জুয়েল বিন জহির
১.
“ফয় সা, ফয় গিনি, ফয় গিত্তাম
ফয় বংআ, ফয় দক, ফয় সিন্নি
ফয় চেত,ফয় স্কু,ফয় চিথিং
ফয় স্রাং। আঃ...
বাগিপ্পাখো হনগিপ্পাখো ফাথি গিপ্পাখো অং
আৎগিপ্পাখো বাআংগিপ্পাখো জাল্লেৎগিপ্পাখো
থম্মিদন গিপ্পানা রাক্ষিগিপ্পানা সালাম দাক্কেংজক
গালাম অন্নেংজক।*
চিংআদে নরমান্দেদে দেমাঋষিদে ইয়
সকগিপ্পা ইয় নাগিপ্পা উমুক আসংনি উমুক
চিগানি গিমিক রাংজক ওয়াকিয়াংজক...”
ভাবানুবাদঃ
প্রথম বন্দনা, দ্বিতীয় বন্দনা, তৃতীয় বন্দনা
চতুর্থ বন্দনা,পঞ্চম বন্দনা, ষষ্ঠ বন্দনা
গপ্তম বন্দনা, অষ্টম বন্দনা নবম বন্দনা
দশম বন্দনা করি।
পুণঃ বন্দনা করি। আঃ...
জন্মদাতা,দানকারী, পরিবেশ সৃষ্টিকারী,সম্প্রসারণকারী,ফল দানকারী, ফসল বৃদ্ধিকারী
সম্মানদানকারী, প্রাণরক্ষাকারী এবং ধনজন রক্ষাকারী দেব-দেবীদের উদ্দেশ্যে সালাম জানাই, প্রণাম জানাই। আমরা নরমানব, যুবঋষি উমুক গ্রামের বাসিন্দা, উমুক নদীর তীরবর্তী স্থানে বসবাসকারী আমরা তোমাদের স্তব করি, পূজা করি।
[সাংসারেক মান্দিদের রুগালার মন্ত্র]
সাংসারেক মান্দিদের বিশ্বাস মতে, মিদ্দি বাগবা হলেন সকল প্রাণের জন্মদাত্রী। মানুষ-পশু-পাখি-সাপ-ব্যাঙ-লতা-পাত-বৃক্ষ-গুল্ম সকল প্রাণই তাঁর গর্ভজাত সন্তান। সেই হিসেবে আমরা প্রত্যেকেই একে অপরের সাথে নাড়ীর সম্পর্কে সম্পর্কিত। আর তাই বিনা প্রয়োজনে সেগুলোর ধবংস মারাং বা দূষণীয়। সেগুলোর লালন-পালন তাই অতিযত্সাথেই করতে হয়। মান্দিরা তাদের বিভিন্ন আমুয়াতে গুরিরুয়া করে থাকেন। গুরিরুয়াতে কোন অসুস্থ ব্যক্তির অসুস্থতা নিরাময়ের জন্য সংশ্লিষ্ট মিদ্দির (দেবতার) আমুয়ার সময় নারীরা গুরিরুয়ার অংশ গ্রহণ করে থাকেন। ৫/৭/১১ অর্থ্যাৎ বিজোড় সংখ্যক নারীরা বারা জাঙ্গি পরিধান করে বুকে ফং ভর্তি চু বা রংজাঙ্গি নিয়ে দেবতাদের উদ্দেশ্যে ধীর লয়ে ঘুরে ঘুরে নৃত্য-গীত পরিবেশন করে থাকেন। অসুস্থ ব্যক্তির আত্মাকে রংজাঙ্গিতে নিয়ে দেবতাদের সন্তুষ্টির নিমিত্তে নাচ-গানের মাধ্যমে অসুস্থ আত্মা বা প্রাণকে সুস্থ করে তোলা এবং জগতের সকল প্রাণের মঙ্গল কামনা করেই এই গুরিরুয়া করা হয়। প্রাণ ও প্রকৃতির সাথে মান্দি দাকবেওয়ালের(সংস্কৃতির) যোগাযোগ কতটা গভীর তা সহজেই অনুমেয়। কেবল মান্দিই নয় বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসরত বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যেই প্রাণ ও প্রকৃতি সাথে তাদের লোকায়ত জীবন ধারার বিশ্বাসী চর্চা তাদের আপন আপন প্রথাগত জ্ঞান কাঠামোকে ঋদ্ধ করে তুলেছে। প্রাণ-প্রকৃতির সাথে তাদের প্রথাগত সম্পর্ক বাস্তুতন্ত্রের বিভিন্ন ফুড চেইন বা খাদ্য শৃঙ্খলকে যুগ যুগ ধরে সজীব ও বহমান রাখতে সহায়ক ভূমিকা রেখে চলেছে। জাতিগোষ্ঠীসমূহের আপন আপন খাদ্যাভ্যাস তাদের পারিপার্শ্বিক বাস্তুতান্ত্রিক জগতের অপরাপর উপদানের সাথে সহাবস্থান নিশ্চিত সাপেক্ষে গড়ে উঠেছে। আমাদের মান্দি,চাকমা, মারমা, মান্দি, মণিপুরী, ত্রিপুরা,সাঁওতাল, মুন্ডা, মাহাতো প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর,এমনি বাঙালির খাদ্যাভাস লক্ষ্য করলেই ব্যাপারটা বেশ সহজে বুঝা যায়। এখানে প্রাণ-প্রকৃতির কোন উপাদনেরই কোন অপচয়ের জায়গা নেই, আধিপত্য বিস্তারের মনোবাসনা নেই, বাণিজ্যিক মনোপলির কোন বিষয় নেই আছে কেবল আপন আপন লোকায়ক জ্ঞান কাঠামোর সাহসী চর্চার ভেতর দিয়ে প্রাণ-প্রকৃতি সংরক্ষণের নানাবিধ কৌশলের প্রয়োগ। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের মধ্যে যুগ যুগ ধরে ফার্মেন্টেড বা গাঁজায়িত খাদ্য ও পানীয়ের প্রচলন তেমনই একটা চর্চা বা কৌশল যা প্রাণ-প্রকৃতির সাথে তাদের সহজ, সরল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আমাদের সামনে হাজির করে। ফার্মেন্টেডেড বা গাঁঁজায়িত খাদ্য ও পানীয় একদিকে যেমন তাদের প্রথাগত খাদ্যাভ্যাসকে সহজ করেছে, প্রাণ-প্রকৃতি বান্ধব করেছে তেমননি তাদের আপন আপন জাতিগত পরিচয় তুলে ধরার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ পালন করে চলেছে। যেমনঃ সুইবাম এর কথা বললে যেমন মৈতৈ মণিপুরি, মিয়া মিচেং বা চু বা নাখাম বললে যেমন মান্দি জাতির বা কাঞ্জির ভাত, পান্তা ভাত বললে যেমন বাঙালির জাতির পরিচয় সামনে চলে আসে। বর্তমান কর্পোরেট সংস্থা সমূহ মারদাঙ্গা চুরি/লুষ্ঠনের মধ্যদিয়ে বিশ্বজুড়ে যে বায়োকলোনিয়াল ব্যবস্থাকে কায়েম করেছে তার বিপরীতে জাতিগোষ্ঠীসমূহের আপন আপন খাদ্যাভ্যাসের ভেতর দিয়ে নিজেদের লড়াকু অবন্থান জারি রেখেছেন।
২.
গাঁজায়িত খাদ্য ও পানীয় হচ্ছে প্রাণীজ বা উদ্ভিজ্জ উৎসের সে সকল খাদ্য বা পানীয়, যা লেক্টোফার্মেন্টেশন পদ্ধতিতে উৎপাদিত হয়; যেখানে প্রাকৃতিকভাবে বিরাজমান ব্যাকটেরিয়া, চিনি ও শর্করা জাতীয় খাদ্যের উপর নির্ভর করে এবং ল্যাকটিক এসিড উৎপাদন করে; অথবা ফার্মেন্টেশন বা গাঁজায়ন হচ্ছে অবাত পরিবেশে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি যা অনুজীব, ঈস্ট বা ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে শর্করাকে ভেঙ্গে এ্যালকোহল বা জৈব এসিডে পরিণত করে। গাঁজায়িত খাদ্য ও পানীয়তে বৈচিত্রপূর্ণ ও প্রচুর পরিমাণে রোগ-প্রতিরোধকারী ও উপকারী ব্যাকটেরিয়া ও অধিকতর অণুপুষ্টি (Micronitrients) পাওয়া যায়। তাছাড়া অনেক টাটকা খাদ্য ও পানীয়তে বিরাজমান অণুপুষ্টি সমূহ আবদ্ধ(Bio-unavailabe) অবস্থায় থাকে, যা দেহ কৃর্তক শোষণ উপযোগি থাকে না। কিন্তু গাঁজন প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত খাদ্য ও পানীয়সমূহ এসব অণুপুষ্টি সমূহকে মুক্ত করে দেয় ফলে মানবদেহ কর্তৃক সেগুলো সহজে শোষিত হতে পারে।
গাঁজায়িত খাদ্য ও পানীয় নিয়ে বর্তমানে বেশ গবেষণা চলছে। বিভিন্ন গবেষণালব্ধ ফলাফলে গাঁজায়িত খাদ্য ও পানীয়ের যেসকল উপকারি দিকগুলো আমাদের সামনে চলে এসেছে, সেগুলো হলো -
ক. প্রোবায়োটিকস ঃ
একে জীবন্ত অণুজীব হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। গাঁজায়িত খাদ্য ও পানীয়তে প্রচুর পরিমাণে প্রোবায়োটিকস থাকে যা ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স বৃদ্ধিতে, মহিলাদের মূত্রনালীর সংক্রমনে,অন্ত্রের ক্রিয়াকলাপে, ভ্রমণকারীদের ডায়রিয়া প্রতিরোধে, প্রদাহজনিত রোগে সর্বোপরি মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। গাঁজায়িত খাদ্যের মাধ্যমে প্রোবায়েটিক মানুষের অন্ত্রে প্রবেশের সাথে সাথেই তার কাজ শুরু করে দেয়।
খ. খাদ্য সংরক্ষণে ঃ
সেই প্রাচীনকাল থেকেই গাঁজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খাদ্য সংরক্ষণ করে আসছে মানুষ। মান্দিদের নাখাম, চাকমা-মারমা-ত্রিপুরাদের নাপ্পি, মণিপুরিদের সৈবাম প্রথাগত খাদ্য সংরক্ষণের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
গ.খাবারের গন্ধ পরিবর্তণেঃ
খাবারের গন্ধ পরিবর্তনে গাঁজায়িত খাদ্যের বেশ ভালো ভূমিকা রাখে। নাপ্পি, নাখাম, সিঁদল দিয়ে রান্না করা বিভিন্ন তরকারি গন্ধে আলাদা বিশেষত্ব থাকে।
ঘ.পুষ্টি উপাদানের গুণগত মান বৃদ্ধিতে ঃ
গাঁজায়িত খাদ্যে অ-গাঁজায়িত খাদ্যের চাইতে পুষ্টি উপাদান অনেক বেশী থাকে। গাঁজায়িত খাদ্যে যে অণুজীবসমূহ থাকে তারা শুধু ক্যাটাবোলিক হিসেবে খাদ্যের যৌগ উপাদানকে ভেঙ্গে সরল উপাদানেই পরিণত করে না, তারা কিছু ভিটামিন ও শরীরের বৃদ্ধির জন্য সহায়ক বিভিন্ন উপাদান তৈরি করে। গাঁজায়িত খাদ্যের অণুজীবসমূহ উদ্ভিজ্জ খাদ্যে যে সকল পুষ্টি উপাদন আবদ্ধ অবস্থায় থাকে যা সরাসরি দেহ কর্তৃক শোষিত হতে পারে না, সেগুলোকে মুক্ত করে দেহের শোষণ উপযোগী করে তোলে। গাঁজায়িত খাদ্যের অম্লত্ব উপযোগী তাপমাত্রায় মাইক্রোবিয়াল এনজাইমের কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এমাইলেজ, প্রোটিয়েজ, ফাইটেজ ও লাইপেজ প্রভৃতি এনজাইম পলিস্যাকারাইড, প্রোটিন,ফাইটিন ও লিপিড এর হাইড্রোলাইসিস ঘটিয়ে খাদ্যের রাসায়নিক গঠনকে পরিবর্তিত করে। ফলে গাঁজন শুধু খাদ্যে এনজাইমের ক্রিয়াকলাপই বৃদ্ধি করে না, এটা খাদ্যের মধ্যকার ফাইটিক এসিড ও ট্যানিনের মত ক্ষতিকর এন্টিনিউট্রিয়েন্টের মাত্রা কমিয়ে আনে, খাদ্যের মধ্যকার বিভিন্ন খনিজ যেমনঃ আয়রন, প্রোটিন প্রভৃতি দেহ কৃর্তক সহজে শোষিত হতে পারে।
ঙ. মাইকোটক্সিন থেকে দেহকে রক্ষা ঃ
ছত্রাক কৃর্তক কিছু মাইকোটক্সিন যা উদ্ভিজ্জ ও প্রাণীজ খাবার গ্রহণের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করে থাকে। গাঁজায়িত খাদ্যের বিভিন্ন এনজাইম এইসব মাইকোটক্সিনের হাত থেকে দেহকে রক্ষা করে থাকে।
৩.
বর্তমান বিশ্বে খাদ্য নিরাপত্তার মহাযজ্ঞের মধ্যেও নিরাপদ খাদ্য বিষয়টা মানুষকে ভাবাচ্ছে বেশ, এ নিয়ে মানুষের মধ্যে নানামুখী আলাপ জারি রয়েছে। অবশ্য এইসব ভাবনা ও আলাপের যথেষ্ট কারণও আছে বৈকি। প্রাণ বাাঁচানের জন্য গৃহীত খাদ্য যখন প্রাণের হানির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তখন সেই ভাবনা থেকে চাইলেও নিজেদের দূরে রাখা সম্ভব নয়। হাইব্রীড বা শংকর বীজের মাধ্যমে খাদ্য বাণিজ্যের হোমরা চোমরারা প্রথমে খাদ্যের পর্যাপ্ত যোগানের জন্য উঠে পড়ে মুনাফা পকেটে ভরতে পারলেও বা মানুষনের সাময়িক বাহবা কুড়াতে সমর্থ হলেও বর্তমানে নিরাপদ খাদ্যের ভাবনা তাদের একচেটিয়া কু-মতলবকে কিছুটা প্রশ্নের মুখে ফেলেছে বলা যায়। সার ও কীটবিষ নির্ভর জিএম ফুড বা হাইব্রিড খাদ্যসমূহের কারণে প্রাণ ও প্রকৃতির ক্ষতির ব্যাপারটা এখন আর রাখঢাকের মধ্যে নেই। যদিও এরই মধ্যে বিশ্বায়িত অর্থনীতির উন্নত দেশগুলোর বহুজাতিক কোম্পানির সৃষ্ট বায়োকলোনিয়ালজমের ভেতর বাংলাদেশ, ভারত, এশিয়া-আফ্রিকা বা আমেরিকা মহাদেশের সিংহভাগ মানুষ আটকা পড়ে গেছি। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এই সমস্ত দেশগুলোতে বসবাসরত বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর লোকায়ত জ্ঞান কাঠামোকে নানান মুখী ছলাকলার ভেতর দিয়ে কুক্ষিগত করে বা চুরি করে প্রাণ ও প্রকৃতির উপর নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে তৎপর রয়েছে এবং বেশ সফলও হয়েছে। আর তাদের এইসব ছলাকলা বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা যেমনঃ ডব্লিওটিও, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ প্রায় সকলেই গাটছাড়া বেঁধে নেমেছে একচেটিয়া বাজারি অর্থনীতির নানান কৌশলপত্র নিয়ে। বহুজাতিকেরা শুধু আমাদের প্রাণ ও প্রকৃতিকেন্দ্রিক নিজস্ব জ্ঞানকাঠামোকে চুরি করেই ক্ষ্যান্ত থাকেনি, একে একে ধ্বংস করে দিয়েছে আমাদের প্রাণবৈচিত্র্যের আধার জলা-জঙ্গল,পাহাড়-নদী তথা পুরো বাস্তুতন্ত্রকেই। প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকা গুটি কয়েক দেশগুলোর বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থার মাধ্যমে প্রাণবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ দেশগুলোর হাজার হাজার বছরের লোকায়ত জ্ঞান কাঠামো, যে জ্ঞান কাঠামোর অবিরাম চর্চার ভেতর দিয়ে পৃথিবীর জেনেটিক সম্পদগুলোকে রক্ষা করে চলেছে সেইগুলোর নিরন্তর দখল/লুণ্ঠন প্রচেষ্টার ভেতর দিয়ে তারা তাদের বায়োকলোনিয়ালিজমকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। ১৯৬০ সালে সবুজ বিপ্লবের বিপ্লবী জোয়ারে আমাদের এই ভূখন্ডের ধানের জাত ১৮,০০০ থেকে নেমে এসেছে একশতে। আমাদের জুমিয়া-কৃষকদের মি.সারাং, মি.খচ্চু,মি.মা মিশি, সারেংমা রংথাম্ব্রেং, দেমব্রা জাগেদেং, আলাংজাসি,তুলসী মালা, কটকতারা, সূর্যমুখী, বাগুনবিচি ধানের জাতগুলো নেই হয়ে গেছে। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশের বাজারে বহুজাতিকের হাইব্রিড বীজ বাণিজ্য প্রবেশ করার তিনদশকের মধ্যেই কৃষকের গোলাঘরে আর কোন বীজ নেই। সবই এখন বহুজাতিক কোম্পানীর বাহারি মোড়কে বাজারের মোড়ে মোড়ে সার-বীজের দোকানে ঠাঁই করে নিয়েছে। বহুজাতিকের মুনাফা নিশ্চিত করতে একচেটিয়া বাজারি ব্যবস্থাকে রমরমা রাখতে আমাদের মান্দি, মারমা, চাকমা,বাঙালি জুমিয়া-চাষীদের ঘরে যুগ যুগ ধরে নিজস্ব ধানের, বেগুনের, তুলার বা অন্যান্য ফসলাদির বিভিন্ন জাতের বিশাল মজুদ ছিল তা নেই হয়ে গেছে, আমাদের জেনেটিক রিসোর্সগুলো লুট হয়ে গেছে। জানা যায় এক বিটি বেগুনের গবেষণার নাম করে বিশ্বের বীজ-কীটনাশকের অন্যতম শক্তিশালী মনসান্তো আমাদের দেশের নয়টি দেশি বেগুনের জাতকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। শুধু বাংলাদেশই নয়, তৃতীয় বিশে^র নানান প্রান্ত থেকেই তারা জেনেটিক্যাল রিসোর্সগুলো হয় চুরি করছে নয়তো ছিনতাই করছে। জিন গবেষণার মাধ্যমে বহুজাতিকেরা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চুরি/ছিনতাই করা নানান জাতের খাদ্যশস্য বীজের জিনোম সিকোয়েন্স নির্ণয় করে যে জিনটি কোন একটি শস্যের বিশেষ বৈশিষ্টের জন্য দায়ী তা সনাক্ত করে নিজেদের নামে তারা পেটেন্ট করে নিচ্ছে। জিন রিকম্বিনেশনের মাধ্যমে তারা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এমন জাতের বীজ বাজার ছাড়ছে যা ফসলের জন্য ক্ষতিকর পোকামাকড় সংবেদনশীল। অর্থ্যাৎ জিন রিকম্বিনেশনের মাধ্যমে উদ্ভাবিত জাত জমিতে লাগালে এমন কিছু পোকামাকড় তার প্রতি আকৃষ্ট হবে যেগুলো দমন করতে আবার বহুজাতিকের কীটনাশকের শরাণাপন্ন হতে হবে কৃষক-জুমিয়াকে। এর ফলে আমাদের মান্দি, সাঁওতাল, কোচ,বর্মণ,মুন্ডা, মাহাতো, ত্রিপুরা, মণিপুরী, পাহান, সিং ও বাঙালি কৃষক-জুমিয়ারা কার্যত এইসমস্ত বায়োকলোনিয়ালিস্টদের শ্রমদাসে পরিণত হয়েছে। এইসমস্ত বায়োকলোনিয়াস্টরা একদিকে বীজের প্রথাগত সংরক্ষণাগারকে তছনছ করে নিজেদের সীড ব্যাংককে উন্নত করছে অন্যদিকে জিন রিকম্বিনেশন বা মোডিফিকেশনের মাধ্যমে সার-বিষ-হরমোন নির্ভর শস্য-ফসলাদির মাধ্যমে মানুষের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির মাত্রা দিনকে দিন বাড়িয়ে চলেছে। এর সাথে আছে স্থানীয় অসাধু ব্যবসায়ীদের তৎপরতা; দীর্ঘমেয়াদে খাদ্য সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত ফরমালিনসহ নানান রাসায়নিকের যথেচ্ছ ব্যবহার। ফলে নিরাপদ খাদ্যের যে ধারণা এই ভূখন্ডের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষজনেরা তাদের লোকায়ত জ্ঞান কাঠামোর মাধ্যমে প্রাত্যহিক জীবনধারার ভেতর দিয়েই বাস্তবায়ন করে চলেছিলেন সেখানে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটে চলেছে। এছাড়াও ফাস্ট ফুড কালচার আমাদের এই ভূখন্ডের প্রচলিত খাদ্যভ্যাসে বিশেষকরে তরুণ প্রজন্মের খাদ্যাভ্যাসে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন নিয়ে আসছে। উচ্চ ক্যালরিযুক্ত ফাস্টফুডের স্বাস্থ্যগত ঝুকির কথা বিভিন্ন গবেষণায় উঠে আসছে। বিএফসি, কেএফসি বা ম্যাকডোনাল্ডস এর মতন কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের শহরগুলোতে আস্তানা গেড়ে বসেছে। ২০১৭ সালে ম্যাকডোলান্ডস এর গ্লোবালি নীট আয়ের পরিমাণ ছিল প্রায় ৫.১৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বিভিন্ন রকমের শরবত, ঘোল, মাঠা, তাড়ি, ভাং, ডাবের পানি, চু, হাড়িয়া, নিয়ে আমাদের এই ভ’খ-ের বিশাল বৈচিত্র্যময় পানীয় সংস্কতি। যুগ যুগ ধরে এই বিশাল ও বৈচিত্র্যময় পানীয় সংস্কৃতি, যা জুমিয়া-কৃষক থেকে সকল শ্রেণী পেশার মানুষের ক্লান্তি দূরীকরণে প্রচলিত। কিন্তু গত কয়েক দশকে এইসমস্ত প্রথাগত পানীয়ের বিপরীতে বাজারি সংস্কৃতির আগ্রাসনে কোকাকোলা, পেপসির পানীয় আজ বাংলাদেশের প্রতিটি আনাচে-কানাছে। বাংলাদেশে এমন কোন পরিবার পাওয়া যাবে না যারা এইসব পানীয় থেকে পরিবারের সদস্যদের দূরে রাখতে পেরেছে। উচ্চ বিত্ত থেকে নি¤œবিত্ত, বাঙালি থেকে চাকমা, মারমা,খুমী, মান্দি, ওঁরাও, ভূমিজ, মুন্ডা প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে পেপসি, কোকাকোলাসহ নানান কিসিমের এনার্জি ড্রিংকস। এই সমস্ত কোমল পানীয় বা এনার্জি ড্রিংকসের ক্ষতিকর বিষয়গুলো আজ আর কারো অজানা নয়। একচুমুক কোলা এক ঘন্টা ধরে মুখে রাখলে দাঁত হলুদ বর্ণ ধারণ করে, টয়লেট পরিষ্কারে কোক ঢেলে এক ঘন্টা পর ওয়াস করলে তা রেগুলার ক্লিনারের চাইতে ঝকঝকে ফলাফল দেয়- কোমল পানীয় সম্পর্কে এমনই মত দেন বিশেষজ্ঞরা। তাহলে কি উপাদান থাকে এই সব কোমল পানীয়ে? ২০০৩ সালে ভারতের সেন্টার ফর সাইন্স এন্ড এনভায়রনমেন্ট (Centre for Science and Environment-CSE) ১২ টি কোমল পানীয়ের নমুনা পরীক্ষায় লিনডেন, ডিডিটি, ম্যালাথিয়ন, ক্লোরপাইরিফস এই পাঁচ ধরণের কীটনাশকের অস্তিত্ব পান। ইউরোপীয় ইকোনমিক কমিশন (European Economic Commission-EEC)কোন পানীয়ে কীটনাশকের পরিমাণ প্রতি লিটারে .০০০৫ মিগ্রা. সহণীয় মাত্রা নির্ধারণ করলেও পেপসির নমুনায় তা ৩৭ গুণ ও কোকাকোলার নমুনায় তা ৪৫ গুণ বেশি পাওয়া গেছে বলে সিএসই’র বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। কিন্তু তারবাদেও এদের ব্যবসা থেমে থাকে না। ২০১৭ সালে পেপসিকোর গ্লোবালি নিট ইনকাম ছিল ৪.৮৫৭ বিলিয়ন ইউএস ডলার আর কোকাকোলার ছিল ১.২৪৮ বিলিয়ন ইউএস ডলার।
৪.
বহুজাতিকের উদ্ভাবিত ও বাজারজাতকৃত নানান জাতের শস্য-ফসলাদি ও পানীয় যেখানে আমাদের বিষ গ্রহণে বাধ্য করছে, আমাদের জাতিগোষ্ঠীসমূহের প্রথাগত জ্ঞানকে প্রতিনিয়ত চুরি/লুণ্ঠণ করে চলেছে, তার বিপরতীতেও আমাদের এই ভূখন্ত্ত্বা সমবিদ্যমান প্রথাগত জ্ঞানঋদ্ধ গাঁজায়িত খাদ্যাভ্যাস লড়াইয়ের প্রেরণা যোগায়।
ক.পান্তা, কাঞ্জি, বগ্নি ভাত, ক্ষারি, মিআ মিচেং, সুইবাম,দই, ঘি, নাখাম/সিঁদল/নাপ্পি/হিদল, জিলাপি ঃ আমাদের প্রথাগত প্রাণ-প্রকৃতি বান্ধব গাঁজায়িত খাদ্য
“পান্তার জল, তিন পুরুষের বল”
বর্তমান সময়ে পান্তার কথা বললে অনেকেই পহেলা বৈশাখের পান্তা-ইলিশের কথাই প্রথমে বলবে; যদিও বৈশাখের সাথে বাঙালির পান্তা-ইলিশের সর্ম্পকটা খুব বেশি পুরনো নয়। কিন্তু পান্তার সাথে বাঙালির সর্ম্পক বেশ পুরনো এব এর প্রচলন নি¤œবিত্ত বা নি¤œমধ্যবিত্তর মধ্যেই অধিক প্রচলিত ছিল। পান্তা হলো রাতের খাবারের পর বেঁচে যাওয়া ভাত পানি দিয়ে রেখে দিয়ে সকালে সেই ভাত খেলে তখন তাকে পান্তা ভাত বা পানি ভাত বলে। ভারতবর্ষে এক সময় বাঙালি, হাজং, চাকমা, ভূমিজসহ উত্তর ভারতের বিভিন্ন জাতিগোষ্টীর মধ্যে এই পান্তা বা পানি ভাতের বেশ প্রচলণ থাকলেও তা বর্তমানে অনেক কমে গেছে। কিন্তু পান্তা ভাতের উপকারিতা নিয়া বর্তমানে বেশ আলাপ চলছে, এর পেছনে রয়েছে সাম্প্রতিক কালে পান্তা নিয়া গবেষণার ফলাফল। ভাত আমাদের শক্তি ও পুষ্টি যোগায়, কিন্তু অলিগোস্যাকারইড থাকায় রান্না করা হলে মানব দেহ তা পুরোপুরি হজম করতে পারে না বা হয় না। এছাড়া ভাতসহ দানাদার জাতীয় খাবারে থাকা ফাইটিক এসিড ভাত হতে প্রাপ্ত অনুপুষ্টি সহ অন্যান্য খনিজ, যেমনঃ আয়রণ,ক্যালসিয়াম,ম্যাগনেসিয়াম এগুলোকে আবদ্ধ অবস্থায় রাখে, অর্থ্যাৎ শোষণে বাধা দেয়। ভাত ভিজিয়ে রাখলে গাঁজন প্রক্রিয়ায় ফাইটিক এসিড হাইড্রোলাইসিসের মাধ্যমে ল্যাকটিক এসিড ব্যাকটেরিয়া উৎপন্ন হয়, যা আবদ্ধকৃত অণুপুষ্টিসমূহকে মুক্ত বা দেহ কর্তৃক সহজে শোষণযোগ্য করে তোলে। গবেষণায় দেখা যায়, ১০০ গ্রাম পান্তা ভাতে(১২ ঘন্টা ভিজানোর পর) ৭৩.৯১ মিগ্রা আয়রন,৮৩৯ মিগ্রা. পটাশিয়াম, ৮৫০ মিগ্রা.পটাশিয়াম থাকে, যেখানে গরম ভাতে থাকে মাত্র ৩.৪ মিগ্রা. আয়রন, ২১ মিগ্রা. ক্যালশিয়াম ও ৩৫ মিগ্রা পটাশিয়াম। পান্তা ভাত ভিটামিট বি-৬ ও বি-১২ এর ভাল উৎস।
চৈতে গিমা তিতা.
বৈশাখে নালিতা মিঠা,
জৈষ্ঠ্যে অমৃতফল, আষাঢ়ে খৈ।
শায়নে দৈ
ভাদরে তালের পিঠা,
আশ্বিণে শসা মিঠা,
কার্তিকে খৈলসার ঝোল,
অগ্রাণে ওল
পৌষে কাঞ্জি, মাঘে তেল
ফাল্গুনে পাকা বেল।
(খনার বচন)
বাঙালির আরেকটি গাঁজায়িত খাবার হলো কাঞ্জির ভাত। ভাত রান্না করার সময় ধোয়া চাল থেকে সাধারণত একমুঠো বা দুইমুঠো বা পরিমাণ চাল নিয়ে চুলার পাশেই রাখা একটি মাটির ঘটিতে পানির মধ্যে জমা রাখা হয়। মাটির ঘটিটি এমন ভাবে চুলার পাশে রাখা হয় যাতে আগুনের তাপ মাটির ঘটিতেও লাগে। এভাবে সাতদিন জমা করার পর ঘটির চাল ভাতমতন ধুয়ে যে ভাত রান্না করা হয় তাকে কাঞ্জির ভাত বলে। আগুনের তাপে ভিজিয়ে রাখা চাল গাঁজন প্রক্রিয়ায় সাতদিনে সামান্য ফুলে ওঠে এবং টক স্বাদ যুক্ত হয়। অনেক সময় গাঁজন প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করতে নতুন করে বসানো কাঞ্জির ঘটিতে পুরনো কাঞ্জির পানি দেওয়া হয়। কাঞ্জির ভাত সাধারণত শুটকি, কালিজিরাসহ বিভিন্ন রকমের ভর্তা দিয়ে খাওয়া হয়। নারায়ণগঞ্জের কাশীপুর, সোনারগাঁও, মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা ছাড়াও ফরিদপুর, মাদারীপুর ও বরিশালের বিভিন্ন এলাকায় এই কাঞ্জির ভাত বেশ প্রচলিত। তবে সেসব এলাকায় এটি কাজির ভাত হিসেবেই পরিচিত। নারায়ণগঞ্জে কাঞ্জির চাল দিয়ে ঝাউ ও বেশ প্রচলিত। এক্ষেত্রে কাঞ্জির চালের সাথে কাঞ্জির পানি দিতে হয়। ফলে ঝাউ বেশ কিছুটা টক স্বাদের হয়। শুটকি র্ভতা, বিভিন্ন পাতার ভর্তা, কালিজিরা ভর্তা, শুকনো মরিচ ভর্তা দিয়ে কাঞ্জির ঝাউ খাওয়া হয়। কাঞ্জির চাল বেটে চাপটি/চাপতি বানানোর রীতিও প্রচলিত রয়েছে নারায়ণগঞ্জে। কাঞ্জিতে গাঁজন প্রক্রিয়ায় প্রচুর পরিমাণে ল্যাকটিক এসিড উৎপন্ন হয় যা দেহের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
“আষাঢ় মাসনি
বুুড়া বুড়িলা মুখ,
খারপানি, বাঙস গিজা
মাছ লিবা খাওয়া সুখ।
বাখার গদলা বেলা
খাওয়া মুজা বিসি ভাত
আমাতি ছাতা বেলা
খাবা চায় বুকনি ভাত।”
অনুবাদ ঃ
আষাঢ় মাসেতে-
বুড়া বুড়িদের মুখ,
খারপানি, বাঙস গিজা,
মাছ লিবা খেতে সুখ
ভরা বাদলের দিনে
খেতে মজা বিশিভাত
আম্বুবাচীর ছাতা ক্ষণে
খেতে চায় বুকনি ভাত।
[ খারপানি= ক্ষার বা সোডা, বাঙস গিজা= বাঁশের কচি কোড়ল, লিবা= চাউলের পিঠালি দিয়ে রান্না করা, বিসি ভাত=ভাপে সিদ্ধ করা বিন্নি চাউলের ভাত, বুকনি ভাত=অংকুরিত ধানের চাউল দিয়ে তৈরী ভাত, আমাতি ছাতা= আষাঢ় মাসের সপ্তম দিবস থেকে ধরনীর ঋতু¯্রাব শুরু হয় বলে হাজংরা বিশ্বাস করে। এসময়টাতে হাজংরা শুভ কাজ থেকে বিরত থাকে। এসময়টাতে আমাতি ছাতা অর্থ্যাৎ আম্বুবাচির অশুচি সময় বলা হয়।]
হাজংদের মধ্যে বুকনি/বগ্নি ভাত নামে একটা খাবারের প্রচলন রয়েছে। আউশ ধান ভিজিয়ে রাখলে ধানভাত অংকুরিত হলে সেই চাল থেকে যে ভাত রান্না করা হয় তাকে বগ্নি ভাত বলে। এখানে ধানের জার্মিনেশন ও আংশিক ফার্মেন্টেশনের ফলে কারণে ভাতের পুষ্টি উপাদান বেড়ে যায়। এই ভাত খেতে মিস্টি স্বাদের হয়; তবে অধিক পরিমাণে খেলে আংশিক গাঁজনের কারণে কিছুটা নেশা ভাব আসে।
মিআ মিচেং হলো বাঁশের কোড়ল (Bamboo shoots) গাঁজায়িত করে মান্দিদের যে নিজস্ব খাদ্য উপকরণ তৈরি হয় তার নাম। সাধারণত তল্লা বাঁশের কচি কোরল নিয়ে সেগুলো খুলে ভাল মতন ধুয়ে ছোট ছোট টুকরো করে একটা বাঁশের চোঙা বা কোন বাযুরোধী জারে রাখা হয়। কেটে রাখা বাঁশের কোড়লে সামান্য পানি ছিটিয়ে তা বাযুরোধী অবস্থায় সপ্তাহ খানেক রেখে দিলে সেখানে গাঁজন প্রক্রিয়ায় মিআ মিচেং তৈরি হয়ে যায়। মাছ, মাংস বা অন্য কোন তরকারিতে মিআ মিচেং মিশিয়ে রান্না করলে খাবারের স¦াদ ও গন্ধ পরিবর্তিত হয়। মৈতৈ মণিপুরীদের মধ্যেও গাঁজায়িত বাঁশের কোড়ল বেশ জনপ্রিয়, মৈতৈ ভাষায় এর নাম সৈবাম। মৈতৈ মণিপুরীদের সৈবাম তৈরি জন্য মাটিতে একটি গর্ত খুড়ে গর্তের সাইজ অনুযায়ী একটি বাঁশের তৈরি ঝুড়ি বানিয়ে গর্তের মধ্যে তলদেশ থেকে সামান্য উপরে তুলে স্থাপন করা হয়। উঁচুতে তুলে স্থাপন করা হয় এজন্য যে গাঁজন প্রক্রিয়ার সময় বাঁশ কোড়লের অতিরিক্ত পানি যাতে বেরিয়ে যেতে পারে। অবশ্য বাঁশের ঝুড়ির তলদেশে এবং চারপাশে ২-৩ পুরত্বের বন্য কচুর পাতা দিয়ে জড়ানো থাকে। পরবর্তী বাঁশ কোড়লের ছোট ছোট টুকরা ঝুড়িতে রেখে বায়ুরোধী অবস্থায় ৩-৫ দিন রেখে দিলে সৈবাম তৈরি হয়ে যায়। মাটির গর্ত ছাড়াও সৈবাম বন্য কচুর পাতায় পেঁচিয়ে খোলা অবস্থায়, মাটির পাত্রে বা পানিতে ডুবিয়েও প্রস্তত করা হয়। সৈবাম যখন রোদো তাপে বা চুলার আগুনের তাপে শুকিয়ে ব্যবহার করা হয় তখন তাকে ঙাথান (ngathan) বলে।
গাঁজায়িত দুগ্ধজাত খাদ্যের মধ্যে দই অতি পরিচিত একটি নাম। ভারতবর্ষে বাঙালিসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেই দুগ্ধজাত গাঁজায়িত খাদ্য হিসেবে এর প্রচলন রয়েছে। দুধের সাথে পরিমাণ মতন চিনি মিশিয়ে ভালমত জ¦াল দিয়ে প্রথমে ঠান্ডা করা হয়। ঠান্ডা করা দুধ মাটির হাড়িতে ঢেলে ৮-১২ ঘন্টা রেখে দিলে গাঁজন প্রক্রিয়ায় দই তৈরি হয়ে যায়। গাঁজন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে মাটির হাড়িতে দুধ ঢালার আগেই তাতে সামান্য দই মাখিয়ে নিতে হয়। এই মাখানো দইয়ে উপস্থিত ল্যাকটিক এসিড ব্যাকটেরিয়া দুধের গাঁজন ঘটিয়ে দই প্রস্তুত করে থাকে। দই হজমে সহায়তা কওে এবং দেহে বিভিন্ন পুষ্টি ও ভিটামিনের যোগান দিয়ে থাকে।
পদ্মার ইলিশ আর পাবনার ঘি
জামাইয়ের পাতে দিলে আর লাগে কি?
ভারতবর্ষের একটি জনপ্রিয় দুগ্ধজাত গাঁজায়িত খাদ্য উপকরণ হলো ঘি। দুধ থেকে প্রস্তুতকৃত ননী জ¦াল দিয়ে ঘি তৈরি করা হয়। প্রাচীনকাল থেকেই ঘি এর ব্যবহার ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মধ্যেই প্রচলিত। ঘিতে ওমেগা থ্রি ও ওমেগা সিক্স চর্বি থাকে যা দেহের প্রদাহের মাত্রা কমাতে সহায়ক। এই চর্বি দ্রুত ভাঙ্গে ও সহজে হজম হয় বলে গলব্লাডার, কোষের স্বাভাবিক কার্যাবলী বজায় রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ঘি এ প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন-এ, লাইনোলেক এসিড ও বিউটারিক এসিড থাকে। এছাড়া সামান্য পরিমাণে ভিটামিন-কে, ই, ও বি-১২ থাকে। ঘি এন্টি অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। ঘিয়ের ভিটামিন-কে ক্যালসিয়ামের সাথে মিলে হাড়ের স্বাস্থ্য ও গঠণ বজায় রাখে। ঘি তৈরিতে ল্যাকটিক এসিড ব্যাকটেরিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি গ্রাম ও শহরের মানুষজনের নিকট জিলাপি অতি জনপ্রিয় একটি মিষ্টান্ন। বাঙালিসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের খাদ্যাভ্যাসে ঠাঁই কওে নিয়েছে এই জিলাপি। গাঁজায়িত এই খাদ্যটি তৈরিতে ময়দা, দই, পানি দিয়ে মিশিয়ে কাই তৈরি করে ৮-১০ ঘন্টা ঘরের ভেতর স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রেখে দিলে তাতে গাঁজন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। গাঁজন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে ঐ কাই একটি ৪ মিমি ছিদ্রযুক্ত সূতি কাপড়ে নিয়ে হাত দিয়ে চেপে গরম তেলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ছাড়া হয়। তেলে ভাঁজা হয়ে গেলে তা চিনির ঘন মিশ্রণে কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রাখলেই তৈরি হয়ে যায় এই মুখরোচক মিষ্টান্ন। Lactobacillus fermenter, Lactobacillus bulgaris, Streptococcus lactis নামক ল্যাকটিক এসিড ব্যাকটেরিয়া এবং Saccharomyces bayanus, Saccharomyces cerevisiae নামক ইস্ট জিলাপিতে গাঁজন প্রক্রিয়া ঘটিয়ে থাকে।
গাঁজায়িত মৎসজাত খাদ্য উপরণ তৈরির প্রাচীন পদ্ধতির প্রচলন রয়েছে আমাদের মান্দি, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে। বানানোর উপকরণে ও পদ্ধতিতে পার্থক্য থাকলেও এই ভূখ-ের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মধ্যকার আন্তঃসাস্কৃতির এক বলিষ্ট যোগাযোগ বেশ লক্ষ্যণীয়। মান্দি ও হাজংদের মধ্যে গাঁজায়িত নাখামের প্রচলন বেশ পুরনো। বিভিন্ন ধরণের ছোট মাছের বিশেষ করে পুটি মাছের শুটকি ঢেঁকিতে গুড়ো করে তার সাথে সামান্য হা.দিবু মিশিয়ে তা বাঁশের চোঙায় সংরক্ষণ করা হয়। চোঙার মুখ কলাপাতার দিয়ে ছিপির মতন করে আটকানো থাকে। এখানে হা.দিবু শুটকিতে গাঁজন প্রক্রিয়া ঘটিয়ে বিভিন্ন অণুপুষ্টিকে শরীরের শোষণোপযোগী করে তোলে। মান্দিরা যে কোন তরকারিতেই এই নাখাম মিশিয়ে নাখাম ক্ষারি রান্না করে থাকেন। নাখাম ক্ষারি মান্দিদের মধ্যো বেশ জনপ্রিয়। নাখামে ফার্মেন্টার ক্ষার মাছের রাসায়নিক গঠন বিশেষ করে প্রোটিনকে ভেঙ্গে সরল যৌগ উৎপন্ন করে।
“বিশি ভাত কাৎচুয়া মাচাং
হিদল পুতে লেহাবাক
গোষ্ঠীবাড়ীর বগনি ভাত।”
[নিজেদের প্রিয় খাদ্যের বর্ণনায় হাজংদের মধ্যে প্রচলিত একটা কথা]
ভাবানুবাদঃ
বিন্নিভাত কাছিমের মাংস
হিদল দিয়া লেহাবাক
কুটুম্ববাড়ীর বগ্নি ভাত।
সিঁদল/হিদল বা চ্যাপা শুটকি বাঙালি,মান্দি, হাজং, সাঁওতাল, মু-া, চাকমা, মাহাতোসহ বাংলাদেশের অপরাপর জাতিগোষ্ঠীর মানুষজনদের প্রথাগত খাদ্যাভ্যাসে ঠাই করে নিয়েছে অনেক আগেই। সিঁদল বা চ্যাপা শুটকি বানানোর জন্য প্রথমে মাছের নাড়িভ’ড়ি বের করে ভালমত ধুয়ে ৭-১০ দিন রোদে শুকানো হয়। সিঁদল বা চ্যাপা শুটকি বানানোরজন্য মাটির কলসি বা মটকি ব্যবহার করা হয় যার ভেতর-বাহিরে অন্য মাছের তেল দিয়ে মেখে আগেই রোদে ভালমত শুকিয়ে নেওয়া হয় যাতে মটকিতে রাখা মাছ থেকে তেল শোষণ করতে না পারে। মটকিতে ভরাব আগে শুকানো মাছ আবার পানিতে ধুঁয়ে বাঁশের চালুনিতে কয়েক ঘন্টার জন্য রেখে পানি ঝরানো হয়। পানি ঝরে গেলে ঐ মাছ মাটির মটকিতে ঠেঁসে ঠেঁসে ভর্তি করা হয় যাতে ভেতরে কোন বাতাস না থাকে। মটকির মুখ ভালমতন বায়ুরোধী করে বন্ধ করে ৪-৬ মাস মটকির গলা পর্যন্ত মাটির নিচে পুঁতে রাখা হয়। চ্যাপা শুটকি প্রোটিন ও খনিজ লবন এর একটি সমৃদ্ধ উৎস এবং এটি সুষম এ্যামাইনো এসিড বহন করে যা মানব দেহের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এত কম-বেশী স্থিতিশীল লিপিড রয়েছে যার কোন মিউটাজেনিক ক্রিয়া নেই এবং গুণগত মান স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ বলে বিবেচনা করা হয়। এই শুটকি নানাবিধ রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। হাজংরা হিদল দিয়ে চালের গুড়া, সোডা মিশিয়ে হালুয়ার মতন একধরণের খাবার তৈরি করেন, যার নাম লেহাবাক ।
পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা,মারমা,ত্রিপুরা,লুসাই,বম, ¤্রাে,খুমী প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে নাপ্পির প্রচলন রয়েছে। নাপ্পিও গাঁজায়িত মৎসজাত খাদ্য উপকরণ। নাপ্পি সাধাররণত চিংড়ি মাছের গুড়া, কিছু সামুদ্রিক মাছের গুড়া ও ভেষজ উপদান দিয়ে তৈরি করা হয়। এতে প্রচুর পরিমাণে খনিজ লবন থাকে। নাপ্পির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও অসাধারণ।
নোনা ইলিশ বাংলাদেশের আরেক জনপ্রিয় গাঁজায়িত খাদ্য। প্রায় শতবছর আগে থেকেই ইলিশ মাছ সংরক্ষণের এই পদ্ধতি এই অঞ্চলে প্রচলিত। ইলিশ মাছ রোদে শুঁকিয়ে তাতে লবন মাখিয়ে মাটির পাত্রে ৩-৪ মাস রেখে দিলে তাতে গাঁজন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। নোনা ইলিশের গাঁজন প্রক্রিয়ার সাথে যেসকল অণুজীবের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় সেগুলো হলো-ইধপরষষং ংঢ়ঢ়., গরপৎড়পড়পঁং ংঢ়ঢ়.
খ. ‘চু’, ‘তাড়ি,’ ‘মাঠা’ ‘হাড়িয়া’, ‘খড়’, ‘ইয়্যু’ ঃ বাণিজ্যিক পানীয়ের বিপরীতে আমাদের আপন আপন নির্ভেজাল ক্লান্তি নাশক পানীয়
“ভূমিষ্ট হবার সাথে সাথে
আমি ‘চু’জাঙ্গির স্বাদ পেলাম
‘চু’জাঙ্গি মানে জীবনমদ
জীবনই মদ,মদই জীবন
প্লিজ মদ ছাড়তে বলো না।”
[কবি বচন নকরেক এর ইচ্ছে বন ইচ্ছে পাহাড় কাব্যগ্রন্থের ‘চু জাঙ্গি ও কবিতা’ এর অংশ বিশেষ]
চু মান্দিদের নিজস্ব ক্লান্তিনাশক পানীয়। ভাতের গাঁজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই চু প্রস্তুত করা হয়। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি এই পানীয় আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। মান্দিদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রায় সকল ক্ষেত্রেই এই চু এর ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। মান্দিদের চু তৈরিতে ফার্মেন্টার হিসেবে কাজ করে চু মান্থি। বিভিন্ন গাছপালার ডগা, লতা-পাতা-কান্ড ইত্যাদি ঢেঁকিতে গুড়ো করে চালের গুড়া ও আগে তৈরি চুমান্থিও সামান্য গুড়া পানি দিয়ে মিশিয়ে প্রথমে ছোট্ট ছোট্ট বলের মতন তৈরি করা হয়। এই বল গুলোকে দুই হাতের তালুতে চেপে চেপে চ্যাপ্টা গোলাকৃতির পিঠার মতন বানানো হয়। এই চ্যাপ্টা পিঠা গুলোকে কুলোর উপরে খড় বিছিয়ে রোদে রেখে ৫-৭ দিন শুকিয়ে নিলে চুমান্থি ব্যবহার উপযোগী হয়ে যায়। তৈরিকৃত চু মান্থি সাধারণত নকমান্দির ভেতরে অঙ্গারির উপরে রেখে সংরক্ষণ করা হয় সময় মতন ব্যবহারের উদ্দেশ্যে। চুমান্থি তৈরীতে সাধারণত নাকদানা গাছের পাতা, থি বং এর পাতা, শুকনা জালিক, থাবলচু গুঁড়া, আচেত্রা পাতা, আখের কচি পাতা, কাঠালের কচি পাতা, সামাখ্যি গাছের কচি পাতা ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। চু বানানোর জন্য ভাত রান্না করে বাঁশের চালুনিতে মার ঝরিয়ে নেওয়া হয়। গরম ভাত পাটিতে ছড়িয়ে দিয়ে হালকা শুকনা ও ঝরঝরে হলে তার উপর চু মান্থির গুড়া ভালমতন মেশানো হয়। এদিকে চু যে পাত্রে তৈরি করা হবে সেই পাত্র অর্থ্যাৎ দিখ্যা, দিকথম ইত্যাদি ধুঁয়ে পরিষ্কার করার ভালভাবে শুকানো হয়। সাধারণত দিখ্যা-দিকথমের মুখ উল্টো করে উনুনের উপর বসিয়ে জ¦লন্ত কয়লার আঁচে শুকানো হয়, একে বলে হিম্মা। ভালমত হিম্মা করা দিখ্যা-দিকথমের মাঝখানে জান্থি খাঁড়া করে বসানো হয়। এবার জান্থির বাইরের চারপাশে অল্প অল্প করে চু মান্থি মেশানো ভাত রেখে পাত্র টিকে জান্থির উপরের মাথার দুই তিন ইঞ্চি নিচ পর্যন্ত এমন ভাবে ভরানো হয় যাতে জান্থির ভেতরে কোন ভাত না পড়ে। দিখ্যা বা দিকথমের কাজ শেষ হলে দিখ্যা-দিকথমের মুখ শুকনা কাপড় দিয়ে মুছে পরিষ্কার করে কলাপাতা বা আজুগি পাতা দিয়ে পাত্রের মুখ ঢেকে কলাগাছের কান্ডের আঁশ দিয়ে দেওয়া হয়, যাতে চু পাত্রের ভেতরে বাতাস প্রবেশ করতে না পারে। এভাবে সপ্তাহ খানেক রেখে দিলে চু মান্থির কারণে ভাতে ফার্মেন্টেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চু প্রস্তত হয়ে যায়। গরমকালে ফার্মেন্টেশন দ্রুত সম্পন্ন হলেও শীতকালে একটু বেশি সময় নেয়। এভাবে বায়ুরোধী অবস্থায় চু যত বেশি সময় রাখা হবে জান্থির মধ্যে চু বিচ্চিও তত বেশি জমা হবে।
শুধু মান্দি নয় বাংলাদেশসহ দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেও ভাতের গাঁজনে নিজস্ব পানীয় তৈরির রীতি প্রচলিত রয়েছে। পাত্র জাতির ‘খড়’, সাঁওতাল-ওঁরাও-মাহাতোদের হাড়িয়া,চাকমাদের ‘দোচুয়ানি’, মৈতৈ মণিপুরীদের ইয়্যু, ভারতের বোডো জাতির ‘জৌ’,রাভাদের ‘চেকো’ উল্লেখযোগ্য। ভাত থেকে তৈরি এই পানীয় বিশ^ব্যাপী রাইস বিয়ার নামে পরিচিত। ভারতের উত্তর-পূর্ব ভারতের আদিবাসীদের ভাতের গাঁজন প্রক্রিয়ায় প্রস্তুত এই প্রথাগত পানীয় নিয়ে এক গবেষণা ফলাফলে দেখা যায় তাতে এ্যালকোহলের পরিমাণ ১২-১৩%, বিভিন্ন খনিজ যেমন-ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাস, আয়রন এর পরিমাণ ছিল ৭৮.১০৮ মিগ্রা/১০০ মিলি। এছাড়া দ্রবীভূত প্রোটিন ও ভিটামিন-সি এর উপস্থিতি রয়েছে এইসব পানীয়তে। দেহের জন্য উপকারী ল্যাকটিক এসিড ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্বও পাওয়া যায়। ক্লান্তিনাশক এই সকল পানীয় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর পুষ্টি চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি অবসাদ, মাথা ব্যথা, প্রদাহ, কলেরার বিপরীতে বেশ উপকারী। এছাড়া এই সকল পানীয় অনেক সময় ব্যথা নাশক ও শরীর-মন চাঙ্গা করে তুলতে ব্যাপক কাজে দেয়। সন্তান ভূমিষ্টের পর মান্দিরা যে চু নবজাতকের জন্য তৈরি করে তাকে বলে চুজাঙ্গি। এই চুজাঙ্গি প্রসূতি মাকে পান করানো হয় ব্যথানাশক ও শরীর চাঙ্গা করে তোলার জন্য।
বাংলাদেশে বাঙালিদের নিকট আরেকটি জনপ্রিয় গাঁজায়িত পানীয় হলো তাড়ি। তালের রস কয়েক ঘন্টা রেখে দিলে তাতে ফার্মেন্টেশন ঘটে তাড়ি নামের পানীয় তৈরি হয়। পরিমিত মাত্রায় তাড়ি পান দেহের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
মাঠা পানের প্রচলন বাংলাদেশের প্রায় সকল অঞ্চলেই রযেছে। ঘি উৎপাদনের সময় প্রাপ্ত অতিরিক্ত তরল থেকেই এই মাঠা প্রস্তুত করা হয়। ক্লান্তি দূর করতে মাঠার জুড়ি মেলা ভার। বিভিন্ন ল্যাকটিক এসিড ব্যাকটেরিয়া মাঠা তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে- Lactobacillus alimentarius, Lactococcus llactis এবং নামক Saccharomycopsis spp., Candida spp. ইস্ট।
৫.
“দিং দিং আপফাদে দিং দিং
দিং দিং ছালাংদে দিং দিং
গোয়েরা আছাক সিঃ এ্আং দিং দিং
ফিংগিরা দোঃগি সিকগেংআ দিং দিং
আঃখি আঃ উৎগ¦াদে দিং দিং
অকগিল ছিদিং গ¦াদে দিং দিং...”
ভাবানুবাদঃ
সটান হয়ে দাঁড়াও বাবা সটান হও বীর, দিং দিং
শালবৃক্ষের মতো তোমার ঊর্ধ্ব তোলো শির, দিং দিং।
তেজি কুকুর চেঁচাচ্ছে আর গাইছে ফিঙের ছানা, দিং দিং
অক্কা ধ্বনি দিয়ে ষাড়ের বাড়ে উত্তেজনা দিং দিং
আমাদের এই ভূখন্ডে বহুজাতিকের খাদ্য-পানীয় বাণিজ্য প্রতিনিয়ত আমাদের প্রথাগত জ্ঞানকে,আমাদের প্রথাগত খাদ্যাভ্যাসকে নিজেদের আয়ত্বে নেবার জন্য বা বিনাশ করার জন্য হণ্যে হয়ে উঠে পড়ে লেগেছে। এদের প্রচ- প্রতাপে আমরা মান্দি, বাঙালি, চাকমা, মারমা, সাঁওতাল, সিং, পাত্র, ওঁরাও, ত্রিপুরা, রাখাইন, বম, লুসাই, ¤্রােসহ বিভিন্ন জাতির মানুষজনেরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছি। আমাদের প্রথাগত খাদ্যাভ্যাস, প্রাণ-প্রকৃতির সাথে আমাদের বাস্তুতান্ত্রিক সর্ম্পককে টিকিয়ে রাখতে হলে আমাদের আপন আপন বৈচিত্র্যময় খাদ্য-পানীয় ভান্ডারকে নিয়ে আমাদের যাপিত জীবনের যে লড়াই জারি রেখেছি তা বহমান রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে। একেকটি প্রথাগত খাদ্য-পানীয় আমাদের একেকটি জাতিগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়কে তুলে ধরতে সক্ষম দারুনভাবেই। আমাদের আপন আপন খাদ্য-পানীয় আর আমাদের অস্তিত্ব যেখানে একাকার, সেখানে আপন আপন খাদ্য-পানীয়ের যেকোন ধরণের বিনাশ প্রকারান্তরে আমাদেরই বিনাশ।