Tuesday, August 21, 2007

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতিগত ভাবনা ও বাস্তবতার সহজ পাঠ

জুয়েল বিন জহির


১. রাষ্ট্র তুমি কার ?
রাষ্ট্র তুমি কার ?? রাষ্ট্র তুমি কার ???...


একটা কাগজে কলমে স্বীকৃত বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্রে বসবাসরত বেবাক সচেতন নাগরিকের পক্ষেই কাগুজে ভাষারীতিতে এর উত্তর দিতে পারা তেমন কোন কঠিন বিষয় না। যে কেউ, যে কোন প্রান্ত থেকে সমস্বরে গলা মেলাবেন‌‌ -জনগণের। এখন এই জনগণের ভেতর কারা পড়েন ? রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমানার ভেতরে লিঙ্গ, বয়স, ধর্ম-বর্ণ, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিগত দিক নির্বিশেষে সকল মানুষই এর আওতাভূক্ত; এই বিষয়েও কারো কোন অস্পষ্টতা নেই। তবে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অস্পষ্টতা অবশ্যই রয়ে গেছে অথবা বলা যেতে পারে অবচেতন বা সচেতন ভাবেই এই দিকটির প্রতি গুরুত্ব দিতে নারাজ এই রাষ্ট্রের প্রায় পচাঁনব্বই ভাগেরও অধিক মানুষ যার ভেতরে রয়েছেন প্রগতিশীল-বুর্জোয়া-প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক সচেতন শাসকগোষ্ঠী-শিল্পী-সাহিতি্যক-বুদ্ধিজীবি-সুশীল সমাজ সহ হরেক অভিধার হরেক ঘরানার মানুষজন। আর এই বিষয়টি হচ্ছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতিগত পরিচয়। ব্যাপারটা একটু খোলসা করে বলা যাক। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মালিক বলা হয়ে থাকে জনগণকে। সেই হিসেবে-বাংলাদেশ-নামক রাষ্ট্রের মালিকও হবেন জনগণ, অতি সহজ সাধারণ একটা ব্যাপার। এখন যদি প্রশ্ন করা হয়, কোন জনগণের বা জনগণের জাতিগত রূপটা কি? উত্তর আসবে বাঙালির, রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে কেউবা বলবে বাংলাদেশী। হ্যাঁ, একদম সত্যি কথা, সংবিধান বিশেষজ্ঞ থেকে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, শাসকগোষ্টী থেকে শোষিত সমাজের প্রতিনিধি, ডান-বাম-আধাবাম-বুর্জোয়া-প্রতিক্রিয়াশীল নির্বিশেষে বেবাকই গর্ব ভরে একই উত্তর দিতে অভ্যস্ত। আমরা সকলেই জানি বাঙালি জাতি কয়েকশত বছর ধরে নানান আত্মত্যাগের ভেতরে নির্মাণ করেছে কাঙ্খিত এক জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের। দেশের যেকোন নাগরিকেরই এ এক বুক ফুলানো ব্যাপার। একে খাটো করে দেখার মতন কোন ব্যাপার নেই। কিন্তু সমস্যা তারপরেও রয়ে যায়, আসলেই কী বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির মালিক কেবলই এদেশের বাঙালি জাতিভূক্ত জনগণ ? যদি তা না হয় তাহলে বাঙালি বাদে অপরাপর জাতি সমূহের অস্তিত্ব নেই কেন সংবিধানের কোন একটি পৃষ্ঠার কোন একটি লাইনে, পচাঁনব্বই ভাগ জনগণের মগজে, তাদের উপস্থাপন রীতিতে ? কেবল সংখ্যার বিবেচনাতেই কী আধুনিক এই রাষ্ট্র তার জাতিগত পরিচয় দেওয়ার ক্ষেত্রে কোন একক জাতির একক আধিপত্যকেই বৈধ করে তুলবে, প্রতিষ্ঠিত করে তুলবে ? মিথ্যার বেসাতি দিয়ে আড়াল করে ফেলবে ওঁরাও, সাঁওতাল, মুণ্ডা, রাজোয়ার, লহরা, হাড়ি, দোসাত, পাহাড়িয়া, রবিদাস, চাকমা, মাংতা, রাখাইন, শিং, মাহাতো, মৈতৈ, লালেং, বিষ্ণুপ্রিয়া, রাজবংশী, বর্মণ, খাসিয়া, ত্রিপুরা, ডালু, কোচ, মান্দি, খিয়াং, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, খুমী, চাক, হাজং প্রভৃতি জাতিসমূহের অস্তিত্ব? একক জাতির একক আধিপত্য পাকাপোক্ত করতে আর সব জাতি সমূহকে -উপজাতি- বানিয়ে ফেলতে হবে? ইসলামকে যখন সংসদে আইন পাসের মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হলো তখন কী একবারের তরেও চিন্তুা করা হয়েছিল সাংসারেক, সারণা, ক্রামা, বৌদ্ধসহ একেক জাতির আপন আপন ধর্মের কথা, তাদের আপন আপন বিশ্বাসের কথা? এই রাষ্ট্র বৃহত্তর জাতির (সংখ্যার বিবেচনায়) প্রার্থণালয়ের জাতীয় স্বীকৃতি (জাতীয় মসজিদ-বায়তুল মোকারম) দিলেও অপরাপর জাতি সমূহের সারণা, মিদ্দি আসং, গোয়ারি, জাহের থান, চিগা সমূহকে জাতীয় স্বীকৃতি দূরের কথা এদের অস্তিত্বের খবরই রাখেনি বা রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি। বরং এই রাষ্ট্রের অধিপতি জাতির আরাম-আয়েশ সহ নানান প্রয়োজনে নানান প্রকল্পের ভেতরে রাষ্ট্রের অনুচ্চারিত হদি, মাহালি, ভূইমালি, ওঁরাও, সাঁওতাল, মুণ্ডা, রাজোয়ার, হাড়ি, দোসাত, পাহাড়িয়া, রবিদাস, চাকমা, মাংতা, রাখাইন, শিং, মাহাতো, মৈতৈ, লালেং, খাসিয়া, ত্রিপুরা, ডালু, কোচ, বিষ্ণুপ্রিয়া, মান্দি, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, খুমী, খিয়াং, চাক জাতিসমূহের বসতভিটা-হাবা-জুম-জাহেরথান-সারণা-গোয়ারি-মিদ্দি আসং-চিগা কখনো তলিয়ে যায় উন্নয়নের বিশাল জলরাশিতে, বন্দি হয়ে যায় ইটের দেয়ালে-চিড়িয়াখানায়-কাঁটাতারের বেড়ায়, কখনোবা পুড়ে ছারখার হয়ে যায় উন্নয়নের দাবানলে, দখল হয়ে যায় প্রভাবশালীদের মারদাঙ্গা প্রভাবের কাছে। এই রাষ্টের নগরে-বন্দরে-শহরে-বিদ্যাপীঠের ভাস্কর্য হিসেবে ফুটে উঠে কত সংগ্রামী যোদ্ধাদের মুখ; কেবল ভেসে ওঠে না রাশিমনি হাজং, কল্পনা চাকমা, পীরেন স্নাল, গীদিতা রেমা কিংবা আলফ্রেড সরেনদের তেজস্বী চাহনিগুলো। এই রাষ্ট্র কত ভাবেই না একক জাতির নিরঙ্কুশ দাপটকে বজায় রাখতে সচেষ্ট। গতবছরের (২০০৬) ১২ এপ্রিল খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক হুমায়ুন কবির কতৃক খাগড়াছড়ি ২০০১-২০০৫ শিরোনামের পুস্তিকাতে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাদের খাগড়াছড়িতে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে বলার মতন উদ্ধত্য দেখানোর পরও রাষ্ট্রযন্ত্রের নিশ্চুপতা কী একেবারেই বিচ্ছিন্ন কোন ব্যাপার? রাষ্ট্রের এই নিশ্চুপতায় কেবলই সংশয় জাগে, প্রশ্ন জাগে মনে - রাষ্ট্র তুমি কার? শুধুই বাঙালি জনগণের?

২.সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার ঠিকাদার রাষ্ট্রের উন্নয়ন সন্ত্রাস ও বিপন্ন জাতির মানুষেরা

আমার ঘরের চাবি পরের হাতে
আমি কেমনে খুলিয়ে সে ধন
দেখব চক্ষেতে;
আপন ঘরে বোঝাই সোনা
পরে করে লেনাদেনা...।
ফকির লালন শাহ্‌

তামাম দুনিয়া জুড়ে কেবলই একই ধুয়া-উন্নয়ন (!), উন্নয়ন (!) আর কেবলি উন্নয়ন (!)। উন্নয়নের তাণ্ডব দাবড়ে বেড়াচ্ছে ধনী-গরীব, ছোট-বড় নির্বিশেষে দুনিয়ার সকল দেশের সকল জনপদের, আকাশ-মাটি, পাহাড়-সমতল, বনাঞ্চল, মরুভূমিসহ সকল প্রতিবেশের সকল কিছুকেই; বিশেষ করে ৯০ এর দশকের পর ভারতবর্ষসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশে মার্কিন শাসিত নয়া অর্থনীতি প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকে। মার্কিন শাসিত এই নয়া অর্থনীতি বাজারের উন্মুক্তকরণ, সম্পদের বেসরকারিকরণ ও পণ্য সংস্কৃতির বিশ্বায়ন অপেক্ষাকৃত দূর্বল দেশগুলোর উপর চাপিয়ে নিজের এককাধিপত্ব বজায় রেখেছে মূলত উন্নয়নের মূলো ঝুলিয়েই। এই উন্নয়ন হুজুগে সাড়া দিয়ে বা সাড়া দিতে বাধ্য হয়ে আমাদের মত গরীব দেশগুলো বিশ্বব্যাপী পূঁজি সঞ্চয়ের একমুখীনতাকেই নিশ্চিত করেছে। আর পূঁজির এই একমুখীনতা যে মানুষের অধিকারচ্যুতির মধ্য দিয়েই সম্পন্ন হয় তা আজ আর কারও অজানা নয়। মার্কিন শাসিত এই নয়া অর্থনীতিতে পূঁজির যে একচেটিয়া ব্যবস্থা তার সাথে ঘনিষ্ট লেনাদেনা গড়ে ওঠে কর্পোরেট পূঁজির। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের উন্নত দেশগুলো গরীব ও কম উন্নত দেশ সমূহের অর্থনীতি ও রাজনীতির উপর নিজেদের দাপুটে অবস্থানকে টিকিয়ে রাখতে বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন নতুন কৌশল বাতলানোর দায়িত্ব তুলে দেয় কর্পোরেট সংস্থাসমূহের উপর। সারাবিশ্বের তালিকাভূক্ত বাঘা বাঘা ৫০০ কর্পোরেট সংস্থার মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই রয়েছে ১৮৫টি। আর মার্কিন শাসিত এই কর্পোরেট সংস্থাগুলো নিয়ন্ত্রন করছে বিশ্বের ৭০ শতাংশ বাণিজ্য ও ৮০ শতাংশ বৈদেশিক বিনিয়োগকে। অপরদিকে কর্পোরেট দুনিয়ার রক্ষাকর্তা বা পাহারাদার বা তত্ত্বাবধানের মহান দায়িত্ব পালন করে চলেছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ (IMF) আর বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (WTO) মত শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলো। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের সাথে গাঁটবাঁধা এই কর্পোরেট পূঁজি তার ধুন্দুমার বাণিজ্যিক লুটপাট চালাতে গিয়ে সর্বদাই সামনে রাখছে নানারকম উন্নয়ন মডেলকে। মার্কিন শাসিত কর্পোরেট পূঁজির একচেটিয়া ব্যবস্থাকে আরো হৃষ্টপুষ্ট করতে গিয়ে তাদের উদ্ভাবিত নানান উন্নয়ন মডেল বাস্তবায়ন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ক্ষমতাহীন মানুষের নিকট উন্নয়ন সন্ত্রাস হিসেবেই দেখা দিয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী কর্পোরেট দুনিয়ার কাছে আত্মসমর্পিত রাষ্ট্রগুলোর বুর্জোয়া শাসকেরা বরাবরই উন্নয়ন সন্ত্রাস পরিচালনার জন্য প্রথমেই বেছে নিয়েছে সেসব দেশের বৃহত্তর জাতি বাদে অন্যান্য জাতি অধ্যূষিত এলাকা সমূহকে। ফিলিপাইনের আম্বুলং, ব্রাজিলের ফোর্টএলিজার তাতাজুবা, প্রেইন্‌হা ডো কেন্ডু বারদি, বতসোয়ানা, বুরুন্ডির সিবিতোকি, লাওসের নাকাই, মালয়েশিয়ার পেনান, আর্জেন্টিনার মিসিওনেস, পেরুর ক্যাজামারকা প্রভৃতি অঞ্চলের অধিবাসীদের সামনে বিভিন্ন সময়ে বনায়ন, কয়লা-তেল-গ্যাস উত্তোলন, ইকোপার্ক, রিজার্ভিয়র কত নামে কত বড় বড় উন্নয়ন মডেল নিয়েইতো হাজির হয়েছিল কর্পোরেট বেনিয়ারা। তুপিনিকিন, বায়া গুয়ারনি, ফিলিপিনো, খি, জ, দাইয়াক প্রভৃতি জাতি সমূহের মানুষজন বুঝেছেন উন্নয়ন মানে কয়লা-তেল-পর্যটন-অবকাশ-গ্যাস-কাঠ-পরিবেশ সংরক্ষণ বাণিজ্যে প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছা লুটতরাজ আর নিজেদের বসত-পাহাড়-বন-সৈকত থেকে নিরন্তর উচ্ছেদ-গুলিবর্ষণ-গুম-গণহত্যাসহ নির্যাতন-নিপীড়ন-উৎপীড়নের আরো কত কি কায়দা কানুন ! রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠীর আস্কারায় নাইজেরিয়াতে Shell, Agip, Mobil, Texaco, Chevron প্রভৃতি কোম্পানিগুলোর উন্নয়ন তাণ্ডবইতো কবি নিমো বেসিকে লিখতে রসদ যুগিয়েছিল, “Dried tear bags/ polluted streams/ things are real/ when found in dreams/ we see their Shells/ behind military shields/ evil, horrible, gallows called oilrigs/ drilling our souls./ We thought it was oil/ but it was blood.” আর এই ধরনের উন্নয়ন তাণ্ডবের বহুমাত্রিক উপস্থিতিতে আজ আমাদের বাংলাদেশেও বিপন্ন, বিপর্যস্ত অবস্থায় সংবিধানে অনুল্লেখিত বাঙালি ভিন্ন ৪৫টিরও অধিক জাতি।

পাকিস্তান আমলে এতদাঞ্চলের বাঙালি জনগণের ঘরে ঘরে বিদ্যূতের আলো বিলিয়ে দেওয়ার উন্নয়ন যজ্ঞে ১৯৫৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি ও ইউতে ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি ইউএসএইড-র আর্থিক যোগানে পাঁচবছর ধরে কর্ণফুলি নদীতে বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করে। তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে সাম্রাজ্যবাদী কোম্পানি সমূহের এই বিজলি সন্ত্রাস রাঙামাটি জেলার চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা প্রভৃতি জাতির লোকজনকে চরম অন্ধকারে ঠেলে দেয়। রাষ্ট্রের উন্নয়ন জোয়ারে ভেসে সেসময় প্রায় একলাখ মানুষ বসত, কৃষিজমি (প্রায় ৫৪ হাজার একর) হারিয়ে উদ্বাস্তু হিসেবে দেশত্যাগে বাধ্য হন।

বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ সাম্রাজ্যবাদী সংস্থাসমূহ পরিবেশীয় সম্পদ লুটপাট ও বিনাশের এক নতুন তরিকা নিয়ে হাজির হয়েছে। এই নতুন তরিকার নাম হচ্ছে, ইকোট্যুরিজম। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার সূত্রে জানা যায়, ২০০২ সালে ইকোট্যুরিজম নাকি অস্ত্র ও আইটি সেক্টরের পরে বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ ইন্ডাস্ট্রি হিসেব বিশ্ব অর্থনীতিতে জায়গা করে নিয়েছে। আর বলাই বাহুল্য এই ইন্ডাস্ট্রিগুলোর বেশির ভাগই গড়ে তোলা হয়েছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে। এক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার উদ্দেশ্যও বেশ পরিষ্কার, পেটেন্ট বা ছিনতাইকর্মের মাধ্যমে দুনিয়ার তাবৎ প্রাণসম্পদের উপর নিজেদের নিরঙ্কুশ মালিকানা প্রতিষ্ঠার পথকে আরো সহজতর করে তোলা। আর সভ্য (!) দুনিয়ার এইসব সভ্য (!) চোরদের গায়ে তেলমাখানো, পথ বাতলানো বা অন্যান্য সব রকম সহযোগিতার জন্যতো আত্মসমর্পিত রাষ্ট্রের শোষক শ্রেণী, কর্পোরেট পূঁজির জরায়ুজাত এনজিও সমূহের হরকসম গবেষণা-প্রকল্প রয়েছেই। আমাদের দেশে এই ইকোট্যুরিজম হুজুগ আসে বিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষ দিকে। বাংলাদেশ সরকার ফরেস্ট কনজারভেশন ও ইকোট্যুরিজম স্কীমের আওতায় ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে দেশের প্রথম ইকোপার্ক এলাকা হিসেবে সীতাকুণ্ডকে বেছে নিলেও এরপর একে একে হাত বাড়াতে থাকে খাসিয়া ও মান্দি অধ্যুষিত মৌলভীবাজারের মাধবকুণ্ড-মুরইছড়ার (১৪৮৭ একর), মান্দি অধ্যুষিত টাঙ্গাইল শালবন (৩০০০ একর), ম্রো প্রধান চিম্বুকের (৫০৫০ একর) এলাকাতে। স্থানীয় আদিবাসীদের সাথে কোনরকম পরামর্শ ব্যতিরেকেই সরকার এইসব প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্যোগী হলে প্রায় সব এলাকা থেকে সঙ্গত কারণে প্রতিরোধের আওয়াজ ওঠে। মৌলভীবাজারে ইকোপার্ক বাস্তবায়নের কাজ বন্ধ হওয়ার পর সরকার হাত বাড়ায় মধুপুরের শালবনকে ধ্বংস করার খেলায়। অবশ্য আদিবাসী বসবাসকারী বনাঞ্চলগুলো নিয়ে রাষ্ট্রের নানান হঠকারী সিদ্বান্ত এটাই প্রথম নয়। আমরা মধুপুর বনেই দেখেছি বিশ্বব্যাংক আর এডিবির টাকায় উন্নয়নের কথা বলে কখনো রাবারের মনোকালচারের নামে, কখনো সোস্যাল ফরেষ্ট্রি ও উডলটের মাধ্যমে কিভাবে শালের কপিছ মাটি খুঁড়ে তুলে ফেলার সাথে সেখানকার মান্দি-কোচ-বর্মণদেরও শেকড়চ্যুত করা হয়েছিল। যে রাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদী সংস্থার উদ্ভাবিত উন্নয়নের দোহাই দিয়ে রাবার বাগান, উডলটের মত বন বিধ্বংসী প্রকল্প আর বনবিভাগের অবাধ লুটপাটের ভেতর দিয়ে ধ্বংসের শেষ কিনারায় নিয়ে এসেছে তারাই যখন আবার বনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণসহ বন উন্নয়নের কথা বলেন সেটা তখন বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। বনের যে আদি বাসিন্দারা বনের প্রাণবৈচিত্রকে রক্ষার জন্য বিভিন্ন পূজা, আমুয়া পালন করেন; বনের বিভিন্ন জায়গায় যেখানে তাদের মিদ্দি আসং (দেবতাদের জায়গা) সেই বন তাদের কাছে কোন বাণিজ্যের বিষয় নয়, বরং তা নিজেদের জীবনধারণ ও বিশ্বাসের গভীর সংযোগ। দীর্ঘদিনের এই বনকেন্দ্রিক জীবনধারন পদ্ধতি আর বিশ্বাসের বিকল্প উপায় কখনো ৭ফুট উচ্চতার ৬১ হাজার ফুট ইটের দেয়াল এবং ভেতরে ১০টি পিকনিক স্পট, ২টি ওয়াচিং টাওয়ার, ২টি কালভার্ট, ৩টি কটেজ, জলাধার সহ লেক ৯টি, রেষ্ট হাউজ ৬টি, রাস্তা নির্মাণ ৬টি, বন কর্মীদের ৬টি ব্যারাক নির্মাণ হতে পারে না। বলাফাল, আসংদেনা আমুয়ার বিকল্প হতে পারে না পিকনিক পার্টির আনন্দ ভ্রমন। আর আদিবাসী এলাকাগুলোতে দেয়াল, কাটা তারের বেড়া, সংরক্ষিত এলাকার আসল মাহাত্ম কি তার জন্য দামিনিকোহ, দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলের নজিরতো রয়েছেই। ২০০৪ সালের ৩ জানুয়ারি নিজেদের হাবিমাতে নিজেদের অস্তিত্ব, হাবিমার প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার জন্য পীরেন স্নালের আত্মদান, উৎপলসহ অন্যান্যদের ত্যাগ আর সংগ্রামে তখনকার মত দেয়াল নির্মাণের কাজ বন্ধ করা হলেও সেই প্রকল্প বাতিল করা হয়নি। বিগত রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতা ছাড়ার পর বনবিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসন আবারো সক্রিয় হয়ে উঠে প্রকল্প বাস্তবায়নে। জরুরী অবস্থার ভেতরে গত ১৯ জানুয়ারি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যস্ত টহলের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের দেয়াল নির্মাণ মার্কা উন্নয়নে আবারো বসত-কৃষিজমি সহ বনে অবাধ বিচরণের অধিকার হারানোর আতঙ্কে সন্ত্রস্ত অবস্থায় রয়েছেন হাবিমার সন্তানেরা। যে উন্নয়ন রাবার বাগান, উডলট, ফায়ারিং রেঞ্জ, পিকনিক স্পট, লেক, ওয়াচিং টাওয়ার, চিড়িয়াখানার নামে বারে বারে মায়ের কোল থেকে সন্তানকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, যে উন্নয়ন সন্তানের সামনে মাকে ধর্ষণ করে সে আবার কেমন উন্নয়ন ? শালবনের মান্দি-কোচ-বর্মণদের, শেরপুরের মান্দি-হাজং কিংবা চিম্বুকের ম্রোদের এমন সহজ প্রশ্নের উত্তর কি জানা আছে এই রাষ্ট্র্রের ?

দিনাজপুরের ফুলবাড়ি, পার্বতীপুর, নবাবগঞ্জ এলাকার ৬৭টি গ্রামের সাঁওতাল সহ অন্যান্য আদিবাসী জাতি সমূহের প্রায় একলাখ মানুষ আজ চরম অনিশ্চিয়তায়। ফুলবাড়িতে যুক্তরাজ্যের এশিয়া এনার্জি কোম্পানি ৯ হাজার ২৫০ কোটি টাকা নিয়ে এসেছে নতুন ফন্দি নিয়ে। যে মায়ের বুকে আদিবাসী সন্তানেরা হেসে-খেলে, নেচে-গেয়ে, শঙ্কায়-সংগ্রামে বসত-কৃষি-জাহেরথানে কর্ম, বিশ্বাস আর বর্ণাঢ্য আচারে জীবনের গতিময়তাকে জিঁইয়ে রেখেছেন সেই মায়ের বুকে ডিনামাইট ফাটিয়ে হৃৎপিণ্ডের ভেতর থেকে কালো মানিক বের করে আনতে চায় এশিয়া এনার্জি। বিশ্বের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে এই সব কালো মানিকের নাকি ব্যাপক চাহিদা, অনেক মুনাফা(!)। যে মায়ের বুক উজাড়করা ভালবাসায় বেড়ে উঠেছেন আদিবাসী সন্তানেরা তারা কিভাবে এটা মেনে নেবেন? তথাকথিত সভ্য (!) জগতের মানুষদের এ কোন ধরনের সভ্যতা? কোটি টাকার গাড়ি, কাড়ি কাড়ি অর্থের বিনিময়ে শাসকেরা কোন মাকে যখন উন্নয়নের দোহাই দিয়ে অন্যের হাতে তুলে দেয় তখন এর চেয়ে বড় সন্ত্রাস দুনিয়ায় আর কি হতে পারে ? এর চেয়ে বড় অসভ্যতাই বা আর কি আছে ?

মাগুড়ছড়া বনে যে খাসিয়ারা তাদের মাকে সর্বদা পলাশ-শিমুল-গর্জন-জারুল-হিজল-কদম-মেহগনিসহ নানা লতাপাতায়-ফুলে-ফলে সাজিয়ে শালিক-টিয়া-ময়নার-কোকিল-দোয়েলের গান শুনিয়ে খুশি রাখত, বিদেশি অক্সিডেন্টাল কোম্পানি (বর্তমানে শেভরন কোম্পানি এ ব্লকের দায়িত্বপ্রাপ্ত) ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন সেই মায়ের সকল রূপ-সৌন্দর্যকে ঝলসে দিয়েছে উন্নয়নের দাবানলে। উনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের প্রথম ভাগে সিলেটের লালেংদের জননীভূমিকে বেআব্রু করেই একে একে খাদিমনগর, কেয়াছড়া, কালাগুল, পুুঁটিছড়া ইউরোপীয়দের চা বাগান গড়ে উঠেছিল। রাষ্ট্রের কথা বাদই থাক, তামাম দুনিয়ার কি এমন ক্ষমতা আছে মায়ের এমন বেআব্রু, সৌন্দর্য্যহানি, শরীর ঝলসে দেয়ার ক্ষতিপূরণ দেবার?

পুরো পরিবার জুংলি-ঝান্টা-ওছা-বীণ-শিঙ্গা-দাড়াইস-কালিপানো-সুতানালি-দুধরাজ-জাইত-গোখরা-আলাজ-বীণরাজ-পাতরাজ-টুনটুনি-কালিনাগ-অজগর নিয়ে বসবাস করবার মতন ছোট্ট একটা নৌকা হলেই যথেষ্ট। ঢেউয়ের তালে ছইয়া নৌকায় ভেসে ভেসে শেলুং-বাইলা-পুঁটি-টেংরা-বোয়াল-শুশুকের সাথে খুনসুটি করতে করতে পাড়ি দেন ধলেশ্বরী-বুড়িগঙ্গা-তুরাগ-বংশাই-শীতলক্ষ্যা-মেঘনা-পদ্মা-আত্রাই-যমুনা-সুরমাসহ কত নদী-নালা-খাল-বিল! অর্থসম্পদ না থাকলেও বিচরণের স্বাধীনতাকে উপভোগ করেন নিজেদের মত করে। কিন্তু এই রাষ্ট্র যেখানে সবাইকেই উন্নয়নের বেড়াজালে বন্দি রাখতে চায় সেখানে মাংতাদের স্বাধীন থাকার এই দুঃসাহস কি মেনে নেয়া যায়? রাষ্ট্র জানাল, জনগণের জন্য আধুনিক ও উন্নত সমাজ গঠন করতে হবে। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে কথা! কিন্তু এই আধুনিক আর উন্নত সমাজের মাপকাঠিটা কি? রাষ্ট্র তখন বৃটিশ সংস্থা Department For International Development (DFID) এর কথাটাই হুবহু আওড়ে গেল- নগরায়ন, হ্যাঁ, একমাত্র নগরায়নই হলো আধুনিক ও উন্নত সমাজের মাপকাঠি। ব্যস, এই ঘোষণার মধ্য দিয়েই শুরু হয়ে গেল দেশি-বিদেশি ফাটকা পূঁজির নগরায়ন বাণিজ্য। বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা-কীর্তণখোলা-ধলেশ্বরী-মেঘনা দখল করে রিভার ভিউ, খাল ভিউ কত প্রকল্প জমজমাট হয়ে গেল দুদিনেই। আর ইয়াংসা বাজার-হাঙ্গার ডেইল-ডেইল পাড়া-রাজারছড়া-বাহারছড়া-ইনানী বিচ-জাফলং এর ঝিরি-ছড়া-ঝরনায় বিস্ফোরেকের আঘাতে প্রকৃতি মায়ের বুক ক্ষত-বিক্ষত করে কোয়ারি বানিয়ে সেখান থেকে ট্রাকে ট্রাকে পাথর আসতে লাগল নগরায়নের মজবুত ভিত্তি গড়তে। নদীখেকো, খালখেকো, বিলখেকো, লেকখেকো, হাওরখেকো কত প্রতিষ্ঠান, কত প্রকল্প, কত ব্যক্তি নগরায়নের মোড়ে মোড়ে ফুলেফেঁপে উঠলো! আধুনিক হয়ে উঠলো! সভ্য বনে গেল! ভেতরের পঁচা-গলা কত রক্ত-পূঁজ আড়াল করে ফেলল নগরের কংক্রীটের দেয়ালে! কিন্তু বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা-কীর্তণখোলা-কর্ণফুলী-মেঘনা-তুরাগ, সিলেট-বান্দরবান-উখিয়া-টেকনাফের ঝিরি-ছড়া-ঝরনা-ডাইং-বাইলা-পুঁটি-টেংরা-বোয়াল-শুশুকের সাথে মাংতা-ম্রো-মারমা-ত্রিপুরা-চাকমা-বোম-লুসাই-খাসিয়াদের সম্মিলিত আর্তনাদকে কি ঢেকে রাখতে পেরেছে ? আধুনিক ও উন্নত নগরের ব্যস্ত কোলাহলের মধ্যে সেই সম্মিলিত আর্তনাদতো অবিরত বলেই চলেছে- আমরা উন্নত হতে চাই না, আমরা আগে বাঁচতে চাই, আমরা বাঁচতে চাই...।

৩.বহুমাত্রিক মনস্তাত্ত্বিক আগ্রাসন কব্জা করে ফেলতে চায় মানুষের সবকিছু

“কুঞ্জের ঘারকার
বুড়হা বুড়হি
আজো বন্দী
বাপ দাদা চৌদ্দ পুরুষ
মানকা আওধি।”

[(ভাবার্থ ঃ এই গৃহের আদি দেবতা/বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা যাকে বন্দনা করেছে/আমরাও তাদের বন্দনা করছি;/পূর্বপুরুষেরা যাকে মেনে এসেছে/আমরাও তাকে মেনে এসেছি) ওরাওঁদের সোহরাই পূজায় গৃহদেবতাদের উদ্দেশ্যে পাঠ করা মন্ত্রের অংশ বিশেষ]

আমাদের এই ভূখণ্ডের আদিবাসী জাতিসমূহ তাদের আপন আপন সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদকে আগলে রেখেছেন যুগ যুগ ধরে। বংশপরম্পরায় চর্চার ভেতর দিয়ে এইসব সংস্কৃতি একেকটি জাতির আপন আপন মনস্তত্ত্ব গড়ে তুলেছে, ঋদ্ধ করেছে স্বতন্ত্র‌্যভাবেই সেই উপনিবেশিক আমল থেকেই মানবতাবাদী এইসব মনস্তত্ত্বকে গিলে ফেলতে সচেষ্ট ছিল শাসক গোষ্ঠীর দখলদারি মনস্তত্ত্ব। শাসকগোষ্টী বেশ ভালো করেই জানেন কোন জাতির আপন মনস্তাত্ত্বিক জগতকে বশে না আনতে পারলে শোষণ প্রক্রিয়ায় গতি সঞ্চার করা যাবে না। অতএব যত তাড়াতাড়ি পারো অধস্তন জাতিসমূহের আপন আপন মনস্তত্ত্বকে সম্ভাব্য সকল উপায়ে নিজের আয়ত্বে রাখার চেষ্টা করো। উপনিবেশিক আমলে শাসকগোষ্ঠী সম্ভাব্য সকল উপায়েই এইসব জাতি সমূহের আপন মনস্তত্ত্বকে দখলে সচেষ্ট ছিল; যার মধ্যে অন্যতম এক প্রক্রিয়া ছিল জাতি সমূহের নিজ নিজ বিশ্বাসের হরণ। ভিনদেশী শাসকেরা শোষণের হাতিয়ার হিসেবেই তাদের আপন বিশ্বাসকে এতদাঞ্চলের প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথমেই বেছে নিয়েছিল আদিবাসী অধূষ্যিত অঞ্চলগুলোকে। শিক্ষা, চিকিৎসাসহ কত সেবামূলক কর্মকাণ্ডের আড়ালে দখল করে নিয়েছে মান্দি, খাসিয়া, লুসাই, সাঁওতাল, ওঁরাওদের আপন আপন বিশ্বাসের জায়গাটিকে- যে বিশ্বাস গড়ে উঠেছিল হাজার হাজার বছরের জীবনাচারের মধ্য দিয়ে। গলাটিপে হত্যা করেছে বিভিন্ন বিশ্বাস কেন্দ্রিক নিজস্ব সংস্কৃতির স্বতস্ফূর্ত প্রবাহকে। কি এমন অপরাধ ছিল এই সব সহজ-স্বাভাবিক মনস্তত্ত্বের অধিকারী জাতিসমূহের মানুষের, সেবার নামে কেন তাদের বিশ্বাসকে লুণ্ঠন করে নিতে হবে? সাংসারেক, সারণা, লালেং, ক্রামা, বিষ্ণুপ্রিয়া ধর্মাবলম্বীরাতো কখনো আপন বিশ্বাসকে অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়ার জন্য কারো দ্বারে দ্বারে যান নি। বিশ্বাসতো কখনো চাপিয়ে দেওয়ার জিনিস হতে পারে না, এতো ধারণ করার ব্যাপার- এমন সহজ চিন্তার অধিকারী যারা, তাদের গয়রা-পত্যেন-কালকামি-উ ব্লাই নাংথউ-উ ব্লাই মংতু-সিংবোঙ্গা-গড়াই ঠাকুর-সালজং-সারণা দেবীদের কেন নির্বাসনে পাঠাতে হবে? জনিক নকরেক, রজনী কান্ত সাংমা, টুকিয়া রেমা, দীনেশ নকরেক, জগদীশ চন্দ্র সিং, সমের মাহাতোদের এমন প্রশ্নের জবাব দিবে কে?

উপনিবেশিক বৃটিশ ও পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর মনস্তাত্ত্বিক আগ্রাসন নীতি অপরিবর্তিত থেকে যায় বাঙালি জাতির নেতৃত্বে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পরও। ১৯৭২ সালেই সবাইকে বাঙালি হয়ে যাওয়ার জন্য শাসকগোষ্ঠীর আহ্বান সত্যিই অবাক করেছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম সহ দেশের অন্যান্য জাতির মানুষদের। সংবিধানে আদিবাসী জাতিসমূহের অনুপস্থিতি, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় আদিবাসী অঞ্চলগুলোতে তাদের সংখ্যালগু করে দেয়া, ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সাংবিধানিক ঘোষণা, নানান আগ্রাসী উন্নয়ন প্রকল্প, সেনাশাসন, শিক্ষা ক্ষেত্রে আদিবাসী শিশুদের নিজ নিজ মায়ের ভাষার পরিবর্তে বাংলায় পাঠ গ্রহণে বাধ্য করা, পাঠ্যপুস্তক-বাংলাপিডিয়া সহ বিভিন্ন জায়গায় আদিবাসীদের হীনভাবে উপস্থাপন, প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহের উগ্র-মৌলবাদী শক্তির সাথে ক্ষমতার ভাগাভাগি বা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য চুক্তি এসবই আদিবাসী জাতিসমূহের সহজ-স্বাভাবিক মনস্তত্ত্বের জন্য হুমকি হিসেবেই দেখা দিয়েছে। এছাড়া শাসকগোষ্ঠী বরাবরই চেষ্টা চালিয়েছে অধিপতি জাতির সাধারণ মনস্তত্ত্বকে নিপীড়িত জাতির মনস্তত্ত্বের বিরোধী পাটাতনে দাঁড় করাতে। এক্ষেত্রে শাসক গোষ্টী বেশ সফলই বলা চলে। হাতেগোনা কিছু ছাড়া প্রায় সব বাঙালিই চাকমা-মারমা-খাসিয়া-মৈতৈ-পাত্র-মান্দি নির্বিশেষে সবাইকেই বাঙালি জাতির অধীন উপজাতি(!), বহিরাগত (অন্যদেশ থেকে আগত অর্থে) হিসেবে ভাবতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এছাড়া পার্বত চট্টগ্রামে সেনাশাসনসহ অন্যান্য বিষয়, ইকোপার্ক ইস্যুতেও শাসকগোষ্ঠীর মনস্তত্ত্বের সাথে উচ্চ শিক্ষিত-নিরক্ষর খেটে খাওয়া বাঙালি মানুষজনের মনস্তত্ত্বের তেমন কোন ফারাক খুঁজে পাওয়া যায় না।

পণ্য সংস্কৃতির বিশ্বায়নের মধ্য দিয়ে কর্পোরেট দুনিয়া তার মুনাফা তুলে নিচ্ছে পৃথিবীর আনাচ-কানাচ থেকে। কর্পোরেট সংস্কৃতি বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন জাতির মানুষ কিভাবে নিল-না নিল সেটা তাদের কাছে কোন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় না। তাদের চেষ্টাই থাকে যে করেই গেলাতে বাধ্য করানোর। একাজে তাদের কত সৈন্যসামন্ত, স্যাটেলাইট চ্যানেল, পত্র-পত্রিকা। তাদের চাতুর্যপূর্ণ কলাকৌশলের কাছে কত ভাবেই না বোকা বনে যাচ্ছি আমরা নানান জাতির নানান মানুষেরা। একদিকে যেমন কর্পোরেট পূঁজির টাকায় উন্নয়ন সন্ত্রাসের তাণ্ডবলীলা, তার পাশাপাশিই রয়েছে এইসব নিপীড়িত জাতিসমূহের জেগে উঠবার প্রবণতাকে দমিয়ে রাখতে কত মেকি মানবিক উদ্যোগ আর কর্মতৎপরতা। কর্পোরেট দুনিয়া বা তার গর্ভজাত এনজিওরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ন্যায় বাংলদেশেও আদিবাসী ভাষা-সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার (!) কত রকমের উদ্যোগ নিচ্ছে; তাদের অনুদানে আদিবাসীদের নিয়ে কত সভা-সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটক, আদিবাসী উৎসব-মেলা হচ্ছে গ্রামে-শহরে-বন্দরে। কত বিশিষ্টজনের দরদ উপচে পড়ছে (!), চোখ চকচক করছে ফায়দা লুটার ধান্দায়। আদিবাসীদের অংশগ্রহণমূলক বা নেতৃত্বাধীন কত উন্নয়ন-গবেষণা প্রকল্পে, দেশি-বিদেশি সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের নানান বেড়াজালে বন্দি করে কর্পোরেট দুনিয়া তার মনস্তাত্ত্বিক দখলদারিত্বকে পাকাপোক্ত করে নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে! কিন্তু সিঁধু-কানু-চাঁদ-ভৈরব-বীরসা-গঙ্গানারায়ণ সিং-পঞ্চানন শর্মা-লীলাবতী শর্মা-রাশিমনি হাজংদের উত্তসূরীদের লড়াকু মনস্তত্ত্বকে কি এত সহজেই করায়ত্ত্ব করা সম্ভব? লড়াকু মনস্তত্ত্বের লড়াকু সৈনিকদের যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবেই কল্পনা চাকমা-পীরেন স্নাল-গিদিতা রেমা-সেন্টু নকরেক-আলফ্রেড সরেনরা কী আবারো প্রমান করে যাননি- নিপীড়িত জাতির দ্রোহী মনস্তত্ত্ব আপসকামীতাকে কখনো প্রশ্রয় দেয় না, দ্রোহে-প্রতিরোধে তা জেগে উঠবেই উঠবে।

৪.তবু আকাঙ্খা আছে বেঁচে থাকবার-দ্রোহী পাটাতনের শামিল হবার

“নুসৌসাবোনে, নওয়ারাবোন চেলে হুঁ
বাকো তেঙে গান,
খাঁটি গেবোন হুল গেয়া হো,
দিশম দিশম দেশ মৌঞজহি পারগানা
নাতো নাতো মাপঞিজি কো
দুঃক্‌ বোন দানাংবোন কংগেকো তোঙ্গোন
তবে ছো বোন হুল গেয়া হো।”

[একটি সাঁওতালী গান; ভাবানুবাদঃ আমরা নিজেরাই বাঁচব/ কেউ আমাদের পাশে দাঁড়াবে না/ তবু আমরা বিদ্রোহ করব/ গ্রামের মাঝি মোড়লরা সাহায্য করবে/ কেউ পাশে দাঁড়াবে না।]

সাংসারেক ধর্মীয় বিশ্বাস মতে, মান্দি মিদ্দিদের (দেবতাদের) মধ্যে শৌর্য-বীর্যে প্রধান ছিলেন মিদ্দি গুয়েরা। মিদ্দি গুয়েরা মানুষের বেশে যখন মায়ের গর্ভ থেকে পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হন তখন থেকেই বিপদে আপদে তিনি মানুষকে রক্ষা করে চলেছেন। মায়ের গর্ভে থাকা কালীন সময়েই মিদ্দি গুয়েরা- রাক্কা গুয়ের/আগল সাকবো/আওয়া ওয়াঙা ওয়াঙ্গা/মাচ্ছাদো মাচ্ছা বেকফ্রেং/নুরুমান্দি দিমারিশিখো/মিন্নো আঙ্গা খিন্নো আঙ্গানা/হিঙ্খো আঙ্গা স্খু-সতনা ওয়াগংসিঙ্গত্‌ন/সংনাগ্রেংরিপনাঙ্গারিবাজক/রাক্কা গুয়েরা... । এরকম গাথেম্মাসহ গ্রীকা করে করে দুনিয়ার সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করবার চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। পুরো ৩২ টি দাঁত আর দাঁড়ি-গোঁফ নিয়ে মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেয়া গুয়েরা মানুষকে শিখিয়ে গেছেন কিভাবে দুনিয়ার শক্তিশালী শয়তানদের বিরুদ্ধে সাহস নিয়ে দাঁড়াতে হয়। একাই তখনকার দিনে যত শকষ-শয়তান ছিল যারা মানুষের উপর চরম অত্যাচার করত তাদেরকে দমন করে গুয়েরা তার পরিবারসহ চলে গিয়েছিলেন আসং ফাতেং-চিগা সিম্মল দেং দেং নামক স্বর্গে সেখানে গিয়েও তিনি দুনিয়ার মানুষকে ভুলে যান নি, বিপদে পড়লে তাঁকে স্মরণ করার পথ বাতলে দিয়েছেন, বলে দিয়েছেন শেষ শক্তি দিয়ে লড়াই করে যাওয়ার। বিপদে-আপদে সাংসারেকরা আজও মানসার আয়োজনে গুয়েরার কাছে আশীর্বাদ চান, লড়াই করার শক্তি চান। মিদ্দি গুয়েরাও কখনো নিরাশ করেন না মান্দি (আচিক ভাষায়-মান্দি- বলতে বুঝায় -মানুষ)দের। হ্যাঁ, মিদ্দি গুয়েরার আশীর্বাদেই দুনিয়ার সকল জাতির সকল মানুষেরা সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে নিজেদের লড়াই আজও জারি রেখেছেন। ইতিহাসে মাদল, ধামসা, আদুরি, মইবঙ, নাগড়ার তালে গ্রীকা (আচিক শব্দ -গ্রীকার- বাংলা -যুদ্ধনৃত্য বুঝা যেতে পারে) হয়েছে বারেবারে। মান্দি বিদ্রোহ(১৭৭৫-১৮৮২),পাহাড়িয়া বিদ্রোহ (১৭৮৯-৯১), চোঁয়াড় বিদ্রোহ (১৭৯৮-৯৯), ভীম বিদ্রোহ (১৮১৮), খাসিয়া বিদ্রোহ (১৮২৯-৩৩), কোল বিদ্রোহ (১৮৩১-৩২), নাগা বিদ্রোহ (১৮৩৯), শবর বিদ্রোহ (১৮৫৩), সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৬), মুণ্ডা বিদ্রোহ(১৮৯৯-১৯০১) চাকমা বিদ্রোহ, রিয়াং বিদ্রোহ (১৯৪২-৪৩), তেভাগা আন্দোলন (১৯৪৬-৪৭), হাজং বিদ্রোহের (১৯৪৫-৪৬) ছপাতি নকমা-সিঁধু মাঝি-কানু মাঝি-বীরসা মুণ্ডা-গঙ্গানারায়ণ সিং-জুম্মা খাঁন-তীর্থ সিং-বুরামানিক-মুকুন্দ সিং-শিবরাম মাঝি-হপন হার্ডি-গহনুয়া মাহাতো-মাকটু সিং-ফাগুয়া কোলকামার-তৎনারায়ণ বর্মণ-সর্বেশ্বর ডালু-বুধু খেড়িয়া-রামু মুণ্ডা-লছমন সিং-করমী ওঁরাও-বুধনী ওঁরাও- স্বর্ণময়ী ওঁরাও-রাশিমণি হাজংদের উত্তরসূরী হিসেবেই মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, কল্পনা চাকমা, গিদিতা রেমা, অবিনাশ মুড়া, অধীর দফো, আলফ্রেড সরেন, সেন্টু নকরেক, পীরেন স্নালরা সংগ্রামের বহমানতাকে চালু রেখে গেছেন পার্বত্য চট্ট্রগ্রামে, মধুপুরে, উত্তরবঙ্গে, খাসিয়া পুঞ্জিগুলোতে। আপন আপন সংস্কৃতির লড়াকু মনস্তত্ত্বই তাঁদেরকে বারেবারে নিয়ে এসেছে-অস্তিত্ত্ব রক্ষার অবিনাশী সংগ্রামে। রাষ্ট্র যতই এইসব জাতিসমূহকে আড়াল করে রাখুক না কেন তাদের কুরুখ,আচিক, ঠার, লালেং, নাগরী, ওঁরাও, খিয়াং, সান্তালী, সিং, ককবরক, মারমা, মৈতৈ, চাকমা, খুমী, ম্রো প্রভৃতি ভাষার প্রতিটি শব্দ, বাক্য একেকটি সংগ্রামী হাতিয়ার। আজও দকমান্দা, দকশাড়ি, পিনন, রিনাই, থামি, রিসা, কা জিমপিন, জৈনসেমের প্রতিটি বুননেই মান্দি-চাকমা-মারমা-ত্রিপুরা-মৈতৈ-খাসিয়া নারীরা গেঁথে চলেছেন আপন আপন সংস্কৃতির প্রতিরোধী বাঁধ। রাষ্ট্রীয় আস্কারায় কর্পোরেট পূঁজি দেশের আনাচে-কানাচে, রাজধানীতে আদিবাসীদের নিয়ে যতই নাটক, নাচ, গান মঞ্চায়ন করে নিজেদের জাহির করে বেড়াক না কেন, তিরেশ নকরেক-মাখন লাল বর্মণ-ভগবান সিং-লক্ষীন্দর সিং-বেহুলা সিং-জগদীশ সিং-খামাল কুনেন্দ্র Pv¤^yMs-Elv রাণী মাহাতোদের শেরেনজিং-আজিয়া-রেরে-হাস্তর-দিগ্গ্যিবান্দি-গেংখুলি-রাসলীলা-ঝুমুরের সংগ্রামী উপস্থাপন আকাঙ্খাকে কখনই দমিয়ে রাখতে পারেনি, পারবেও না। কেননা তিরেশ-মাখন-ভগবান-লক্ষীন্দর-বেহুলা-কুনেন্দ্র-ঊষা রানীরা কোন বাণিজ্যের আশায়, পদকের আশায় নিজেদের জাহির করেন না। এ তাদের অস্তিত্বের লড়াকু জানান। গুনীন-ওঝা-দেবর্ষি-পাহান-সেম্মা খামাল-মিদ্দি খামাল-নায়েকে-লাংদুহ-কার্বারি-নকমা-আতু মাঝি-দিশম মাঝি-পারগানা-পরধান-মাথা-মন্ত্রী-রাজা এখনো অকার্যকর হয়ে যায়নি। পরাক্রমশালী বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েইতো আপন বিশ্বাসের দ্রোহী অবগাহন নিরন্তর জারি রেখে চলেছেন রজনী কান্ত সাংমা, সতীশ চন্দ্র মাহাতো, জনিক নকরেক, অনিতা মৃ, মানিক চন্দ্র সিং, নরেন্দ্র মারাক, রাগেন নকমারা। এই বিশ্বাসী লড়াইয়ের কোন বিনাশ হতে পারে না। আপন বিশ্বাস আর সংগ্রামের যুথবদ্ধতার মধ্য দিয়েই এই ভূখণ্ডের বিপন্ন জাতির বিপন্ন মানুষেরা আপনার অস্তিত্বের জানান দিয়ে যাবেন নিরন্তর-এমন লড়াকু বিশ্বাসকে এই রাষ্ট্র, সাম্রাজ্যবাদী কর্পোরেট দুনিয়ার কোন কলাকৌশলই রুখতে পারে না। সিঁদু-কানু-বীরসা-রাশিমনি-আলফ্রেড-পীরেন-কল্পনা-গিদিতা-সেন্টু-অবিনাশদের উত্তরসূরীরা নিজেদের অস্তিত্বের জন্যই বারেবারে জেগে উঠবেন ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে, আঘাতে আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেবেন রাষ্ট্র-বিশ্ব-বহুজাতিক কোম্পানিসহ সকল আগ্রাসী-নিপীড়ক-দখলদারি মনস্তত্ত্বকে, আপন ভূমি-সংস্কৃতি-বিশ্বাসের আপন অধিকার ও চর্চার মধ্য দিয়েই প্রতিনিয়ত তাদের নিজস্ব অস্তিত্ত্বের লড়াকু জানান দিয়ে যাবেন ।


( লেখাটি রাঙামাটির জুম ঈসেথটিকস কাউন্সিল-জাক এর বৈসুক-সাংগ্রাই-বিঝু সংকলন ২০০৭ লামপুক (রনেল চাকমা সম্পাদিত) এ প্রকাশিত)

No comments: