মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই রয়েছে ১৮৫টি। আর মার্কিন শাসিত এই কর্পোরেট সংস্থাগুলো নিয়ন্ত্রন করছে বিশ্বের ৭০ শতাংশ বাণিজ্য ও ৮০ শতাংশ বৈদেশিক বিনিয়োগকে। অপরদিকে কর্পোরেট দুনিয়ার রক্ষাকর্তা বা পাহারাদার বা তত্ত্বাবধানের মহান দায়িত্ব পালন করে চলেছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ (IMF) আর বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (WTO) মত শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলো। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের সাথে গাঁটবাঁধা এই কর্পোরেট পূঁজি তার ধুন্দুমার বাণিজ্যিক লুটপাট চালাতে গিয়ে সর্বদাই সামনে রাখছে নানারকম উন্নয়ন মডেলকে। মার্কিন শাসিত কর্পোরেট পূঁজির একচেটিয়া ব্যবস্থাকে আরো হৃষ্টপুষ্ট করতে গিয়ে তাদের উদ্ভাবিত নানান উন্নয়ন মডেল বাস্তবায়ন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ক্ষমতাহীন মানুষের নিকট উন্নয়ন সন্ত্রাস হিসেবেই দেখা দিয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী কর্পোরেট দুনিয়ার কাছে আত্মসমর্পিত রাষ্ট্রগুলোর বুর্জোয়া শাসকেরা বরাবরই উন্নয়ন সন্ত্রাস পরিচালনার জন্য প্রথমেই বেছে নিয়েছে সেসব দেশের বৃহত্তর জাতি বাদে অন্যান্য জাতি অধ্যূষিত এলাকা সমূহকে। ফিলিপাইনের আম্বুলং, ব্রাজিলের ফোর্টএলিজার তাতাজুবা, প্রেইন্‌হা ডো কেন্ডু বারদি, বতসোয়ানা, বুরুন্ডির সিবিতোকি, লাওসের নাকাই, মালয়েশিয়ার পেনান, আর্জেন্টিনার মিসিওনেস, পেরুর ক্যাজামারকা প্রভৃতি অঞ্চলের অধিবাসীদের সামনে বিভিন্ন সময়ে বনায়ন, কয়লা-তেল-গ্যাস উত্তোলন, ইকোপার্ক, রিজার্ভিয়র কত নামে কত বড় বড় উন্নয়ন মডেল নিয়েইতো হাজির হয়েছিল কর্পোরেট বেনিয়ারা। তুপিনিকিন, বায়া গুয়ারনি, ফিলিপিনো, খি, জ, দাইয়াক প্রভৃতি জাতি সমূহের মানুষজন বুঝেছেন উন্নয়ন মানে কয়লা-তেল-পর্যটন-অবকাশ-গ্যাস-কাঠ-পরিবেশ সংরক্ষণ বাণিজ্যে প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছা লুটতরাজ আর নিজেদের বসত-পাহাড়-বন-সৈকত থেকে নিরন্তর উচ্ছেদ-গুলিবর্ষণ-গুম-গণহত্যাসহ নির্যাতন-নিপীড়ন-উৎপীড়নের আরো কত কি কায়দা কানুন ! রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠীর আস্কারায় নাইজেরিয়াতে Shell, Agip, Mobil, Texaco, Chevron প্রভৃতি কোম্পানিগুলোর উন্নয়ন তাণ্ডবইতো কবি নিমো বেসিকে লিখতে রসদ যুগিয়েছিল, “Dried tear bags/ polluted streams/ things are real/ when found in dreams/ we see their Shells/ behind military shields/ evil, horrible, gallows called oilrigs/ drilling our souls./ We thought it was oil/ but it was blood.” আর এই ধরনের উন্নয়ন তাণ্ডবের বহুমাত্রিক উপস্থিতিতে আজ আমাদের বাংলাদেশেও বিপন্ন, বিপর্যস্ত অবস্থায় সংবিধানে অনুল্লেখিত বাঙালি ভিন্ন ৪৫টিরও অধিক জাতি।

পাকিস্তান আমলে এতদাঞ্চলের বাঙালি জনগণের ঘরে ঘরে বিদ্যূতের আলো বিলিয়ে দেওয়ার উন্নয়ন যজ্ঞে ১৯৫৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি ও ইউতে ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি ইউএসএইড-র আর্থিক যোগানে পাঁচবছর ধরে কর্ণফুলি নদীতে বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করে। তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে সাম্রাজ্যবাদী কোম্পানি সমূহের এই বিজলি সন্ত্রাস রাঙামাটি জেলার চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা প্রভৃতি জাতির লোকজনকে চরম অন্ধকারে ঠেলে দেয়। রাষ্ট্রের উন্নয়ন জোয়ারে ভেসে সেসময় প্রায় একলাখ মানুষ বসত, কৃষিজমি (প্রায় ৫৪ হাজার একর) হারিয়ে উদ্বাস্তু হিসেবে দেশত্যাগে বাধ্য হন।

বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ সাম্রাজ্যবাদী সংস্থাসমূহ পরিবেশীয় সম্পদ লুটপাট ও বিনাশের এক নতুন তরিকা নিয়ে হাজির হয়েছে। এই নতুন তরিকার নাম হচ্ছে, ইকোট্যুরিজম। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার সূত্রে জানা যায়, ২০০২ সালে ইকোট্যুরিজম নাকি অস্ত্র ও আইটি সেক্টরের পরে বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ ইন্ডাস্ট্রি হিসেব বিশ্ব অর্থনীতিতে জায়গা করে নিয়েছে। আর বলাই বাহুল্য এই ইন্ডাস্ট্রিগুলোর বেশির ভাগই গড়ে তোলা হয়েছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে। এক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার উদ্দেশ্যও বেশ পরিষ্কার, পেটেন্ট বা ছিনতাইকর্মের মাধ্যমে দুনিয়ার তাবৎ প্রাণসম্পদের উপর নিজেদের নিরঙ্কুশ মালিকানা প্রতিষ্ঠার পথকে আরো সহজতর করে তোলা। আর সভ্য (!) দুনিয়ার এইসব সভ্য (!) চোরদের গায়ে তেলমাখানো, পথ বাতলানো বা অন্যান্য সব রকম সহযোগিতার জন্যতো আত্মসমর্পিত রাষ্ট্রের শোষক শ্রেণী, কর্পোরেট পূঁজির জরায়ুজাত এনজিও সমূহের হরকসম গবেষণা-প্রকল্প রয়েছেই। আমাদের দেশে এই ইকোট্যুরিজম হুজুগ আসে বিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষ দিকে। বাংলাদেশ সরকার ফরেস্ট কনজারভেশন ও ইকোট্যুরিজম স্কীমের আওতায় ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে দেশের প্রথম ইকোপার্ক এলাকা হিসেবে সীতাকুণ্ডকে বেছে নিলেও এরপর একে একে হাত বাড়াতে থাকে খাসিয়া ও মান্দি অধ্যুষিত মৌলভীবাজারের মাধবকুণ্ড-মুরইছড়ার (১৪৮৭ একর), মান্দি অধ্যুষিত টাঙ্গাইল শালবন (৩০০০ একর), ম্রো প্রধান চিম্বুকের (৫০৫০ একর) এলাকাতে। স্থানীয় আদিবাসীদের সাথে কোনরকম পরামর্শ ব্যতিরেকেই সরকার এইসব প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্যোগী হলে প্রায় সব এলাকা থেকে সঙ্গত কারণে প্রতিরোধের আওয়াজ ওঠে। মৌলভীবাজারে ইকোপার্ক বাস্তবায়নের কাজ বন্ধ হওয়ার পর সরকার হাত বাড়ায় মধুপুরের শালবনকে ধ্বংস করার খেলায়। অবশ্য আদিবাসী বসবাসকারী বনাঞ্চলগুলো নিয়ে রাষ্ট্রের নানান হঠকারী সিদ্বান্ত এটাই প্রথম নয়। আমরা মধুপুর বনেই দেখেছি বিশ্বব্যাংক আর এডিবির টাকায় উন্নয়নের কথা বলে কখনো রাবারের মনোকালচারের নামে, কখনো সোস্যাল ফরেষ্ট্রি ও উডলটের মাধ্যমে কিভাবে শালের কপিছ মাটি খুঁড়ে তুলে ফেলার সাথে সেখানকার মান্দি-কোচ-বর্মণদেরও শেকড়চ্যুত করা হয়েছিল। যে রাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদী সংস্থার উদ্ভাবিত উন্নয়নের দোহাই দিয়ে রাবার বাগান, উডলটের মত বন বিধ্বংসী প্রকল্প আর বনবিভাগের অবাধ লুটপাটের ভেতর দিয়ে ধ্বংসের শেষ কিনারায় নিয়ে এসেছে তারাই যখন আবার বনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণসহ বন উন্নয়নের কথা বলেন সেটা তখন বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। বনের যে আদি বাসিন্দারা বনের প্রাণবৈচিত্রকে রক্ষার জন্য বিভিন্ন পূজা, আমুয়া পালন করেন; বনের বিভিন্ন জায়গায় যেখানে তাদের মিদ্দি আসং (দেবতাদের জায়গা) সেই বন তাদের কাছে কোন বাণিজ্যের বিষয় নয়, বরং তা নিজেদের জীবনধারণ ও বিশ্বাসের গভীর সংযোগ। দীর্ঘদিনের এই বনকেন্দ্রিক জীবনধারন পদ্ধতি আর বিশ্বাসের বিকল্প উপায় কখনো ৭ফুট উচ্চতার ৬১ হাজার ফুট ইটের দেয়াল এবং ভেতরে ১০টি পিকনিক স্পট, ২টি ওয়াচিং টাওয়ার, ২টি কালভার্ট, ৩টি কটেজ, জলাধার সহ লেক ৯টি, রেষ্ট হাউজ ৬টি, রাস্তা নির্মাণ ৬টি, বন কর্মীদের ৬টি ব্যারাক নির্মাণ হতে পারে না। বলাফাল, আসংদেনা আমুয়ার বিকল্প হতে পারে না পিকনিক পার্টির আনন্দ ভ্রমন। আর আদিবাসী এলাকাগুলোতে দেয়াল, কাটা তারের বেড়া, সংরক্ষিত এলাকার আসল মাহাত্ম কি তার জন্য দামিনিকোহ, দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলের নজিরতো রয়েছেই। ২০০৪ সালের ৩ জানুয়ারি নিজেদের হাবিমাতে নিজেদের অস্তিত্ব, হাবিমার প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার জন্য পীরেন স্নালের আত্মদান, উৎপলসহ অন্যান্যদের ত্যাগ আর সংগ্রামে তখনকার মত দেয়াল নির্মাণের কাজ বন্ধ করা হলেও সেই প্রকল্প বাতিল করা হয়নি। বিগত রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতা ছাড়ার পর বনবিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসন আবারো সক্রিয় হয়ে উঠে প্রকল্প বাস্তবায়নে। জরুরী অবস্থার ভেতরে গত ১৯ জানুয়ারি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যস্ত টহলের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের দেয়াল নির্মাণ মার্কা উন্নয়নে আবারো বসত-কৃষিজমি সহ বনে অবাধ বিচরণের অধিকার হারানোর আতঙ্কে সন্ত্রস্ত অবস্থায় রয়েছেন হাবিমার সন্তানেরা। যে উন্নয়ন রাবার বাগান, উডলট, ফায়ারিং রেঞ্জ, পিকনিক স্পট, লেক, ওয়াচিং টাওয়ার, চিড়িয়াখানার নামে বারে বারে মায়ের কোল থেকে সন্তানকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, যে উন্নয়ন সন্তানের সামনে মাকে ধর্ষণ করে সে আবার কেমন উন্নয়ন ? শালবনের মান্দি-কোচ-বর্মণদের, শেরপুরের মান্দি-হাজং কিংবা চিম্বুকের ম্রোদের এমন সহজ প্রশ্নের উত্তর কি জানা আছে এই রাষ্ট্র্রের ?

দিনাজপুরের ফুলবাড়ি, পার্বতীপুর, নবাবগঞ্জ এলাকার ৬৭টি গ্রামের সাঁওতাল সহ অন্যান্য আদিবাসী জাতি সমূহের প্রায় একলাখ মানুষ আজ চরম অনিশ্চিয়তায়। ফুলবাড়িতে যুক্তরাজ্যের এশিয়া এনার্জি কোম্পানি ৯ হাজার ২৫০ কোটি টাকা নিয়ে এসেছে নতুন ফন্দি নিয়ে। যে মায়ের বুকে আদিবাসী সন্তানেরা হেসে-খেলে, নেচে-গেয়ে, শঙ্কায়-সংগ্রামে বসত-কৃষি-জাহেরথানে কর্ম, বিশ্বাস আর বর্ণাঢ্য আচারে জীবনের গতিময়তাকে জিঁইয়ে রেখেছেন সেই মায়ের বুকে ডিনামাইট ফাটিয়ে হৃৎপিণ্ডের ভেতর থেকে কালো মানিক বের করে আনতে চায় এশিয়া এনার্জি। বিশ্বের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে এই সব কালো মানিকের নাকি ব্যাপক চাহিদা, অনেক মুনাফা(!)। যে মায়ের বুক উজাড়করা ভালবাসায় বেড়ে উঠেছেন আদিবাসী সন্তানেরা তারা কিভাবে এটা মেনে নেবেন? তথাকথিত সভ্য (!) জগতের মানুষদের এ কোন ধরনের সভ্যতা? কোটি টাকার গাড়ি, কাড়ি কাড়ি অর্থের বিনিময়ে শাসকেরা কোন মাকে যখন উন্নয়নের দোহাই দিয়ে অন্যের হাতে তুলে দেয় তখন এর চেয়ে বড় সন্ত্রাস দুনিয়ায় আর কি হতে পারে ? এর চেয়ে বড় অসভ্যতাই বা আর কি আছে ?

মাগুড়ছড়া বনে যে খাসিয়ারা তাদের মাকে সর্বদা পলাশ-শিমুল-গর্জন-জারুল-হিজল-কদম-মেহগনিসহ নানা লতাপাতায়-ফুলে-ফলে সাজিয়ে শালিক-টিয়া-ময়নার-কোকিল-দোয়েলের গান শুনিয়ে খুশি রাখত, বিদেশি অক্সিডেন্টাল কোম্পানি (বর্তমানে শেভরন কোম্পানি এ ব্লকের দায়িত্বপ্রাপ্ত) ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন সেই মায়ের সকল রূপ-সৌন্দর্যকে ঝলসে দিয়েছে উন্নয়নের দাবানলে। উনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের প্রথম ভাগে সিলেটের লালেংদের জননীভূমিকে বেআব্রু করেই একে একে খাদিমনগর, কেয়াছড়া, কালাগুল, পুুঁটিছড়া ইউরোপীয়দের চা বাগান গড়ে উঠেছিল। রাষ্ট্রের কথা বাদই থাক, তামাম দুনিয়ার কি এমন ক্ষমতা আছে মায়ের এমন বেআব্রু, সৌন্দর্য্যহানি, শরীর ঝলসে দেয়ার ক্ষতিপূরণ দেবার?

পুরো পরিবার জুংলি-ঝান্টা-ওছা-বীণ-শিঙ্গা-দাড়াইস-কালিপানো-সুতানালি-দুধরাজ-জাইত-গোখরা-আলাজ-বীণরাজ-পাতরাজ-টুনটুনি-কালিনাগ-অজগর নিয়ে বসবাস করবার মতন ছোট্ট একটা নৌকা হলেই যথেষ্ট। ঢেউয়ের তালে ছইয়া নৌকায় ভেসে ভেসে শেলুং-বাইলা-পুঁটি-টেংরা-বোয়াল-শুশুকের সাথে খুনসুটি করতে করতে পাড়ি দেন ধলেশ্বরী-বুড়িগঙ্গা-তুরাগ-বংশাই-শীতলক্ষ্যা-মেঘনা-পদ্মা-আত্রাই-যমুনা-সুরমাসহ কত নদী-নালা-খাল-বিল! অর্থসম্পদ না থাকলেও বিচরণের স্বাধীনতাকে উপভোগ করেন নিজেদের মত করে। কিন্তু এই রাষ্ট্র যেখানে সবাইকেই উন্নয়নের বেড়াজালে বন্দি রাখতে চায় সেখানে মাংতাদের স্বাধীন থাকার এই দুঃসাহস কি মেনে নেয়া যায়? রাষ্ট্র জানাল, জনগণের জন্য আধুনিক ও উন্নত সমাজ গঠন করতে হবে। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে কথা! কিন্তু এই আধুনিক আর উন্নত সমাজের মাপকাঠিটা কি? রাষ্ট্র তখন বৃটিশ সংস্থা Department For International Development (DFID) এর কথাটাই হুবহু আওড়ে গেল- নগরায়ন, হ্যাঁ, একমাত্র নগরায়নই হলো আধুনিক ও উন্নত সমাজের মাপকাঠি। ব্যস, এই ঘোষণার মধ্য দিয়েই শুরু হয়ে গেল দেশি-বিদেশি ফাটকা পূঁজির নগরায়ন বাণিজ্য। বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা-কীর্তণখোলা-ধলেশ্বরী-মেঘনা দখল করে রিভার ভিউ, খাল ভিউ কত প্রকল্প জমজমাট হয়ে গেল দুদিনেই। আর ইয়াংসা বাজার-হাঙ্গার ডেইল-ডেইল পাড়া-রাজারছড়া-বাহারছড়া-ইনানী বিচ-জাফলং এর ঝিরি-ছড়া-ঝরনায় বিস্ফোরেকের আঘাতে প্রকৃতি মায়ের বুক ক্ষত-বিক্ষত করে কোয়ারি বানিয়ে সেখান থেকে ট্রাকে ট্রাকে পাথর আসতে লাগল নগরায়নের মজবুত ভিত্তি গড়তে। নদীখেকো, খালখেকো, বিলখেকো, লেকখেকো, হাওরখেকো কত প্রতিষ্ঠান, কত প্রকল্প, কত ব্যক্তি নগরায়নের মোড়ে মোড়ে ফুলেফেঁপে উঠলো! আধুনিক হয়ে উঠলো! সভ্য বনে গেল! ভেতরের পঁচা-গলা কত রক্ত-পূঁজ আড়াল করে ফেলল নগরের কংক্রীটের দেয়ালে! কিন্তু বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা-কীর্তণখোলা-কর্ণফুলী-মেঘনা-তুরাগ, সিলেট-বান্দরবান-উখিয়া-টেকনাফের ঝিরি-ছড়া-ঝরনা-ডাইং-বাইলা-পুঁটি-টেংরা-বোয়াল-শুশুকের সাথে মাংতা-ম্রো-মারমা-ত্রিপুরা-চাকমা-বোম-লুসাই-খাসিয়াদের সম্মিলিত আর্তনাদকে কি ঢেকে রাখতে পেরেছে ? আধুনিক ও উন্নত নগরের ব্যস্ত কোলাহলের মধ্যে সেই সম্মিলিত আর্তনাদতো অবিরত বলেই চলেছে- আমরা উন্নত হতে চাই না, আমরা আগে বাঁচতে চাই, আমরা বাঁচতে চাই...।

৩.বহুমাত্রিক মনস্তাত্ত্বিক আগ্রাসন কব্জা করে ফেলতে চায় মানুষের সবকিছু

“কুঞ্জের ঘারকার
বুড়হা বুড়হি
আজো বন্দী
বাপ দাদা চৌদ্দ পুরুষ
মানকা আওধি।”

[(ভাবার্থ ঃ এই গৃহের আদি দেবতা/বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা যাকে বন্দনা করেছে/আমরাও তাদের বন্দনা করছি;/পূর্বপুরুষেরা যাকে মেনে এসেছে/আমরাও তাকে মেনে এসেছি) ওরাওঁদের সোহরাই পূজায় গৃহদেবতাদের উদ্দেশ্যে পাঠ করা মন্ত্রের অংশ বিশেষ]

আমাদের এই ভূখণ্ডের আদিবাসী জাতিসমূহ তাদের আপন আপন সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদকে আগলে রেখেছেন যুগ যুগ ধরে। বংশপরম্পরায় চর্চার ভেতর দিয়ে এইসব সংস্কৃতি একেকটি জাতির আপন আপন মনস্তত্ত্ব গড়ে তুলেছে, ঋদ্ধ করেছে স্বতন্ত্র‌্যভাবেই সেই উপনিবেশিক আমল থেকেই মানবতাবাদী এইসব মনস্তত্ত্বকে গিলে ফেলতে সচেষ্ট ছিল শাসক গোষ্ঠীর দখলদারি মনস্তত্ত্ব। শাসকগোষ্টী বেশ ভালো করেই জানেন কোন জাতির আপন মনস্তাত্ত্বিক জগতকে বশে না আনতে পারলে শোষণ প্রক্রিয়ায় গতি সঞ্চার করা যাবে না। অতএব যত তাড়াতাড়ি পারো অধস্তন জাতিসমূহের আপন আপন মনস্তত্ত্বকে সম্ভাব্য সকল উপায়ে নিজের আয়ত্বে রাখার চেষ্টা করো। উপনিবেশিক আমলে শাসকগোষ্ঠী সম্ভাব্য সকল উপায়েই এইসব জাতি সমূহের আপন মনস্তত্ত্বকে দখলে সচেষ্ট ছিল; যার মধ্যে অন্যতম এক প্রক্রিয়া ছিল জাতি সমূহের নিজ নিজ বিশ্বাসের হরণ। ভিনদেশী শাসকেরা শোষণের হাতিয়ার হিসেবেই তাদের আপন বিশ্বাসকে এতদাঞ্চলের প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথমেই বেছে নিয়েছিল আদিবাসী অধূষ্যিত অঞ্চলগুলোকে। শিক্ষা, চিকিৎসাসহ কত সেবামূলক কর্মকাণ্ডের আড়ালে দখল করে নিয়েছে মান্দি, খাসিয়া, লুসাই, সাঁওতাল, ওঁরাওদের আপন আপন বিশ্বাসের জায়গাটিকে- যে বিশ্বাস গড়ে উঠেছিল হাজার হাজার বছরের জীবনাচারের মধ্য দিয়ে। গলাটিপে হত্যা করেছে বিভিন্ন বিশ্বাস কেন্দ্রিক নিজস্ব সংস্কৃতির স্বতস্ফূর্ত প্রবাহকে। কি এমন অপরাধ ছিল এই সব সহজ-স্বাভাবিক মনস্তত্ত্বের অধিকারী জাতিসমূহের মানুষের, সেবার নামে কেন তাদের বিশ্বাসকে লুণ্ঠন করে নিতে হবে? সাংসারেক, সারণা, লালেং, ক্রামা, বিষ্ণুপ্রিয়া ধর্মাবলম্বীরাতো কখনো আপন বিশ্বাসকে অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়ার জন্য কারো দ্বারে দ্বারে যান নি। বিশ্বাসতো কখনো চাপিয়ে দেওয়ার জিনিস হতে পারে না, এতো ধারণ করার ব্যাপার- এমন সহজ চিন্তার অধিকারী যারা, তাদের গয়রা-পত্যেন-কালকামি-উ ব্লাই নাংথউ-উ ব্লাই মংতু-সিংবোঙ্গা-গড়াই ঠাকুর-সালজং-সারণা দেবীদের কেন নির্বাসনে পাঠাতে হবে? জনিক নকরেক, রজনী কান্ত সাংমা, টুকিয়া রেমা, দীনেশ নকরেক, জগদীশ চন্দ্র সিং, সমের মাহাতোদের এমন প্রশ্নের জবাব দিবে কে?

উপনিবেশিক বৃটিশ ও পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর মনস্তাত্ত্বিক আগ্রাসন নীতি অপরিবর্তিত থেকে যায় বাঙালি জাতির নেতৃত্বে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পরও। ১৯৭২ সালেই সবাইকে বাঙালি হয়ে যাওয়ার জন্য শাসকগোষ্ঠীর আহ্বান সত্যিই অবাক করেছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম সহ দেশের অন্যান্য জাতির মানুষদের। সংবিধানে আদিবাসী জাতিসমূহের অনুপস্থিতি, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় আদিবাসী অঞ্চলগুলোতে তাদের সংখ্যালগু করে দেয়া, ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সাংবিধানিক ঘোষণা, নানান আগ্রাসী উন্নয়ন প্রকল্প, সেনাশাসন, শিক্ষা ক্ষেত্রে আদিবাসী শিশুদের নিজ নিজ মায়ের ভাষার পরিবর্তে বাংলায় পাঠ গ্রহণে বাধ্য করা, পাঠ্যপুস্তক-বাংলাপিডিয়া সহ বিভিন্ন জায়গায় আদিবাসীদের হীনভাবে উপস্থাপন, প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহের উগ্র-মৌলবাদী শক্তির সাথে ক্ষমতার ভাগাভাগি বা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য চুক্তি এসবই আদিবাসী জাতিসমূহের সহজ-স্বাভাবিক মনস্তত্ত্বের জন্য হুমকি হিসেবেই দেখা দিয়েছে। এছাড়া শাসকগোষ্ঠী বরাবরই চেষ্টা চালিয়েছে অধিপতি জাতির সাধারণ মনস্তত্ত্বকে নিপীড়িত জাতির মনস্তত্ত্বের বিরোধী পাটাতনে দাঁড় করাতে। এক্ষেত্রে শাসক গোষ্টী বেশ সফলই বলা চলে। হাতেগোনা কিছু ছাড়া প্রায় সব বাঙালিই চাকমা-মারমা-খাসিয়া-মৈতৈ-পাত্র-মান্দি নির্বিশেষে সবাইকেই বাঙালি জাতির অধীন উপজাতি(!), বহিরাগত (অন্যদেশ থেকে আগত অর্থে) হিসেবে ভাবতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এছাড়া পার্বত চট্টগ্রামে সেনাশাসনসহ অন্যান্য বিষয়, ইকোপার্ক ইস্যুতেও শাসকগোষ্ঠীর মনস্তত্ত্বের সাথে উচ্চ শিক্ষিত-নিরক্ষর খেটে খাওয়া বাঙালি মানুষজনের মনস্তত্ত্বের তেমন কোন ফারাক খুঁজে পাওয়া যায় না।

পণ্য সংস্কৃতির বিশ্বায়নের মধ্য দিয়ে কর্পোরেট দুনিয়া তার মুনাফা তুলে নিচ্ছে পৃথিবীর আনাচ-কানাচ থেকে। কর্পোরেট সংস্কৃতি বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন জাতির মানুষ কিভাবে নিল-না নিল সেটা তাদের কাছে কোন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় না। তাদের চেষ্টাই থাকে যে করেই গেলাতে বাধ্য করানোর। একাজে তাদের কত সৈন্যসামন্ত, স্যাটেলাইট চ্যানেল, পত্র-পত্রিকা। তাদের চাতুর্যপূর্ণ কলাকৌশলের কাছে কত ভাবেই না বোকা বনে যাচ্ছি আমরা নানান জাতির নানান মানুষেরা। একদিকে যেমন কর্পোরেট পূঁজির টাকায় উন্নয়ন সন্ত্রাসের তাণ্ডবলীলা, তার পাশাপাশিই রয়েছে এইসব নিপীড়িত জাতিসমূহের জেগে উঠবার প্রবণতাকে দমিয়ে রাখতে কত মেকি মানবিক উদ্যোগ আর কর্মতৎপরতা। কর্পোরেট দুনিয়া বা তার গর্ভজাত এনজিওরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ন্যায় বাংলদেশেও আদিবাসী ভাষা-সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার (!) কত রকমের উদ্যোগ নিচ্ছে; তাদের অনুদানে আদিবাসীদের নিয়ে কত সভা-সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটক, আদিবাসী উৎসব-মেলা হচ্ছে গ্রামে-শহরে-বন্দরে। কত বিশিষ্টজনের দরদ উপচে পড়ছে (!), চোখ চকচক করছে ফায়দা লুটার ধান্দায়। আদিবাসীদের অংশগ্রহণমূলক বা নেতৃত্বাধীন কত উন্নয়ন-গবেষণা প্রকল্পে, দেশি-বিদেশি সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের নানান বেড়াজালে বন্দি করে কর্পোরেট দুনিয়া তার মনস্তাত্ত্বিক দখলদারিত্বকে পাকাপোক্ত করে নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে! কিন্তু সিঁধু-কানু-চাঁদ-ভৈরব-বীরসা-গঙ্গানারায়ণ সিং-পঞ্চানন শর্মা-লীলাবতী শর্মা-রাশিমনি হাজংদের উত্তসূরীদের লড়াকু মনস্তত্ত্বকে কি এত সহজেই করায়ত্ত্ব করা সম্ভব? লড়াকু মনস্তত্ত্বের লড়াকু সৈনিকদের যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবেই কল্পনা চাকমা-পীরেন স্নাল-গিদিতা রেমা-সেন্টু নকরেক-আলফ্রেড সরেনরা কী আবারো প্রমান করে যাননি- নিপীড়িত জাতির দ্রোহী মনস্তত্ত্ব আপসকামীতাকে কখনো প্রশ্রয় দেয় না, দ্রোহে-প্রতিরোধে তা জেগে উঠবেই উঠবে।

৪.তবু আকাঙ্খা আছে বেঁচে থাকবার-দ্রোহী পাটাতনের শামিল হবার

“নুসৌসাবোনে, নওয়ারাবোন চেলে হুঁ
বাকো তেঙে গান,
খাঁটি গেবোন হুল গেয়া হো,
দিশম দিশম দেশ মৌঞজহি পারগানা
নাতো নাতো মাপঞিজি কো
দুঃক্‌ বোন দানাংবোন কংগেকো তোঙ্গোন
তবে ছো বোন হুল গেয়া হো।”

[একটি সাঁওতালী গান; ভাবানুবাদঃ আমরা নিজেরাই বাঁচব/ কেউ আমাদের পাশে দাঁড়াবে না/ তবু আমরা বিদ্রোহ করব/ গ্রামের মাঝি মোড়লরা সাহায্য করবে/ কেউ পাশে দাঁড়াবে না।]

সাংসারেক ধর্মীয় বিশ্বাস মতে, মান্দি মিদ্দিদের (দেবতাদের) মধ্যে শৌর্য-বীর্যে প্রধান ছিলেন মিদ্দি গুয়েরা। মিদ্দি গুয়েরা মানুষের বেশে যখন মায়ের গর্ভ থেকে পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হন তখন থেকেই বিপদে আপদে তিনি মানুষকে রক্ষা করে চলেছেন। মায়ের গর্ভে থাকা কালীন সময়েই মিদ্দি গুয়েরা- রাক্কা গুয়ের/আগল সাকবো/আওয়া ওয়াঙা ওয়াঙ্গা/মাচ্ছাদো মাচ্ছা বেকফ্রেং/নুরুমান্দি দিমারিশিখো/মিন্নো আঙ্গা খিন্নো আঙ্গানা/হিঙ্খো আঙ্গা স্খু-সতনা ওয়াগংসিঙ্গত্‌ন/সংনাগ্রেংরিপনাঙ্গারিবাজক/রাক্কা গুয়েরা... । এরকম গাথেম্মাসহ গ্রীকা করে করে দুনিয়ার সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করবার চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। পুরো ৩২ টি দাঁত আর দাঁড়ি-গোঁফ নিয়ে মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেয়া গুয়েরা মানুষকে শিখিয়ে গেছেন কিভাবে দুনিয়ার শক্তিশালী শয়তানদের বিরুদ্ধে সাহস নিয়ে দাঁড়াতে হয়। একাই তখনকার দিনে যত শকষ-শয়তান ছিল যারা মানুষের উপর চরম অত্যাচার করত তাদেরকে দমন করে গুয়েরা তার পরিবারসহ চলে গিয়েছিলেন আসং ফাতেং-চিগা সিম্মল দেং দেং নামক স্বর্গে সেখানে গিয়েও তিনি দুনিয়ার মানুষকে ভুলে যান নি, বিপদে পড়লে তাঁকে স্মরণ করার পথ বাতলে দিয়েছেন, বলে দিয়েছেন শেষ শক্তি দিয়ে লড়াই করে যাওয়ার। বিপদে-আপদে সাংসারেকরা আজও মানসার আয়োজনে গুয়েরার কাছে আশীর্বাদ চান, লড়াই করার শক্তি চান। মিদ্দি গুয়েরাও কখনো নিরাশ করেন না মান্দি (আচিক ভাষায়-মান্দি- বলতে বুঝায় -মানুষ)দের। হ্যাঁ, মিদ্দি গুয়েরার আশীর্বাদেই দুনিয়ার সকল জাতির সকল মানুষেরা সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে নিজেদের লড়াই আজও জারি রেখেছেন। ইতিহাসে মাদল, ধামসা, আদুরি, মইবঙ, নাগড়ার তালে গ্রীকা (আচিক শব্দ -গ্রীকার- বাংলা -যুদ্ধনৃত্য বুঝা যেতে পারে) হয়েছে বারেবারে। মান্দি বিদ্রোহ(১৭৭৫-১৮৮২),পাহাড়িয়া বিদ্রোহ (১৭৮৯-৯১), চোঁয়াড় বিদ্রোহ (১৭৯৮-৯৯), ভীম বিদ্রোহ (১৮১৮), খাসিয়া বিদ্রোহ (১৮২৯-৩৩), কোল বিদ্রোহ (১৮৩১-৩২), নাগা বিদ্রোহ (১৮৩৯), শবর বিদ্রোহ (১৮৫৩), সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৬), মুণ্ডা বিদ্রোহ(১৮৯৯-১৯০১) চাকমা বিদ্রোহ, রিয়াং বিদ্রোহ (১৯৪২-৪৩), তেভাগা আন্দোলন (১৯৪৬-৪৭), হাজং বিদ্রোহের (১৯৪৫-৪৬) ছপাতি নকমা-সিঁধু মাঝি-কানু মাঝি-বীরসা মুণ্ডা-গঙ্গানারায়ণ সিং-জুম্মা খাঁন-তীর্থ সিং-বুরামানিক-মুকুন্দ সিং-শিবরাম মাঝি-হপন হার্ডি-গহনুয়া মাহাতো-মাকটু সিং-ফাগুয়া কোলকামার-তৎনারায়ণ বর্মণ-সর্বেশ্বর ডালু-বুধু খেড়িয়া-রামু মুণ্ডা-লছমন সিং-করমী ওঁরাও-বুধনী ওঁরাও- স্বর্ণময়ী ওঁরাও-রাশিমণি হাজংদের উত্তরসূরী হিসেবেই মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, কল্পনা চাকমা, গিদিতা রেমা, অবিনাশ মুড়া, অধীর দফো, আলফ্রেড সরেন, সেন্টু নকরেক, পীরেন স্নালরা সংগ্রামের বহমানতাকে চালু রেখে গেছেন পার্বত্য চট্ট্রগ্রামে, মধুপুরে, উত্তরবঙ্গে, খাসিয়া পুঞ্জিগুলোতে। আপন আপন সংস্কৃতির লড়াকু মনস্তত্ত্বই তাঁদেরকে বারেবারে নিয়ে এসেছে-অস্তিত্ত্ব রক্ষার অবিনাশী সংগ্রামে। রাষ্ট্র যতই এইসব জাতিসমূহকে আড়াল করে রাখুক না কেন তাদের কুরুখ,আচিক, ঠার, লালেং, নাগরী, ওঁরাও, খিয়াং, সান্তালী, সিং, ককবরক, মারমা, মৈতৈ, চাকমা, খুমী, ম্রো প্রভৃতি ভাষার প্রতিটি শব্দ, বাক্য একেকটি সংগ্রামী হাতিয়ার। আজও দকমান্দা, দকশাড়ি, পিনন, রিনাই, থামি, রিসা, কা জিমপিন, জৈনসেমের প্রতিটি বুননেই মান্দি-চাকমা-মারমা-ত্রিপুরা-মৈতৈ-খাসিয়া নারীরা গেঁথে চলেছেন আপন আপন সংস্কৃতির প্রতিরোধী বাঁধ। রাষ্ট্রীয় আস্কারায় কর্পোরেট পূঁজি দেশের আনাচে-কানাচে, রাজধানীতে আদিবাসীদের নিয়ে যতই নাটক, নাচ, গান মঞ্চায়ন করে নিজেদের জাহির করে বেড়াক না কেন, তিরেশ নকরেক-মাখন লাল বর্মণ-ভগবান সিং-লক্ষীন্দর সিং-বেহুলা সিং-জগদীশ সিং-খামাল কুনেন্দ্র Pv¤^yMs-Elv রাণী মাহাতোদের শেরেনজিং-আজিয়া-রেরে-হাস্তর-দিগ্গ্যিবান্দি-গেংখুলি-রাসলীলা-ঝুমুরের সংগ্রামী উপস্থাপন আকাঙ্খাকে কখনই দমিয়ে রাখতে পারেনি, পারবেও না। কেননা তিরেশ-মাখন-ভগবান-লক্ষীন্দর-বেহুলা-কুনেন্দ্র-ঊষা রানীরা কোন বাণিজ্যের আশায়, পদকের আশায় নিজেদের জাহির করেন না। এ তাদের অস্তিত্বের লড়াকু জানান। গুনীন-ওঝা-দেবর্ষি-পাহান-সেম্মা খামাল-মিদ্দি খামাল-নায়েকে-লাংদুহ-কার্বারি-নকমা-আতু মাঝি-দিশম মাঝি-পারগানা-পরধান-মাথা-মন্ত্রী-রাজা এখনো অকার্যকর হয়ে যায়নি। পরাক্রমশালী বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েইতো আপন বিশ্বাসের দ্রোহী অবগাহন নিরন্তর জারি রেখে চলেছেন রজনী কান্ত সাংমা, সতীশ চন্দ্র মাহাতো, জনিক নকরেক, অনিতা মৃ, মানিক চন্দ্র সিং, নরেন্দ্র মারাক, রাগেন নকমারা। এই বিশ্বাসী লড়াইয়ের কোন বিনাশ হতে পারে না। আপন বিশ্বাস আর সংগ্রামের যুথবদ্ধতার মধ্য দিয়েই এই ভূখণ্ডের বিপন্ন জাতির বিপন্ন মানুষেরা আপনার অস্তিত্বের জানান দিয়ে যাবেন নিরন্তর-এমন লড়াকু বিশ্বাসকে এই রাষ্ট্র, সাম্রাজ্যবাদী কর্পোরেট দুনিয়ার কোন কলাকৌশলই রুখতে পারে না। সিঁদু-কানু-বীরসা-রাশিমনি-আলফ্রেড-পীরেন-কল্পনা-গিদিতা-সেন্টু-অবিনাশদের উত্তরসূরীরা নিজেদের অস্তিত্বের জন্যই বারেবারে জেগে উঠবেন ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে, আঘাতে আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেবেন রাষ্ট্র-বিশ্ব-বহুজাতিক কোম্পানিসহ সকল আগ্রাসী-নিপীড়ক-দখলদারি মনস্তত্ত্বকে, আপন ভূমি-সংস্কৃতি-বিশ্বাসের আপন অধিকার ও চর্চার মধ্য দিয়েই প্রতিনিয়ত তাদের নিজস্ব অস্তিত্ত্বের লড়াকু জানান দিয়ে যাবেন ।


( লেখাটি রাঙামাটির জুম ঈসেথটিকস কাউন্সিল-জাক এর বৈসুক-সাংগ্রাই-বিঝু সংকলন ২০০৭ লামপুক (রনেল চাকমা সম্পাদিত) এ প্রকাশিত)

তারপরেও মাংতারা টিকে আছেন আপসহীন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে

জুয়েল বিন জহির



১.
!
দখল
নদী দখল, খাল দখল, বিল দখল
নদীর জল দখল, জলের মাছ দখল, শ্যাওলা দখল
ব্যাঙ দখল, পোক-মাকড় দখল, শামুক দখল, ঝিনুক দখল
ওছা দখল, বিণ দখল, ঝুড়ি দখল, শিং দখল, জুংলি দখল, ঝান্টা দখল
ঠার দখল, কিচ্ছা দখল, গীত দখল, খেলা দখল, নাম দখল,সমাজ দখল
দাড়াইস, কালিপানো, সুতানালি, দুধরাজ, জাইত, গোখরা, আলাজ, বীনরাজ দখল
পাতরাজ, টুনটুনি, গলাকাটি, লালটিঙি, পিরপিরে, টিয়াঠুটি, সুতাশঙ্খ, কালিনাগ, অজগর দখল

চারপাশের সব কিছুই দখল হয়ে যাচ্ছে। তাদের আবাসস্থল, নদী-নালা-খাল-বিল, জলের মাছ, সাপ, ব্যাঙ, কাকড়া, শামুক, ঝিনুক ইত্যাদি সব কিছুই। অথচ দখল করার মতন তারা নিজেরা কোন কিছুই খুঁজে পান না। একে তো তাদের পুস্তকি জানাশোনা নেই তার উপর জ্ঞান-গম্মিও বেজায় কম (!)। এত কম জ্ঞান নিয়ে তো আর দখলের মতন জটিল বিষয় মাথায় খেলানো চাট্টিখানি কথা নয়। জীবিকার জন্য বাপ-দাদারা যে সামান্য কিছু বিদ্যেটুকু শিখিয়ে দিয়ে গেছেন তাতে তো আর দখল জিনিসটাকে রপ্ত করার মতন কোন ব্যাপার ছিল না। কেবলমাত্র দাড়াইস, কালিপানো, খইয়াপানো, দুধরাজ, সুতানালি,জাইত, গোখরা, আলাজ, বীনরাজ, পাতরাজ, টুনটুনি, গলাকাটি, লালটিঙি, পিরপিরে, টিয়াঠুটি, সুতাশঙ্খ, কালিনাগ প্রভৃতি নানান জাতের বিষধর সাপ ধরা, বীণ বাজিয়ে সাপের খেলা, সাপের বিষ নামানো, বানরের নাচ ও যাদুর খেলা দেখানো; কাঁচের চুড়ি, কাপ-পিরিচ, মুক্তার মালা, কড়ির মালা বিক্রি; নানান জাতের লতা-পাতা, শিকড়-বাকর, মাছের কাটা, জীব-জানোয়ারের হাড়গোর দিয়ে বিভিন্ন রোগের ঔষধ বানানোর কায়দা-কানুন ও মন্ত্র-তন্ত্র, যাদু-টোনা; গরু-মহিষের শিং দিয়ে আপন কায়দায় দেহের বিষাক্ত রক্ত-পুঁজ বের করার মতন সামান্য বিদ্যে টুকুই আত্মস্থ করেছেন, চর্চা করে চলেছেন শত শত বছর ধরে। সভ্য,শিক্ষিত,আধুনিক মানুষেরা তাদের এই জানাশোনাকে নাকসিটকিয়ে উড়িয়ে দিলেও অন্যের জানাশোনার উপর তাদের কোন অবজ্ঞা নেই। বরং অন্যের বিদ্যা-বুদ্ধিকে তারা সম্মান জানিয়ে, সমীহ করেই চলেন। শিক্ষিত মানুষজনেরা তাদের আপন বিশ্বাসকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেও অপরের বিশ্বাসের সাথে তারা তাদের আপন বিশ্বাসের এক যোগসূত্র খুঁজে নিয়েছেন নিজস্ব কায়দাতেই। তাদের কাছে মনসা, খোয়াজ খিজির, গঙ্গা মা সবাই বিশেষ মর্যাদায় আসীন। যুগ যুগ ধরে নদী-নালা-খালের মধ্যে ভাসমান জীবন পার করলেও সেগুলোর উপর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা কখনো ক্যানভাস করে বেড়ান নি। তারা কখনো ভাবেন নি নদী-নালা-খাল এভাবে দখল হয়ে যেতে পারে, বদলে যেতে পারে নদীর-নালার পানির রং, হারিয়ে যেতে পারে নানান জাতের মাছ । তারা কখনো চিন্তাই করেন নি ডাঙ্গার শিক্ষিত, বুদ্ধিমান মানুষেরা এভাবে সাপ, ব্যাঙ, শামুক, ঝিনুক, ছাইপ্‌লা, পশু-পক্ষীর হাড়গোড়, মাছের ঠোঁট-কাটা সব বিনাশ করে ফেলবে, নাই করে ফেলবে। তাদের বিশ্বাসকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে মোটেই লজ্জিত নয় ডাঙ্গার মানুষ জনেরা, কোন কষ্টই অনুভুত হয় না মনে। এভাবে সবকিছু তছনছ করার মধ্যেই নাকি গিরস্ত (ঘরে বাস করা অর্থে) মানুষের বাহাদুরি (!) প্রকাশ পায়। কিন্তু নদী হারানো, খাল-বিল-নালা হারানো, হরকসম মাছ, সাপ, গাছ-গাছালি, পশু-পক্ষী, জীব-জানোয়ার হারানোর কষ্টতো বুকের গভীর থেকে কিছুতেই মুছতে পারেন না অশিক্ষিত, কম জ্ঞানওয়ালা মানুষেরা। ভুলতে পারেন না নিজেদের নাম-পরিচয় আড়াল হয়ে যাওয়ার বেদনা। কিন্তু তারপরেও এইসব অচ্ছুত, অশিক্ষিত, কম জ্ঞানওয়ালা মানুষেরা টিকে আছেন অবশিষ্ট নদী-নালা, জীব-জানোয়ার, পশু-পক্ষী নিয়ে, আজীবন চর্চিত সামান্য বিদ্যেটুকুকে পুঁজি করে; ডাঙ্গার মানুষজনের কাছে না হোক অন্তত নিজেদের আগামী প্রজন্মকে জানাতে তাদের নাম-পরিচয় আর জলের ঢেউয়ে ভাসমান জীবনের কথা।

২.
আমরা বাইদ্যা না, বেদে না; আমরা বাইদ্যা না, বেদে না; আমরা বাইদ্যা না, বেদে না;...
আমরা মাংতা, আমরা মাংতা, আমরা মাংতা, আমরা মাংতা, আমরা মাংতা, আমরা মাংতা, আমরা মাংতা...

...অন্ত্যজ বর্ণের... বেদে প্রভৃতিদেরই অন্যতম বৃত্তি ছিল সাপ-খেলানো, যাদুবিদ্যার নানা খেলা দেখানো ইত্যাদি।...রাজসভায় জাঙ্গলিক বা বিষবৈদ্য অন্যতম রাজপুরুষ ছিলেন...।
[বাঙ্গালীর ইতিহাস(আদি পর্ব), ড. নীহার রঞ্জন রায়]

আমরা সবাই বেদে,বাইদ্যাদের সাথে কম-বেশি পরিচিত। সংস্কৃত বৈদ্য থেকে বাইদিয়া বা বাইদ্যা শব্দের উৎপত্তি। বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা ভাষার অভিধানে বেদে, বেদিয়া, বাইদিয়া শব্দের অর্থ বলা হয়েছে যাযাবর, সাপুড়ে জাতি বিশেষ, বিষবৈদ্য । প্রাচীন বাংলায় লোকচিকিৎসা পেশায় জড়িত অন্ত্যজ বর্ণের একদল লোক কালক্রমে অন্যান্য উচ্চ বর্ণর লোকজনের কাছে বৈদ্য,বাইদ্যা,বেদে প্রভৃতি অভিধায় পরিচিত হয়ে ওঠে। উচ্চ বর্ণর দেয়া এইসব অভিধায় পরিচিত ওঠার পাশাপাশি আড়াল হয়ে যেতে থাকে অন্ত্যজ বর্ণর আপন জাতিগত পরিচয়। তাছাড়া উচ্চ বর্ণ কর্তৃক অন্ত্যজ বর্ণর নাম-পরিচয় আড়াল করে দেওয়ার পেছনে যে নিজের সাপেক্ষে অপরকে নিচু,নিকৃষ্ট,ঘৃণিত রূপে প্রতিপন্ন করার একটা প্রবণতা থেকে যায় তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু এইসব বর্ণ দেমাগি দৃষ্টিভঙ্গির সাথে কখনোই একাত্ম হতে পারেন নি সেই অন্ত্যজ বর্ণর লোকজনেরা; মেনে নেন নি অন্যের দ্বারা নিজেদের জাতিগত নাম-পরিচয় আড়াল হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটাকে। অধিপতি শ্রেণীর চাপিয়ে দেয় নানান অভিধার বিপরীতে সেই অন্ত্যজ বর্ণর লোকেরা আজও নিজেদের জাতিগত পরিচয় মাংতা হিসেবেই দেন; বাইদ্যা বেদে বা বেবাইজ্যা বলে নয়।

...এইযে বাইদ্যা কয়, আমাগো ভিতরে একটা খারাপ লাগে, কেন খারাপ লাগে; যে আমরা তো বাইদ্যা না। তোমরা এই যে একটা নাম রাখছ, বলতাছ-তোমরা এই নামটা পাইলা কোনথন। অহন তোমাগো জিগাইতে গেলে একটা ঝগড়া আসে। ...আমরাতো বাইদ্যা না। ...আমাগো জাতের নাম আছে, আমরা মাংতা।
[ মোন্তাজ মাতবর(৬০), রিকাবী বাজার বহর, মুন্সীগঞ্জ ]

মাংতাদের জাতিগত উৎপত্তি নিয়ে বেশ কয়েকটি অষ্পষ্ট মতভেদ প্রচলিত রয়েছে; যার কোনটিই তাদের জাতিগত উৎপত্তি বা অরিজিন নিয়ে পরিস্কার কোন ধারণা দিতে সক্ষম নয়। ড. শেখ মাকসুদ আলী সম্পাদিত বাংলাদেশ জেলা গেজেটিয়ার-বৃহত্তর ঢাকা তে উল্লেখ রয়েছে, বেদে সমপ্রদায় কতদিনের পুরনো তা বলা সম্ভব নয়। তবে এদেশের শহর-বন্দর ও গ্রামে এদের বিচরণ দীর্ঘদিনের। এরা আমাদের সামাজিক জীবনের সাথে মিশে আছে।

বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির বাংলা পিডিয়াতে মাংতাদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে, ১৬৩৮ সালে আরাকানের বল্লাল রাজার সাথে সেখানকার মনতং জাতিগোষ্ঠীর একটা অংশ বিতারিত হয়ে প্রথমে বঙ্গদেশের বিক্রমপুরে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং পরবর্তীতে এরা বঙ্গদেশ ও আসামের প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েন। এছাড়া মনতং জাতিগোষ্ঠীর থেট বা ঠেট ভাষার সাথে বেদে বা মাংতাদের ঠার ভাষার নাকি মিলও রয়েছে।

এই সূত্র মতে আরাকান থেকে মাংতাদের এতদাঞ্চলে প্রথম আগমনের সময় কাল ১৬৩৮ সাল উল্লেখ করা হলেও আরো অনেক থেকেই প্রাচীন বাংলায় মাংতাদের উপস্থিতি ও তাদের পেশাগত পরিচিতির প্রমাণ পাওয়া যায়। ড. নীহার রঞ্জন রায় তাঁর বাঙ্গালীর ইতিহাস গ্রন্থের আরেক জায়গায় উল্লেখ করেছেন,...অন্ত্যজ পর্যায়ের আর একটি বর্ণের খবর দিতেছেন বন্দ্যঘটীয় আর্তিহর পুত্র সর্বানন্দ (১১৬০)। ইহারা বেদে বা বাদিয়া; বাদিয়ারা সাপ খেলা দেখাইয়া বেড়াইত ( ভিক্ষার্থং সর্পধারিণি বাদিয়া ইতি খ্যাত)। এছাড়া যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত ১৩১৬ বঙ্গাব্দে তাঁর বিক্রমপুরের ইতিহাস প্রথম খণ্ডে মাংতাদেরকে হিন্দু সমাজেরই একটা বর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন-...বিক্রমপুরে বহুজাতীয় লোকের বাস। হিন্দুদের মধ্যেই বিভিন্ন জাতি ও তাহার শ্রেণীবিভাগ আছে। ... বৈদ্য, কায়স্থ, জেলে, কৈবর্ত, বৈষ্ণব, বারুই, বেদিয়া (বাইদা), বেলদার, ভূঁইমালি, ধোপা, গোপ (গোয়ালা), ঝাল-মাল, যুগী...।

অনেকের মতে মাংতারা দ্রাবিড় ভাষা-ভাষী কোন জাতি। এছাড়া নিজেদের জাতিগত উৎপত্তি নিয়ে মাংতাদের নিজস্ব কিছু ধারণা রয়ে যা মুখে মুখে বংশপরম্পরায় আজও টিকে আছে।

“... বিভিন্ন এলাকায় মাংতা আছে। কিন্তু অদের ভাষা আবার অন্য। ...আরবিয়ান মাংতা আছে আরবি ভাষা। আমরা বুঝব না। আমাগো ভাষা অরা বুঝে না। জাত সব একই, জাত সব মাংতা। ...আমাগো গোড়াটা ঐ আরব থেইকাই আইছে।”
[ মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন (৫২), মিরকাদিক পৌরভবন সংলগ্ন, মুন্সীগঞ্জ]

“...আগে মুরব্বিরা কইছে, নুহু নবীর কিস্তি আছিল। ... তয় নুহু নবীর ছিলছিলায় যেমুন আমরাও নৌকায় বসবাস করতাছি। ...ঐ আমল থেকাই। নুহু নবীর ছিলছিলাতেই আমরা আইছি...অখান থেনই আরকি আমাদের নৌকায় থাকা পড়তাছে...।”
[ মোন্তাজ মাতবর(৬০), রিকাবী বাজার বহর, মুন্সীগঞ্জ]

মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন ও মোন্তাজ মাতবরের ন্যায় মাংতাদের অনেকে মনে করেন যে, তাদের মাংতা জাতের উৎপত্তিস্থল আরবে বা তাদের নৌকায় বসবাসের শুরু হয়েছে নূহ্‌ নবীর সেই প্লাবনের সময় থেকেই। নিজেদেরকে মনে করেন নূহ্‌ নবীর বংশধর হিসেবে। সেই ছিলছিলাতেই তাদের নৌকায় বসবাস।

আমি নূহ্‌কে প্রেরণ করেছিলাম তাঁর সমপ্রদায়ের প্রতি একথা বলেঃ তুমি তোমার সমপ্রদায়কে সতর্ক কর, তাদের প্রতি মর্মন্তদ শাস্তি আসার আগে।
(সূরা নূহ্‌, আয়াত-১)

নিজ সমপ্রদায়ের লোকজন যখন বারে বারে হযরত নূহ্‌ নবীর প্রচারিত বাণীকে অস্বীকার করতে লাগল তখন তাদের উপর মহাপ্লাবন হিসেবে কঠিন শাস্তি নেমে এসেছিল। নূহ্‌ নবী তাঁর অনুসারীদের নিয়ে বিশালাকার কিস্তিতে চড়ে সেই প্লাবনে নিজেদের রক্ষা করেছিলেন। ছয় মাস আটদিন কিস্তিতে থাকার পর নূহ্‌ নবী তাঁর আশিজন অনুসারী নিয়ে জুদি পর্বতে ( খ্রিস্টানদের মতে নূহ নবীর কিস্তি এসে থেমেছিল আর্মেনিয়ার Mt. Ararat এ, যা থেকে জুদি পর্বত ১৮০ মাইল দূরে অবস্থিত ) এসে থামেন। পরবর্তীতে এই পর্বতের পাদদেশেই থামানিন (Thamanin) নামের এক জনপদ গড়ে ওঠে। এই জুদি পর্বতটি অবস্থিত বর্তমান তুরস্কে। প্লাবনের পর নূহ্‌ নবীর জীবিত তিন ছেলের মধ্যে হামের বংশধরদের পাক-ভারতের একাংশ, আফ্রিকা ও ইউরোপ; শামের বংধরদের দ্বারা আরব ও পার্শ্ববর্তী দেশ সমূহ; ইয়াসেফের বংশধরদের দ্বারা তুরস্ক, রোম প্রভৃতি অঞ্চল জনবসতিপূর্ণ হয়। জানা যায়- শাম, হাম ও ইয়াসেফের বংশধরদের মধ্যে যথাক্রমে ১৯, ১৮ ও ২৬ টি পৃথক ভাষার সৃষ্টি হয়। হাম ও শামের বংশধরদের ভাষাগুলোকে ভাষাতাত্ত্বিকেরা হেমিটিক-শেমিটিক ভাষাগোষ্ঠী ভূক্ত করেছেন। হেমিটিক-শেমিটিক ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত আরবি ভাষায় বাদিয়াহ্‌ বলে একটা শব্দ আছে যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় যাযাবর। তবে এই বাদিয়াহ্ বলতে যে মাংতাদেরই বুঝানো হয়েছে তা নিশ্চিত নয়। এখন মাংতা জাতিগোষ্ঠীটি ঠিক কখন কীভাবে নিজেদের স্বাতন্ত্র‌্য পরিচয় নিয়ে নূহ নবীর কিস্তির ছিলছিলায় নিজেরা নৌকায় বসবাস ও যাযাবর জীবন শুরু করেন তা বের করা দীর্ঘ গবেষণা সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

বর্তমানে মাংতাদের নিজস্ব ঠার ভাষার ধাতু ও ক্রিয়াপদ বাংলা তথা ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারের ন্যায়। তবে ঠার ভাষার বর্তমান এইরূপ দীর্ঘদিন বঙ্গদেশে অবস্থানের ফলে বাংলা বা ইন্দো-আর্য পরিবারের অন্যান্য ভাষা দ্বারা যে অনেক খানিই প্রভাবিত তা মোটামুটি নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়। মাংতাদের ঠার ভাষায় যে নিজস্ব কিছু শব্দ আছে যেমনঃ খাইপ্তা (বাবা), খাইপ্তানি (মা), খুপি (লবণ), ছাইম্‌লা (মাছ), ময়াল (সাপ), উড়ুম (চিড়া), বতুন (ভাত), লেবন (তরকারি), উজ্জালি (মাংস), ছোলতা /মইল্‌ত (ঔষধ), বেলং (তেল), আম (তুওম), দকলা (কলা), ডুওম (মাথা), গেসকই (চুল), গুন্‌কি/গুনারি (চোখ), বক (রক্ত) গেইত্‌লা (হাড়ি), দবলা (কুলা), পেছকো (দা), টোঙ্গা (জুতা), বুইত্‌কাল (কুকুর), নেওয়ারি (পানি), কাইকাল (পরিবার), বম্‌কই (মায়ের দুধ) ইত্যাদি ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে গণ্য হতে পারে।

৩.
চুড়ি লাগব নি চুড়ি...;লাগব নি কাঁচের কাপ-পিরিছ, প্লেট-বাটি... ;খেলা দেখাইগো খেলা, সাপের খেলা দেখাই...; রস টানি, বাত টানি, কোমড় টানি, মাঝা টানি, চোখের পোকা, দাঁতের পোকা ফালাই, শিঙ্গা লাগাই...; খা খা খা বক্ষিলেরে খা, কিরপিনেরে খা...

ক্ষুদ্রান্তে ভূজগাঃ শিরাংসি নময়ত্যাদায় যেষামিদং
ভ্রাতর্জাঙ্গালিক ত্বদাননমিলন্মন্ত্রানুবিন্ধং রজঃ।
জীর্ণস্তেষফণীন যস্য কিমপি ত্বাদৃগগুণীন্দ্রব্রজা-
কীর্ণক্ষ্মাতলধাবনাদপি ভজত্যানম্রভাবং শিরঃ।।


ভাই জাঙ্গালিক (সাপুড়ে), তোমার এই সাপগুলি ছোট ছোট; তোমার মুখের মন্ত্রপড়া ধূলি ইহাদের মাথা নমিত করিয়া দিতেছে। এই ফণাধারী সাপটি বোধ হয় জীর্ণ (অর্থাৎ প্রবীণ বা অভিজ্ঞ), কেননা তোমার মতো গুণী দ্বারা পূর্ণ মাটিতে ধাবন করিয়াও ইহার মাথা নম্রভাব হইতেছে না (অর্থাৎ নমিত ভাব হইতেছে না)।

উমাপতি ধরের এই সংস্কৃত শ্লোকের ন্যায় সাধারণের কাছে বেদে,বাইদ্যা শব্দের সাথে সাপ ধরা বা সাপের খেলা দেখানোর বৃত্তিটাই অধিকতর স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এছাড়া গল্প-উপন্যাস বা সিনেমাতেও বেদে বলতে কেবলমাত্র সাপুড়েরাই বারবার উপস্থাপিত হয়ে আসছেন। তবে এর বাইরেও যে মাংতাদের আরো পেশাগত বৈচিত্র্যতা রয়েছে এবং এই পেশাগত বৈচিত্র্যতার সাথে সাথে তারা বেশ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত তা, অনেকের কাছেই হয়ত স্পষ্ট নয়। ড. শেখ মাকসুদ আলী সম্পাদিত বাংলাদেশ জেলা গেজেটিয়ার-বৃহত্তর ঢাকা এর আরেক জায়গায় বলা হয়েছে- ...বেদে সমপ্রদাযের বেশ কটি জাত রয়েছে। ... এদের মধ্যে বৈদ্য, বৈরাল ও সাখার শ্রেণী প্রধান। এদের জীবন ও জীবিকা ভিন্নতর না হলেও রীতি-নীতি ও আকারে কিন্তু পার্থক্য রয়েছে।

মাংতাদের মতে, তাদের কয়েকটা জাত আছে। এক জাতের সাথে আরেক জাতের পেশাগত পার্থক্য ছাড়াও রীতিনীতে রয়েছে স্বাতন্ত্র‌্যতা বাংলাদেশের মাংতারা মালবৈদ্য, তৈল বা বান্দারিয়া, সাপুড়িয়া, মিসিগারি, বৈরাল, বাজিকর, শৈল, সওদাগর বা সান্দার বা লাইয়ো ইত্যাদি ভাগে বিভক্ত।

“...মাল মাংতা যারা, তারা নেয়ারবইনা করে। নেয়ারবইনা অইল ঐ যে শিঙ্গা লাগায়, পোকাটোকা ফেলায়...। তৈল মাংতা যাদের কয় ওরা বাঁদর লিয়া খেলায়। একপ্রকার আছে মিসিগারি মাংতা, অরা চহের (চোখের) পর্দা কাটে। তারপরে একপদের আছে লাইয়ো মাংতা, ...তারা ঐ কাপ-পিরিচ বেঁছে; আরেক পদের আছে বৈরাল মাংতা-মাছ ধরে, বড়শি বায়। আছে হাবুখেলা মাংতা-এইগুলি ইণ্ডিয়ায়। অরা হাবুখেলায়।...মানে ‘হাব হাবু হাবু কার বাড়ি যাবো ...’এরম কইরা মেয়েছেলে সবাই গেরাম করে। এমন কইরা সাইর গাইব আর টাকা উঠাইব। তারপরে আবার আছে লেল্লছ মাংতা। লেল্লছ মাংতা ওরা কী আবর্জনা খায়। যেমন-ব্যাঙ খায়, কুইছা খায়, সাপ খায় ওদের লেল্লছ বলা হয়। চাইয়া-চিন্তা খায় আরকি। বাংলাদেশে নাই, ওটা ভারতে। আরেকটা আছে ভাল্লুকধারী মাংতা। অরা ভাল্লুক লইয়া গেরাম করে। যারা ধামাধন্নি তারা ধামা (টুকরি) নিয়া ঘুইরা বেড়ায়, ... অনেক মালছামানা বেঁছে, অষুধঅ বেঁছে।...এই দুইটাঅ ভারতে। আরেক পদের আছে সাপুইড়া মাংতা। তারা সাপ খেলা দেখায়। মেয়ে-পুরুষ সবাই। ওদের সাপুইড়া বলা হয়। ঠিক আছে, আরেক পদের আছে বাজিকর, বাংলাদেশে আছে। যাদু দিয়া ময়নার ছাও, পুতুলের ছাও বানায়’, এইটার নাম ‘কতিখেলা’। ঐ গেলে বলে যাদুখেলা আর মাংতা বলে কতিখেলা।”
[ মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন (৫২), মিরকাদিক পৌরভবন সংলগ্ন, মুন্সীগঞ্জ]

মাংতাদের একজাতের সাথে আরেক জাতের রীতিনীতিতে যেমন পার্থক্য রয়েছে, রয়েছে আলাদা আলাদা
সমাজ ব্যবস্থাও। চারপাশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বৃত্তিগত বৈচিত্র্যতা ক্রমেই সংকীর্ণ হয়ে আসছে। নিজেদের একজাতের পেশাকে আরেক জাতের লোকজন যেমন গ্রহণ করছে তেমনি গ্রহণ করছেন অন্য পেশাও। তবে মাংতাদের সব জাতের মধ্যেই আপন চিকিৎসা পদ্ধতির দূর্দান্ত চর্চা রয়েছে।

মাংতাদের একজাতের সাথে আরেক জাতের বিবাহ সামাজিক ভাবে নিষিদ্ধ। তবে বর্তমানে কিছুটা হলেও এর ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। এখন মাংতাদের একজাতের সাথে আরেক জাতের ছাড়াও গিরস্ত বাঙালিদের
সাথেও বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে উঠছে, তবে এর সংখ্যা খুব একটা বেশী নয়।

৪.
গড়াইস, দাড়াইস, দুধরাজ, বেকরাজ, কালিপানো, খইয়াপানো, সুতানালি, বিণরাজ, কোবরা, অজগর, গরুর শিং, কাইক্যা মাছের ঠোট, বনরুইর আঁইশটা, সজারুর কাটা, ময়না-শালিকের ঠোট, কট মাছ, ওরাল মাছের কাটা, ঝিনুক, শামুক, পোকা-মাকড়, মনিরাজ, উলটচণ্ডাল, নিম, তুকমা হায়াত, ঘৃতকুমারি, সাদা তুলসী, অর্জুনবানের গোটা, নদী, খাল, বিল, মাটি...

... রোজার মাসে রাইতে এক মহিলারে লইয়া আইছে কয়জন। ... সাপে কামড় দিছে। ... মন্ত্র পইড়া রোগীরে একটা মইছ (মরিচ) গালে দিলাম, কইলাম-ধর এইটা চাবান দে। খাইল, ধাক অইছে। মইছ (মরিচ) দিয়া পরীক্ষা দিলাম, যদি ধাক না ধরে তয় জানব যে এই রোগী আর বাঁচব না... মাথায় বিষ ওইঠা গেছে।... হেরপর একটা মুরগী কিনা আনলে বেটির আতটা(হাতটা) একটু কাইটা মুরগীটার পুটকিটা ঐখানে লাগাইলাম; রক্তটা লাগাইলাম। লাগাইলাম যদি বিষাক্ত সাপে কামড় দিয়া থাকে লগে লগে মুরগীটা দাপাইয়া মইরা যাইব।..একদম মইরা যাইব। পরীক্ষা অইটাই। ... নতুন ব্লেড কিইন্যা আইনা এই বান্ধের গোড়া কেচা দিলাম।...কেইচা দিলাম নানান গাছগাছালির অষুধ লাগাইয়া। ... অষুধ লাগাই দিলাম মাগো বেটি চিক্কার দিয়া দাপড়ান। এরপর গরম পানি দিয়া ধুইয়া বান ছাইড়া দিলাম, রোগী পুরা সুস্থ।

[হাফিজা (৪৫), মিরকাদিম পৌরভবন সংলগ্ন, মুন্সীগঞ্জ]

যদি গেইজের ব্যারামের রোগীরে বনরুইত মাছের আঁইশটা দিয়া অষুধ বানাইয়া ব্যবহার করান যায় তাইলে গ্যারান্টি, রোগ ভালা অইয়া যাইব।... কট মাছের কাটা, অর্জুনবানের গোটা, আখরোটের ফল মাজা ব্যথার জইন্য উপকার দেয়, বাতের জন্য উপকার দেয়।

[আব্দুল কাদের (৫৫), মুক্তারপুর বহর, মুন্সীগঞ্জ]

অনেকদিনের পুরানি কাঁশির জন্য কুই মাছ খাওয়ানো গেলে কাঁশি ভালা অইয়া যাইব।
[পাগলনি খালা(৫০), কদম আলী গুদারা ঘাট, কাশীপুর নারায়ণগঞ্জ]

...আমি সাপ ধরছি, সাপ নাচাইছি। আমি সাপ ধরছি না-দাড়াইস ধরছি, গড়াইস ধরছি, দুধরাজ, বেকরাজ, জাইত, গোক্‌েখার, আলাজ, বীনরাজ, পাতরাজ, টুনটুনি, গলাকাটি, লালটিঙি, পিরপিরে, টিয়াঠুটি, সুতাশঙ্খ, কালিনাগ বহু ধরনের সাপ ধরছি।...এইগুলি বাংলাদেশেও ধরছি ভারতেও ধরছি...অনেক সাপ ধরছি আমি।...সাপ ধরা তো কোন ব্যাপার না। সাপ ধরাতো সাবাস। ... কোন কিছূ লাগে না। সাপ ধরা সাবাস আর হাতের ক্যাপাসিটি, চখ্যের নজর। ...তারপরেও সাথে গাছ রাহি, লাঠি রাহি।
[ কান্দার খান (৬৫),খরিয়া মালবৈদ্য বহর, মুন্সীগঞ্জ]

মাংতাদের আপন চিকিৎসা পদ্ধতি বা বৃত্তিগত উপকরণের সবকটিই উদ্ভিদ-প্রাণী বা পরিবেশীয় অন্যান্য উপাদানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট। মাংতাদের আপন চিকিৎসা পদ্ধতিতে তন্ত্র-মন্ত্রের এক অনিবার্য উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলেও পরিবেশীয় জীবীয় বা অজীবীয় উপাদানগুলোও প্রত্যক্ষভাবেই জড়িত। আর এইসমস্ত উপাদান সমূহের ব্যবহারাদির পুরোটাই যে মাংতাদের আপন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে তা বলাই বাহুল্য। মাংতাদের অন্যান্য বৃত্তিসহ নিজস্ব চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগ নির্ণয়ন কৌশল থেকে শুরু করে অষুধপাতি পর্যন্ত্ত পুরো প্রক্রিয়াতেই পরিবেশীয় উপাদানের অপরিহার্যতা লক্ষ্যণীয়।

পুস্তকি জ্ঞান না থাকলেও পূর্বপুরুষের জ্ঞান-অভিজ্ঞতার আলোকে মাংতারা চারপাশের পরিবেশকে অত্যন্ত নিবিড় ভাবে পাঠ করেন। ভৌগলিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের সকল উপাদানের সাথেই মাংতাদের রয়েছে এক সংহত সম্পর্কের; আর এই সংহত সম্পর্কের ভেতর দিয়েই তারা পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের নানা বিষয়াদি রপ্ত করে নেন। এখানে কোন দখল নেই, বিনাশ নেই, পাচার নেই, আছে, কেবল এক অকৃত্রিম বান্ধব সম্পর্কের। এই সম্পর্কই মাংতাদের শিখিয়ে দেয় কোন অসুখ-বিসুখে কখন, কোন সময়ে, কোন গাছের ফল-বাকল-পাতা-ফুল বা শিকড় কতটুকু পরিমানে সংগ্রহ করতে; কীভাবে জুনি পোকা, ইঁদুরের লেজ, কাইক্যা মাছের ঠোঁট, কুঁই মাছ, কোরাল মাছের কাটা, কট মাছের কাটা, ওরাল মাছের কাটা, ধনেশ পাখির ঠোঁট, গরু-ছাগল-মহিষের শিং, ময়না পাখির ঠোঁট, পোকা-মাকড়, বিভিন্ন জাতের সাপ, সাপের বিষ, কুমিরের মাংস, বনরুইয়ের আঁশটে বা প্রাণীর হাড়গোর সংগ্রহ করতে হবে প্রাণীকূল বা গাছ-গাছালির স্থায়ী কোন বিনাশ ছাড়াই। পরিবেশীয় এইসব নানান উপাদান দিয়েই তারা শত শত বছর ধরে দাঁতের পোকা, চোখের পোকা, চোখের ছানি, রস বাত, বিষ বাত, ওরশ্যের ব্যারাম, হাঁপানি, বিভিন্ন রকমের চর্মরোগ, যৌনরোগ, রক্তস্রাব, সাদাস্রাব, সাপের বিষ নামানো সহ নানান চিকিৎসা দিয়ে আসছেন ডাঙ্গার গৃহস্থ মানুষদের। শুধুমাত্র মানুষের চিকিৎসাতেই নয় গৃহপালিত পশুপাখির চিকিৎসা পদ্ধতিতেও তারা সিদ্ধহস্ত। যেমনঃ ভাদ্র-আশ্বিণ মসে গরুকে যদি কুমিরের মাংস খাওয়ানো যায় তাহলে গরু আর জ্বরতে (খুড়া রোগ) পারে না ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রাকৃতিক সম্পদের বিনাশকে তারা কখনোই প্রশ্রয় দেন না; কেননা এইসবের বিনাশকে তারা সার্বিক ভাবে নিজেদের বিনাশই মনে করেন। সভ্য মানুষেরা যখন আরাম-আয়েশ আর মুনাফার লোভে একের পর এক নদ-নদী, খাল-বিল ভরাট করে ফেলছেন, বন-জঙ্গল-পাহাড় সব দখল করে ফেলছেন তখন মাংতারা বাকরুদ্ধ হয়ে যান; এ যেন নদী বা খাল-বিলকে মেরে ফেলা নয়,বন-জঙ্গল ধ্বংস নয়; মাংতাদেরই গলা টিপে হত্যা করা। গৃহস্থ মানুষের কল-কারখানার বিষ দিয়ে পানিকে দূষিত করে হাজার হাজার জাতের জলজ জীবের বংশ নাশ করাকে মাংতারা নিজেদেরই বংশনাশ জ্ঞান করেন। কেননা এই নদ-নদী, খাল-বিলই তো অন্যান্য জলজ জীবের ন্যায় তাদেরও আবাসস্থল, বিচরণ ক্ষেত্র। উপযোগী পরিবেশীয় বিচরণক্ষেত্র ছাড়া কোন জীবই তো স্বাভাবিকভাবে টিকে থাকতে পারে না; মাংতারাও পারছেন না। গৃহস্থ মানুষেরা কীভাবে এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে জানা নেই মাংতাদের; জানা নেই এই ভাবে নদী-খাল-বিল হত্যার কোন বিচার আছে কী না বা থাকলেও কার কাছে তারা চাইবেন এইসব হত্যা, দখল আর বিনাশের। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নদ-নদী, খাল-বিলের পানিতে জীবন পার করলেও এবং ঝোপ-ঝাড়, বন-জঙ্গল থেকে তারা তাদের প্রয়োজনীয় সাপ, ব্যাঙ, পোকামাকড়, পাখি, গাছগাছালি সংগ্রহ করলেও কখনো একরত্তি জায়গাওতো নিজেদের দখলে রাখার কোন চেষ্টা করেন নি কিংবা সাপ, পোকামাকড়, জন্তু-জানোয়ার নির্বিচারে হত্যা করেন নি, পাচার করেন নি, দখল করার কথা ভাবেন নি নদী-খাল-বিল আর পাহাড়-জঙ্গলকে। কিন্তু তারপরেও একের পর এক নদ-নদী-নালা-বিল-খাল সব উধাও হয়ে যায়, জলের মাছ, পোকামাকড়সহ হাজার হাজার প্রজাতির জীব-জানোয়ার, ঝোপ-ঝাড়, বন-জঙ্গল সব উজার হয়ে যায়।

অষুধি গাছ পাইতেতো এহন অনেক সমস্যা। বছরে দুই-একবার ভারত যাইতে অয় গাছগাছন্ত আনতে। আগেতো মধুপুর জঙ্গল থিকা তারপরে রাঙ্গামাটি, বান্দরবন, খাগড়াছড়ি ও চিটাগাংএর পাহাড়ি বন থিকা আনতাম। এহনতো কিচ্ছু নাই, অনেক গাছপালা কাইটা হালাইছে। ...অষুধ পাইতে অনেক কষ্ট অয়।
[ মোঃ আলাউদ্দিন (৪৫),আমিন বাজার ব্রিজ বহর, ঢাকা]

...এইযে রঙের পানিটা, ডাইংয়ের পানিটা নদীর মইধ্যে যেইভাবে ছাড়তাছে -এভাবে মাছ সব মইরা যাইতাছে; আগে বড় বড় বোয়াল মাছ, আইড় মাছ, মিরকা মাছ, রুইত মাছ, বাউস মাছ, চেউয়া মাছ, চাপিলা মাছ, বাইল্যা মাছ, বাইম মাছ অইত, অহন যে কেন অয়না- এই রঙের পানির কারণে। ... বোয়াল মাছ এক ইসাবে নাইই, ... ডাইং মাছ- সেলুং মাছটা বড় অইলে ঐটারে আমরা ডাইং মাছ কই...ঐ জিনিসটাও নাই। ... ছাটা ইছা মাছটা থাকতই পারে না। ...আমারতো আধার দিয়া মাছটা মারতাছি।... কারেন জাল দিয়া মাছ মারতাছি না। ...গিরস্তরা কারেন জাল দিয়া মাছের বীজ শেষ কইরা হালাইছে।... এই রঙের পানিটা মুখে দেওয়া যাইতেছে না, পছা পানিটায় যে গোসল করে তাদেরও ক্ষতি অইতাছে,... শরীরে একটা গোটা অইতাছে। ....যারা পানির ভেতরে থাকে না তাগর খাওয়া পড়ে না।...আমাদের থাকতে অইতাছে, এই পছা পানিই খাইতে অইতাছে।
[মোন্তাজ মাতবর(৬০), রিকাবী বাজার বহর, মুন্সীগঞ্জ]

৫.
আল্লারে মানি, রসুলরে মানি, নবী মানি, মনসারে মানি, বাবা খোয়াজ খিজির মানি,মা গঙ্গীরে মানি, নামাজ পড়ি, রোজা রাহি, খোয়াজ খিজিররে খোদাই সিন্নি দেই, মা গঙ্গীর লাইগা সিন্নি ভাসাই, দেবী মনসারে ভোগ দেই, পৌষ সংক্রান্তির বুড়াবুড়ি পূজায় মানতি দেই...; আমরা মানুষ, আমাগো দেখলে পাপ অইব কেন?...

আদি বিশ্বাস যাই থাকুক না কেন বর্তমানে ধর্মীয় বিশ্বাসগত দিক থেকে মাংতারা ইসলাম ধর্মের অনুসারী।
আল্লাহ্‌, রাসুল সহ ইসলামের প্রধান পাঁচ স্তম্ভের উপর এদের বিশ্বাস রয়েছে। কিন্তু মুসলমান হলেও তাদের নিজস্ব কিছু বিশ্বাস ও লৌকিক সংস্কারের প্রচলন রয়েছে যা তাদের স্বতন্ত্র‌্য পরিচয় আমাদের সামনে হাজির করে। ইসলামের অনুসারী হলেও অন্য ধর্মের অনেক কিছুই তারা আত্মস্থ করেছেন নিজস্ব ঢঙে। পানির উপরে সারাজীবন বসবাসের দরুন পানির পীর হিসেবে খ্যাত বাবা খোয়াজ খিজিরের উপর মাংতাদের রয়েছে পরম আস্থা। প্রতিবছর অগ্রহায়ণ মাসে মাংতাদের প্রতিটি বহরেই বাবা খোয়াজ খিজিরের নামে করা হয় খোদাই সিন্নি। সকলের সম্মিলিত আয়োজনে খোদাই সিন্নি তৈরির পর প্রথমেই তা খোয়াজ খিজিরের নামে একটা কলাপাতায় করে ভাসিয়ে দেয়া হয় নদীর জলে। কিন্তু এই খোদাই সিন্নি খোয়াজ খিজিরের নামে ভাসানোর পাশাপাশি একইভাবে মা গঙ্গীর উদ্দেশ্যেও উৎসর্গ করেন মাংতারা। তাদের জলজ জীবনে খোয়াজ খিজির ও মা গঙ্গী দুজনের সমান গুরুত্বের। ঝড়-বাদল সহ সকল প্রকার বিপদে-আপদে তারা একই সাথে স্মরণ করেন মা গঙ্গী ও বাবা খোয়াজ খিজিরকে। জলের উপরে বসবাস, সাপের হাত থেকে নিজেদের রক্ষাসহ অন্যান্য দুঃখ-কষ্ট থেকে নিস্কৃতির জন্য সর্পদেবী মনসার শুভদৃষ্টি কামনায় মাংতারা দুধ, কলা, ধান,দূর্বা সহ ভোগ দেয় নানান কিছু। এছাড়া ছেলে-মেয়েদের অসুখ-বিসুখের হাত থেকে রক্ষার জন্য পৌষ সংক্রান্তিতে আয়োজিত বুড়াবুড়ির (শিব-পার্বতী) পূজায়ও মানত দিয়ে আসেন একান্ত বিশ্বাসের সাথে।

যাদুবিদ্যা,তন্ত্র-মন্ত্র মানুষের অতি পুরনো বিশ্বাসের ধারাটিকেই ঝিইয়ে রেখেছে। যাদুবিদ্যা এমন একটা কৌশল যা দিয়ে মানুষ অতিপ্রাকৃত শক্তিকে বশে এনে স্বীয় উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চায়। কল্পনার হাতিয়ার দিয়ে অজেয় প্রকৃতিকে বশীভূত করার একটা অনেক পুরনো প্রচেষ্টা। তন্ত্র-মন্ত্র, যাদুবিদ্যায় অগাধ বিশ্বাস ও তার নিয়মিত চর্চা রয়েছে মাংতা জীবনে। মাংতাদের সকল চিকিৎসা পদ্ধতিতে তন্ত্র-মন্ত্রের উপস্থিতি অণিবার্য। মাংতাদের তন্ত্র-মন্ত্রের সাথে প্রায় ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে আছে আসামের কামরূপ পাহাড়ের নাম। তাদের অনেকেই নিজেদের ও তাদের পূর্ব পুরুষদের আসামের কামরূপ পাহাড়ের কামাখ্যা মন্দিরে যাদুবিদ্যা শিখে আসার কথা মজমা সহ নানান জায়গায় বেশ গর্বের সাথে প্রচার করেন। সাথে থাকে সেখানকার নানান গল্প ও যাদুবিদ্যা শেখার বই লজ্জাতুন্নেছার নাম। তাদের বিশ্বাস মতে গাছ-গাছন্ত, জীব-জানোয়ারের দেহের বিভিন্নাংশের সাথে এই তন্ত্র-মন্ত্রের ব্যাপারটা যুক্ত হলে তা থেকে অতি সহজেই কাঙ্খিত ফল পাওয়া যায়। বিশেষায়িত দ্রব্যগুণের বিশাল কদর রয়েছে মাংতা জীবনে। অমাবস্যা-পূর্ণিমা রাতে জোয়ারের সময় কাটা পাটের আঁশের বিশেষ গুণ আছে বলে বিশ্বাস করেন। এই বিশেষ গুণ সম্পন্ন পাটের আঁশ দিয়ে ওঝা রোগীর যেখানে সাপে কামড়েছে তার উপরের দিকে বাঁধ দিয়ে দেন। এরপর হাতে কড়ি নিয়ে মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে ঝাড়ার পর কাইক্যা মাছের ঠোট বা ব্লেড দিয়ে ক্ষতস্থানের উপরে কেটে বিষ বের করে ফেলেন। এছাড়া অমাবস্যা রাতে কেউ যদি একাকী উলঙ্গ অবস্থায় নির্দিষ্ট স্থান থেকে সাদা তুলসির শিকড় তুলে আনতে পারে তাহলে তা দিয়ে যাদু-টোনা, বাণ সহ নানান কাজে লাগানো যায় ইত্যাদি অনেক বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে।

... মানুষ হইয়ে মানুষেরা ঘিন্না নাইকা-মহাপাপ। আমি যামু, আমারে দেইখা কেউ ঘিন্না করে করুক, আমি তারে ঘিন্না করলাম না। অর মন চায় আমার কাছে আহুক না চায় না আহুক; আমার কাম আমি কইরা আমু। গেরাম করতে গেলে কতকের গাইল-কনি খাওন লাগে, কতকের খিবুকসি (?) শুনন লাগে, কতকের... । গিরস্তের বাড়ি গেলে কউক, কাজ করতে গেলে কত কতাইতো হুনতে অয়, কতায় কয় না- নদী দিয়া গান গাইয়া গেলে নদীর জোয়ার যায় না, মুখের জোয়ার যায়।
[ হাফিজা বেগম(৪৫), মিরকাদিম পৌরসভা সংলগ্ন, মুন্সীগঞ্জ]

মাংতারা তাদের আপন বিশ্বাসে আর সংস্কারে গৃহস্থদের অনেক বিশ্বাস আর সংস্কারের সহাবস্থান ঘটালেও ডাঙ্গার মানুষদের কাছে তারা বরাবরই নিচু জাত,অচ্ছুত বা ঘৃণার পাত্র হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছেন। মাংতারা মুসলমান হওয়া সত্বেও এবং ইসলাম ধর্মে বর্ণবাদের কোন স্থান না থাকলেও তারা গৃহস্থ মুসলমানের বর্ণবিদ্বেষী আচরণের সম্মুখীন হন প্রতিনিয়তই। মাংতা পুরুষেরা সাধারণত হাটে-মাঠে-ঘাটে নিজের পেশাগত মজমা বসালেও মাংতা নারীরা গৃহস্থদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে যাদুখেলা, সাপের খেলা, চুড়ি বিক্রি, শিঙ্গা লাগানোর কাজ করে থাকেন। আর একারণে স্বভাবতই মাংতা পুরুষদের চেয়ে নারীরা বর্ণদাপটের চরিত্রকে টের পান হাড়ে হাড়ে। বাড়ির শূচিতা নষ্ট হবে বলে অনেক গৃহস্থ বাড়িতেই মাংতা নারীদের প্রবেশের কোন অনুমতি মেলে না। আর কোন রকমে অনুমতি মিললেও গৃহস্থের ঘরে ঢুকবার কোন সুযোগ থাকে না। কারো কারো মতে...বাইদ্যানিগো চেহারা দেখলে পাপ অয়, জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে অইব, মাংতাদের দিকে তাকালে নাকি কারো চল্লিশ দিনের জন্য পবিত্রতা থাকে না, কবুল হয় না কোন ইবাদত-বন্দেগি এমন বিশ্বাসও প্রচলিত রয়েছে অনেক গৃহস্থ মানুষের। মাংতা নারী বুঝে পায় না মানুষ মানুষের দিকে তাকালে কী ভাবে পাপ হয়, দেহের পবিত্রতা নষ্ট হয়, ইবাদত-বন্দেগি সব পানি হয়ে যায়। জাত-পাতের বিবেচনায় নিচু জাত বলে অবজ্ঞা করলেও সুযোগ পেলে গৃহস্থ পুরুষদের অনেকেই মাংতা নারীর দিকে লিঙ্গীয় আঘাত হানতে কার্পণ্য করেন না। এহেন বর্ণ আর পুরুষতান্ত্রিক দাপটের কাছে মাংতা নারী-পুরুষ কোণঠাসা হলেও কখনো দমে যান নি। আপন সংস্কার, বিশ্বাস, সহনশীলতা আর পেশাগত দক্ষতা আর জাতিগত সংহতিকে পুঁজি করে আজও মাংতারা মোকাবিলা করে চলেছেন সকল দাপটকে, নিজেদের টিকিয়ে রাখার এক অদম্য প্রত্যয়ে।

...একবার মুক্তাগাছায় গিরস্তরা আমাগো সাভারের এক মাইয়া তুইলা নিয়া গেছিল। পরে কেস কইরা দুই দিন পর মেয়ে ফেরত পাইছিল। এই রহম অয় অনেক জায়গায়। ...এইসব সমস্যা আমরা সবাই মিল্যা মীমাংসা করি। আর এইগুলি যেইখানে অয়, সেখানে আমরা সারাদেশের মাংতারা সবাই টেকা দেই সমাধানের লেইগা। আর আমগো সব দলের একজন কইরা মাতবর ওইহানে যাইব, যেইহানে এই ঘটনাটা হইল-মীমাংসার লেইগা।
[আব্দুল কাদের (৫৫), মুক্তারপুর বহর, মুন্সীগঞ্জ]

৬.
আমাগো বম্‌কই আমাগো নেমরা-নিমরির লেইগা...; আমাগো নৌকায় কুনোসুম ডিবির দুধ ঢুকে নাই...; রাজা, মায়া বড়ি,...কুনোসুম কিনি নাই, ব্যবহার করি নাই...

বাজারি অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পণ্যের অবাধ প্রবাহ আজ আছড়ে পড়ছে সর্বত্র। মুনাফা লোভীদের তাণ্ডবে বিধ্বস্ত আজ পাহাড়-জঙ্গল-সমতলের সকল জাতির মানুষের স্বাভাবিক জীবন-যাত্রা। পণ্যের বাঁধভাঙ্গা জোয়ারে বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার আপন প্রতিরোধী ব্যবস্থা আজ হুমকির সম্মুখীন। মাংতাদের জীবনও এর বাইরের কিছু নয়। সভ্য, শিক্ষিত মানুষের কাছে মাংতারা যতই অসভ্য,নিকৃষ্ট,অচ্ছুত হোক না কেন বাজারি দুনিয়ার দাপুটে ব্যবস্থায় উৎপাদিত পণ্যের ভোক্তা হিসেবে তারা মোটেই ‘অচ্ছুত’ নন। ভোক্তা হিসেবে সভ্য দুনিয়ার বিভিন্ন কোম্পানিগুলোর কাছে অন্যান্য সবার ন্যায় তারাও হয়ে ওঠেন কাঙ্খিতজন। দাপুটে বাজারি অর্থনীতির কাছে আত্মসমর্পিত রাষ্ট্রযন্ত্র তার নানান বিধিব্যবস্থার মাধ্যমে বেঁচে থাকবার নূন্যতম অধিকার থেকে মাংতাদের প্রতিনিয়ত দূরে ঠেলে রাখলেও পণ্যের বাহারি সব প্রচার-প্রচারণায় কাউকেই দূরে রাখতে বা বঞ্চিত করতে চায় না (!) ব্যবসায়িক দুনিয়া। সভ্য দুনিয়ার অর্থনৈতিক মারপ্যাঁচ না বুঝলেও চারপাশের নানান পরিবর্তন তাদের মানস চিন্তায় রেখে চলে অনেক প্রশ্নের ছায়াপাত; যে প্রশ্ন তাদেরকে শংকিত করে তুলে নিজেদের বিশ্বাস, আচার ও পেশাগত ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার বিষয়ে। কিন্তু তারপরেও মাংতারা আপন বিশ্বাস আর সংস্কারগত সংহতিকে অক্ষুণ্ন রাখার ভেতর দিয়েই গড়ে তোলেন তাদের আপন প্রতিরোধের ভিত্তি।

...বাইচ্চা না অওনের লেইগা আমাগোর পদ্ধতিই করি। ... ডাক্তারি অষুধে সাদা সেরাবের ব্যারাম অইয়া যায়, রক্ত সেরাবের ব্যারাম অইয়া যায়, কতকের ফুইলা যায়গা...। আর আমাগো গাছন্ত অষুধে শরীলে কোন সমস্যা অইব না। ...চাইরটা ট্যাবলেট বানাই দিমু খাইলে জীবন পার ...। তেরো জন ছেলে মেয়ে অইছে, আমার স্বামী একটু হাদিসের পদের তো হেই জন্য বাইচ্চা বন্ধ করতে দেয় নাই। ...আমার কোলের ছেলের পরেই আমি চাইরটা ট্যাবলেট খাইছি, আর চিন্তা নাই...; ... অল্প কয়েকদিনের জন্য বাইচ্চা হওন বন্ধ করার অষুধও আমাগো জানা আছে।
[ হাফিজা বেগম (৪৫), মিরকাদিম পৌরসভা সংলগ্ন, মুন্সীগঞ্জ]

মাংতা পরিবারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি হলেও তাদের রয়েছে নিজস্ব নিয়ন্ত্রন পদ্ধতি। বাজারি জন্ম নিয়ন্ত্রন সামগ্রী সমূহের উপর কোন আস্থা রাখতে পারে না মাংতা নারী। হাটে-বাজারে, রেডিও- টেলিভিশনে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর বাহারি সব বিজ্ঞাপণ দেখলে-শুনলেও সেদিকে তাদের কোন আকর্ষণ নেই। বহুজাতিক কোম্পানীগুলো তাদের কনডম, পিল ইত্যাদি দিয়ে সারা দুনিয়া দাঁপিয়ে বেড়ালেও মাংতা জীবনে কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। মাংতাদের দাবি, বাজারি এই সব জন্ম নিয়ন্ত্রন সামগ্রীতে নানান পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকলেও উদ্ভিজ্জ ও প্রাণীজ উপাদানে তাদের নিজেদের তৈরিকৃত ঔষধে কোনো শারিরীক ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। প্রকৃতি থেকে পরিমান মতন উদ্ভিজ্জ ও প্রাণীজ উপাদান নিয়ে আপন জ্ঞান আর অভিজ্ঞতার নির্যাস মিলিয়ে নিজেরাই তৈরি করে নিচ্ছেন নিজেদের শরীরবান্ধব জন্মনিয়ন্ত্রন সামগ্রী। এছাড়া মাংতা মায়েরা গৃহস্থ মায়েদের ন্যায় সন্তানের বেড়ে উঠার দায়দায়িত্ব ডানো, নিডো, এ্যাংকার বা অন্যান্য গুড়ো দুধের কৌটায় বন্দী রাখতে চান না মোটেও। মাংতা মায়ের বিশ্বাস বমকই বা বুকের দুধ পান করানোর সাথে সন্তানের স্বাস্থ্যগত ব্যাপারটা যেমন জড়িত তেমনি জড়িত সন্তানের সাথে মায়ের নিবিড় ভালোবাসার বাঁধনটাকে আরো পোক্ত করার। মাংতা মায়েরা তাদের সন্তানদের দেড়/দুই বছর পর্যন্ত বুকের দুধই পান করান। আলগা দুধ পান করানোর রীতি মোটেই পছন্দ নয় তাদের। তবে মায়ের স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণে বাচ্চাকে বুকের দুধ পান করানো না গেলে সেক্ষেত্রে গরুর দুধ বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে এর হারও খুবই কম। মাংতা মায়েরা সারাদিন কর্মব্যস্ত থাকলেও তাদের সন্তানের দেখাশুনার দায়িত্বটুকুও অন্যের হাতে ছাড়তে নারাজ। নিজের আঁচলে শিশু সন্তানকে পিঠে বেঁধে নিয়েই গ্রাম ঘুরতে তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

৭.
বামাদের যা কিছু খাছরে, তাই লিয়ে ঝেলের নতে লড়পাব... ;বামাদের যা কিছু খাছরে, তাই লিয়ে ঝেলের নতে লড়পাব...; বামাদের যা কিছু খাছরে, তাই লিয়ে ঝেলের নতে লড়পাব...

...এই রহম অইছে, আমরা এক জায়গায় গেছি দল লইয়া, ভালা সুন্দরী মাইয়া দেখলে ওরা (গৃহস্তরা) হামলা দিতে আইছে কিন্তু আমরা আবার রাত জাইগা ঐ সেখান থেইকা চইলা গেছিগা। আমাদের কাছও ঐ গুলিবাঁশ, গুলাইল থাকে; এগুলি লইয়া আমরা রাত জাগছি। এইগুলি দিয়া আমরা পাহারা দিছি। দেখছি ওহানে খারাপ ওখানে আর থাকি নাই চইলা গেছি গা। আবার কত জায়গায় হামলাও দিয়া হালাইছে, মারামারিও হইয়া গেছে; আমরা কেস-মামলা করছি।... এই ভাবেই আমরা টিক্যা আছি।
[আব্দুল কাদের (৫৫), মুক্তারপুর বহর, মুন্সীগঞ্জ]

অধিপতি শ্রেণীর নিত্য নতুন কৌশলের কাছে মাংতারা প্রতিনিয়ত কোণঠাসা হয়ে পড়লেও টিকে থাকার সংগ্রামে তারা আজও লড়াকু সৈনিক। সভ্য দুনিয়ার নানান সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত মাংতারা দমে যাবার পাত্র নন। তারা তাদের নিজস্ব জ্ঞান, বিশ্বাস আর প্রথাগত সংস্কারের সাহসী চর্চার মধ্য দিয়েই মোকাবিলা করে চলেছেন নানান প্রতিকুলতাকে। সভ্য সমাজের সুযোগ-সুবিধা থেকে অনেক পিছিয়ে থাকলেও মাংতারা হতাশ হতে নারাজ। হতাশ কেন হবেনই বা কেন- শিশু-বৃদ্ধ প্রতিটি মাংতাইতো আজও তাদের নিজস্ব জীবনাচার ধরে রাখছেন সাহসিকতার সাথে। তাদের চাঁন মিঞা সর্দার, পান্না মাতবর আর মোন্তাজ মাতবরেরা আজও বিচক্ষণতার সাথে মাংতা বহরের নিজস্ব রীতি-নীতি পালন করে চলেছেন; আমিন বাজারের আলাউদ্দিন মিয়া শহরে-বন্দরে বীন বাঁশিতে সুরের ঢেউ তুলে মুক্তারপুরের আব্দুল কাদেরের দক্ষ হাতে ধরা সুতানালি, পিলপিলে, জাইত, গোখরা, মাইটাপানস নাঁচিয়ে চলেছেন সমানে। কাশীপুরের পাগলনি খালা, মিরকাদিমের হাফিজা, আফুজারা তাদের জুংলি আজও বোঝাই রাখেন গাছগাছন্ত আর জীব-জানোয়ার দেহাংশ থেকে তৈরি নানা রোগের অষুধে, মহিষ-গরু আর ছাগলের শিং, কাইক্যা মাছের ঠোট আর কার্তিক অমাবস্যার পাটের দড়িতে; দক্ষ হাতের কৌশলে শিঙ্গা টেনে টেনে বের করে আনছেন গৃহস্থ মানুষের শরীরের বিষাক্ত রক্ত-পূঁজ। আর এই রক্ত-পূঁজের সাথেই হয়ত একদিন বের করে আনবেন গৃহস্থ মানুষের দেমাগি মনের সকল আবর্জনাকে -এমন স্বপ্নের ঝিলিকইতো খেলে যায় মাফুজাদের চোখে-মুখে। অধিপতি শ্রেণীর নানাবিধ কাঠামো তাদেরকে প্রতিনিয়ত আড়াল করে রাখতে চাইলেও আমিন বাজারের মান্নান সর্দারেরা নতুন প্রজন্মের মাংতাদের কাছে চান না কোন কিছু আড়াল করতে; মাংতাদের নিজস্ব রীতিনীতির কথা বলে যান বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে। রিকাবী বাজারের সোনিয়া, সালমারা গৃহস্থ পুরুষের নানা রকম হয়রানির মুখোমুখি হলেও কাপ-পিরিচের পাতিতো মাথা থেকে নামান নি; গৃহস্থ পুরুষের কুদৃষ্টির কাছে হার না মেনে মাথা উঁচু করেই তো গ্রামে গ্রামে ঘুরছেন। নদীতে মাছ না থাকলেও রমিজ মিয়ারা আজও তার বড়শিতে আধার গেঁথে চলেন ধলেশ্বরীর বুকে কারেন জালের কাছে আপোস না করার ব্রতটা জিঁইয়ে রেখেই। বিয়ান্যার শাজাহান মিয়া তালি-চাবি ঠিক করে দিয়ে অনেক সময় ন্যায্য পাওনা না পেলে গৃহস্থদের দুটো উচিৎ কথা শুনিয়ে দিতে তো ভয় করেন না কখনো। খরিয়া গ্রামের কান্দার খানেরা আজও জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ান অষুধি গাছের খোঁজে। লোকমান মিয়া আর মামুনেরা কড়িমালা, ঝিনুকমালা সহ নানান গাছন্ত তাবিজের ঝান্টা নিয়ে পাড়ি দেন শহর-বন্দর-গ্রাম। লুটপাট আর ছিনতাইয়ের দুনিয়ায় হানিফ মিয়া তার ওছা আর আছড়া নিয়ে হাঁক দিয়ে বেড়ান-পানিত পইড়া যাওয়া সোনা-রূপার জিনিস তুলি...। প্রাকৃতিক নানান উপাদানের মাধ্যমেই ওরশ্যের ব্যারাম, হাঁপানি, যৌনরোগ, বা জন্ম নিয়ন্ত্রণের অব্যর্থ অষুধ দিয়ে চলেছেন দেলোয়ার হোসেন। গৃহস্থদের প্রতিনিয়ত খালবিল ভরাটের বিপরীতেও আবু বকর, সালামেরা নতুন নতুন বিরকি (নৌকা) ভাসাচ্ছেন পানিতে। রোখসানা, রেহানারা তাদের সন্তানদের ঘুম পাড়াচ্ছেন ঠারে গান শুনিয়েই। গৃহস্থজনের সামপ্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিকে উপেক্ষা করেই পাগলনি খালারা একই সাথে খোয়াজ খিজির আর মা গঙ্গীর নামে পানিতে ক্ষীর ভাসাচ্ছেন, একই হাতে মিলাদের তবারক আর পূজার প্রসাদ গ্রহণ করছেন পরম বিশ্বাসের সাথে। পান্না আর শম্ভু মাতবরদের আহ্বানে পোড়াবাড়ি সহ বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানের ন্যায় খরিয়া গ্রামে এখনও সকল মাংতারা জড়ো হন কার্তিক মাসে, মেতে উঠেন উৎসবে-আমোদে। আর এই সমস্ত কিছুই মাংতাদের প্রেরণা যোগায় সকল দাপটের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়ে যাবার, শক্তি যোগায় সম্মিলিত কণ্ঠে উচ্চারণ করার-

আমাগো যত তন্ত্র-মন্ত্র, বিশ্বাস, বিরকি, বহর আছে তাই নিয়ে লড়ে যাব
আমাগো ঠারে যত শব্দ, গীত, রূপকথা, প্রবাদ, ডাকের কথা আছে তাই নিয়ে লড়ে যাব
আমাগো বহর যতগুলা নদী-নালা-খাল-বিল-জলাশয়-রাস্তার ধারে আছে তাই নিয়ে লড়ে যাব
আমাগো চেনা যত জাতের সাপ, পোকামাকড়, পশু-পাখি, জীব-জানোয়ার আছে তাই নিয়ে লড়ে যাব
আমাগো যত ওছা, আছড়া, বীন, ঝাপি, ঝুড়ি, জুংলি, ঝান্টা, গুলিবাঁশ, গুলাইল আছে তাই নিয়ে লড়ে যাব
আমাগো যত বনরুইর আঁইশটা,সজারুর কাটা, কুমিরের মাংস, কট মাছের কাটা আছে তাই নিয়ে লড়ে যাব।


(This article was published in `Mhrittika’-vol.-3, issue-3; editor-Jewel Bin Zahir, Parag Ritchil, Dhaka, August 2006)