Tuesday, August 21, 2007

তারপরেও মাংতারা টিকে আছেন আপসহীন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে

জুয়েল বিন জহির



১.
!
দখল
নদী দখল, খাল দখল, বিল দখল
নদীর জল দখল, জলের মাছ দখল, শ্যাওলা দখল
ব্যাঙ দখল, পোক-মাকড় দখল, শামুক দখল, ঝিনুক দখল
ওছা দখল, বিণ দখল, ঝুড়ি দখল, শিং দখল, জুংলি দখল, ঝান্টা দখল
ঠার দখল, কিচ্ছা দখল, গীত দখল, খেলা দখল, নাম দখল,সমাজ দখল
দাড়াইস, কালিপানো, সুতানালি, দুধরাজ, জাইত, গোখরা, আলাজ, বীনরাজ দখল
পাতরাজ, টুনটুনি, গলাকাটি, লালটিঙি, পিরপিরে, টিয়াঠুটি, সুতাশঙ্খ, কালিনাগ, অজগর দখল

চারপাশের সব কিছুই দখল হয়ে যাচ্ছে। তাদের আবাসস্থল, নদী-নালা-খাল-বিল, জলের মাছ, সাপ, ব্যাঙ, কাকড়া, শামুক, ঝিনুক ইত্যাদি সব কিছুই। অথচ দখল করার মতন তারা নিজেরা কোন কিছুই খুঁজে পান না। একে তো তাদের পুস্তকি জানাশোনা নেই তার উপর জ্ঞান-গম্মিও বেজায় কম (!)। এত কম জ্ঞান নিয়ে তো আর দখলের মতন জটিল বিষয় মাথায় খেলানো চাট্টিখানি কথা নয়। জীবিকার জন্য বাপ-দাদারা যে সামান্য কিছু বিদ্যেটুকু শিখিয়ে দিয়ে গেছেন তাতে তো আর দখল জিনিসটাকে রপ্ত করার মতন কোন ব্যাপার ছিল না। কেবলমাত্র দাড়াইস, কালিপানো, খইয়াপানো, দুধরাজ, সুতানালি,জাইত, গোখরা, আলাজ, বীনরাজ, পাতরাজ, টুনটুনি, গলাকাটি, লালটিঙি, পিরপিরে, টিয়াঠুটি, সুতাশঙ্খ, কালিনাগ প্রভৃতি নানান জাতের বিষধর সাপ ধরা, বীণ বাজিয়ে সাপের খেলা, সাপের বিষ নামানো, বানরের নাচ ও যাদুর খেলা দেখানো; কাঁচের চুড়ি, কাপ-পিরিচ, মুক্তার মালা, কড়ির মালা বিক্রি; নানান জাতের লতা-পাতা, শিকড়-বাকর, মাছের কাটা, জীব-জানোয়ারের হাড়গোর দিয়ে বিভিন্ন রোগের ঔষধ বানানোর কায়দা-কানুন ও মন্ত্র-তন্ত্র, যাদু-টোনা; গরু-মহিষের শিং দিয়ে আপন কায়দায় দেহের বিষাক্ত রক্ত-পুঁজ বের করার মতন সামান্য বিদ্যে টুকুই আত্মস্থ করেছেন, চর্চা করে চলেছেন শত শত বছর ধরে। সভ্য,শিক্ষিত,আধুনিক মানুষেরা তাদের এই জানাশোনাকে নাকসিটকিয়ে উড়িয়ে দিলেও অন্যের জানাশোনার উপর তাদের কোন অবজ্ঞা নেই। বরং অন্যের বিদ্যা-বুদ্ধিকে তারা সম্মান জানিয়ে, সমীহ করেই চলেন। শিক্ষিত মানুষজনেরা তাদের আপন বিশ্বাসকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেও অপরের বিশ্বাসের সাথে তারা তাদের আপন বিশ্বাসের এক যোগসূত্র খুঁজে নিয়েছেন নিজস্ব কায়দাতেই। তাদের কাছে মনসা, খোয়াজ খিজির, গঙ্গা মা সবাই বিশেষ মর্যাদায় আসীন। যুগ যুগ ধরে নদী-নালা-খালের মধ্যে ভাসমান জীবন পার করলেও সেগুলোর উপর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা কখনো ক্যানভাস করে বেড়ান নি। তারা কখনো ভাবেন নি নদী-নালা-খাল এভাবে দখল হয়ে যেতে পারে, বদলে যেতে পারে নদীর-নালার পানির রং, হারিয়ে যেতে পারে নানান জাতের মাছ । তারা কখনো চিন্তাই করেন নি ডাঙ্গার শিক্ষিত, বুদ্ধিমান মানুষেরা এভাবে সাপ, ব্যাঙ, শামুক, ঝিনুক, ছাইপ্‌লা, পশু-পক্ষীর হাড়গোড়, মাছের ঠোঁট-কাটা সব বিনাশ করে ফেলবে, নাই করে ফেলবে। তাদের বিশ্বাসকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে মোটেই লজ্জিত নয় ডাঙ্গার মানুষ জনেরা, কোন কষ্টই অনুভুত হয় না মনে। এভাবে সবকিছু তছনছ করার মধ্যেই নাকি গিরস্ত (ঘরে বাস করা অর্থে) মানুষের বাহাদুরি (!) প্রকাশ পায়। কিন্তু নদী হারানো, খাল-বিল-নালা হারানো, হরকসম মাছ, সাপ, গাছ-গাছালি, পশু-পক্ষী, জীব-জানোয়ার হারানোর কষ্টতো বুকের গভীর থেকে কিছুতেই মুছতে পারেন না অশিক্ষিত, কম জ্ঞানওয়ালা মানুষেরা। ভুলতে পারেন না নিজেদের নাম-পরিচয় আড়াল হয়ে যাওয়ার বেদনা। কিন্তু তারপরেও এইসব অচ্ছুত, অশিক্ষিত, কম জ্ঞানওয়ালা মানুষেরা টিকে আছেন অবশিষ্ট নদী-নালা, জীব-জানোয়ার, পশু-পক্ষী নিয়ে, আজীবন চর্চিত সামান্য বিদ্যেটুকুকে পুঁজি করে; ডাঙ্গার মানুষজনের কাছে না হোক অন্তত নিজেদের আগামী প্রজন্মকে জানাতে তাদের নাম-পরিচয় আর জলের ঢেউয়ে ভাসমান জীবনের কথা।

২.
আমরা বাইদ্যা না, বেদে না; আমরা বাইদ্যা না, বেদে না; আমরা বাইদ্যা না, বেদে না;...
আমরা মাংতা, আমরা মাংতা, আমরা মাংতা, আমরা মাংতা, আমরা মাংতা, আমরা মাংতা, আমরা মাংতা...

...অন্ত্যজ বর্ণের... বেদে প্রভৃতিদেরই অন্যতম বৃত্তি ছিল সাপ-খেলানো, যাদুবিদ্যার নানা খেলা দেখানো ইত্যাদি।...রাজসভায় জাঙ্গলিক বা বিষবৈদ্য অন্যতম রাজপুরুষ ছিলেন...।
[বাঙ্গালীর ইতিহাস(আদি পর্ব), ড. নীহার রঞ্জন রায়]

আমরা সবাই বেদে,বাইদ্যাদের সাথে কম-বেশি পরিচিত। সংস্কৃত বৈদ্য থেকে বাইদিয়া বা বাইদ্যা শব্দের উৎপত্তি। বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা ভাষার অভিধানে বেদে, বেদিয়া, বাইদিয়া শব্দের অর্থ বলা হয়েছে যাযাবর, সাপুড়ে জাতি বিশেষ, বিষবৈদ্য । প্রাচীন বাংলায় লোকচিকিৎসা পেশায় জড়িত অন্ত্যজ বর্ণের একদল লোক কালক্রমে অন্যান্য উচ্চ বর্ণর লোকজনের কাছে বৈদ্য,বাইদ্যা,বেদে প্রভৃতি অভিধায় পরিচিত হয়ে ওঠে। উচ্চ বর্ণর দেয়া এইসব অভিধায় পরিচিত ওঠার পাশাপাশি আড়াল হয়ে যেতে থাকে অন্ত্যজ বর্ণর আপন জাতিগত পরিচয়। তাছাড়া উচ্চ বর্ণ কর্তৃক অন্ত্যজ বর্ণর নাম-পরিচয় আড়াল করে দেওয়ার পেছনে যে নিজের সাপেক্ষে অপরকে নিচু,নিকৃষ্ট,ঘৃণিত রূপে প্রতিপন্ন করার একটা প্রবণতা থেকে যায় তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু এইসব বর্ণ দেমাগি দৃষ্টিভঙ্গির সাথে কখনোই একাত্ম হতে পারেন নি সেই অন্ত্যজ বর্ণর লোকজনেরা; মেনে নেন নি অন্যের দ্বারা নিজেদের জাতিগত নাম-পরিচয় আড়াল হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটাকে। অধিপতি শ্রেণীর চাপিয়ে দেয় নানান অভিধার বিপরীতে সেই অন্ত্যজ বর্ণর লোকেরা আজও নিজেদের জাতিগত পরিচয় মাংতা হিসেবেই দেন; বাইদ্যা বেদে বা বেবাইজ্যা বলে নয়।

...এইযে বাইদ্যা কয়, আমাগো ভিতরে একটা খারাপ লাগে, কেন খারাপ লাগে; যে আমরা তো বাইদ্যা না। তোমরা এই যে একটা নাম রাখছ, বলতাছ-তোমরা এই নামটা পাইলা কোনথন। অহন তোমাগো জিগাইতে গেলে একটা ঝগড়া আসে। ...আমরাতো বাইদ্যা না। ...আমাগো জাতের নাম আছে, আমরা মাংতা।
[ মোন্তাজ মাতবর(৬০), রিকাবী বাজার বহর, মুন্সীগঞ্জ ]

মাংতাদের জাতিগত উৎপত্তি নিয়ে বেশ কয়েকটি অষ্পষ্ট মতভেদ প্রচলিত রয়েছে; যার কোনটিই তাদের জাতিগত উৎপত্তি বা অরিজিন নিয়ে পরিস্কার কোন ধারণা দিতে সক্ষম নয়। ড. শেখ মাকসুদ আলী সম্পাদিত বাংলাদেশ জেলা গেজেটিয়ার-বৃহত্তর ঢাকা তে উল্লেখ রয়েছে, বেদে সমপ্রদায় কতদিনের পুরনো তা বলা সম্ভব নয়। তবে এদেশের শহর-বন্দর ও গ্রামে এদের বিচরণ দীর্ঘদিনের। এরা আমাদের সামাজিক জীবনের সাথে মিশে আছে।

বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির বাংলা পিডিয়াতে মাংতাদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে, ১৬৩৮ সালে আরাকানের বল্লাল রাজার সাথে সেখানকার মনতং জাতিগোষ্ঠীর একটা অংশ বিতারিত হয়ে প্রথমে বঙ্গদেশের বিক্রমপুরে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং পরবর্তীতে এরা বঙ্গদেশ ও আসামের প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েন। এছাড়া মনতং জাতিগোষ্ঠীর থেট বা ঠেট ভাষার সাথে বেদে বা মাংতাদের ঠার ভাষার নাকি মিলও রয়েছে।

এই সূত্র মতে আরাকান থেকে মাংতাদের এতদাঞ্চলে প্রথম আগমনের সময় কাল ১৬৩৮ সাল উল্লেখ করা হলেও আরো অনেক থেকেই প্রাচীন বাংলায় মাংতাদের উপস্থিতি ও তাদের পেশাগত পরিচিতির প্রমাণ পাওয়া যায়। ড. নীহার রঞ্জন রায় তাঁর বাঙ্গালীর ইতিহাস গ্রন্থের আরেক জায়গায় উল্লেখ করেছেন,...অন্ত্যজ পর্যায়ের আর একটি বর্ণের খবর দিতেছেন বন্দ্যঘটীয় আর্তিহর পুত্র সর্বানন্দ (১১৬০)। ইহারা বেদে বা বাদিয়া; বাদিয়ারা সাপ খেলা দেখাইয়া বেড়াইত ( ভিক্ষার্থং সর্পধারিণি বাদিয়া ইতি খ্যাত)। এছাড়া যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত ১৩১৬ বঙ্গাব্দে তাঁর বিক্রমপুরের ইতিহাস প্রথম খণ্ডে মাংতাদেরকে হিন্দু সমাজেরই একটা বর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন-...বিক্রমপুরে বহুজাতীয় লোকের বাস। হিন্দুদের মধ্যেই বিভিন্ন জাতি ও তাহার শ্রেণীবিভাগ আছে। ... বৈদ্য, কায়স্থ, জেলে, কৈবর্ত, বৈষ্ণব, বারুই, বেদিয়া (বাইদা), বেলদার, ভূঁইমালি, ধোপা, গোপ (গোয়ালা), ঝাল-মাল, যুগী...।

অনেকের মতে মাংতারা দ্রাবিড় ভাষা-ভাষী কোন জাতি। এছাড়া নিজেদের জাতিগত উৎপত্তি নিয়ে মাংতাদের নিজস্ব কিছু ধারণা রয়ে যা মুখে মুখে বংশপরম্পরায় আজও টিকে আছে।

“... বিভিন্ন এলাকায় মাংতা আছে। কিন্তু অদের ভাষা আবার অন্য। ...আরবিয়ান মাংতা আছে আরবি ভাষা। আমরা বুঝব না। আমাগো ভাষা অরা বুঝে না। জাত সব একই, জাত সব মাংতা। ...আমাগো গোড়াটা ঐ আরব থেইকাই আইছে।”
[ মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন (৫২), মিরকাদিক পৌরভবন সংলগ্ন, মুন্সীগঞ্জ]

“...আগে মুরব্বিরা কইছে, নুহু নবীর কিস্তি আছিল। ... তয় নুহু নবীর ছিলছিলায় যেমুন আমরাও নৌকায় বসবাস করতাছি। ...ঐ আমল থেকাই। নুহু নবীর ছিলছিলাতেই আমরা আইছি...অখান থেনই আরকি আমাদের নৌকায় থাকা পড়তাছে...।”
[ মোন্তাজ মাতবর(৬০), রিকাবী বাজার বহর, মুন্সীগঞ্জ]

মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন ও মোন্তাজ মাতবরের ন্যায় মাংতাদের অনেকে মনে করেন যে, তাদের মাংতা জাতের উৎপত্তিস্থল আরবে বা তাদের নৌকায় বসবাসের শুরু হয়েছে নূহ্‌ নবীর সেই প্লাবনের সময় থেকেই। নিজেদেরকে মনে করেন নূহ্‌ নবীর বংশধর হিসেবে। সেই ছিলছিলাতেই তাদের নৌকায় বসবাস।

আমি নূহ্‌কে প্রেরণ করেছিলাম তাঁর সমপ্রদায়ের প্রতি একথা বলেঃ তুমি তোমার সমপ্রদায়কে সতর্ক কর, তাদের প্রতি মর্মন্তদ শাস্তি আসার আগে।
(সূরা নূহ্‌, আয়াত-১)

নিজ সমপ্রদায়ের লোকজন যখন বারে বারে হযরত নূহ্‌ নবীর প্রচারিত বাণীকে অস্বীকার করতে লাগল তখন তাদের উপর মহাপ্লাবন হিসেবে কঠিন শাস্তি নেমে এসেছিল। নূহ্‌ নবী তাঁর অনুসারীদের নিয়ে বিশালাকার কিস্তিতে চড়ে সেই প্লাবনে নিজেদের রক্ষা করেছিলেন। ছয় মাস আটদিন কিস্তিতে থাকার পর নূহ্‌ নবী তাঁর আশিজন অনুসারী নিয়ে জুদি পর্বতে ( খ্রিস্টানদের মতে নূহ নবীর কিস্তি এসে থেমেছিল আর্মেনিয়ার Mt. Ararat এ, যা থেকে জুদি পর্বত ১৮০ মাইল দূরে অবস্থিত ) এসে থামেন। পরবর্তীতে এই পর্বতের পাদদেশেই থামানিন (Thamanin) নামের এক জনপদ গড়ে ওঠে। এই জুদি পর্বতটি অবস্থিত বর্তমান তুরস্কে। প্লাবনের পর নূহ্‌ নবীর জীবিত তিন ছেলের মধ্যে হামের বংশধরদের পাক-ভারতের একাংশ, আফ্রিকা ও ইউরোপ; শামের বংধরদের দ্বারা আরব ও পার্শ্ববর্তী দেশ সমূহ; ইয়াসেফের বংশধরদের দ্বারা তুরস্ক, রোম প্রভৃতি অঞ্চল জনবসতিপূর্ণ হয়। জানা যায়- শাম, হাম ও ইয়াসেফের বংশধরদের মধ্যে যথাক্রমে ১৯, ১৮ ও ২৬ টি পৃথক ভাষার সৃষ্টি হয়। হাম ও শামের বংশধরদের ভাষাগুলোকে ভাষাতাত্ত্বিকেরা হেমিটিক-শেমিটিক ভাষাগোষ্ঠী ভূক্ত করেছেন। হেমিটিক-শেমিটিক ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত আরবি ভাষায় বাদিয়াহ্‌ বলে একটা শব্দ আছে যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় যাযাবর। তবে এই বাদিয়াহ্ বলতে যে মাংতাদেরই বুঝানো হয়েছে তা নিশ্চিত নয়। এখন মাংতা জাতিগোষ্ঠীটি ঠিক কখন কীভাবে নিজেদের স্বাতন্ত্র‌্য পরিচয় নিয়ে নূহ নবীর কিস্তির ছিলছিলায় নিজেরা নৌকায় বসবাস ও যাযাবর জীবন শুরু করেন তা বের করা দীর্ঘ গবেষণা সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

বর্তমানে মাংতাদের নিজস্ব ঠার ভাষার ধাতু ও ক্রিয়াপদ বাংলা তথা ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারের ন্যায়। তবে ঠার ভাষার বর্তমান এইরূপ দীর্ঘদিন বঙ্গদেশে অবস্থানের ফলে বাংলা বা ইন্দো-আর্য পরিবারের অন্যান্য ভাষা দ্বারা যে অনেক খানিই প্রভাবিত তা মোটামুটি নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়। মাংতাদের ঠার ভাষায় যে নিজস্ব কিছু শব্দ আছে যেমনঃ খাইপ্তা (বাবা), খাইপ্তানি (মা), খুপি (লবণ), ছাইম্‌লা (মাছ), ময়াল (সাপ), উড়ুম (চিড়া), বতুন (ভাত), লেবন (তরকারি), উজ্জালি (মাংস), ছোলতা /মইল্‌ত (ঔষধ), বেলং (তেল), আম (তুওম), দকলা (কলা), ডুওম (মাথা), গেসকই (চুল), গুন্‌কি/গুনারি (চোখ), বক (রক্ত) গেইত্‌লা (হাড়ি), দবলা (কুলা), পেছকো (দা), টোঙ্গা (জুতা), বুইত্‌কাল (কুকুর), নেওয়ারি (পানি), কাইকাল (পরিবার), বম্‌কই (মায়ের দুধ) ইত্যাদি ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে গণ্য হতে পারে।

৩.
চুড়ি লাগব নি চুড়ি...;লাগব নি কাঁচের কাপ-পিরিছ, প্লেট-বাটি... ;খেলা দেখাইগো খেলা, সাপের খেলা দেখাই...; রস টানি, বাত টানি, কোমড় টানি, মাঝা টানি, চোখের পোকা, দাঁতের পোকা ফালাই, শিঙ্গা লাগাই...; খা খা খা বক্ষিলেরে খা, কিরপিনেরে খা...

ক্ষুদ্রান্তে ভূজগাঃ শিরাংসি নময়ত্যাদায় যেষামিদং
ভ্রাতর্জাঙ্গালিক ত্বদাননমিলন্মন্ত্রানুবিন্ধং রজঃ।
জীর্ণস্তেষফণীন যস্য কিমপি ত্বাদৃগগুণীন্দ্রব্রজা-
কীর্ণক্ষ্মাতলধাবনাদপি ভজত্যানম্রভাবং শিরঃ।।


ভাই জাঙ্গালিক (সাপুড়ে), তোমার এই সাপগুলি ছোট ছোট; তোমার মুখের মন্ত্রপড়া ধূলি ইহাদের মাথা নমিত করিয়া দিতেছে। এই ফণাধারী সাপটি বোধ হয় জীর্ণ (অর্থাৎ প্রবীণ বা অভিজ্ঞ), কেননা তোমার মতো গুণী দ্বারা পূর্ণ মাটিতে ধাবন করিয়াও ইহার মাথা নম্রভাব হইতেছে না (অর্থাৎ নমিত ভাব হইতেছে না)।

উমাপতি ধরের এই সংস্কৃত শ্লোকের ন্যায় সাধারণের কাছে বেদে,বাইদ্যা শব্দের সাথে সাপ ধরা বা সাপের খেলা দেখানোর বৃত্তিটাই অধিকতর স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এছাড়া গল্প-উপন্যাস বা সিনেমাতেও বেদে বলতে কেবলমাত্র সাপুড়েরাই বারবার উপস্থাপিত হয়ে আসছেন। তবে এর বাইরেও যে মাংতাদের আরো পেশাগত বৈচিত্র্যতা রয়েছে এবং এই পেশাগত বৈচিত্র্যতার সাথে সাথে তারা বেশ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত তা, অনেকের কাছেই হয়ত স্পষ্ট নয়। ড. শেখ মাকসুদ আলী সম্পাদিত বাংলাদেশ জেলা গেজেটিয়ার-বৃহত্তর ঢাকা এর আরেক জায়গায় বলা হয়েছে- ...বেদে সমপ্রদাযের বেশ কটি জাত রয়েছে। ... এদের মধ্যে বৈদ্য, বৈরাল ও সাখার শ্রেণী প্রধান। এদের জীবন ও জীবিকা ভিন্নতর না হলেও রীতি-নীতি ও আকারে কিন্তু পার্থক্য রয়েছে।

মাংতাদের মতে, তাদের কয়েকটা জাত আছে। এক জাতের সাথে আরেক জাতের পেশাগত পার্থক্য ছাড়াও রীতিনীতে রয়েছে স্বাতন্ত্র‌্যতা বাংলাদেশের মাংতারা মালবৈদ্য, তৈল বা বান্দারিয়া, সাপুড়িয়া, মিসিগারি, বৈরাল, বাজিকর, শৈল, সওদাগর বা সান্দার বা লাইয়ো ইত্যাদি ভাগে বিভক্ত।

“...মাল মাংতা যারা, তারা নেয়ারবইনা করে। নেয়ারবইনা অইল ঐ যে শিঙ্গা লাগায়, পোকাটোকা ফেলায়...। তৈল মাংতা যাদের কয় ওরা বাঁদর লিয়া খেলায়। একপ্রকার আছে মিসিগারি মাংতা, অরা চহের (চোখের) পর্দা কাটে। তারপরে একপদের আছে লাইয়ো মাংতা, ...তারা ঐ কাপ-পিরিচ বেঁছে; আরেক পদের আছে বৈরাল মাংতা-মাছ ধরে, বড়শি বায়। আছে হাবুখেলা মাংতা-এইগুলি ইণ্ডিয়ায়। অরা হাবুখেলায়।...মানে ‘হাব হাবু হাবু কার বাড়ি যাবো ...’এরম কইরা মেয়েছেলে সবাই গেরাম করে। এমন কইরা সাইর গাইব আর টাকা উঠাইব। তারপরে আবার আছে লেল্লছ মাংতা। লেল্লছ মাংতা ওরা কী আবর্জনা খায়। যেমন-ব্যাঙ খায়, কুইছা খায়, সাপ খায় ওদের লেল্লছ বলা হয়। চাইয়া-চিন্তা খায় আরকি। বাংলাদেশে নাই, ওটা ভারতে। আরেকটা আছে ভাল্লুকধারী মাংতা। অরা ভাল্লুক লইয়া গেরাম করে। যারা ধামাধন্নি তারা ধামা (টুকরি) নিয়া ঘুইরা বেড়ায়, ... অনেক মালছামানা বেঁছে, অষুধঅ বেঁছে।...এই দুইটাঅ ভারতে। আরেক পদের আছে সাপুইড়া মাংতা। তারা সাপ খেলা দেখায়। মেয়ে-পুরুষ সবাই। ওদের সাপুইড়া বলা হয়। ঠিক আছে, আরেক পদের আছে বাজিকর, বাংলাদেশে আছে। যাদু দিয়া ময়নার ছাও, পুতুলের ছাও বানায়’, এইটার নাম ‘কতিখেলা’। ঐ গেলে বলে যাদুখেলা আর মাংতা বলে কতিখেলা।”
[ মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন (৫২), মিরকাদিক পৌরভবন সংলগ্ন, মুন্সীগঞ্জ]

মাংতাদের একজাতের সাথে আরেক জাতের রীতিনীতিতে যেমন পার্থক্য রয়েছে, রয়েছে আলাদা আলাদা
সমাজ ব্যবস্থাও। চারপাশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বৃত্তিগত বৈচিত্র্যতা ক্রমেই সংকীর্ণ হয়ে আসছে। নিজেদের একজাতের পেশাকে আরেক জাতের লোকজন যেমন গ্রহণ করছে তেমনি গ্রহণ করছেন অন্য পেশাও। তবে মাংতাদের সব জাতের মধ্যেই আপন চিকিৎসা পদ্ধতির দূর্দান্ত চর্চা রয়েছে।

মাংতাদের একজাতের সাথে আরেক জাতের বিবাহ সামাজিক ভাবে নিষিদ্ধ। তবে বর্তমানে কিছুটা হলেও এর ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। এখন মাংতাদের একজাতের সাথে আরেক জাতের ছাড়াও গিরস্ত বাঙালিদের
সাথেও বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে উঠছে, তবে এর সংখ্যা খুব একটা বেশী নয়।

৪.
গড়াইস, দাড়াইস, দুধরাজ, বেকরাজ, কালিপানো, খইয়াপানো, সুতানালি, বিণরাজ, কোবরা, অজগর, গরুর শিং, কাইক্যা মাছের ঠোট, বনরুইর আঁইশটা, সজারুর কাটা, ময়না-শালিকের ঠোট, কট মাছ, ওরাল মাছের কাটা, ঝিনুক, শামুক, পোকা-মাকড়, মনিরাজ, উলটচণ্ডাল, নিম, তুকমা হায়াত, ঘৃতকুমারি, সাদা তুলসী, অর্জুনবানের গোটা, নদী, খাল, বিল, মাটি...

... রোজার মাসে রাইতে এক মহিলারে লইয়া আইছে কয়জন। ... সাপে কামড় দিছে। ... মন্ত্র পইড়া রোগীরে একটা মইছ (মরিচ) গালে দিলাম, কইলাম-ধর এইটা চাবান দে। খাইল, ধাক অইছে। মইছ (মরিচ) দিয়া পরীক্ষা দিলাম, যদি ধাক না ধরে তয় জানব যে এই রোগী আর বাঁচব না... মাথায় বিষ ওইঠা গেছে।... হেরপর একটা মুরগী কিনা আনলে বেটির আতটা(হাতটা) একটু কাইটা মুরগীটার পুটকিটা ঐখানে লাগাইলাম; রক্তটা লাগাইলাম। লাগাইলাম যদি বিষাক্ত সাপে কামড় দিয়া থাকে লগে লগে মুরগীটা দাপাইয়া মইরা যাইব।..একদম মইরা যাইব। পরীক্ষা অইটাই। ... নতুন ব্লেড কিইন্যা আইনা এই বান্ধের গোড়া কেচা দিলাম।...কেইচা দিলাম নানান গাছগাছালির অষুধ লাগাইয়া। ... অষুধ লাগাই দিলাম মাগো বেটি চিক্কার দিয়া দাপড়ান। এরপর গরম পানি দিয়া ধুইয়া বান ছাইড়া দিলাম, রোগী পুরা সুস্থ।

[হাফিজা (৪৫), মিরকাদিম পৌরভবন সংলগ্ন, মুন্সীগঞ্জ]

যদি গেইজের ব্যারামের রোগীরে বনরুইত মাছের আঁইশটা দিয়া অষুধ বানাইয়া ব্যবহার করান যায় তাইলে গ্যারান্টি, রোগ ভালা অইয়া যাইব।... কট মাছের কাটা, অর্জুনবানের গোটা, আখরোটের ফল মাজা ব্যথার জইন্য উপকার দেয়, বাতের জন্য উপকার দেয়।

[আব্দুল কাদের (৫৫), মুক্তারপুর বহর, মুন্সীগঞ্জ]

অনেকদিনের পুরানি কাঁশির জন্য কুই মাছ খাওয়ানো গেলে কাঁশি ভালা অইয়া যাইব।
[পাগলনি খালা(৫০), কদম আলী গুদারা ঘাট, কাশীপুর নারায়ণগঞ্জ]

...আমি সাপ ধরছি, সাপ নাচাইছি। আমি সাপ ধরছি না-দাড়াইস ধরছি, গড়াইস ধরছি, দুধরাজ, বেকরাজ, জাইত, গোক্‌েখার, আলাজ, বীনরাজ, পাতরাজ, টুনটুনি, গলাকাটি, লালটিঙি, পিরপিরে, টিয়াঠুটি, সুতাশঙ্খ, কালিনাগ বহু ধরনের সাপ ধরছি।...এইগুলি বাংলাদেশেও ধরছি ভারতেও ধরছি...অনেক সাপ ধরছি আমি।...সাপ ধরা তো কোন ব্যাপার না। সাপ ধরাতো সাবাস। ... কোন কিছূ লাগে না। সাপ ধরা সাবাস আর হাতের ক্যাপাসিটি, চখ্যের নজর। ...তারপরেও সাথে গাছ রাহি, লাঠি রাহি।
[ কান্দার খান (৬৫),খরিয়া মালবৈদ্য বহর, মুন্সীগঞ্জ]

মাংতাদের আপন চিকিৎসা পদ্ধতি বা বৃত্তিগত উপকরণের সবকটিই উদ্ভিদ-প্রাণী বা পরিবেশীয় অন্যান্য উপাদানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট। মাংতাদের আপন চিকিৎসা পদ্ধতিতে তন্ত্র-মন্ত্রের এক অনিবার্য উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলেও পরিবেশীয় জীবীয় বা অজীবীয় উপাদানগুলোও প্রত্যক্ষভাবেই জড়িত। আর এইসমস্ত উপাদান সমূহের ব্যবহারাদির পুরোটাই যে মাংতাদের আপন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে তা বলাই বাহুল্য। মাংতাদের অন্যান্য বৃত্তিসহ নিজস্ব চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগ নির্ণয়ন কৌশল থেকে শুরু করে অষুধপাতি পর্যন্ত্ত পুরো প্রক্রিয়াতেই পরিবেশীয় উপাদানের অপরিহার্যতা লক্ষ্যণীয়।

পুস্তকি জ্ঞান না থাকলেও পূর্বপুরুষের জ্ঞান-অভিজ্ঞতার আলোকে মাংতারা চারপাশের পরিবেশকে অত্যন্ত নিবিড় ভাবে পাঠ করেন। ভৌগলিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের সকল উপাদানের সাথেই মাংতাদের রয়েছে এক সংহত সম্পর্কের; আর এই সংহত সম্পর্কের ভেতর দিয়েই তারা পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের নানা বিষয়াদি রপ্ত করে নেন। এখানে কোন দখল নেই, বিনাশ নেই, পাচার নেই, আছে, কেবল এক অকৃত্রিম বান্ধব সম্পর্কের। এই সম্পর্কই মাংতাদের শিখিয়ে দেয় কোন অসুখ-বিসুখে কখন, কোন সময়ে, কোন গাছের ফল-বাকল-পাতা-ফুল বা শিকড় কতটুকু পরিমানে সংগ্রহ করতে; কীভাবে জুনি পোকা, ইঁদুরের লেজ, কাইক্যা মাছের ঠোঁট, কুঁই মাছ, কোরাল মাছের কাটা, কট মাছের কাটা, ওরাল মাছের কাটা, ধনেশ পাখির ঠোঁট, গরু-ছাগল-মহিষের শিং, ময়না পাখির ঠোঁট, পোকা-মাকড়, বিভিন্ন জাতের সাপ, সাপের বিষ, কুমিরের মাংস, বনরুইয়ের আঁশটে বা প্রাণীর হাড়গোর সংগ্রহ করতে হবে প্রাণীকূল বা গাছ-গাছালির স্থায়ী কোন বিনাশ ছাড়াই। পরিবেশীয় এইসব নানান উপাদান দিয়েই তারা শত শত বছর ধরে দাঁতের পোকা, চোখের পোকা, চোখের ছানি, রস বাত, বিষ বাত, ওরশ্যের ব্যারাম, হাঁপানি, বিভিন্ন রকমের চর্মরোগ, যৌনরোগ, রক্তস্রাব, সাদাস্রাব, সাপের বিষ নামানো সহ নানান চিকিৎসা দিয়ে আসছেন ডাঙ্গার গৃহস্থ মানুষদের। শুধুমাত্র মানুষের চিকিৎসাতেই নয় গৃহপালিত পশুপাখির চিকিৎসা পদ্ধতিতেও তারা সিদ্ধহস্ত। যেমনঃ ভাদ্র-আশ্বিণ মসে গরুকে যদি কুমিরের মাংস খাওয়ানো যায় তাহলে গরু আর জ্বরতে (খুড়া রোগ) পারে না ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রাকৃতিক সম্পদের বিনাশকে তারা কখনোই প্রশ্রয় দেন না; কেননা এইসবের বিনাশকে তারা সার্বিক ভাবে নিজেদের বিনাশই মনে করেন। সভ্য মানুষেরা যখন আরাম-আয়েশ আর মুনাফার লোভে একের পর এক নদ-নদী, খাল-বিল ভরাট করে ফেলছেন, বন-জঙ্গল-পাহাড় সব দখল করে ফেলছেন তখন মাংতারা বাকরুদ্ধ হয়ে যান; এ যেন নদী বা খাল-বিলকে মেরে ফেলা নয়,বন-জঙ্গল ধ্বংস নয়; মাংতাদেরই গলা টিপে হত্যা করা। গৃহস্থ মানুষের কল-কারখানার বিষ দিয়ে পানিকে দূষিত করে হাজার হাজার জাতের জলজ জীবের বংশ নাশ করাকে মাংতারা নিজেদেরই বংশনাশ জ্ঞান করেন। কেননা এই নদ-নদী, খাল-বিলই তো অন্যান্য জলজ জীবের ন্যায় তাদেরও আবাসস্থল, বিচরণ ক্ষেত্র। উপযোগী পরিবেশীয় বিচরণক্ষেত্র ছাড়া কোন জীবই তো স্বাভাবিকভাবে টিকে থাকতে পারে না; মাংতারাও পারছেন না। গৃহস্থ মানুষেরা কীভাবে এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে জানা নেই মাংতাদের; জানা নেই এই ভাবে নদী-খাল-বিল হত্যার কোন বিচার আছে কী না বা থাকলেও কার কাছে তারা চাইবেন এইসব হত্যা, দখল আর বিনাশের। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নদ-নদী, খাল-বিলের পানিতে জীবন পার করলেও এবং ঝোপ-ঝাড়, বন-জঙ্গল থেকে তারা তাদের প্রয়োজনীয় সাপ, ব্যাঙ, পোকামাকড়, পাখি, গাছগাছালি সংগ্রহ করলেও কখনো একরত্তি জায়গাওতো নিজেদের দখলে রাখার কোন চেষ্টা করেন নি কিংবা সাপ, পোকামাকড়, জন্তু-জানোয়ার নির্বিচারে হত্যা করেন নি, পাচার করেন নি, দখল করার কথা ভাবেন নি নদী-খাল-বিল আর পাহাড়-জঙ্গলকে। কিন্তু তারপরেও একের পর এক নদ-নদী-নালা-বিল-খাল সব উধাও হয়ে যায়, জলের মাছ, পোকামাকড়সহ হাজার হাজার প্রজাতির জীব-জানোয়ার, ঝোপ-ঝাড়, বন-জঙ্গল সব উজার হয়ে যায়।

অষুধি গাছ পাইতেতো এহন অনেক সমস্যা। বছরে দুই-একবার ভারত যাইতে অয় গাছগাছন্ত আনতে। আগেতো মধুপুর জঙ্গল থিকা তারপরে রাঙ্গামাটি, বান্দরবন, খাগড়াছড়ি ও চিটাগাংএর পাহাড়ি বন থিকা আনতাম। এহনতো কিচ্ছু নাই, অনেক গাছপালা কাইটা হালাইছে। ...অষুধ পাইতে অনেক কষ্ট অয়।
[ মোঃ আলাউদ্দিন (৪৫),আমিন বাজার ব্রিজ বহর, ঢাকা]

...এইযে রঙের পানিটা, ডাইংয়ের পানিটা নদীর মইধ্যে যেইভাবে ছাড়তাছে -এভাবে মাছ সব মইরা যাইতাছে; আগে বড় বড় বোয়াল মাছ, আইড় মাছ, মিরকা মাছ, রুইত মাছ, বাউস মাছ, চেউয়া মাছ, চাপিলা মাছ, বাইল্যা মাছ, বাইম মাছ অইত, অহন যে কেন অয়না- এই রঙের পানির কারণে। ... বোয়াল মাছ এক ইসাবে নাইই, ... ডাইং মাছ- সেলুং মাছটা বড় অইলে ঐটারে আমরা ডাইং মাছ কই...ঐ জিনিসটাও নাই। ... ছাটা ইছা মাছটা থাকতই পারে না। ...আমারতো আধার দিয়া মাছটা মারতাছি।... কারেন জাল দিয়া মাছ মারতাছি না। ...গিরস্তরা কারেন জাল দিয়া মাছের বীজ শেষ কইরা হালাইছে।... এই রঙের পানিটা মুখে দেওয়া যাইতেছে না, পছা পানিটায় যে গোসল করে তাদেরও ক্ষতি অইতাছে,... শরীরে একটা গোটা অইতাছে। ....যারা পানির ভেতরে থাকে না তাগর খাওয়া পড়ে না।...আমাদের থাকতে অইতাছে, এই পছা পানিই খাইতে অইতাছে।
[মোন্তাজ মাতবর(৬০), রিকাবী বাজার বহর, মুন্সীগঞ্জ]

৫.
আল্লারে মানি, রসুলরে মানি, নবী মানি, মনসারে মানি, বাবা খোয়াজ খিজির মানি,মা গঙ্গীরে মানি, নামাজ পড়ি, রোজা রাহি, খোয়াজ খিজিররে খোদাই সিন্নি দেই, মা গঙ্গীর লাইগা সিন্নি ভাসাই, দেবী মনসারে ভোগ দেই, পৌষ সংক্রান্তির বুড়াবুড়ি পূজায় মানতি দেই...; আমরা মানুষ, আমাগো দেখলে পাপ অইব কেন?...

আদি বিশ্বাস যাই থাকুক না কেন বর্তমানে ধর্মীয় বিশ্বাসগত দিক থেকে মাংতারা ইসলাম ধর্মের অনুসারী।
আল্লাহ্‌, রাসুল সহ ইসলামের প্রধান পাঁচ স্তম্ভের উপর এদের বিশ্বাস রয়েছে। কিন্তু মুসলমান হলেও তাদের নিজস্ব কিছু বিশ্বাস ও লৌকিক সংস্কারের প্রচলন রয়েছে যা তাদের স্বতন্ত্র‌্য পরিচয় আমাদের সামনে হাজির করে। ইসলামের অনুসারী হলেও অন্য ধর্মের অনেক কিছুই তারা আত্মস্থ করেছেন নিজস্ব ঢঙে। পানির উপরে সারাজীবন বসবাসের দরুন পানির পীর হিসেবে খ্যাত বাবা খোয়াজ খিজিরের উপর মাংতাদের রয়েছে পরম আস্থা। প্রতিবছর অগ্রহায়ণ মাসে মাংতাদের প্রতিটি বহরেই বাবা খোয়াজ খিজিরের নামে করা হয় খোদাই সিন্নি। সকলের সম্মিলিত আয়োজনে খোদাই সিন্নি তৈরির পর প্রথমেই তা খোয়াজ খিজিরের নামে একটা কলাপাতায় করে ভাসিয়ে দেয়া হয় নদীর জলে। কিন্তু এই খোদাই সিন্নি খোয়াজ খিজিরের নামে ভাসানোর পাশাপাশি একইভাবে মা গঙ্গীর উদ্দেশ্যেও উৎসর্গ করেন মাংতারা। তাদের জলজ জীবনে খোয়াজ খিজির ও মা গঙ্গী দুজনের সমান গুরুত্বের। ঝড়-বাদল সহ সকল প্রকার বিপদে-আপদে তারা একই সাথে স্মরণ করেন মা গঙ্গী ও বাবা খোয়াজ খিজিরকে। জলের উপরে বসবাস, সাপের হাত থেকে নিজেদের রক্ষাসহ অন্যান্য দুঃখ-কষ্ট থেকে নিস্কৃতির জন্য সর্পদেবী মনসার শুভদৃষ্টি কামনায় মাংতারা দুধ, কলা, ধান,দূর্বা সহ ভোগ দেয় নানান কিছু। এছাড়া ছেলে-মেয়েদের অসুখ-বিসুখের হাত থেকে রক্ষার জন্য পৌষ সংক্রান্তিতে আয়োজিত বুড়াবুড়ির (শিব-পার্বতী) পূজায়ও মানত দিয়ে আসেন একান্ত বিশ্বাসের সাথে।

যাদুবিদ্যা,তন্ত্র-মন্ত্র মানুষের অতি পুরনো বিশ্বাসের ধারাটিকেই ঝিইয়ে রেখেছে। যাদুবিদ্যা এমন একটা কৌশল যা দিয়ে মানুষ অতিপ্রাকৃত শক্তিকে বশে এনে স্বীয় উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চায়। কল্পনার হাতিয়ার দিয়ে অজেয় প্রকৃতিকে বশীভূত করার একটা অনেক পুরনো প্রচেষ্টা। তন্ত্র-মন্ত্র, যাদুবিদ্যায় অগাধ বিশ্বাস ও তার নিয়মিত চর্চা রয়েছে মাংতা জীবনে। মাংতাদের সকল চিকিৎসা পদ্ধতিতে তন্ত্র-মন্ত্রের উপস্থিতি অণিবার্য। মাংতাদের তন্ত্র-মন্ত্রের সাথে প্রায় ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে আছে আসামের কামরূপ পাহাড়ের নাম। তাদের অনেকেই নিজেদের ও তাদের পূর্ব পুরুষদের আসামের কামরূপ পাহাড়ের কামাখ্যা মন্দিরে যাদুবিদ্যা শিখে আসার কথা মজমা সহ নানান জায়গায় বেশ গর্বের সাথে প্রচার করেন। সাথে থাকে সেখানকার নানান গল্প ও যাদুবিদ্যা শেখার বই লজ্জাতুন্নেছার নাম। তাদের বিশ্বাস মতে গাছ-গাছন্ত, জীব-জানোয়ারের দেহের বিভিন্নাংশের সাথে এই তন্ত্র-মন্ত্রের ব্যাপারটা যুক্ত হলে তা থেকে অতি সহজেই কাঙ্খিত ফল পাওয়া যায়। বিশেষায়িত দ্রব্যগুণের বিশাল কদর রয়েছে মাংতা জীবনে। অমাবস্যা-পূর্ণিমা রাতে জোয়ারের সময় কাটা পাটের আঁশের বিশেষ গুণ আছে বলে বিশ্বাস করেন। এই বিশেষ গুণ সম্পন্ন পাটের আঁশ দিয়ে ওঝা রোগীর যেখানে সাপে কামড়েছে তার উপরের দিকে বাঁধ দিয়ে দেন। এরপর হাতে কড়ি নিয়ে মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে ঝাড়ার পর কাইক্যা মাছের ঠোট বা ব্লেড দিয়ে ক্ষতস্থানের উপরে কেটে বিষ বের করে ফেলেন। এছাড়া অমাবস্যা রাতে কেউ যদি একাকী উলঙ্গ অবস্থায় নির্দিষ্ট স্থান থেকে সাদা তুলসির শিকড় তুলে আনতে পারে তাহলে তা দিয়ে যাদু-টোনা, বাণ সহ নানান কাজে লাগানো যায় ইত্যাদি অনেক বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে।

... মানুষ হইয়ে মানুষেরা ঘিন্না নাইকা-মহাপাপ। আমি যামু, আমারে দেইখা কেউ ঘিন্না করে করুক, আমি তারে ঘিন্না করলাম না। অর মন চায় আমার কাছে আহুক না চায় না আহুক; আমার কাম আমি কইরা আমু। গেরাম করতে গেলে কতকের গাইল-কনি খাওন লাগে, কতকের খিবুকসি (?) শুনন লাগে, কতকের... । গিরস্তের বাড়ি গেলে কউক, কাজ করতে গেলে কত কতাইতো হুনতে অয়, কতায় কয় না- নদী দিয়া গান গাইয়া গেলে নদীর জোয়ার যায় না, মুখের জোয়ার যায়।
[ হাফিজা বেগম(৪৫), মিরকাদিম পৌরসভা সংলগ্ন, মুন্সীগঞ্জ]

মাংতারা তাদের আপন বিশ্বাসে আর সংস্কারে গৃহস্থদের অনেক বিশ্বাস আর সংস্কারের সহাবস্থান ঘটালেও ডাঙ্গার মানুষদের কাছে তারা বরাবরই নিচু জাত,অচ্ছুত বা ঘৃণার পাত্র হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছেন। মাংতারা মুসলমান হওয়া সত্বেও এবং ইসলাম ধর্মে বর্ণবাদের কোন স্থান না থাকলেও তারা গৃহস্থ মুসলমানের বর্ণবিদ্বেষী আচরণের সম্মুখীন হন প্রতিনিয়তই। মাংতা পুরুষেরা সাধারণত হাটে-মাঠে-ঘাটে নিজের পেশাগত মজমা বসালেও মাংতা নারীরা গৃহস্থদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে যাদুখেলা, সাপের খেলা, চুড়ি বিক্রি, শিঙ্গা লাগানোর কাজ করে থাকেন। আর একারণে স্বভাবতই মাংতা পুরুষদের চেয়ে নারীরা বর্ণদাপটের চরিত্রকে টের পান হাড়ে হাড়ে। বাড়ির শূচিতা নষ্ট হবে বলে অনেক গৃহস্থ বাড়িতেই মাংতা নারীদের প্রবেশের কোন অনুমতি মেলে না। আর কোন রকমে অনুমতি মিললেও গৃহস্থের ঘরে ঢুকবার কোন সুযোগ থাকে না। কারো কারো মতে...বাইদ্যানিগো চেহারা দেখলে পাপ অয়, জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে অইব, মাংতাদের দিকে তাকালে নাকি কারো চল্লিশ দিনের জন্য পবিত্রতা থাকে না, কবুল হয় না কোন ইবাদত-বন্দেগি এমন বিশ্বাসও প্রচলিত রয়েছে অনেক গৃহস্থ মানুষের। মাংতা নারী বুঝে পায় না মানুষ মানুষের দিকে তাকালে কী ভাবে পাপ হয়, দেহের পবিত্রতা নষ্ট হয়, ইবাদত-বন্দেগি সব পানি হয়ে যায়। জাত-পাতের বিবেচনায় নিচু জাত বলে অবজ্ঞা করলেও সুযোগ পেলে গৃহস্থ পুরুষদের অনেকেই মাংতা নারীর দিকে লিঙ্গীয় আঘাত হানতে কার্পণ্য করেন না। এহেন বর্ণ আর পুরুষতান্ত্রিক দাপটের কাছে মাংতা নারী-পুরুষ কোণঠাসা হলেও কখনো দমে যান নি। আপন সংস্কার, বিশ্বাস, সহনশীলতা আর পেশাগত দক্ষতা আর জাতিগত সংহতিকে পুঁজি করে আজও মাংতারা মোকাবিলা করে চলেছেন সকল দাপটকে, নিজেদের টিকিয়ে রাখার এক অদম্য প্রত্যয়ে।

...একবার মুক্তাগাছায় গিরস্তরা আমাগো সাভারের এক মাইয়া তুইলা নিয়া গেছিল। পরে কেস কইরা দুই দিন পর মেয়ে ফেরত পাইছিল। এই রহম অয় অনেক জায়গায়। ...এইসব সমস্যা আমরা সবাই মিল্যা মীমাংসা করি। আর এইগুলি যেইখানে অয়, সেখানে আমরা সারাদেশের মাংতারা সবাই টেকা দেই সমাধানের লেইগা। আর আমগো সব দলের একজন কইরা মাতবর ওইহানে যাইব, যেইহানে এই ঘটনাটা হইল-মীমাংসার লেইগা।
[আব্দুল কাদের (৫৫), মুক্তারপুর বহর, মুন্সীগঞ্জ]

৬.
আমাগো বম্‌কই আমাগো নেমরা-নিমরির লেইগা...; আমাগো নৌকায় কুনোসুম ডিবির দুধ ঢুকে নাই...; রাজা, মায়া বড়ি,...কুনোসুম কিনি নাই, ব্যবহার করি নাই...

বাজারি অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পণ্যের অবাধ প্রবাহ আজ আছড়ে পড়ছে সর্বত্র। মুনাফা লোভীদের তাণ্ডবে বিধ্বস্ত আজ পাহাড়-জঙ্গল-সমতলের সকল জাতির মানুষের স্বাভাবিক জীবন-যাত্রা। পণ্যের বাঁধভাঙ্গা জোয়ারে বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার আপন প্রতিরোধী ব্যবস্থা আজ হুমকির সম্মুখীন। মাংতাদের জীবনও এর বাইরের কিছু নয়। সভ্য, শিক্ষিত মানুষের কাছে মাংতারা যতই অসভ্য,নিকৃষ্ট,অচ্ছুত হোক না কেন বাজারি দুনিয়ার দাপুটে ব্যবস্থায় উৎপাদিত পণ্যের ভোক্তা হিসেবে তারা মোটেই ‘অচ্ছুত’ নন। ভোক্তা হিসেবে সভ্য দুনিয়ার বিভিন্ন কোম্পানিগুলোর কাছে অন্যান্য সবার ন্যায় তারাও হয়ে ওঠেন কাঙ্খিতজন। দাপুটে বাজারি অর্থনীতির কাছে আত্মসমর্পিত রাষ্ট্রযন্ত্র তার নানান বিধিব্যবস্থার মাধ্যমে বেঁচে থাকবার নূন্যতম অধিকার থেকে মাংতাদের প্রতিনিয়ত দূরে ঠেলে রাখলেও পণ্যের বাহারি সব প্রচার-প্রচারণায় কাউকেই দূরে রাখতে বা বঞ্চিত করতে চায় না (!) ব্যবসায়িক দুনিয়া। সভ্য দুনিয়ার অর্থনৈতিক মারপ্যাঁচ না বুঝলেও চারপাশের নানান পরিবর্তন তাদের মানস চিন্তায় রেখে চলে অনেক প্রশ্নের ছায়াপাত; যে প্রশ্ন তাদেরকে শংকিত করে তুলে নিজেদের বিশ্বাস, আচার ও পেশাগত ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার বিষয়ে। কিন্তু তারপরেও মাংতারা আপন বিশ্বাস আর সংস্কারগত সংহতিকে অক্ষুণ্ন রাখার ভেতর দিয়েই গড়ে তোলেন তাদের আপন প্রতিরোধের ভিত্তি।

...বাইচ্চা না অওনের লেইগা আমাগোর পদ্ধতিই করি। ... ডাক্তারি অষুধে সাদা সেরাবের ব্যারাম অইয়া যায়, রক্ত সেরাবের ব্যারাম অইয়া যায়, কতকের ফুইলা যায়গা...। আর আমাগো গাছন্ত অষুধে শরীলে কোন সমস্যা অইব না। ...চাইরটা ট্যাবলেট বানাই দিমু খাইলে জীবন পার ...। তেরো জন ছেলে মেয়ে অইছে, আমার স্বামী একটু হাদিসের পদের তো হেই জন্য বাইচ্চা বন্ধ করতে দেয় নাই। ...আমার কোলের ছেলের পরেই আমি চাইরটা ট্যাবলেট খাইছি, আর চিন্তা নাই...; ... অল্প কয়েকদিনের জন্য বাইচ্চা হওন বন্ধ করার অষুধও আমাগো জানা আছে।
[ হাফিজা বেগম (৪৫), মিরকাদিম পৌরসভা সংলগ্ন, মুন্সীগঞ্জ]

মাংতা পরিবারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি হলেও তাদের রয়েছে নিজস্ব নিয়ন্ত্রন পদ্ধতি। বাজারি জন্ম নিয়ন্ত্রন সামগ্রী সমূহের উপর কোন আস্থা রাখতে পারে না মাংতা নারী। হাটে-বাজারে, রেডিও- টেলিভিশনে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর বাহারি সব বিজ্ঞাপণ দেখলে-শুনলেও সেদিকে তাদের কোন আকর্ষণ নেই। বহুজাতিক কোম্পানীগুলো তাদের কনডম, পিল ইত্যাদি দিয়ে সারা দুনিয়া দাঁপিয়ে বেড়ালেও মাংতা জীবনে কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। মাংতাদের দাবি, বাজারি এই সব জন্ম নিয়ন্ত্রন সামগ্রীতে নানান পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকলেও উদ্ভিজ্জ ও প্রাণীজ উপাদানে তাদের নিজেদের তৈরিকৃত ঔষধে কোনো শারিরীক ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। প্রকৃতি থেকে পরিমান মতন উদ্ভিজ্জ ও প্রাণীজ উপাদান নিয়ে আপন জ্ঞান আর অভিজ্ঞতার নির্যাস মিলিয়ে নিজেরাই তৈরি করে নিচ্ছেন নিজেদের শরীরবান্ধব জন্মনিয়ন্ত্রন সামগ্রী। এছাড়া মাংতা মায়েরা গৃহস্থ মায়েদের ন্যায় সন্তানের বেড়ে উঠার দায়দায়িত্ব ডানো, নিডো, এ্যাংকার বা অন্যান্য গুড়ো দুধের কৌটায় বন্দী রাখতে চান না মোটেও। মাংতা মায়ের বিশ্বাস বমকই বা বুকের দুধ পান করানোর সাথে সন্তানের স্বাস্থ্যগত ব্যাপারটা যেমন জড়িত তেমনি জড়িত সন্তানের সাথে মায়ের নিবিড় ভালোবাসার বাঁধনটাকে আরো পোক্ত করার। মাংতা মায়েরা তাদের সন্তানদের দেড়/দুই বছর পর্যন্ত বুকের দুধই পান করান। আলগা দুধ পান করানোর রীতি মোটেই পছন্দ নয় তাদের। তবে মায়ের স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণে বাচ্চাকে বুকের দুধ পান করানো না গেলে সেক্ষেত্রে গরুর দুধ বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে এর হারও খুবই কম। মাংতা মায়েরা সারাদিন কর্মব্যস্ত থাকলেও তাদের সন্তানের দেখাশুনার দায়িত্বটুকুও অন্যের হাতে ছাড়তে নারাজ। নিজের আঁচলে শিশু সন্তানকে পিঠে বেঁধে নিয়েই গ্রাম ঘুরতে তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

৭.
বামাদের যা কিছু খাছরে, তাই লিয়ে ঝেলের নতে লড়পাব... ;বামাদের যা কিছু খাছরে, তাই লিয়ে ঝেলের নতে লড়পাব...; বামাদের যা কিছু খাছরে, তাই লিয়ে ঝেলের নতে লড়পাব...

...এই রহম অইছে, আমরা এক জায়গায় গেছি দল লইয়া, ভালা সুন্দরী মাইয়া দেখলে ওরা (গৃহস্তরা) হামলা দিতে আইছে কিন্তু আমরা আবার রাত জাইগা ঐ সেখান থেইকা চইলা গেছিগা। আমাদের কাছও ঐ গুলিবাঁশ, গুলাইল থাকে; এগুলি লইয়া আমরা রাত জাগছি। এইগুলি দিয়া আমরা পাহারা দিছি। দেখছি ওহানে খারাপ ওখানে আর থাকি নাই চইলা গেছি গা। আবার কত জায়গায় হামলাও দিয়া হালাইছে, মারামারিও হইয়া গেছে; আমরা কেস-মামলা করছি।... এই ভাবেই আমরা টিক্যা আছি।
[আব্দুল কাদের (৫৫), মুক্তারপুর বহর, মুন্সীগঞ্জ]

অধিপতি শ্রেণীর নিত্য নতুন কৌশলের কাছে মাংতারা প্রতিনিয়ত কোণঠাসা হয়ে পড়লেও টিকে থাকার সংগ্রামে তারা আজও লড়াকু সৈনিক। সভ্য দুনিয়ার নানান সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত মাংতারা দমে যাবার পাত্র নন। তারা তাদের নিজস্ব জ্ঞান, বিশ্বাস আর প্রথাগত সংস্কারের সাহসী চর্চার মধ্য দিয়েই মোকাবিলা করে চলেছেন নানান প্রতিকুলতাকে। সভ্য সমাজের সুযোগ-সুবিধা থেকে অনেক পিছিয়ে থাকলেও মাংতারা হতাশ হতে নারাজ। হতাশ কেন হবেনই বা কেন- শিশু-বৃদ্ধ প্রতিটি মাংতাইতো আজও তাদের নিজস্ব জীবনাচার ধরে রাখছেন সাহসিকতার সাথে। তাদের চাঁন মিঞা সর্দার, পান্না মাতবর আর মোন্তাজ মাতবরেরা আজও বিচক্ষণতার সাথে মাংতা বহরের নিজস্ব রীতি-নীতি পালন করে চলেছেন; আমিন বাজারের আলাউদ্দিন মিয়া শহরে-বন্দরে বীন বাঁশিতে সুরের ঢেউ তুলে মুক্তারপুরের আব্দুল কাদেরের দক্ষ হাতে ধরা সুতানালি, পিলপিলে, জাইত, গোখরা, মাইটাপানস নাঁচিয়ে চলেছেন সমানে। কাশীপুরের পাগলনি খালা, মিরকাদিমের হাফিজা, আফুজারা তাদের জুংলি আজও বোঝাই রাখেন গাছগাছন্ত আর জীব-জানোয়ার দেহাংশ থেকে তৈরি নানা রোগের অষুধে, মহিষ-গরু আর ছাগলের শিং, কাইক্যা মাছের ঠোট আর কার্তিক অমাবস্যার পাটের দড়িতে; দক্ষ হাতের কৌশলে শিঙ্গা টেনে টেনে বের করে আনছেন গৃহস্থ মানুষের শরীরের বিষাক্ত রক্ত-পূঁজ। আর এই রক্ত-পূঁজের সাথেই হয়ত একদিন বের করে আনবেন গৃহস্থ মানুষের দেমাগি মনের সকল আবর্জনাকে -এমন স্বপ্নের ঝিলিকইতো খেলে যায় মাফুজাদের চোখে-মুখে। অধিপতি শ্রেণীর নানাবিধ কাঠামো তাদেরকে প্রতিনিয়ত আড়াল করে রাখতে চাইলেও আমিন বাজারের মান্নান সর্দারেরা নতুন প্রজন্মের মাংতাদের কাছে চান না কোন কিছু আড়াল করতে; মাংতাদের নিজস্ব রীতিনীতির কথা বলে যান বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে। রিকাবী বাজারের সোনিয়া, সালমারা গৃহস্থ পুরুষের নানা রকম হয়রানির মুখোমুখি হলেও কাপ-পিরিচের পাতিতো মাথা থেকে নামান নি; গৃহস্থ পুরুষের কুদৃষ্টির কাছে হার না মেনে মাথা উঁচু করেই তো গ্রামে গ্রামে ঘুরছেন। নদীতে মাছ না থাকলেও রমিজ মিয়ারা আজও তার বড়শিতে আধার গেঁথে চলেন ধলেশ্বরীর বুকে কারেন জালের কাছে আপোস না করার ব্রতটা জিঁইয়ে রেখেই। বিয়ান্যার শাজাহান মিয়া তালি-চাবি ঠিক করে দিয়ে অনেক সময় ন্যায্য পাওনা না পেলে গৃহস্থদের দুটো উচিৎ কথা শুনিয়ে দিতে তো ভয় করেন না কখনো। খরিয়া গ্রামের কান্দার খানেরা আজও জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ান অষুধি গাছের খোঁজে। লোকমান মিয়া আর মামুনেরা কড়িমালা, ঝিনুকমালা সহ নানান গাছন্ত তাবিজের ঝান্টা নিয়ে পাড়ি দেন শহর-বন্দর-গ্রাম। লুটপাট আর ছিনতাইয়ের দুনিয়ায় হানিফ মিয়া তার ওছা আর আছড়া নিয়ে হাঁক দিয়ে বেড়ান-পানিত পইড়া যাওয়া সোনা-রূপার জিনিস তুলি...। প্রাকৃতিক নানান উপাদানের মাধ্যমেই ওরশ্যের ব্যারাম, হাঁপানি, যৌনরোগ, বা জন্ম নিয়ন্ত্রণের অব্যর্থ অষুধ দিয়ে চলেছেন দেলোয়ার হোসেন। গৃহস্থদের প্রতিনিয়ত খালবিল ভরাটের বিপরীতেও আবু বকর, সালামেরা নতুন নতুন বিরকি (নৌকা) ভাসাচ্ছেন পানিতে। রোখসানা, রেহানারা তাদের সন্তানদের ঘুম পাড়াচ্ছেন ঠারে গান শুনিয়েই। গৃহস্থজনের সামপ্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিকে উপেক্ষা করেই পাগলনি খালারা একই সাথে খোয়াজ খিজির আর মা গঙ্গীর নামে পানিতে ক্ষীর ভাসাচ্ছেন, একই হাতে মিলাদের তবারক আর পূজার প্রসাদ গ্রহণ করছেন পরম বিশ্বাসের সাথে। পান্না আর শম্ভু মাতবরদের আহ্বানে পোড়াবাড়ি সহ বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানের ন্যায় খরিয়া গ্রামে এখনও সকল মাংতারা জড়ো হন কার্তিক মাসে, মেতে উঠেন উৎসবে-আমোদে। আর এই সমস্ত কিছুই মাংতাদের প্রেরণা যোগায় সকল দাপটের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়ে যাবার, শক্তি যোগায় সম্মিলিত কণ্ঠে উচ্চারণ করার-

আমাগো যত তন্ত্র-মন্ত্র, বিশ্বাস, বিরকি, বহর আছে তাই নিয়ে লড়ে যাব
আমাগো ঠারে যত শব্দ, গীত, রূপকথা, প্রবাদ, ডাকের কথা আছে তাই নিয়ে লড়ে যাব
আমাগো বহর যতগুলা নদী-নালা-খাল-বিল-জলাশয়-রাস্তার ধারে আছে তাই নিয়ে লড়ে যাব
আমাগো চেনা যত জাতের সাপ, পোকামাকড়, পশু-পাখি, জীব-জানোয়ার আছে তাই নিয়ে লড়ে যাব
আমাগো যত ওছা, আছড়া, বীন, ঝাপি, ঝুড়ি, জুংলি, ঝান্টা, গুলিবাঁশ, গুলাইল আছে তাই নিয়ে লড়ে যাব
আমাগো যত বনরুইর আঁইশটা,সজারুর কাটা, কুমিরের মাংস, কট মাছের কাটা আছে তাই নিয়ে লড়ে যাব।


(This article was published in `Mhrittika’-vol.-3, issue-3; editor-Jewel Bin Zahir, Parag Ritchil, Dhaka, August 2006)

No comments: