জুয়েল বিন জহির
জিসি দা.সালদেম দা.জাদেম
রংচুগালেঙা বিজাকসতেঙ্গা
আমানিগ দগ্রিসিয়ানা
আম্বিনি নাচিলগ্রি বন্নানা
দিশা দক মি,মারিমং মাংমিচ্ছিবিমং
খ্রাম দুখখং দগ্গি
আদুরি বংগিসকি...
(আজকে এই মাসে/ রংচুগালা করছি, পাতা কাটছি/ মা মুরগীর বাচ্চাহীন মৃতূ্যর কারণে/ নানীর নি:শব্দ মৃতূ্যর কারণে/এইভাবে বাজিয়ে/খ্রাম বাজিয়ে/আদুরি বাজিয়ে...)
৭ সেপ্টেম্বর ২০০৬ । সাংসারেক (মান্দিদের নিজস্ব ধর্ম) খামাল (পুরোহিত) দীনেশ নকরেক আদুরি, দামা, খ্রাম এর তালে তালে সুর করে করে খ্রিতা (মন্ত্র) পড়ে রংচুগালার রুগালার কাজ শেষ করেছেন। রংচুগালা হলো মান্দিদের ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব; ওয়ান্নার ঠিক আগের একটা কৃত্যের নাম। হাবা বা জুম ক্ষেত থেকে ধান তোলার পর তা মাড়াইসহ অন্যান্য কাজ সমাধার পরই মান্দিরা আয়োজন করতেন রংচুগালার। রংচুগালা না করে অর্থাৎ দেবতা মিসি আর সালজং এর উদ্দেশ্যে রংচু বা চিড়া উৎসর্গ না করে নতুন ধানের ভাত রান্না করে খাওয়া সাংসারেক ধর্মীয় মতে নিষিদ্ধ। হাবাহুয়া বা জুম চাষ নিষিদ্ধ হয়েছে সে অনেক আগেই আর বর্তমানে প্রায় ৯৯ শতাংশ মান্দিই যিশুকে প্রভু হিসেবে মেনে নিয়েছেন, কিন্তু তারপরেও গুটিকয়েক সাংসারেকদের হাত ধরে মধুপুরে আজও টিকে আছে রংচুগালা, ওয়ান্নাসহ সাংসারেক ধর্মের অনেক কিছুই। যাই হোক, চুনিয়া গ্রামের অন্যান্য বাড়ির ন্যায় রংচুগালার অনুষ্ঠানিকতা শেষে বড়বাড়ির বারান্দায় (হাবিমার মান্দি রাজা বলে খ্যাত প্রয়াত পরেশ মৃ-র বাড়িতে) আমি, বচনদা (কবি বচন নকরেক) আর মৃত্তিকা কর্মী উক্যেনু মারমা অন্যান্যদের সাথে বসে আলৎ ফলের খাজি খাচ্ছি আর চু এর গ্লাসে ঠোঁট ছোয়াচ্ছি। আমাদের পান পর্ব যখন শেষের দিকে তখনই নেবুলদির ( নেবুল দারু-পরেশ মৃ-র ছোট মেয়ে) সাথে সাথে একদল মানুষ বড়বাড়িতে প্রবেশ করল। আগত দলের অধিকাংশই ছিলেন তরুণ-তরুণী। তাদের পোষাক পরিচ্ছদের বৈচিত্র্যই বলে দিচ্ছিল তারা বিভিন্ন জাতির লোকজন একত্রে জড়ো হয়েছেন বিশেষ কোন উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। নেবুল দারুই তাদেরকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। জানতে পারলাম উনারা পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে এসেছেন ঢাকার একটা এনজিওর আমন্ত্রণে। ময়মনসিংহে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষে এরা আজ পীরগাছা মিশনের আমন্ত্রণে থমথমা নামক জায়গায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেছে। আর ঐ দিনেই যেহেতু রংচুগালা চলছে তাই সমতলের অন্য একটি আদিবাসী জাতির নিজস্ব সংস্কৃতির একটা অংশ দেখার লোভ সামলাতে পারেননি। রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি থেকে আগত দলের তরুণ-তরুণীদের সাথে আমাদেরও কুশল বিনিময় হলো। উক্যেনুর বাড়ি বান্দরবান হওয়াতে কাজটা বেশ সহজ হয়ে গেল। বিভিন্ন জনের সাথে কথাবার্তা বলার পরে পরিচিত হলাম এক দীর্ঘদেহী লোকের সাথে। উনার সাথে আলাপ করার পরে টের পেলাম দারুন এক ভদ্রলোক তিনি। পঞ্চাশ পেরোনো মানুষ হলেও মনের জোরটা ছিল তরুণদের মতই। উনাকে মৃত্তিকার নতুন-পুরনো কয়েকটা সংখ্যা দিলাম, উনিও সানন্দে গ্রহণ করলেন। আমার নোটবুকে উনি উনার ঠিকানা মোবাইল নাম্বার লিখে দিলেন। আমারটা চাইলে বললাম মৃত্তিকার ঠিকানায় যোগাযোগ করলেই হবে। বড়বাড়িতে বেশ কিছুক্ষণ কাটানোর পর জনিক আচ্চু পুরো দলকে নিয়ে গেলেন তাঁর বাড়ির নকমান্দি দেখাতে। নকমান্দি হলো মান্দিদের ঐতিহ্যবাহী ঘর। পুরো মধুপুরের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি বাড়িতেই দেখা মেলে এই নকমান্দির। সাংস্কৃতিক দলের ঢাকা যাওয়ার তাড়া ছিল বিধায় উনারা আর দেরি করলেন না। অরুন লেইব্রেসকে বিদায় জানালাম, বললাম পরে যোগাযোগ করব। কিন্তু সেই পরে আর যোগাযোগ করাটা হয়নি। ভেবেছিলাম এবারের ৯ আগস্ট আদিবাসী দিবসে হয়তো দেখা হবে খিয়াং জাতির অরুন লেইব্রেসের সাথে। কিন্তু আদিবাসী দিবস উপলক্ষে সুখেন চাম্বুগং, হেমার্শন হাদিমাদের দাওয়াতে আমরা (পরাগ রিছিল ও আমি) চলে যাই শেরপুরের নালিতা বাড়িতে। জানি না এবারের আদিবাসী দিবসে অরুন বাবু এসেছিলেন কি না। আগের মত প্রাণবন্ত ছিলেন কি না।
১৫ আগস্ট ২০০৭। প্রতিদিনের ন্যায় ঘুম জড়ানো চোখেই দৈনিক পত্রিকা নিয়ে বসে পড়লাম। প্রথম পৃষ্টায় বঙ্গবন্ধু নিয়ে লেখা গুলোয় চোখ বুলিয়ে ভেতরের দিকে যেতেই একটা সংবাদে এসে চোখ আটকে গেল। হ্যাঁ, অরুন লেইব্রেস, ছবির নিচে ছাপানো অক্ষরে তাঁর নাম। অনেকদিন পর অরুন লেইব্রেসের খবর পেয়ে মনটা ভালো হয়ে যাওয়ারই কথা, কিন্তু কেমন যেন অন্যরকম একটা অনুভূতির সৃষ্টি হচ্ছে আমার মগজে। চুনিয়ার প্রতিটি দৃশ্য কয়েক গুণিতক হারে বেড়ে মাথার ভেতর কিলবিল কিলবিল শুরু করে দিয়েছে। অরুন বাবুর সাথে আমারতো মাত্র কয়েক মিনিটের আলাপ-পরিচয় মাত্র, কিন্তু তার পরও ওনার জন্য মনটা অন্যরকম লাগছে কেন। সংবাদের শিরোনাম আমাকে পুরো খবর পড়ার জন্য তাড়া দিচ্ছিল -সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে চলে গেলেন খিয়াং নেতা। প্রথম দুটো লাইন ( কিছুই করে যেতে পারলাম না, আমাকে সবাই ক্ষমা করবেন। নিজ সমপ্রদায়ের কাছে একটি চিরকুটে এভাবে ব্যর্থতা স্বীকার করে আত্মহনণের পথ বেছে নিলেন বাংলাদেশ খিয়াং কল্যাণ সমিতির সভাপতি অরুন লাইব্রেস।) পড়ে কিছুই পরিষ্কার হচ্ছিল না। কিসের ক্ষমা? কিসের ব্যর্থতার দায়ভার একাই বহন করতে চেয়েছেন অরুন লেইব্রেস? মাথা কিঞ্চিত ঠান্ডা রেখে সংবাদ পুরোটা শেষ করলাম। কিছূতেই কিছু মেলাতে পারছিলাম না। নিজের জাতির জন্য অনেক কিছু করতে চেয়েছিলেন অরুন, রাজস্থলীতে খিয়াং ছেলে-মেয়েদের জন্য পরিচালনা করতেন নিজের গড়া খিয়াং হোস্টেল। রাষ্ট্রের সুবিধা বঞ্চিত খিয়াং ছেলে-মেয়েদের থাকা-খাওয়াসহ পড়শোনার দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন নিজের কাঁধেই। ধনুছড়ি, কুক্যাছড়ি মৌজার খিয়াংরা যখন একে একে ভূমি হারানো সহ নানান সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছিলেন তখন তিনিই হয়ে উঠেছিলেন প্রতিটি শো (খিয়াং জাতির লোকজন নিজেদের পরিচয় দেন শো হিসেবে) নারী-পুরুষের ভরসার জন। সরকারি-বেসকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সুশীল সমাজের দ্বারে দ্বারে অরুন নিজেদের ভূমি, নিজেদের সাংস্কৃতিক তথা জাতিগত ঐতিহ্য রক্ষার কথা তুলে ধরেছিলেন বলিষ্ট ভাবে। হয়ত অনেক অপ্রাপ্তি ছিল, কিন্তু প্রাপ্তি কি কিছুটাও ছিল না। জীবনে অপ্রাপ্তি থাকলেই কি মানুষ ব্যর্থ হয়ে যায়? না, আমি কিছুই চিন্তা করতে পারছি না, গত বছর যেই তারুণ্যদীপ্ত অরুন লেইব্রেসের সাথে কথা হয়েছিল সে ব্যর্থ হতে পারেন না। আর ব্যর্থ হলেই বা কি, জীবন যুদ্ধে আমরা ছোট-বড় কেউই কি আসলে ব্যর্থতাকে পাশ কাটিয়ে চলতে পারি। আর এই ব্যর্থতার দায় আপনিই বা কেন নিজের করে নিলেন অরুন? কেউ তো আপনার স্বপ্নের প্রতি আপনার আন্তরিকতা নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলেনি, এর জন্য কোন খিয়াং নারী-পুরুষতো আপনাকে তাদের ভালোবাসার বন্ধন থেকে দূরে ঠেলে দেয়নি। আর যে ব্যর্থতার কথা আপনি বলেছেন সেই ব্যর্থতার দায়তো আপনার নয়। এ দায় কি এই রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রশাসন, ডান-বাম নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সাম্রাজ্যবাদী বিভিন্ন সংস্থা বা আমরা কেউই এড়াতে পারি? না, আমরা কেউই তা পারি না। এই রাষ্ট্র স্বাধীনতার ৩৬ বছরেও তার ভৌগোলিক সীমানার ভেতরে বসবাসরত সকল জাতির অস্তিত্ব পবিত্র সংবিধানে তুলে ধরতে পারেনি, পারেনি বাঙালি ভিন্ন অন্যান্য যে ৪৫ টি বা তারও অধিক জাতিসত্ত্বা রয়েছে তাদের আপন আপন ভূমি-সংস্কৃতি নিয়ে আপন আপন জাতিগত ঐতিহ্যকে ধরে রাখার কার্যকর কোন পদক্ষেপ নিতে। এই রাষ্ট্র পারেনি বাঙালি বাদে অপরাপর জাতির শিশুদের জন্য তাদের নিজ মাতৃভাষায় পড়াশোনার ব্যবস্থা নিতে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শান্তিচুক্তি হলেও পারেনি পাহাড়ের সেই কাঙ্ক্ষিত জলপাই রংহীন শান্তি ফিরিয়ে আনতে। সাম্রাজ্যবাদী সংস্থা সমূহের কোটি কোটি ডলারের উন্নয়ন সন্ত্রাসে লক্ষ লক্ষ মানুষকে ভিটে-মাটি ছাড়া হতে হয়েছে, সামাজিক বনায়ন-উডলট-রাবার বাগানের নামে পাহাড় ন্যাড়া হয়েছে-দখল হয়েছে, সমতলের বনাঞ্চলগুলো হয়েছে প্রায় প্রাণবৈচিত্র শূণ্য। আমরা সমতলের বৃহত্তর জাতির শিক্ষিত লোকজনেরা আপনাদের নিয়ে ভাবার কথাতো কখনো চিন্তাই করতে পারি না। আমাদের কত কাজ! কত ব্যস্ততা! কত কত ধান্দা! তারপরেও আপনারা আমাদেরকে বারে বারে বিশ্বাস করেছেন, বন্ধু হিসেবে কাছে পেতে চেয়েছেন। কিন্তু তার মর্ম আমরা বুঝিনি বা ইচ্ছে করেই বুঝতে চাইনি, কিছু করাতো দূরে থাক। আমরা নাট্যব্যক্তিত্বরা আপনাদের সাথে মেশবার ভান করেছি যাতে রাজধানীর বুকে আদিবাসী নাট্য উৎসবের আয়োজন করে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির একটা অংশ নিজের পকেটে তুলতে পারি। আমরা উন্নয়ন কর্তা-কর্মীরা মেশার চেষ্টা করেছি যাতে আপনাদের উন্নয়নের কথা বলে-আজগুবি সব প্রকল্প হাজির করে-সেমিনার আয়োজন করে-আদিবাসী উৎসব পালন করে দাতা সংস্থার কাড়ি কাড়ি টাকা-পয়সা বাগিয়ে নিতে পারি এই আশায়। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আপনাদের আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিভিন্ন জায়গায় আপনাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জান কবুল করার ভান করেছি ভবিষ্যতে আদিবাসীদের অধিকার-আন্দোলনের কথা বলে এনজিও খুলে বসার ধান্দায়। আমরা বুদ্ধিজীবিরা আদিবাসী দরদী সেজেছি আমাদের জানা-বুঝা-বুদ্ধি দিতে পারার ক্ষমতা কত বেশি তা প্রকাশ করার জন্য। আমরা গবেষকেরা বিভিন্ন সেমিনারে গবেষণা প্রবন্ধ পাঠ করেছি নিজের ক্যারিয়ারকে আরো মজবুত করার আশায়। আমরা ফটোগ্রাফাররা আদিবাসী নারীর নানান ভঙ্গিমার ছবি তুলে প্রদশর্ণী করেছি ফটোগ্রাফার হিসেবে নিজেদের জাহির করার জন্য। আমরা রাজনৈতিক নেতারা আপনাদের জন্য গলাবাজি করেছি নিজেদের অক্ষমতা ঢেকে রাখার জন্য, ইত্যাদি আরো কত কি! কিন্তু কই, এসবের জন্যতো আমাদের কারো কোন অনুশোচনা নেই, লজ্জা নেই, আমরা কেউইতো মানুষের জন্য কিছু করতে না পারার যন্ত্রনায় সামান্যতম কাতর হইনি; আত্মহনন সে তো অনেক দূর। কিন্তু এই রাষ্ট্র, সাম্রাজ্যবাদী সংস্থা সমূহ, এত এত মানুষ জনের ব্যর্থতার দায়ভার আপনি কেন নিবেন? আপনিতো তাও অনেক কিছু করেছেন, আরো বেশি বেশি করার আকাঙ্খাকে ধারণ করেছিলেন। আপনিতো নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে নেমেছিলেন, তাহলে কেন এতটা অভিমানী হয়ে উঠলেন অরুন ? আপনিতো বেশ ভালো করেই টের পেয়েছিলেন এই রাষ্ট্র, সাম্রাজ্যবাদী সংস্থা ও এর দালাল রাষ্ট্রের সুশীল সমাজ-রাজনীতিক-শিক্ষিত- বুদ্ধিজীবি- শিল্পী- সাহিত্যিকসহ নানান ঘরানার মানুষজনের নানানমুখী স্বার্থবাদীতার বিষয়গুলো। এই স্বার্থবাদীতার জাল ছিঁড়ে ফেলার জন্য আপন আপন জাতির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে আপনার এগিয়ে চলায় কি শক্তি পেতেন না খিয়াং জাতির লোকজনেরা। আপনি কেন এত অভিমান করে মুখ লুকোলেন? শো নারী-পুরুষেরা কার কাছে রুখে দাঁড়াবার, লড়াই করার প্রেরণা খুঁজবেন ? আমি জানি না অরুন, বিশ্বাস করেন আমি কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারছি না। আমি বিশ্বাস করতে চাই, অরুন লেইব্রেস মারা যাননি, সংগ্রামী মানুষের কোন মরন হতে পারে না। আর কিছু দিন পরেই মান্দি গ্রামগুলোতে শুরু হচ্ছে রংচুগালা। জনিক আচ্চু হয়ত সেপ্টেম্বরের শুরুও দিকের কোন ভোরে মোবাইল করে রংচুগালার তারিখ জানাবেন। আমিও হয়ত এক সকালে মায়ের কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিয়ে নারায়ণগঞ্জ থেকে রওনা দিয়ে রংচুগালার আগের সন্ধ্যায় হাজির হব চুনিয়াতে। রংচুগালার দিন খামাল আসবেন। আদুরি, দামা, রাং এর তালে তালে বাড়ি বাড়ি রুগালা হবে। বচনদাকে নিয়ে বড়বাড়ির বারান্দায় চু খেতে খেতে পথ চেয়ে থাকব কোন আগত অতিথি দলের আশায়। আবার মুখরিত হবে শালবনের কোড়কে প্রয়াত পরেশ মৃ-র পুরো নানান প্রজাতির ফুলে ফুলে ভরা উঠোন। অতিথি দলের তরুণ-তরুণীদের সাথে পরিচিত হতে হতে দেখা পাব অরুন লেইব্রেসের। সেই প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা হাসি মাখা মুখে আপনি বলে উঠবেন- না, আমি আত্মহনন করিনি, আমি তা পারি না, কেননা আমি সংগ্রামী, আপন জাতির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে আমি আছি, সর্বদাই থাকব।
Thursday, August 30, 2007
Tuesday, August 21, 2007
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতিগত ভাবনা ও বাস্তবতার সহজ পাঠ
জুয়েল বিন জহির
১. রাষ্ট্র তুমি কার ?
রাষ্ট্র তুমি কার ?? রাষ্ট্র তুমি কার ???...
একটা কাগজে কলমে স্বীকৃত বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্রে বসবাসরত বেবাক সচেতন নাগরিকের পক্ষেই কাগুজে ভাষারীতিতে এর উত্তর দিতে পারা তেমন কোন কঠিন বিষয় না। যে কেউ, যে কোন প্রান্ত থেকে সমস্বরে গলা মেলাবেন -জনগণের। এখন এই জনগণের ভেতর কারা পড়েন ? রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমানার ভেতরে লিঙ্গ, বয়স, ধর্ম-বর্ণ, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিগত দিক নির্বিশেষে সকল মানুষই এর আওতাভূক্ত; এই বিষয়েও কারো কোন অস্পষ্টতা নেই। তবে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অস্পষ্টতা অবশ্যই রয়ে গেছে অথবা বলা যেতে পারে অবচেতন বা সচেতন ভাবেই এই দিকটির প্রতি গুরুত্ব দিতে নারাজ এই রাষ্ট্রের প্রায় পচাঁনব্বই ভাগেরও অধিক মানুষ যার ভেতরে রয়েছেন প্রগতিশীল-বুর্জোয়া-প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক সচেতন শাসকগোষ্ঠী-শিল্পী-সাহিতি্যক-বুদ্ধিজীবি-সুশীল সমাজ সহ হরেক অভিধার হরেক ঘরানার মানুষজন। আর এই বিষয়টি হচ্ছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতিগত পরিচয়। ব্যাপারটা একটু খোলসা করে বলা যাক। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মালিক বলা হয়ে থাকে জনগণকে। সেই হিসেবে-বাংলাদেশ-নামক রাষ্ট্রের মালিকও হবেন জনগণ, অতি সহজ সাধারণ একটা ব্যাপার। এখন যদি প্রশ্ন করা হয়, কোন জনগণের বা জনগণের জাতিগত রূপটা কি? উত্তর আসবে বাঙালির, রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে কেউবা বলবে বাংলাদেশী। হ্যাঁ, একদম সত্যি কথা, সংবিধান বিশেষজ্ঞ থেকে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, শাসকগোষ্টী থেকে শোষিত সমাজের প্রতিনিধি, ডান-বাম-আধাবাম-বুর্জোয়া-প্রতিক্রিয়াশীল নির্বিশেষে বেবাকই গর্ব ভরে একই উত্তর দিতে অভ্যস্ত। আমরা সকলেই জানি বাঙালি জাতি কয়েকশত বছর ধরে নানান আত্মত্যাগের ভেতরে নির্মাণ করেছে কাঙ্খিত এক জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের। দেশের যেকোন নাগরিকেরই এ এক বুক ফুলানো ব্যাপার। একে খাটো করে দেখার মতন কোন ব্যাপার নেই। কিন্তু সমস্যা তারপরেও রয়ে যায়, আসলেই কী বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির মালিক কেবলই এদেশের বাঙালি জাতিভূক্ত জনগণ ? যদি তা না হয় তাহলে বাঙালি বাদে অপরাপর জাতি সমূহের অস্তিত্ব নেই কেন সংবিধানের কোন একটি পৃষ্ঠার কোন একটি লাইনে, পচাঁনব্বই ভাগ জনগণের মগজে, তাদের উপস্থাপন রীতিতে ? কেবল সংখ্যার বিবেচনাতেই কী আধুনিক এই রাষ্ট্র তার জাতিগত পরিচয় দেওয়ার ক্ষেত্রে কোন একক জাতির একক আধিপত্যকেই বৈধ করে তুলবে, প্রতিষ্ঠিত করে তুলবে ? মিথ্যার বেসাতি দিয়ে আড়াল করে ফেলবে ওঁরাও, সাঁওতাল, মুণ্ডা, রাজোয়ার, লহরা, হাড়ি, দোসাত, পাহাড়িয়া, রবিদাস, চাকমা, মাংতা, রাখাইন, শিং, মাহাতো, মৈতৈ, লালেং, বিষ্ণুপ্রিয়া, রাজবংশী, বর্মণ, খাসিয়া, ত্রিপুরা, ডালু, কোচ, মান্দি, খিয়াং, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, খুমী, চাক, হাজং প্রভৃতি জাতিসমূহের অস্তিত্ব? একক জাতির একক আধিপত্য পাকাপোক্ত করতে আর সব জাতি সমূহকে -উপজাতি- বানিয়ে ফেলতে হবে? ইসলামকে যখন সংসদে আইন পাসের মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হলো তখন কী একবারের তরেও চিন্তুা করা হয়েছিল সাংসারেক, সারণা, ক্রামা, বৌদ্ধসহ একেক জাতির আপন আপন ধর্মের কথা, তাদের আপন আপন বিশ্বাসের কথা? এই রাষ্ট্র বৃহত্তর জাতির (সংখ্যার বিবেচনায়) প্রার্থণালয়ের জাতীয় স্বীকৃতি (জাতীয় মসজিদ-বায়তুল মোকারম) দিলেও অপরাপর জাতি সমূহের সারণা, মিদ্দি আসং, গোয়ারি, জাহের থান, চিগা সমূহকে জাতীয় স্বীকৃতি দূরের কথা এদের অস্তিত্বের খবরই রাখেনি বা রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি। বরং এই রাষ্ট্রের অধিপতি জাতির আরাম-আয়েশ সহ নানান প্রয়োজনে নানান প্রকল্পের ভেতরে রাষ্ট্রের অনুচ্চারিত হদি, মাহালি, ভূইমালি, ওঁরাও, সাঁওতাল, মুণ্ডা, রাজোয়ার, হাড়ি, দোসাত, পাহাড়িয়া, রবিদাস, চাকমা, মাংতা, রাখাইন, শিং, মাহাতো, মৈতৈ, লালেং, খাসিয়া, ত্রিপুরা, ডালু, কোচ, বিষ্ণুপ্রিয়া, মান্দি, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, খুমী, খিয়াং, চাক জাতিসমূহের বসতভিটা-হাবা-জুম-জাহেরথান-সারণা-গোয়ারি-মিদ্দি আসং-চিগা কখনো তলিয়ে যায় উন্নয়নের বিশাল জলরাশিতে, বন্দি হয়ে যায় ইটের দেয়ালে-চিড়িয়াখানায়-কাঁটাতারের বেড়ায়, কখনোবা পুড়ে ছারখার হয়ে যায় উন্নয়নের দাবানলে, দখল হয়ে যায় প্রভাবশালীদের মারদাঙ্গা প্রভাবের কাছে। এই রাষ্টের নগরে-বন্দরে-শহরে-বিদ্যাপীঠের ভাস্কর্য হিসেবে ফুটে উঠে কত সংগ্রামী যোদ্ধাদের মুখ; কেবল ভেসে ওঠে না রাশিমনি হাজং, কল্পনা চাকমা, পীরেন স্নাল, গীদিতা রেমা কিংবা আলফ্রেড সরেনদের তেজস্বী চাহনিগুলো। এই রাষ্ট্র কত ভাবেই না একক জাতির নিরঙ্কুশ দাপটকে বজায় রাখতে সচেষ্ট। গতবছরের (২০০৬) ১২ এপ্রিল খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক হুমায়ুন কবির কতৃক খাগড়াছড়ি ২০০১-২০০৫ শিরোনামের পুস্তিকাতে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাদের খাগড়াছড়িতে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে বলার মতন উদ্ধত্য দেখানোর পরও রাষ্ট্রযন্ত্রের নিশ্চুপতা কী একেবারেই বিচ্ছিন্ন কোন ব্যাপার? রাষ্ট্রের এই নিশ্চুপতায় কেবলই সংশয় জাগে, প্রশ্ন জাগে মনে - রাষ্ট্র তুমি কার? শুধুই বাঙালি জনগণের?
২.সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার ঠিকাদার রাষ্ট্রের উন্নয়ন সন্ত্রাস ও বিপন্ন জাতির মানুষেরা
আমার ঘরের চাবি পরের হাতে
আমি কেমনে খুলিয়ে সে ধন
দেখব চক্ষেতে;
আপন ঘরে বোঝাই সোনা
পরে করে লেনাদেনা...।
ফকির লালন শাহ্
তামাম দুনিয়া জুড়ে কেবলই একই ধুয়া-উন্নয়ন (!), উন্নয়ন (!) আর কেবলি উন্নয়ন (!)। উন্নয়নের তাণ্ডব দাবড়ে বেড়াচ্ছে ধনী-গরীব, ছোট-বড় নির্বিশেষে দুনিয়ার সকল দেশের সকল জনপদের, আকাশ-মাটি, পাহাড়-সমতল, বনাঞ্চল, মরুভূমিসহ সকল প্রতিবেশের সকল কিছুকেই; বিশেষ করে ৯০ এর দশকের পর ভারতবর্ষসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশে মার্কিন শাসিত নয়া অর্থনীতি প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকে। মার্কিন শাসিত এই নয়া অর্থনীতি বাজারের উন্মুক্তকরণ, সম্পদের বেসরকারিকরণ ও পণ্য সংস্কৃতির বিশ্বায়ন অপেক্ষাকৃত দূর্বল দেশগুলোর উপর চাপিয়ে নিজের এককাধিপত্ব বজায় রেখেছে মূলত উন্নয়নের মূলো ঝুলিয়েই। এই উন্নয়ন হুজুগে সাড়া দিয়ে বা সাড়া দিতে বাধ্য হয়ে আমাদের মত গরীব দেশগুলো বিশ্বব্যাপী পূঁজি সঞ্চয়ের একমুখীনতাকেই নিশ্চিত করেছে। আর পূঁজির এই একমুখীনতা যে মানুষের অধিকারচ্যুতির মধ্য দিয়েই সম্পন্ন হয় তা আজ আর কারও অজানা নয়। মার্কিন শাসিত এই নয়া অর্থনীতিতে পূঁজির যে একচেটিয়া ব্যবস্থা তার সাথে ঘনিষ্ট লেনাদেনা গড়ে ওঠে কর্পোরেট পূঁজির। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের উন্নত দেশগুলো গরীব ও কম উন্নত দেশ সমূহের অর্থনীতি ও রাজনীতির উপর নিজেদের দাপুটে অবস্থানকে টিকিয়ে রাখতে বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন নতুন কৌশল বাতলানোর দায়িত্ব তুলে দেয় কর্পোরেট সংস্থাসমূহের উপর। সারাবিশ্বের তালিকাভূক্ত বাঘা বাঘা ৫০০ কর্পোরেট সংস্থার মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই রয়েছে ১৮৫টি। আর মার্কিন শাসিত এই কর্পোরেট সংস্থাগুলো নিয়ন্ত্রন করছে বিশ্বের ৭০ শতাংশ বাণিজ্য ও ৮০ শতাংশ বৈদেশিক বিনিয়োগকে। অপরদিকে কর্পোরেট দুনিয়ার রক্ষাকর্তা বা পাহারাদার বা তত্ত্বাবধানের মহান দায়িত্ব পালন করে চলেছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ (IMF) আর বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (WTO) মত শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলো। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের সাথে গাঁটবাঁধা এই কর্পোরেট পূঁজি তার ধুন্দুমার বাণিজ্যিক লুটপাট চালাতে গিয়ে সর্বদাই সামনে রাখছে নানারকম উন্নয়ন মডেলকে। মার্কিন শাসিত কর্পোরেট পূঁজির একচেটিয়া ব্যবস্থাকে আরো হৃষ্টপুষ্ট করতে গিয়ে তাদের উদ্ভাবিত নানান উন্নয়ন মডেল বাস্তবায়ন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ক্ষমতাহীন মানুষের নিকট উন্নয়ন সন্ত্রাস হিসেবেই দেখা দিয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী কর্পোরেট দুনিয়ার কাছে আত্মসমর্পিত রাষ্ট্রগুলোর বুর্জোয়া শাসকেরা বরাবরই উন্নয়ন সন্ত্রাস পরিচালনার জন্য প্রথমেই বেছে নিয়েছে সেসব দেশের বৃহত্তর জাতি বাদে অন্যান্য জাতি অধ্যূষিত এলাকা সমূহকে। ফিলিপাইনের আম্বুলং, ব্রাজিলের ফোর্টএলিজার তাতাজুবা, প্রেইন্হা ডো কেন্ডু বারদি, বতসোয়ানা, বুরুন্ডির সিবিতোকি, লাওসের নাকাই, মালয়েশিয়ার পেনান, আর্জেন্টিনার মিসিওনেস, পেরুর ক্যাজামারকা প্রভৃতি অঞ্চলের অধিবাসীদের সামনে বিভিন্ন সময়ে বনায়ন, কয়লা-তেল-গ্যাস উত্তোলন, ইকোপার্ক, রিজার্ভিয়র কত নামে কত বড় বড় উন্নয়ন মডেল নিয়েইতো হাজির হয়েছিল কর্পোরেট বেনিয়ারা। তুপিনিকিন, বায়া গুয়ারনি, ফিলিপিনো, খি, জ, দাইয়াক প্রভৃতি জাতি সমূহের মানুষজন বুঝেছেন উন্নয়ন মানে কয়লা-তেল-পর্যটন-অবকাশ-গ্যাস-কাঠ-পরিবেশ সংরক্ষণ বাণিজ্যে প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছা লুটতরাজ আর নিজেদের বসত-পাহাড়-বন-সৈকত থেকে নিরন্তর উচ্ছেদ-গুলিবর্ষণ-গুম-গণহত্যাসহ নির্যাতন-নিপীড়ন-উৎপীড়নের আরো কত কি কায়দা কানুন ! রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠীর আস্কারায় নাইজেরিয়াতে Shell, Agip, Mobil, Texaco, Chevron প্রভৃতি কোম্পানিগুলোর উন্নয়ন তাণ্ডবইতো কবি নিমো বেসিকে লিখতে রসদ যুগিয়েছিল, “Dried tear bags/ polluted streams/ things are real/ when found in dreams/ we see their Shells/ behind military shields/ evil, horrible, gallows called oilrigs/ drilling our souls./ We thought it was oil/ but it was blood.” আর এই ধরনের উন্নয়ন তাণ্ডবের বহুমাত্রিক উপস্থিতিতে আজ আমাদের বাংলাদেশেও বিপন্ন, বিপর্যস্ত অবস্থায় সংবিধানে অনুল্লেখিত বাঙালি ভিন্ন ৪৫টিরও অধিক জাতি।
পাকিস্তান আমলে এতদাঞ্চলের বাঙালি জনগণের ঘরে ঘরে বিদ্যূতের আলো বিলিয়ে দেওয়ার উন্নয়ন যজ্ঞে ১৯৫৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি ও ইউতে ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি ইউএসএইড-র আর্থিক যোগানে পাঁচবছর ধরে কর্ণফুলি নদীতে বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করে। তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে সাম্রাজ্যবাদী কোম্পানি সমূহের এই বিজলি সন্ত্রাস রাঙামাটি জেলার চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা প্রভৃতি জাতির লোকজনকে চরম অন্ধকারে ঠেলে দেয়। রাষ্ট্রের উন্নয়ন জোয়ারে ভেসে সেসময় প্রায় একলাখ মানুষ বসত, কৃষিজমি (প্রায় ৫৪ হাজার একর) হারিয়ে উদ্বাস্তু হিসেবে দেশত্যাগে বাধ্য হন।
বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ সাম্রাজ্যবাদী সংস্থাসমূহ পরিবেশীয় সম্পদ লুটপাট ও বিনাশের এক নতুন তরিকা নিয়ে হাজির হয়েছে। এই নতুন তরিকার নাম হচ্ছে, ইকোট্যুরিজম। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার সূত্রে জানা যায়, ২০০২ সালে ইকোট্যুরিজম নাকি অস্ত্র ও আইটি সেক্টরের পরে বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ ইন্ডাস্ট্রি হিসেব বিশ্ব অর্থনীতিতে জায়গা করে নিয়েছে। আর বলাই বাহুল্য এই ইন্ডাস্ট্রিগুলোর বেশির ভাগই গড়ে তোলা হয়েছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে। এক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার উদ্দেশ্যও বেশ পরিষ্কার, পেটেন্ট বা ছিনতাইকর্মের মাধ্যমে দুনিয়ার তাবৎ প্রাণসম্পদের উপর নিজেদের নিরঙ্কুশ মালিকানা প্রতিষ্ঠার পথকে আরো সহজতর করে তোলা। আর সভ্য (!) দুনিয়ার এইসব সভ্য (!) চোরদের গায়ে তেলমাখানো, পথ বাতলানো বা অন্যান্য সব রকম সহযোগিতার জন্যতো আত্মসমর্পিত রাষ্ট্রের শোষক শ্রেণী, কর্পোরেট পূঁজির জরায়ুজাত এনজিও সমূহের হরকসম গবেষণা-প্রকল্প রয়েছেই। আমাদের দেশে এই ইকোট্যুরিজম হুজুগ আসে বিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষ দিকে। বাংলাদেশ সরকার ফরেস্ট কনজারভেশন ও ইকোট্যুরিজম স্কীমের আওতায় ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে দেশের প্রথম ইকোপার্ক এলাকা হিসেবে সীতাকুণ্ডকে বেছে নিলেও এরপর একে একে হাত বাড়াতে থাকে খাসিয়া ও মান্দি অধ্যুষিত মৌলভীবাজারের মাধবকুণ্ড-মুরইছড়ার (১৪৮৭ একর), মান্দি অধ্যুষিত টাঙ্গাইল শালবন (৩০০০ একর), ম্রো প্রধান চিম্বুকের (৫০৫০ একর) এলাকাতে। স্থানীয় আদিবাসীদের সাথে কোনরকম পরামর্শ ব্যতিরেকেই সরকার এইসব প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্যোগী হলে প্রায় সব এলাকা থেকে সঙ্গত কারণে প্রতিরোধের আওয়াজ ওঠে। মৌলভীবাজারে ইকোপার্ক বাস্তবায়নের কাজ বন্ধ হওয়ার পর সরকার হাত বাড়ায় মধুপুরের শালবনকে ধ্বংস করার খেলায়। অবশ্য আদিবাসী বসবাসকারী বনাঞ্চলগুলো নিয়ে রাষ্ট্রের নানান হঠকারী সিদ্বান্ত এটাই প্রথম নয়। আমরা মধুপুর বনেই দেখেছি বিশ্বব্যাংক আর এডিবির টাকায় উন্নয়নের কথা বলে কখনো রাবারের মনোকালচারের নামে, কখনো সোস্যাল ফরেষ্ট্রি ও উডলটের মাধ্যমে কিভাবে শালের কপিছ মাটি খুঁড়ে তুলে ফেলার সাথে সেখানকার মান্দি-কোচ-বর্মণদেরও শেকড়চ্যুত করা হয়েছিল। যে রাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদী সংস্থার উদ্ভাবিত উন্নয়নের দোহাই দিয়ে রাবার বাগান, উডলটের মত বন বিধ্বংসী প্রকল্প আর বনবিভাগের অবাধ লুটপাটের ভেতর দিয়ে ধ্বংসের শেষ কিনারায় নিয়ে এসেছে তারাই যখন আবার বনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণসহ বন উন্নয়নের কথা বলেন সেটা তখন বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। বনের যে আদি বাসিন্দারা বনের প্রাণবৈচিত্রকে রক্ষার জন্য বিভিন্ন পূজা, আমুয়া পালন করেন; বনের বিভিন্ন জায়গায় যেখানে তাদের মিদ্দি আসং (দেবতাদের জায়গা) সেই বন তাদের কাছে কোন বাণিজ্যের বিষয় নয়, বরং তা নিজেদের জীবনধারণ ও বিশ্বাসের গভীর সংযোগ। দীর্ঘদিনের এই বনকেন্দ্রিক জীবনধারন পদ্ধতি আর বিশ্বাসের বিকল্প উপায় কখনো ৭ফুট উচ্চতার ৬১ হাজার ফুট ইটের দেয়াল এবং ভেতরে ১০টি পিকনিক স্পট, ২টি ওয়াচিং টাওয়ার, ২টি কালভার্ট, ৩টি কটেজ, জলাধার সহ লেক ৯টি, রেষ্ট হাউজ ৬টি, রাস্তা নির্মাণ ৬টি, বন কর্মীদের ৬টি ব্যারাক নির্মাণ হতে পারে না। বলাফাল, আসংদেনা আমুয়ার বিকল্প হতে পারে না পিকনিক পার্টির আনন্দ ভ্রমন। আর আদিবাসী এলাকাগুলোতে দেয়াল, কাটা তারের বেড়া, সংরক্ষিত এলাকার আসল মাহাত্ম কি তার জন্য দামিনিকোহ, দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলের নজিরতো রয়েছেই। ২০০৪ সালের ৩ জানুয়ারি নিজেদের হাবিমাতে নিজেদের অস্তিত্ব, হাবিমার প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার জন্য পীরেন স্নালের আত্মদান, উৎপলসহ অন্যান্যদের ত্যাগ আর সংগ্রামে তখনকার মত দেয়াল নির্মাণের কাজ বন্ধ করা হলেও সেই প্রকল্প বাতিল করা হয়নি। বিগত রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতা ছাড়ার পর বনবিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসন আবারো সক্রিয় হয়ে উঠে প্রকল্প বাস্তবায়নে। জরুরী অবস্থার ভেতরে গত ১৯ জানুয়ারি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যস্ত টহলের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের দেয়াল নির্মাণ মার্কা উন্নয়নে আবারো বসত-কৃষিজমি সহ বনে অবাধ বিচরণের অধিকার হারানোর আতঙ্কে সন্ত্রস্ত অবস্থায় রয়েছেন হাবিমার সন্তানেরা। যে উন্নয়ন রাবার বাগান, উডলট, ফায়ারিং রেঞ্জ, পিকনিক স্পট, লেক, ওয়াচিং টাওয়ার, চিড়িয়াখানার নামে বারে বারে মায়ের কোল থেকে সন্তানকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, যে উন্নয়ন সন্তানের সামনে মাকে ধর্ষণ করে সে আবার কেমন উন্নয়ন ? শালবনের মান্দি-কোচ-বর্মণদের, শেরপুরের মান্দি-হাজং কিংবা চিম্বুকের ম্রোদের এমন সহজ প্রশ্নের উত্তর কি জানা আছে এই রাষ্ট্র্রের ?
দিনাজপুরের ফুলবাড়ি, পার্বতীপুর, নবাবগঞ্জ এলাকার ৬৭টি গ্রামের সাঁওতাল সহ অন্যান্য আদিবাসী জাতি সমূহের প্রায় একলাখ মানুষ আজ চরম অনিশ্চিয়তায়। ফুলবাড়িতে যুক্তরাজ্যের এশিয়া এনার্জি কোম্পানি ৯ হাজার ২৫০ কোটি টাকা নিয়ে এসেছে নতুন ফন্দি নিয়ে। যে মায়ের বুকে আদিবাসী সন্তানেরা হেসে-খেলে, নেচে-গেয়ে, শঙ্কায়-সংগ্রামে বসত-কৃষি-জাহেরথানে কর্ম, বিশ্বাস আর বর্ণাঢ্য আচারে জীবনের গতিময়তাকে জিঁইয়ে রেখেছেন সেই মায়ের বুকে ডিনামাইট ফাটিয়ে হৃৎপিণ্ডের ভেতর থেকে কালো মানিক বের করে আনতে চায় এশিয়া এনার্জি। বিশ্বের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে এই সব কালো মানিকের নাকি ব্যাপক চাহিদা, অনেক মুনাফা(!)। যে মায়ের বুক উজাড়করা ভালবাসায় বেড়ে উঠেছেন আদিবাসী সন্তানেরা তারা কিভাবে এটা মেনে নেবেন? তথাকথিত সভ্য (!) জগতের মানুষদের এ কোন ধরনের সভ্যতা? কোটি টাকার গাড়ি, কাড়ি কাড়ি অর্থের বিনিময়ে শাসকেরা কোন মাকে যখন উন্নয়নের দোহাই দিয়ে অন্যের হাতে তুলে দেয় তখন এর চেয়ে বড় সন্ত্রাস দুনিয়ায় আর কি হতে পারে ? এর চেয়ে বড় অসভ্যতাই বা আর কি আছে ?
মাগুড়ছড়া বনে যে খাসিয়ারা তাদের মাকে সর্বদা পলাশ-শিমুল-গর্জন-জারুল-হিজল-কদম-মেহগনিসহ নানা লতাপাতায়-ফুলে-ফলে সাজিয়ে শালিক-টিয়া-ময়নার-কোকিল-দোয়েলের গান শুনিয়ে খুশি রাখত, বিদেশি অক্সিডেন্টাল কোম্পানি (বর্তমানে শেভরন কোম্পানি এ ব্লকের দায়িত্বপ্রাপ্ত) ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন সেই মায়ের সকল রূপ-সৌন্দর্যকে ঝলসে দিয়েছে উন্নয়নের দাবানলে। উনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের প্রথম ভাগে সিলেটের লালেংদের জননীভূমিকে বেআব্রু করেই একে একে খাদিমনগর, কেয়াছড়া, কালাগুল, পুুঁটিছড়া ইউরোপীয়দের চা বাগান গড়ে উঠেছিল। রাষ্ট্রের কথা বাদই থাক, তামাম দুনিয়ার কি এমন ক্ষমতা আছে মায়ের এমন বেআব্রু, সৌন্দর্য্যহানি, শরীর ঝলসে দেয়ার ক্ষতিপূরণ দেবার?
পুরো পরিবার জুংলি-ঝান্টা-ওছা-বীণ-শিঙ্গা-দাড়াইস-কালিপানো-সুতানালি-দুধরাজ-জাইত-গোখরা-আলাজ-বীণরাজ-পাতরাজ-টুনটুনি-কালিনাগ-অজগর নিয়ে বসবাস করবার মতন ছোট্ট একটা নৌকা হলেই যথেষ্ট। ঢেউয়ের তালে ছইয়া নৌকায় ভেসে ভেসে শেলুং-বাইলা-পুঁটি-টেংরা-বোয়াল-শুশুকের সাথে খুনসুটি করতে করতে পাড়ি দেন ধলেশ্বরী-বুড়িগঙ্গা-তুরাগ-বংশাই-শীতলক্ষ্যা-মেঘনা-পদ্মা-আত্রাই-যমুনা-সুরমাসহ কত নদী-নালা-খাল-বিল! অর্থসম্পদ না থাকলেও বিচরণের স্বাধীনতাকে উপভোগ করেন নিজেদের মত করে। কিন্তু এই রাষ্ট্র যেখানে সবাইকেই উন্নয়নের বেড়াজালে বন্দি রাখতে চায় সেখানে মাংতাদের স্বাধীন থাকার এই দুঃসাহস কি মেনে নেয়া যায়? রাষ্ট্র জানাল, জনগণের জন্য আধুনিক ও উন্নত সমাজ গঠন করতে হবে। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে কথা! কিন্তু এই আধুনিক আর উন্নত সমাজের মাপকাঠিটা কি? রাষ্ট্র তখন বৃটিশ সংস্থা Department For International Development (DFID) এর কথাটাই হুবহু আওড়ে গেল- নগরায়ন, হ্যাঁ, একমাত্র নগরায়নই হলো আধুনিক ও উন্নত সমাজের মাপকাঠি। ব্যস, এই ঘোষণার মধ্য দিয়েই শুরু হয়ে গেল দেশি-বিদেশি ফাটকা পূঁজির নগরায়ন বাণিজ্য। বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা-কীর্তণখোলা-ধলেশ্বরী-মেঘনা দখল করে রিভার ভিউ, খাল ভিউ কত প্রকল্প জমজমাট হয়ে গেল দুদিনেই। আর ইয়াংসা বাজার-হাঙ্গার ডেইল-ডেইল পাড়া-রাজারছড়া-বাহারছড়া-ইনানী বিচ-জাফলং এর ঝিরি-ছড়া-ঝরনায় বিস্ফোরেকের আঘাতে প্রকৃতি মায়ের বুক ক্ষত-বিক্ষত করে কোয়ারি বানিয়ে সেখান থেকে ট্রাকে ট্রাকে পাথর আসতে লাগল নগরায়নের মজবুত ভিত্তি গড়তে। নদীখেকো, খালখেকো, বিলখেকো, লেকখেকো, হাওরখেকো কত প্রতিষ্ঠান, কত প্রকল্প, কত ব্যক্তি নগরায়নের মোড়ে মোড়ে ফুলেফেঁপে উঠলো! আধুনিক হয়ে উঠলো! সভ্য বনে গেল! ভেতরের পঁচা-গলা কত রক্ত-পূঁজ আড়াল করে ফেলল নগরের কংক্রীটের দেয়ালে! কিন্তু বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা-কীর্তণখোলা-কর্ণফুলী-মেঘনা-তুরাগ, সিলেট-বান্দরবান-উখিয়া-টেকনাফের ঝিরি-ছড়া-ঝরনা-ডাইং-বাইলা-পুঁটি-টেংরা-বোয়াল-শুশুকের সাথে মাংতা-ম্রো-মারমা-ত্রিপুরা-চাকমা-বোম-লুসাই-খাসিয়াদের সম্মিলিত আর্তনাদকে কি ঢেকে রাখতে পেরেছে ? আধুনিক ও উন্নত নগরের ব্যস্ত কোলাহলের মধ্যে সেই সম্মিলিত আর্তনাদতো অবিরত বলেই চলেছে- আমরা উন্নত হতে চাই না, আমরা আগে বাঁচতে চাই, আমরা বাঁচতে চাই...।
৩.বহুমাত্রিক মনস্তাত্ত্বিক আগ্রাসন কব্জা করে ফেলতে চায় মানুষের সবকিছু
“কুঞ্জের ঘারকার
বুড়হা বুড়হি
আজো বন্দী
বাপ দাদা চৌদ্দ পুরুষ
মানকা আওধি।”
[(ভাবার্থ ঃ এই গৃহের আদি দেবতা/বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা যাকে বন্দনা করেছে/আমরাও তাদের বন্দনা করছি;/পূর্বপুরুষেরা যাকে মেনে এসেছে/আমরাও তাকে মেনে এসেছি) ওরাওঁদের সোহরাই পূজায় গৃহদেবতাদের উদ্দেশ্যে পাঠ করা মন্ত্রের অংশ বিশেষ]
আমাদের এই ভূখণ্ডের আদিবাসী জাতিসমূহ তাদের আপন আপন সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদকে আগলে রেখেছেন যুগ যুগ ধরে। বংশপরম্পরায় চর্চার ভেতর দিয়ে এইসব সংস্কৃতি একেকটি জাতির আপন আপন মনস্তত্ত্ব গড়ে তুলেছে, ঋদ্ধ করেছে স্বতন্ত্র্যভাবেই সেই উপনিবেশিক আমল থেকেই মানবতাবাদী এইসব মনস্তত্ত্বকে গিলে ফেলতে সচেষ্ট ছিল শাসক গোষ্ঠীর দখলদারি মনস্তত্ত্ব। শাসকগোষ্টী বেশ ভালো করেই জানেন কোন জাতির আপন মনস্তাত্ত্বিক জগতকে বশে না আনতে পারলে শোষণ প্রক্রিয়ায় গতি সঞ্চার করা যাবে না। অতএব যত তাড়াতাড়ি পারো অধস্তন জাতিসমূহের আপন আপন মনস্তত্ত্বকে সম্ভাব্য সকল উপায়ে নিজের আয়ত্বে রাখার চেষ্টা করো। উপনিবেশিক আমলে শাসকগোষ্ঠী সম্ভাব্য সকল উপায়েই এইসব জাতি সমূহের আপন মনস্তত্ত্বকে দখলে সচেষ্ট ছিল; যার মধ্যে অন্যতম এক প্রক্রিয়া ছিল জাতি সমূহের নিজ নিজ বিশ্বাসের হরণ। ভিনদেশী শাসকেরা শোষণের হাতিয়ার হিসেবেই তাদের আপন বিশ্বাসকে এতদাঞ্চলের প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথমেই বেছে নিয়েছিল আদিবাসী অধূষ্যিত অঞ্চলগুলোকে। শিক্ষা, চিকিৎসাসহ কত সেবামূলক কর্মকাণ্ডের আড়ালে দখল করে নিয়েছে মান্দি, খাসিয়া, লুসাই, সাঁওতাল, ওঁরাওদের আপন আপন বিশ্বাসের জায়গাটিকে- যে বিশ্বাস গড়ে উঠেছিল হাজার হাজার বছরের জীবনাচারের মধ্য দিয়ে। গলাটিপে হত্যা করেছে বিভিন্ন বিশ্বাস কেন্দ্রিক নিজস্ব সংস্কৃতির স্বতস্ফূর্ত প্রবাহকে। কি এমন অপরাধ ছিল এই সব সহজ-স্বাভাবিক মনস্তত্ত্বের অধিকারী জাতিসমূহের মানুষের, সেবার নামে কেন তাদের বিশ্বাসকে লুণ্ঠন করে নিতে হবে? সাংসারেক, সারণা, লালেং, ক্রামা, বিষ্ণুপ্রিয়া ধর্মাবলম্বীরাতো কখনো আপন বিশ্বাসকে অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়ার জন্য কারো দ্বারে দ্বারে যান নি। বিশ্বাসতো কখনো চাপিয়ে দেওয়ার জিনিস হতে পারে না, এতো ধারণ করার ব্যাপার- এমন সহজ চিন্তার অধিকারী যারা, তাদের গয়রা-পত্যেন-কালকামি-উ ব্লাই নাংথউ-উ ব্লাই মংতু-সিংবোঙ্গা-গড়াই ঠাকুর-সালজং-সারণা দেবীদের কেন নির্বাসনে পাঠাতে হবে? জনিক নকরেক, রজনী কান্ত সাংমা, টুকিয়া রেমা, দীনেশ নকরেক, জগদীশ চন্দ্র সিং, সমের মাহাতোদের এমন প্রশ্নের জবাব দিবে কে?
উপনিবেশিক বৃটিশ ও পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর মনস্তাত্ত্বিক আগ্রাসন নীতি অপরিবর্তিত থেকে যায় বাঙালি জাতির নেতৃত্বে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পরও। ১৯৭২ সালেই সবাইকে বাঙালি হয়ে যাওয়ার জন্য শাসকগোষ্ঠীর আহ্বান সত্যিই অবাক করেছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম সহ দেশের অন্যান্য জাতির মানুষদের। সংবিধানে আদিবাসী জাতিসমূহের অনুপস্থিতি, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় আদিবাসী অঞ্চলগুলোতে তাদের সংখ্যালগু করে দেয়া, ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সাংবিধানিক ঘোষণা, নানান আগ্রাসী উন্নয়ন প্রকল্প, সেনাশাসন, শিক্ষা ক্ষেত্রে আদিবাসী শিশুদের নিজ নিজ মায়ের ভাষার পরিবর্তে বাংলায় পাঠ গ্রহণে বাধ্য করা, পাঠ্যপুস্তক-বাংলাপিডিয়া সহ বিভিন্ন জায়গায় আদিবাসীদের হীনভাবে উপস্থাপন, প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহের উগ্র-মৌলবাদী শক্তির সাথে ক্ষমতার ভাগাভাগি বা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য চুক্তি এসবই আদিবাসী জাতিসমূহের সহজ-স্বাভাবিক মনস্তত্ত্বের জন্য হুমকি হিসেবেই দেখা দিয়েছে। এছাড়া শাসকগোষ্ঠী বরাবরই চেষ্টা চালিয়েছে অধিপতি জাতির সাধারণ মনস্তত্ত্বকে নিপীড়িত জাতির মনস্তত্ত্বের বিরোধী পাটাতনে দাঁড় করাতে। এক্ষেত্রে শাসক গোষ্টী বেশ সফলই বলা চলে। হাতেগোনা কিছু ছাড়া প্রায় সব বাঙালিই চাকমা-মারমা-খাসিয়া-মৈতৈ-পাত্র-মান্দি নির্বিশেষে সবাইকেই বাঙালি জাতির অধীন উপজাতি(!), বহিরাগত (অন্যদেশ থেকে আগত অর্থে) হিসেবে ভাবতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এছাড়া পার্বত চট্টগ্রামে সেনাশাসনসহ অন্যান্য বিষয়, ইকোপার্ক ইস্যুতেও শাসকগোষ্ঠীর মনস্তত্ত্বের সাথে উচ্চ শিক্ষিত-নিরক্ষর খেটে খাওয়া বাঙালি মানুষজনের মনস্তত্ত্বের তেমন কোন ফারাক খুঁজে পাওয়া যায় না।
পণ্য সংস্কৃতির বিশ্বায়নের মধ্য দিয়ে কর্পোরেট দুনিয়া তার মুনাফা তুলে নিচ্ছে পৃথিবীর আনাচ-কানাচ থেকে। কর্পোরেট সংস্কৃতি বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন জাতির মানুষ কিভাবে নিল-না নিল সেটা তাদের কাছে কোন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় না। তাদের চেষ্টাই থাকে যে করেই গেলাতে বাধ্য করানোর। একাজে তাদের কত সৈন্যসামন্ত, স্যাটেলাইট চ্যানেল, পত্র-পত্রিকা। তাদের চাতুর্যপূর্ণ কলাকৌশলের কাছে কত ভাবেই না বোকা বনে যাচ্ছি আমরা নানান জাতির নানান মানুষেরা। একদিকে যেমন কর্পোরেট পূঁজির টাকায় উন্নয়ন সন্ত্রাসের তাণ্ডবলীলা, তার পাশাপাশিই রয়েছে এইসব নিপীড়িত জাতিসমূহের জেগে উঠবার প্রবণতাকে দমিয়ে রাখতে কত মেকি মানবিক উদ্যোগ আর কর্মতৎপরতা। কর্পোরেট দুনিয়া বা তার গর্ভজাত এনজিওরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ন্যায় বাংলদেশেও আদিবাসী ভাষা-সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার (!) কত রকমের উদ্যোগ নিচ্ছে; তাদের অনুদানে আদিবাসীদের নিয়ে কত সভা-সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটক, আদিবাসী উৎসব-মেলা হচ্ছে গ্রামে-শহরে-বন্দরে। কত বিশিষ্টজনের দরদ উপচে পড়ছে (!), চোখ চকচক করছে ফায়দা লুটার ধান্দায়। আদিবাসীদের অংশগ্রহণমূলক বা নেতৃত্বাধীন কত উন্নয়ন-গবেষণা প্রকল্পে, দেশি-বিদেশি সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের নানান বেড়াজালে বন্দি করে কর্পোরেট দুনিয়া তার মনস্তাত্ত্বিক দখলদারিত্বকে পাকাপোক্ত করে নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে! কিন্তু সিঁধু-কানু-চাঁদ-ভৈরব-বীরসা-গঙ্গানারায়ণ সিং-পঞ্চানন শর্মা-লীলাবতী শর্মা-রাশিমনি হাজংদের উত্তসূরীদের লড়াকু মনস্তত্ত্বকে কি এত সহজেই করায়ত্ত্ব করা সম্ভব? লড়াকু মনস্তত্ত্বের লড়াকু সৈনিকদের যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবেই কল্পনা চাকমা-পীরেন স্নাল-গিদিতা রেমা-সেন্টু নকরেক-আলফ্রেড সরেনরা কী আবারো প্রমান করে যাননি- নিপীড়িত জাতির দ্রোহী মনস্তত্ত্ব আপসকামীতাকে কখনো প্রশ্রয় দেয় না, দ্রোহে-প্রতিরোধে তা জেগে উঠবেই উঠবে।
৪.তবু আকাঙ্খা আছে বেঁচে থাকবার-দ্রোহী পাটাতনের শামিল হবার
“নুসৌসাবোনে, নওয়ারাবোন চেলে হুঁ
বাকো তেঙে গান,
খাঁটি গেবোন হুল গেয়া হো,
দিশম দিশম দেশ মৌঞজহি পারগানা
নাতো নাতো মাপঞিজি কো
দুঃক্ বোন দানাংবোন কংগেকো তোঙ্গোন
তবে ছো বোন হুল গেয়া হো।”
[একটি সাঁওতালী গান; ভাবানুবাদঃ আমরা নিজেরাই বাঁচব/ কেউ আমাদের পাশে দাঁড়াবে না/ তবু আমরা বিদ্রোহ করব/ গ্রামের মাঝি মোড়লরা সাহায্য করবে/ কেউ পাশে দাঁড়াবে না।]
সাংসারেক ধর্মীয় বিশ্বাস মতে, মান্দি মিদ্দিদের (দেবতাদের) মধ্যে শৌর্য-বীর্যে প্রধান ছিলেন মিদ্দি গুয়েরা। মিদ্দি গুয়েরা মানুষের বেশে যখন মায়ের গর্ভ থেকে পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হন তখন থেকেই বিপদে আপদে তিনি মানুষকে রক্ষা করে চলেছেন। মায়ের গর্ভে থাকা কালীন সময়েই মিদ্দি গুয়েরা- রাক্কা গুয়ের/আগল সাকবো/আওয়া ওয়াঙা ওয়াঙ্গা/মাচ্ছাদো মাচ্ছা বেকফ্রেং/নুরুমান্দি দিমারিশিখো/মিন্নো আঙ্গা খিন্নো আঙ্গানা/হিঙ্খো আঙ্গা স্খু-সতনা ওয়াগংসিঙ্গত্ন/সংনাগ্রেংরিপনাঙ্গারিবাজক/রাক্কা গুয়েরা... । এরকম গাথেম্মাসহ গ্রীকা করে করে দুনিয়ার সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করবার চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। পুরো ৩২ টি দাঁত আর দাঁড়ি-গোঁফ নিয়ে মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেয়া গুয়েরা মানুষকে শিখিয়ে গেছেন কিভাবে দুনিয়ার শক্তিশালী শয়তানদের বিরুদ্ধে সাহস নিয়ে দাঁড়াতে হয়। একাই তখনকার দিনে যত শকষ-শয়তান ছিল যারা মানুষের উপর চরম অত্যাচার করত তাদেরকে দমন করে গুয়েরা তার পরিবারসহ চলে গিয়েছিলেন আসং ফাতেং-চিগা সিম্মল দেং দেং নামক স্বর্গে সেখানে গিয়েও তিনি দুনিয়ার মানুষকে ভুলে যান নি, বিপদে পড়লে তাঁকে স্মরণ করার পথ বাতলে দিয়েছেন, বলে দিয়েছেন শেষ শক্তি দিয়ে লড়াই করে যাওয়ার। বিপদে-আপদে সাংসারেকরা আজও মানসার আয়োজনে গুয়েরার কাছে আশীর্বাদ চান, লড়াই করার শক্তি চান। মিদ্দি গুয়েরাও কখনো নিরাশ করেন না মান্দি (আচিক ভাষায়-মান্দি- বলতে বুঝায় -মানুষ)দের। হ্যাঁ, মিদ্দি গুয়েরার আশীর্বাদেই দুনিয়ার সকল জাতির সকল মানুষেরা সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে নিজেদের লড়াই আজও জারি রেখেছেন। ইতিহাসে মাদল, ধামসা, আদুরি, মইবঙ, নাগড়ার তালে গ্রীকা (আচিক শব্দ -গ্রীকার- বাংলা -যুদ্ধনৃত্য বুঝা যেতে পারে) হয়েছে বারেবারে। মান্দি বিদ্রোহ(১৭৭৫-১৮৮২),পাহাড়িয়া বিদ্রোহ (১৭৮৯-৯১), চোঁয়াড় বিদ্রোহ (১৭৯৮-৯৯), ভীম বিদ্রোহ (১৮১৮), খাসিয়া বিদ্রোহ (১৮২৯-৩৩), কোল বিদ্রোহ (১৮৩১-৩২), নাগা বিদ্রোহ (১৮৩৯), শবর বিদ্রোহ (১৮৫৩), সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৬), মুণ্ডা বিদ্রোহ(১৮৯৯-১৯০১) চাকমা বিদ্রোহ, রিয়াং বিদ্রোহ (১৯৪২-৪৩), তেভাগা আন্দোলন (১৯৪৬-৪৭), হাজং বিদ্রোহের (১৯৪৫-৪৬) ছপাতি নকমা-সিঁধু মাঝি-কানু মাঝি-বীরসা মুণ্ডা-গঙ্গানারায়ণ সিং-জুম্মা খাঁন-তীর্থ সিং-বুরামানিক-মুকুন্দ সিং-শিবরাম মাঝি-হপন হার্ডি-গহনুয়া মাহাতো-মাকটু সিং-ফাগুয়া কোলকামার-তৎনারায়ণ বর্মণ-সর্বেশ্বর ডালু-বুধু খেড়িয়া-রামু মুণ্ডা-লছমন সিং-করমী ওঁরাও-বুধনী ওঁরাও- স্বর্ণময়ী ওঁরাও-রাশিমণি হাজংদের উত্তরসূরী হিসেবেই মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, কল্পনা চাকমা, গিদিতা রেমা, অবিনাশ মুড়া, অধীর দফো, আলফ্রেড সরেন, সেন্টু নকরেক, পীরেন স্নালরা সংগ্রামের বহমানতাকে চালু রেখে গেছেন পার্বত্য চট্ট্রগ্রামে, মধুপুরে, উত্তরবঙ্গে, খাসিয়া পুঞ্জিগুলোতে। আপন আপন সংস্কৃতির লড়াকু মনস্তত্ত্বই তাঁদেরকে বারেবারে নিয়ে এসেছে-অস্তিত্ত্ব রক্ষার অবিনাশী সংগ্রামে। রাষ্ট্র যতই এইসব জাতিসমূহকে আড়াল করে রাখুক না কেন তাদের কুরুখ,আচিক, ঠার, লালেং, নাগরী, ওঁরাও, খিয়াং, সান্তালী, সিং, ককবরক, মারমা, মৈতৈ, চাকমা, খুমী, ম্রো প্রভৃতি ভাষার প্রতিটি শব্দ, বাক্য একেকটি সংগ্রামী হাতিয়ার। আজও দকমান্দা, দকশাড়ি, পিনন, রিনাই, থামি, রিসা, কা জিমপিন, জৈনসেমের প্রতিটি বুননেই মান্দি-চাকমা-মারমা-ত্রিপুরা-মৈতৈ-খাসিয়া নারীরা গেঁথে চলেছেন আপন আপন সংস্কৃতির প্রতিরোধী বাঁধ। রাষ্ট্রীয় আস্কারায় কর্পোরেট পূঁজি দেশের আনাচে-কানাচে, রাজধানীতে আদিবাসীদের নিয়ে যতই নাটক, নাচ, গান মঞ্চায়ন করে নিজেদের জাহির করে বেড়াক না কেন, তিরেশ নকরেক-মাখন লাল বর্মণ-ভগবান সিং-লক্ষীন্দর সিং-বেহুলা সিং-জগদীশ সিং-খামাল কুনেন্দ্র Pv¤^yMs-Elv রাণী মাহাতোদের শেরেনজিং-আজিয়া-রেরে-হাস্তর-দিগ্গ্যিবান্দি-গেংখুলি-রাসলীলা-ঝুমুরের সংগ্রামী উপস্থাপন আকাঙ্খাকে কখনই দমিয়ে রাখতে পারেনি, পারবেও না। কেননা তিরেশ-মাখন-ভগবান-লক্ষীন্দর-বেহুলা-কুনেন্দ্র-ঊষা রানীরা কোন বাণিজ্যের আশায়, পদকের আশায় নিজেদের জাহির করেন না। এ তাদের অস্তিত্বের লড়াকু জানান। গুনীন-ওঝা-দেবর্ষি-পাহান-সেম্মা খামাল-মিদ্দি খামাল-নায়েকে-লাংদুহ-কার্বারি-নকমা-আতু মাঝি-দিশম মাঝি-পারগানা-পরধান-মাথা-মন্ত্রী-রাজা এখনো অকার্যকর হয়ে যায়নি। পরাক্রমশালী বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েইতো আপন বিশ্বাসের দ্রোহী অবগাহন নিরন্তর জারি রেখে চলেছেন রজনী কান্ত সাংমা, সতীশ চন্দ্র মাহাতো, জনিক নকরেক, অনিতা মৃ, মানিক চন্দ্র সিং, নরেন্দ্র মারাক, রাগেন নকমারা। এই বিশ্বাসী লড়াইয়ের কোন বিনাশ হতে পারে না। আপন বিশ্বাস আর সংগ্রামের যুথবদ্ধতার মধ্য দিয়েই এই ভূখণ্ডের বিপন্ন জাতির বিপন্ন মানুষেরা আপনার অস্তিত্বের জানান দিয়ে যাবেন নিরন্তর-এমন লড়াকু বিশ্বাসকে এই রাষ্ট্র, সাম্রাজ্যবাদী কর্পোরেট দুনিয়ার কোন কলাকৌশলই রুখতে পারে না। সিঁদু-কানু-বীরসা-রাশিমনি-আলফ্রেড-পীরেন-কল্পনা-গিদিতা-সেন্টু-অবিনাশদের উত্তরসূরীরা নিজেদের অস্তিত্বের জন্যই বারেবারে জেগে উঠবেন ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে, আঘাতে আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেবেন রাষ্ট্র-বিশ্ব-বহুজাতিক কোম্পানিসহ সকল আগ্রাসী-নিপীড়ক-দখলদারি মনস্তত্ত্বকে, আপন ভূমি-সংস্কৃতি-বিশ্বাসের আপন অধিকার ও চর্চার মধ্য দিয়েই প্রতিনিয়ত তাদের নিজস্ব অস্তিত্ত্বের লড়াকু জানান দিয়ে যাবেন ।
( লেখাটি রাঙামাটির জুম ঈসেথটিকস কাউন্সিল-জাক এর বৈসুক-সাংগ্রাই-বিঝু সংকলন ২০০৭ লামপুক (রনেল চাকমা সম্পাদিত) এ প্রকাশিত)
১. রাষ্ট্র তুমি কার ?
রাষ্ট্র তুমি কার ?? রাষ্ট্র তুমি কার ???...
একটা কাগজে কলমে স্বীকৃত বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্রে বসবাসরত বেবাক সচেতন নাগরিকের পক্ষেই কাগুজে ভাষারীতিতে এর উত্তর দিতে পারা তেমন কোন কঠিন বিষয় না। যে কেউ, যে কোন প্রান্ত থেকে সমস্বরে গলা মেলাবেন -জনগণের। এখন এই জনগণের ভেতর কারা পড়েন ? রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমানার ভেতরে লিঙ্গ, বয়স, ধর্ম-বর্ণ, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিগত দিক নির্বিশেষে সকল মানুষই এর আওতাভূক্ত; এই বিষয়েও কারো কোন অস্পষ্টতা নেই। তবে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অস্পষ্টতা অবশ্যই রয়ে গেছে অথবা বলা যেতে পারে অবচেতন বা সচেতন ভাবেই এই দিকটির প্রতি গুরুত্ব দিতে নারাজ এই রাষ্ট্রের প্রায় পচাঁনব্বই ভাগেরও অধিক মানুষ যার ভেতরে রয়েছেন প্রগতিশীল-বুর্জোয়া-প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক সচেতন শাসকগোষ্ঠী-শিল্পী-সাহিতি্যক-বুদ্ধিজীবি-সুশীল সমাজ সহ হরেক অভিধার হরেক ঘরানার মানুষজন। আর এই বিষয়টি হচ্ছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতিগত পরিচয়। ব্যাপারটা একটু খোলসা করে বলা যাক। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মালিক বলা হয়ে থাকে জনগণকে। সেই হিসেবে-বাংলাদেশ-নামক রাষ্ট্রের মালিকও হবেন জনগণ, অতি সহজ সাধারণ একটা ব্যাপার। এখন যদি প্রশ্ন করা হয়, কোন জনগণের বা জনগণের জাতিগত রূপটা কি? উত্তর আসবে বাঙালির, রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে কেউবা বলবে বাংলাদেশী। হ্যাঁ, একদম সত্যি কথা, সংবিধান বিশেষজ্ঞ থেকে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, শাসকগোষ্টী থেকে শোষিত সমাজের প্রতিনিধি, ডান-বাম-আধাবাম-বুর্জোয়া-প্রতিক্রিয়াশীল নির্বিশেষে বেবাকই গর্ব ভরে একই উত্তর দিতে অভ্যস্ত। আমরা সকলেই জানি বাঙালি জাতি কয়েকশত বছর ধরে নানান আত্মত্যাগের ভেতরে নির্মাণ করেছে কাঙ্খিত এক জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের। দেশের যেকোন নাগরিকেরই এ এক বুক ফুলানো ব্যাপার। একে খাটো করে দেখার মতন কোন ব্যাপার নেই। কিন্তু সমস্যা তারপরেও রয়ে যায়, আসলেই কী বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির মালিক কেবলই এদেশের বাঙালি জাতিভূক্ত জনগণ ? যদি তা না হয় তাহলে বাঙালি বাদে অপরাপর জাতি সমূহের অস্তিত্ব নেই কেন সংবিধানের কোন একটি পৃষ্ঠার কোন একটি লাইনে, পচাঁনব্বই ভাগ জনগণের মগজে, তাদের উপস্থাপন রীতিতে ? কেবল সংখ্যার বিবেচনাতেই কী আধুনিক এই রাষ্ট্র তার জাতিগত পরিচয় দেওয়ার ক্ষেত্রে কোন একক জাতির একক আধিপত্যকেই বৈধ করে তুলবে, প্রতিষ্ঠিত করে তুলবে ? মিথ্যার বেসাতি দিয়ে আড়াল করে ফেলবে ওঁরাও, সাঁওতাল, মুণ্ডা, রাজোয়ার, লহরা, হাড়ি, দোসাত, পাহাড়িয়া, রবিদাস, চাকমা, মাংতা, রাখাইন, শিং, মাহাতো, মৈতৈ, লালেং, বিষ্ণুপ্রিয়া, রাজবংশী, বর্মণ, খাসিয়া, ত্রিপুরা, ডালু, কোচ, মান্দি, খিয়াং, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, খুমী, চাক, হাজং প্রভৃতি জাতিসমূহের অস্তিত্ব? একক জাতির একক আধিপত্য পাকাপোক্ত করতে আর সব জাতি সমূহকে -উপজাতি- বানিয়ে ফেলতে হবে? ইসলামকে যখন সংসদে আইন পাসের মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হলো তখন কী একবারের তরেও চিন্তুা করা হয়েছিল সাংসারেক, সারণা, ক্রামা, বৌদ্ধসহ একেক জাতির আপন আপন ধর্মের কথা, তাদের আপন আপন বিশ্বাসের কথা? এই রাষ্ট্র বৃহত্তর জাতির (সংখ্যার বিবেচনায়) প্রার্থণালয়ের জাতীয় স্বীকৃতি (জাতীয় মসজিদ-বায়তুল মোকারম) দিলেও অপরাপর জাতি সমূহের সারণা, মিদ্দি আসং, গোয়ারি, জাহের থান, চিগা সমূহকে জাতীয় স্বীকৃতি দূরের কথা এদের অস্তিত্বের খবরই রাখেনি বা রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি। বরং এই রাষ্ট্রের অধিপতি জাতির আরাম-আয়েশ সহ নানান প্রয়োজনে নানান প্রকল্পের ভেতরে রাষ্ট্রের অনুচ্চারিত হদি, মাহালি, ভূইমালি, ওঁরাও, সাঁওতাল, মুণ্ডা, রাজোয়ার, হাড়ি, দোসাত, পাহাড়িয়া, রবিদাস, চাকমা, মাংতা, রাখাইন, শিং, মাহাতো, মৈতৈ, লালেং, খাসিয়া, ত্রিপুরা, ডালু, কোচ, বিষ্ণুপ্রিয়া, মান্দি, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, খুমী, খিয়াং, চাক জাতিসমূহের বসতভিটা-হাবা-জুম-জাহেরথান-সারণা-গোয়ারি-মিদ্দি আসং-চিগা কখনো তলিয়ে যায় উন্নয়নের বিশাল জলরাশিতে, বন্দি হয়ে যায় ইটের দেয়ালে-চিড়িয়াখানায়-কাঁটাতারের বেড়ায়, কখনোবা পুড়ে ছারখার হয়ে যায় উন্নয়নের দাবানলে, দখল হয়ে যায় প্রভাবশালীদের মারদাঙ্গা প্রভাবের কাছে। এই রাষ্টের নগরে-বন্দরে-শহরে-বিদ্যাপীঠের ভাস্কর্য হিসেবে ফুটে উঠে কত সংগ্রামী যোদ্ধাদের মুখ; কেবল ভেসে ওঠে না রাশিমনি হাজং, কল্পনা চাকমা, পীরেন স্নাল, গীদিতা রেমা কিংবা আলফ্রেড সরেনদের তেজস্বী চাহনিগুলো। এই রাষ্ট্র কত ভাবেই না একক জাতির নিরঙ্কুশ দাপটকে বজায় রাখতে সচেষ্ট। গতবছরের (২০০৬) ১২ এপ্রিল খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক হুমায়ুন কবির কতৃক খাগড়াছড়ি ২০০১-২০০৫ শিরোনামের পুস্তিকাতে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাদের খাগড়াছড়িতে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে বলার মতন উদ্ধত্য দেখানোর পরও রাষ্ট্রযন্ত্রের নিশ্চুপতা কী একেবারেই বিচ্ছিন্ন কোন ব্যাপার? রাষ্ট্রের এই নিশ্চুপতায় কেবলই সংশয় জাগে, প্রশ্ন জাগে মনে - রাষ্ট্র তুমি কার? শুধুই বাঙালি জনগণের?
২.সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার ঠিকাদার রাষ্ট্রের উন্নয়ন সন্ত্রাস ও বিপন্ন জাতির মানুষেরা
আমার ঘরের চাবি পরের হাতে
আমি কেমনে খুলিয়ে সে ধন
দেখব চক্ষেতে;
আপন ঘরে বোঝাই সোনা
পরে করে লেনাদেনা...।
ফকির লালন শাহ্
তামাম দুনিয়া জুড়ে কেবলই একই ধুয়া-উন্নয়ন (!), উন্নয়ন (!) আর কেবলি উন্নয়ন (!)। উন্নয়নের তাণ্ডব দাবড়ে বেড়াচ্ছে ধনী-গরীব, ছোট-বড় নির্বিশেষে দুনিয়ার সকল দেশের সকল জনপদের, আকাশ-মাটি, পাহাড়-সমতল, বনাঞ্চল, মরুভূমিসহ সকল প্রতিবেশের সকল কিছুকেই; বিশেষ করে ৯০ এর দশকের পর ভারতবর্ষসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশে মার্কিন শাসিত নয়া অর্থনীতি প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকে। মার্কিন শাসিত এই নয়া অর্থনীতি বাজারের উন্মুক্তকরণ, সম্পদের বেসরকারিকরণ ও পণ্য সংস্কৃতির বিশ্বায়ন অপেক্ষাকৃত দূর্বল দেশগুলোর উপর চাপিয়ে নিজের এককাধিপত্ব বজায় রেখেছে মূলত উন্নয়নের মূলো ঝুলিয়েই। এই উন্নয়ন হুজুগে সাড়া দিয়ে বা সাড়া দিতে বাধ্য হয়ে আমাদের মত গরীব দেশগুলো বিশ্বব্যাপী পূঁজি সঞ্চয়ের একমুখীনতাকেই নিশ্চিত করেছে। আর পূঁজির এই একমুখীনতা যে মানুষের অধিকারচ্যুতির মধ্য দিয়েই সম্পন্ন হয় তা আজ আর কারও অজানা নয়। মার্কিন শাসিত এই নয়া অর্থনীতিতে পূঁজির যে একচেটিয়া ব্যবস্থা তার সাথে ঘনিষ্ট লেনাদেনা গড়ে ওঠে কর্পোরেট পূঁজির। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের উন্নত দেশগুলো গরীব ও কম উন্নত দেশ সমূহের অর্থনীতি ও রাজনীতির উপর নিজেদের দাপুটে অবস্থানকে টিকিয়ে রাখতে বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন নতুন কৌশল বাতলানোর দায়িত্ব তুলে দেয় কর্পোরেট সংস্থাসমূহের উপর। সারাবিশ্বের তালিকাভূক্ত বাঘা বাঘা ৫০০ কর্পোরেট সংস্থার মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই রয়েছে ১৮৫টি। আর মার্কিন শাসিত এই কর্পোরেট সংস্থাগুলো নিয়ন্ত্রন করছে বিশ্বের ৭০ শতাংশ বাণিজ্য ও ৮০ শতাংশ বৈদেশিক বিনিয়োগকে। অপরদিকে কর্পোরেট দুনিয়ার রক্ষাকর্তা বা পাহারাদার বা তত্ত্বাবধানের মহান দায়িত্ব পালন করে চলেছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ (IMF) আর বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (WTO) মত শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলো। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের সাথে গাঁটবাঁধা এই কর্পোরেট পূঁজি তার ধুন্দুমার বাণিজ্যিক লুটপাট চালাতে গিয়ে সর্বদাই সামনে রাখছে নানারকম উন্নয়ন মডেলকে। মার্কিন শাসিত কর্পোরেট পূঁজির একচেটিয়া ব্যবস্থাকে আরো হৃষ্টপুষ্ট করতে গিয়ে তাদের উদ্ভাবিত নানান উন্নয়ন মডেল বাস্তবায়ন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ক্ষমতাহীন মানুষের নিকট উন্নয়ন সন্ত্রাস হিসেবেই দেখা দিয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী কর্পোরেট দুনিয়ার কাছে আত্মসমর্পিত রাষ্ট্রগুলোর বুর্জোয়া শাসকেরা বরাবরই উন্নয়ন সন্ত্রাস পরিচালনার জন্য প্রথমেই বেছে নিয়েছে সেসব দেশের বৃহত্তর জাতি বাদে অন্যান্য জাতি অধ্যূষিত এলাকা সমূহকে। ফিলিপাইনের আম্বুলং, ব্রাজিলের ফোর্টএলিজার তাতাজুবা, প্রেইন্হা ডো কেন্ডু বারদি, বতসোয়ানা, বুরুন্ডির সিবিতোকি, লাওসের নাকাই, মালয়েশিয়ার পেনান, আর্জেন্টিনার মিসিওনেস, পেরুর ক্যাজামারকা প্রভৃতি অঞ্চলের অধিবাসীদের সামনে বিভিন্ন সময়ে বনায়ন, কয়লা-তেল-গ্যাস উত্তোলন, ইকোপার্ক, রিজার্ভিয়র কত নামে কত বড় বড় উন্নয়ন মডেল নিয়েইতো হাজির হয়েছিল কর্পোরেট বেনিয়ারা। তুপিনিকিন, বায়া গুয়ারনি, ফিলিপিনো, খি, জ, দাইয়াক প্রভৃতি জাতি সমূহের মানুষজন বুঝেছেন উন্নয়ন মানে কয়লা-তেল-পর্যটন-অবকাশ-গ্যাস-কাঠ-পরিবেশ সংরক্ষণ বাণিজ্যে প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছা লুটতরাজ আর নিজেদের বসত-পাহাড়-বন-সৈকত থেকে নিরন্তর উচ্ছেদ-গুলিবর্ষণ-গুম-গণহত্যাসহ নির্যাতন-নিপীড়ন-উৎপীড়নের আরো কত কি কায়দা কানুন ! রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠীর আস্কারায় নাইজেরিয়াতে Shell, Agip, Mobil, Texaco, Chevron প্রভৃতি কোম্পানিগুলোর উন্নয়ন তাণ্ডবইতো কবি নিমো বেসিকে লিখতে রসদ যুগিয়েছিল, “Dried tear bags/ polluted streams/ things are real/ when found in dreams/ we see their Shells/ behind military shields/ evil, horrible, gallows called oilrigs/ drilling our souls./ We thought it was oil/ but it was blood.” আর এই ধরনের উন্নয়ন তাণ্ডবের বহুমাত্রিক উপস্থিতিতে আজ আমাদের বাংলাদেশেও বিপন্ন, বিপর্যস্ত অবস্থায় সংবিধানে অনুল্লেখিত বাঙালি ভিন্ন ৪৫টিরও অধিক জাতি।
পাকিস্তান আমলে এতদাঞ্চলের বাঙালি জনগণের ঘরে ঘরে বিদ্যূতের আলো বিলিয়ে দেওয়ার উন্নয়ন যজ্ঞে ১৯৫৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি ও ইউতে ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি ইউএসএইড-র আর্থিক যোগানে পাঁচবছর ধরে কর্ণফুলি নদীতে বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করে। তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে সাম্রাজ্যবাদী কোম্পানি সমূহের এই বিজলি সন্ত্রাস রাঙামাটি জেলার চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা প্রভৃতি জাতির লোকজনকে চরম অন্ধকারে ঠেলে দেয়। রাষ্ট্রের উন্নয়ন জোয়ারে ভেসে সেসময় প্রায় একলাখ মানুষ বসত, কৃষিজমি (প্রায় ৫৪ হাজার একর) হারিয়ে উদ্বাস্তু হিসেবে দেশত্যাগে বাধ্য হন।
বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ সাম্রাজ্যবাদী সংস্থাসমূহ পরিবেশীয় সম্পদ লুটপাট ও বিনাশের এক নতুন তরিকা নিয়ে হাজির হয়েছে। এই নতুন তরিকার নাম হচ্ছে, ইকোট্যুরিজম। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার সূত্রে জানা যায়, ২০০২ সালে ইকোট্যুরিজম নাকি অস্ত্র ও আইটি সেক্টরের পরে বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ ইন্ডাস্ট্রি হিসেব বিশ্ব অর্থনীতিতে জায়গা করে নিয়েছে। আর বলাই বাহুল্য এই ইন্ডাস্ট্রিগুলোর বেশির ভাগই গড়ে তোলা হয়েছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে। এক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার উদ্দেশ্যও বেশ পরিষ্কার, পেটেন্ট বা ছিনতাইকর্মের মাধ্যমে দুনিয়ার তাবৎ প্রাণসম্পদের উপর নিজেদের নিরঙ্কুশ মালিকানা প্রতিষ্ঠার পথকে আরো সহজতর করে তোলা। আর সভ্য (!) দুনিয়ার এইসব সভ্য (!) চোরদের গায়ে তেলমাখানো, পথ বাতলানো বা অন্যান্য সব রকম সহযোগিতার জন্যতো আত্মসমর্পিত রাষ্ট্রের শোষক শ্রেণী, কর্পোরেট পূঁজির জরায়ুজাত এনজিও সমূহের হরকসম গবেষণা-প্রকল্প রয়েছেই। আমাদের দেশে এই ইকোট্যুরিজম হুজুগ আসে বিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষ দিকে। বাংলাদেশ সরকার ফরেস্ট কনজারভেশন ও ইকোট্যুরিজম স্কীমের আওতায় ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে দেশের প্রথম ইকোপার্ক এলাকা হিসেবে সীতাকুণ্ডকে বেছে নিলেও এরপর একে একে হাত বাড়াতে থাকে খাসিয়া ও মান্দি অধ্যুষিত মৌলভীবাজারের মাধবকুণ্ড-মুরইছড়ার (১৪৮৭ একর), মান্দি অধ্যুষিত টাঙ্গাইল শালবন (৩০০০ একর), ম্রো প্রধান চিম্বুকের (৫০৫০ একর) এলাকাতে। স্থানীয় আদিবাসীদের সাথে কোনরকম পরামর্শ ব্যতিরেকেই সরকার এইসব প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্যোগী হলে প্রায় সব এলাকা থেকে সঙ্গত কারণে প্রতিরোধের আওয়াজ ওঠে। মৌলভীবাজারে ইকোপার্ক বাস্তবায়নের কাজ বন্ধ হওয়ার পর সরকার হাত বাড়ায় মধুপুরের শালবনকে ধ্বংস করার খেলায়। অবশ্য আদিবাসী বসবাসকারী বনাঞ্চলগুলো নিয়ে রাষ্ট্রের নানান হঠকারী সিদ্বান্ত এটাই প্রথম নয়। আমরা মধুপুর বনেই দেখেছি বিশ্বব্যাংক আর এডিবির টাকায় উন্নয়নের কথা বলে কখনো রাবারের মনোকালচারের নামে, কখনো সোস্যাল ফরেষ্ট্রি ও উডলটের মাধ্যমে কিভাবে শালের কপিছ মাটি খুঁড়ে তুলে ফেলার সাথে সেখানকার মান্দি-কোচ-বর্মণদেরও শেকড়চ্যুত করা হয়েছিল। যে রাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদী সংস্থার উদ্ভাবিত উন্নয়নের দোহাই দিয়ে রাবার বাগান, উডলটের মত বন বিধ্বংসী প্রকল্প আর বনবিভাগের অবাধ লুটপাটের ভেতর দিয়ে ধ্বংসের শেষ কিনারায় নিয়ে এসেছে তারাই যখন আবার বনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণসহ বন উন্নয়নের কথা বলেন সেটা তখন বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। বনের যে আদি বাসিন্দারা বনের প্রাণবৈচিত্রকে রক্ষার জন্য বিভিন্ন পূজা, আমুয়া পালন করেন; বনের বিভিন্ন জায়গায় যেখানে তাদের মিদ্দি আসং (দেবতাদের জায়গা) সেই বন তাদের কাছে কোন বাণিজ্যের বিষয় নয়, বরং তা নিজেদের জীবনধারণ ও বিশ্বাসের গভীর সংযোগ। দীর্ঘদিনের এই বনকেন্দ্রিক জীবনধারন পদ্ধতি আর বিশ্বাসের বিকল্প উপায় কখনো ৭ফুট উচ্চতার ৬১ হাজার ফুট ইটের দেয়াল এবং ভেতরে ১০টি পিকনিক স্পট, ২টি ওয়াচিং টাওয়ার, ২টি কালভার্ট, ৩টি কটেজ, জলাধার সহ লেক ৯টি, রেষ্ট হাউজ ৬টি, রাস্তা নির্মাণ ৬টি, বন কর্মীদের ৬টি ব্যারাক নির্মাণ হতে পারে না। বলাফাল, আসংদেনা আমুয়ার বিকল্প হতে পারে না পিকনিক পার্টির আনন্দ ভ্রমন। আর আদিবাসী এলাকাগুলোতে দেয়াল, কাটা তারের বেড়া, সংরক্ষিত এলাকার আসল মাহাত্ম কি তার জন্য দামিনিকোহ, দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলের নজিরতো রয়েছেই। ২০০৪ সালের ৩ জানুয়ারি নিজেদের হাবিমাতে নিজেদের অস্তিত্ব, হাবিমার প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার জন্য পীরেন স্নালের আত্মদান, উৎপলসহ অন্যান্যদের ত্যাগ আর সংগ্রামে তখনকার মত দেয়াল নির্মাণের কাজ বন্ধ করা হলেও সেই প্রকল্প বাতিল করা হয়নি। বিগত রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতা ছাড়ার পর বনবিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসন আবারো সক্রিয় হয়ে উঠে প্রকল্প বাস্তবায়নে। জরুরী অবস্থার ভেতরে গত ১৯ জানুয়ারি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যস্ত টহলের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের দেয়াল নির্মাণ মার্কা উন্নয়নে আবারো বসত-কৃষিজমি সহ বনে অবাধ বিচরণের অধিকার হারানোর আতঙ্কে সন্ত্রস্ত অবস্থায় রয়েছেন হাবিমার সন্তানেরা। যে উন্নয়ন রাবার বাগান, উডলট, ফায়ারিং রেঞ্জ, পিকনিক স্পট, লেক, ওয়াচিং টাওয়ার, চিড়িয়াখানার নামে বারে বারে মায়ের কোল থেকে সন্তানকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, যে উন্নয়ন সন্তানের সামনে মাকে ধর্ষণ করে সে আবার কেমন উন্নয়ন ? শালবনের মান্দি-কোচ-বর্মণদের, শেরপুরের মান্দি-হাজং কিংবা চিম্বুকের ম্রোদের এমন সহজ প্রশ্নের উত্তর কি জানা আছে এই রাষ্ট্র্রের ?
দিনাজপুরের ফুলবাড়ি, পার্বতীপুর, নবাবগঞ্জ এলাকার ৬৭টি গ্রামের সাঁওতাল সহ অন্যান্য আদিবাসী জাতি সমূহের প্রায় একলাখ মানুষ আজ চরম অনিশ্চিয়তায়। ফুলবাড়িতে যুক্তরাজ্যের এশিয়া এনার্জি কোম্পানি ৯ হাজার ২৫০ কোটি টাকা নিয়ে এসেছে নতুন ফন্দি নিয়ে। যে মায়ের বুকে আদিবাসী সন্তানেরা হেসে-খেলে, নেচে-গেয়ে, শঙ্কায়-সংগ্রামে বসত-কৃষি-জাহেরথানে কর্ম, বিশ্বাস আর বর্ণাঢ্য আচারে জীবনের গতিময়তাকে জিঁইয়ে রেখেছেন সেই মায়ের বুকে ডিনামাইট ফাটিয়ে হৃৎপিণ্ডের ভেতর থেকে কালো মানিক বের করে আনতে চায় এশিয়া এনার্জি। বিশ্বের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে এই সব কালো মানিকের নাকি ব্যাপক চাহিদা, অনেক মুনাফা(!)। যে মায়ের বুক উজাড়করা ভালবাসায় বেড়ে উঠেছেন আদিবাসী সন্তানেরা তারা কিভাবে এটা মেনে নেবেন? তথাকথিত সভ্য (!) জগতের মানুষদের এ কোন ধরনের সভ্যতা? কোটি টাকার গাড়ি, কাড়ি কাড়ি অর্থের বিনিময়ে শাসকেরা কোন মাকে যখন উন্নয়নের দোহাই দিয়ে অন্যের হাতে তুলে দেয় তখন এর চেয়ে বড় সন্ত্রাস দুনিয়ায় আর কি হতে পারে ? এর চেয়ে বড় অসভ্যতাই বা আর কি আছে ?
মাগুড়ছড়া বনে যে খাসিয়ারা তাদের মাকে সর্বদা পলাশ-শিমুল-গর্জন-জারুল-হিজল-কদম-মেহগনিসহ নানা লতাপাতায়-ফুলে-ফলে সাজিয়ে শালিক-টিয়া-ময়নার-কোকিল-দোয়েলের গান শুনিয়ে খুশি রাখত, বিদেশি অক্সিডেন্টাল কোম্পানি (বর্তমানে শেভরন কোম্পানি এ ব্লকের দায়িত্বপ্রাপ্ত) ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন সেই মায়ের সকল রূপ-সৌন্দর্যকে ঝলসে দিয়েছে উন্নয়নের দাবানলে। উনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের প্রথম ভাগে সিলেটের লালেংদের জননীভূমিকে বেআব্রু করেই একে একে খাদিমনগর, কেয়াছড়া, কালাগুল, পুুঁটিছড়া ইউরোপীয়দের চা বাগান গড়ে উঠেছিল। রাষ্ট্রের কথা বাদই থাক, তামাম দুনিয়ার কি এমন ক্ষমতা আছে মায়ের এমন বেআব্রু, সৌন্দর্য্যহানি, শরীর ঝলসে দেয়ার ক্ষতিপূরণ দেবার?
পুরো পরিবার জুংলি-ঝান্টা-ওছা-বীণ-শিঙ্গা-দাড়াইস-কালিপানো-সুতানালি-দুধরাজ-জাইত-গোখরা-আলাজ-বীণরাজ-পাতরাজ-টুনটুনি-কালিনাগ-অজগর নিয়ে বসবাস করবার মতন ছোট্ট একটা নৌকা হলেই যথেষ্ট। ঢেউয়ের তালে ছইয়া নৌকায় ভেসে ভেসে শেলুং-বাইলা-পুঁটি-টেংরা-বোয়াল-শুশুকের সাথে খুনসুটি করতে করতে পাড়ি দেন ধলেশ্বরী-বুড়িগঙ্গা-তুরাগ-বংশাই-শীতলক্ষ্যা-মেঘনা-পদ্মা-আত্রাই-যমুনা-সুরমাসহ কত নদী-নালা-খাল-বিল! অর্থসম্পদ না থাকলেও বিচরণের স্বাধীনতাকে উপভোগ করেন নিজেদের মত করে। কিন্তু এই রাষ্ট্র যেখানে সবাইকেই উন্নয়নের বেড়াজালে বন্দি রাখতে চায় সেখানে মাংতাদের স্বাধীন থাকার এই দুঃসাহস কি মেনে নেয়া যায়? রাষ্ট্র জানাল, জনগণের জন্য আধুনিক ও উন্নত সমাজ গঠন করতে হবে। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে কথা! কিন্তু এই আধুনিক আর উন্নত সমাজের মাপকাঠিটা কি? রাষ্ট্র তখন বৃটিশ সংস্থা Department For International Development (DFID) এর কথাটাই হুবহু আওড়ে গেল- নগরায়ন, হ্যাঁ, একমাত্র নগরায়নই হলো আধুনিক ও উন্নত সমাজের মাপকাঠি। ব্যস, এই ঘোষণার মধ্য দিয়েই শুরু হয়ে গেল দেশি-বিদেশি ফাটকা পূঁজির নগরায়ন বাণিজ্য। বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা-কীর্তণখোলা-ধলেশ্বরী-মেঘনা দখল করে রিভার ভিউ, খাল ভিউ কত প্রকল্প জমজমাট হয়ে গেল দুদিনেই। আর ইয়াংসা বাজার-হাঙ্গার ডেইল-ডেইল পাড়া-রাজারছড়া-বাহারছড়া-ইনানী বিচ-জাফলং এর ঝিরি-ছড়া-ঝরনায় বিস্ফোরেকের আঘাতে প্রকৃতি মায়ের বুক ক্ষত-বিক্ষত করে কোয়ারি বানিয়ে সেখান থেকে ট্রাকে ট্রাকে পাথর আসতে লাগল নগরায়নের মজবুত ভিত্তি গড়তে। নদীখেকো, খালখেকো, বিলখেকো, লেকখেকো, হাওরখেকো কত প্রতিষ্ঠান, কত প্রকল্প, কত ব্যক্তি নগরায়নের মোড়ে মোড়ে ফুলেফেঁপে উঠলো! আধুনিক হয়ে উঠলো! সভ্য বনে গেল! ভেতরের পঁচা-গলা কত রক্ত-পূঁজ আড়াল করে ফেলল নগরের কংক্রীটের দেয়ালে! কিন্তু বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা-কীর্তণখোলা-কর্ণফুলী-মেঘনা-তুরাগ, সিলেট-বান্দরবান-উখিয়া-টেকনাফের ঝিরি-ছড়া-ঝরনা-ডাইং-বাইলা-পুঁটি-টেংরা-বোয়াল-শুশুকের সাথে মাংতা-ম্রো-মারমা-ত্রিপুরা-চাকমা-বোম-লুসাই-খাসিয়াদের সম্মিলিত আর্তনাদকে কি ঢেকে রাখতে পেরেছে ? আধুনিক ও উন্নত নগরের ব্যস্ত কোলাহলের মধ্যে সেই সম্মিলিত আর্তনাদতো অবিরত বলেই চলেছে- আমরা উন্নত হতে চাই না, আমরা আগে বাঁচতে চাই, আমরা বাঁচতে চাই...।
৩.বহুমাত্রিক মনস্তাত্ত্বিক আগ্রাসন কব্জা করে ফেলতে চায় মানুষের সবকিছু
“কুঞ্জের ঘারকার
বুড়হা বুড়হি
আজো বন্দী
বাপ দাদা চৌদ্দ পুরুষ
মানকা আওধি।”
[(ভাবার্থ ঃ এই গৃহের আদি দেবতা/বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা যাকে বন্দনা করেছে/আমরাও তাদের বন্দনা করছি;/পূর্বপুরুষেরা যাকে মেনে এসেছে/আমরাও তাকে মেনে এসেছি) ওরাওঁদের সোহরাই পূজায় গৃহদেবতাদের উদ্দেশ্যে পাঠ করা মন্ত্রের অংশ বিশেষ]
আমাদের এই ভূখণ্ডের আদিবাসী জাতিসমূহ তাদের আপন আপন সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদকে আগলে রেখেছেন যুগ যুগ ধরে। বংশপরম্পরায় চর্চার ভেতর দিয়ে এইসব সংস্কৃতি একেকটি জাতির আপন আপন মনস্তত্ত্ব গড়ে তুলেছে, ঋদ্ধ করেছে স্বতন্ত্র্যভাবেই সেই উপনিবেশিক আমল থেকেই মানবতাবাদী এইসব মনস্তত্ত্বকে গিলে ফেলতে সচেষ্ট ছিল শাসক গোষ্ঠীর দখলদারি মনস্তত্ত্ব। শাসকগোষ্টী বেশ ভালো করেই জানেন কোন জাতির আপন মনস্তাত্ত্বিক জগতকে বশে না আনতে পারলে শোষণ প্রক্রিয়ায় গতি সঞ্চার করা যাবে না। অতএব যত তাড়াতাড়ি পারো অধস্তন জাতিসমূহের আপন আপন মনস্তত্ত্বকে সম্ভাব্য সকল উপায়ে নিজের আয়ত্বে রাখার চেষ্টা করো। উপনিবেশিক আমলে শাসকগোষ্ঠী সম্ভাব্য সকল উপায়েই এইসব জাতি সমূহের আপন মনস্তত্ত্বকে দখলে সচেষ্ট ছিল; যার মধ্যে অন্যতম এক প্রক্রিয়া ছিল জাতি সমূহের নিজ নিজ বিশ্বাসের হরণ। ভিনদেশী শাসকেরা শোষণের হাতিয়ার হিসেবেই তাদের আপন বিশ্বাসকে এতদাঞ্চলের প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথমেই বেছে নিয়েছিল আদিবাসী অধূষ্যিত অঞ্চলগুলোকে। শিক্ষা, চিকিৎসাসহ কত সেবামূলক কর্মকাণ্ডের আড়ালে দখল করে নিয়েছে মান্দি, খাসিয়া, লুসাই, সাঁওতাল, ওঁরাওদের আপন আপন বিশ্বাসের জায়গাটিকে- যে বিশ্বাস গড়ে উঠেছিল হাজার হাজার বছরের জীবনাচারের মধ্য দিয়ে। গলাটিপে হত্যা করেছে বিভিন্ন বিশ্বাস কেন্দ্রিক নিজস্ব সংস্কৃতির স্বতস্ফূর্ত প্রবাহকে। কি এমন অপরাধ ছিল এই সব সহজ-স্বাভাবিক মনস্তত্ত্বের অধিকারী জাতিসমূহের মানুষের, সেবার নামে কেন তাদের বিশ্বাসকে লুণ্ঠন করে নিতে হবে? সাংসারেক, সারণা, লালেং, ক্রামা, বিষ্ণুপ্রিয়া ধর্মাবলম্বীরাতো কখনো আপন বিশ্বাসকে অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়ার জন্য কারো দ্বারে দ্বারে যান নি। বিশ্বাসতো কখনো চাপিয়ে দেওয়ার জিনিস হতে পারে না, এতো ধারণ করার ব্যাপার- এমন সহজ চিন্তার অধিকারী যারা, তাদের গয়রা-পত্যেন-কালকামি-উ ব্লাই নাংথউ-উ ব্লাই মংতু-সিংবোঙ্গা-গড়াই ঠাকুর-সালজং-সারণা দেবীদের কেন নির্বাসনে পাঠাতে হবে? জনিক নকরেক, রজনী কান্ত সাংমা, টুকিয়া রেমা, দীনেশ নকরেক, জগদীশ চন্দ্র সিং, সমের মাহাতোদের এমন প্রশ্নের জবাব দিবে কে?
উপনিবেশিক বৃটিশ ও পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর মনস্তাত্ত্বিক আগ্রাসন নীতি অপরিবর্তিত থেকে যায় বাঙালি জাতির নেতৃত্বে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পরও। ১৯৭২ সালেই সবাইকে বাঙালি হয়ে যাওয়ার জন্য শাসকগোষ্ঠীর আহ্বান সত্যিই অবাক করেছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম সহ দেশের অন্যান্য জাতির মানুষদের। সংবিধানে আদিবাসী জাতিসমূহের অনুপস্থিতি, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় আদিবাসী অঞ্চলগুলোতে তাদের সংখ্যালগু করে দেয়া, ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সাংবিধানিক ঘোষণা, নানান আগ্রাসী উন্নয়ন প্রকল্প, সেনাশাসন, শিক্ষা ক্ষেত্রে আদিবাসী শিশুদের নিজ নিজ মায়ের ভাষার পরিবর্তে বাংলায় পাঠ গ্রহণে বাধ্য করা, পাঠ্যপুস্তক-বাংলাপিডিয়া সহ বিভিন্ন জায়গায় আদিবাসীদের হীনভাবে উপস্থাপন, প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহের উগ্র-মৌলবাদী শক্তির সাথে ক্ষমতার ভাগাভাগি বা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য চুক্তি এসবই আদিবাসী জাতিসমূহের সহজ-স্বাভাবিক মনস্তত্ত্বের জন্য হুমকি হিসেবেই দেখা দিয়েছে। এছাড়া শাসকগোষ্ঠী বরাবরই চেষ্টা চালিয়েছে অধিপতি জাতির সাধারণ মনস্তত্ত্বকে নিপীড়িত জাতির মনস্তত্ত্বের বিরোধী পাটাতনে দাঁড় করাতে। এক্ষেত্রে শাসক গোষ্টী বেশ সফলই বলা চলে। হাতেগোনা কিছু ছাড়া প্রায় সব বাঙালিই চাকমা-মারমা-খাসিয়া-মৈতৈ-পাত্র-মান্দি নির্বিশেষে সবাইকেই বাঙালি জাতির অধীন উপজাতি(!), বহিরাগত (অন্যদেশ থেকে আগত অর্থে) হিসেবে ভাবতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এছাড়া পার্বত চট্টগ্রামে সেনাশাসনসহ অন্যান্য বিষয়, ইকোপার্ক ইস্যুতেও শাসকগোষ্ঠীর মনস্তত্ত্বের সাথে উচ্চ শিক্ষিত-নিরক্ষর খেটে খাওয়া বাঙালি মানুষজনের মনস্তত্ত্বের তেমন কোন ফারাক খুঁজে পাওয়া যায় না।
পণ্য সংস্কৃতির বিশ্বায়নের মধ্য দিয়ে কর্পোরেট দুনিয়া তার মুনাফা তুলে নিচ্ছে পৃথিবীর আনাচ-কানাচ থেকে। কর্পোরেট সংস্কৃতি বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন জাতির মানুষ কিভাবে নিল-না নিল সেটা তাদের কাছে কোন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় না। তাদের চেষ্টাই থাকে যে করেই গেলাতে বাধ্য করানোর। একাজে তাদের কত সৈন্যসামন্ত, স্যাটেলাইট চ্যানেল, পত্র-পত্রিকা। তাদের চাতুর্যপূর্ণ কলাকৌশলের কাছে কত ভাবেই না বোকা বনে যাচ্ছি আমরা নানান জাতির নানান মানুষেরা। একদিকে যেমন কর্পোরেট পূঁজির টাকায় উন্নয়ন সন্ত্রাসের তাণ্ডবলীলা, তার পাশাপাশিই রয়েছে এইসব নিপীড়িত জাতিসমূহের জেগে উঠবার প্রবণতাকে দমিয়ে রাখতে কত মেকি মানবিক উদ্যোগ আর কর্মতৎপরতা। কর্পোরেট দুনিয়া বা তার গর্ভজাত এনজিওরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ন্যায় বাংলদেশেও আদিবাসী ভাষা-সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার (!) কত রকমের উদ্যোগ নিচ্ছে; তাদের অনুদানে আদিবাসীদের নিয়ে কত সভা-সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটক, আদিবাসী উৎসব-মেলা হচ্ছে গ্রামে-শহরে-বন্দরে। কত বিশিষ্টজনের দরদ উপচে পড়ছে (!), চোখ চকচক করছে ফায়দা লুটার ধান্দায়। আদিবাসীদের অংশগ্রহণমূলক বা নেতৃত্বাধীন কত উন্নয়ন-গবেষণা প্রকল্পে, দেশি-বিদেশি সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের নানান বেড়াজালে বন্দি করে কর্পোরেট দুনিয়া তার মনস্তাত্ত্বিক দখলদারিত্বকে পাকাপোক্ত করে নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে! কিন্তু সিঁধু-কানু-চাঁদ-ভৈরব-বীরসা-গঙ্গানারায়ণ সিং-পঞ্চানন শর্মা-লীলাবতী শর্মা-রাশিমনি হাজংদের উত্তসূরীদের লড়াকু মনস্তত্ত্বকে কি এত সহজেই করায়ত্ত্ব করা সম্ভব? লড়াকু মনস্তত্ত্বের লড়াকু সৈনিকদের যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবেই কল্পনা চাকমা-পীরেন স্নাল-গিদিতা রেমা-সেন্টু নকরেক-আলফ্রেড সরেনরা কী আবারো প্রমান করে যাননি- নিপীড়িত জাতির দ্রোহী মনস্তত্ত্ব আপসকামীতাকে কখনো প্রশ্রয় দেয় না, দ্রোহে-প্রতিরোধে তা জেগে উঠবেই উঠবে।
৪.তবু আকাঙ্খা আছে বেঁচে থাকবার-দ্রোহী পাটাতনের শামিল হবার
“নুসৌসাবোনে, নওয়ারাবোন চেলে হুঁ
বাকো তেঙে গান,
খাঁটি গেবোন হুল গেয়া হো,
দিশম দিশম দেশ মৌঞজহি পারগানা
নাতো নাতো মাপঞিজি কো
দুঃক্ বোন দানাংবোন কংগেকো তোঙ্গোন
তবে ছো বোন হুল গেয়া হো।”
[একটি সাঁওতালী গান; ভাবানুবাদঃ আমরা নিজেরাই বাঁচব/ কেউ আমাদের পাশে দাঁড়াবে না/ তবু আমরা বিদ্রোহ করব/ গ্রামের মাঝি মোড়লরা সাহায্য করবে/ কেউ পাশে দাঁড়াবে না।]
সাংসারেক ধর্মীয় বিশ্বাস মতে, মান্দি মিদ্দিদের (দেবতাদের) মধ্যে শৌর্য-বীর্যে প্রধান ছিলেন মিদ্দি গুয়েরা। মিদ্দি গুয়েরা মানুষের বেশে যখন মায়ের গর্ভ থেকে পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হন তখন থেকেই বিপদে আপদে তিনি মানুষকে রক্ষা করে চলেছেন। মায়ের গর্ভে থাকা কালীন সময়েই মিদ্দি গুয়েরা- রাক্কা গুয়ের/আগল সাকবো/আওয়া ওয়াঙা ওয়াঙ্গা/মাচ্ছাদো মাচ্ছা বেকফ্রেং/নুরুমান্দি দিমারিশিখো/মিন্নো আঙ্গা খিন্নো আঙ্গানা/হিঙ্খো আঙ্গা স্খু-সতনা ওয়াগংসিঙ্গত্ন/সংনাগ্রেংরিপনাঙ্গারিবাজক/রাক্কা গুয়েরা... । এরকম গাথেম্মাসহ গ্রীকা করে করে দুনিয়ার সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করবার চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। পুরো ৩২ টি দাঁত আর দাঁড়ি-গোঁফ নিয়ে মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেয়া গুয়েরা মানুষকে শিখিয়ে গেছেন কিভাবে দুনিয়ার শক্তিশালী শয়তানদের বিরুদ্ধে সাহস নিয়ে দাঁড়াতে হয়। একাই তখনকার দিনে যত শকষ-শয়তান ছিল যারা মানুষের উপর চরম অত্যাচার করত তাদেরকে দমন করে গুয়েরা তার পরিবারসহ চলে গিয়েছিলেন আসং ফাতেং-চিগা সিম্মল দেং দেং নামক স্বর্গে সেখানে গিয়েও তিনি দুনিয়ার মানুষকে ভুলে যান নি, বিপদে পড়লে তাঁকে স্মরণ করার পথ বাতলে দিয়েছেন, বলে দিয়েছেন শেষ শক্তি দিয়ে লড়াই করে যাওয়ার। বিপদে-আপদে সাংসারেকরা আজও মানসার আয়োজনে গুয়েরার কাছে আশীর্বাদ চান, লড়াই করার শক্তি চান। মিদ্দি গুয়েরাও কখনো নিরাশ করেন না মান্দি (আচিক ভাষায়-মান্দি- বলতে বুঝায় -মানুষ)দের। হ্যাঁ, মিদ্দি গুয়েরার আশীর্বাদেই দুনিয়ার সকল জাতির সকল মানুষেরা সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে নিজেদের লড়াই আজও জারি রেখেছেন। ইতিহাসে মাদল, ধামসা, আদুরি, মইবঙ, নাগড়ার তালে গ্রীকা (আচিক শব্দ -গ্রীকার- বাংলা -যুদ্ধনৃত্য বুঝা যেতে পারে) হয়েছে বারেবারে। মান্দি বিদ্রোহ(১৭৭৫-১৮৮২),পাহাড়িয়া বিদ্রোহ (১৭৮৯-৯১), চোঁয়াড় বিদ্রোহ (১৭৯৮-৯৯), ভীম বিদ্রোহ (১৮১৮), খাসিয়া বিদ্রোহ (১৮২৯-৩৩), কোল বিদ্রোহ (১৮৩১-৩২), নাগা বিদ্রোহ (১৮৩৯), শবর বিদ্রোহ (১৮৫৩), সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৬), মুণ্ডা বিদ্রোহ(১৮৯৯-১৯০১) চাকমা বিদ্রোহ, রিয়াং বিদ্রোহ (১৯৪২-৪৩), তেভাগা আন্দোলন (১৯৪৬-৪৭), হাজং বিদ্রোহের (১৯৪৫-৪৬) ছপাতি নকমা-সিঁধু মাঝি-কানু মাঝি-বীরসা মুণ্ডা-গঙ্গানারায়ণ সিং-জুম্মা খাঁন-তীর্থ সিং-বুরামানিক-মুকুন্দ সিং-শিবরাম মাঝি-হপন হার্ডি-গহনুয়া মাহাতো-মাকটু সিং-ফাগুয়া কোলকামার-তৎনারায়ণ বর্মণ-সর্বেশ্বর ডালু-বুধু খেড়িয়া-রামু মুণ্ডা-লছমন সিং-করমী ওঁরাও-বুধনী ওঁরাও- স্বর্ণময়ী ওঁরাও-রাশিমণি হাজংদের উত্তরসূরী হিসেবেই মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, কল্পনা চাকমা, গিদিতা রেমা, অবিনাশ মুড়া, অধীর দফো, আলফ্রেড সরেন, সেন্টু নকরেক, পীরেন স্নালরা সংগ্রামের বহমানতাকে চালু রেখে গেছেন পার্বত্য চট্ট্রগ্রামে, মধুপুরে, উত্তরবঙ্গে, খাসিয়া পুঞ্জিগুলোতে। আপন আপন সংস্কৃতির লড়াকু মনস্তত্ত্বই তাঁদেরকে বারেবারে নিয়ে এসেছে-অস্তিত্ত্ব রক্ষার অবিনাশী সংগ্রামে। রাষ্ট্র যতই এইসব জাতিসমূহকে আড়াল করে রাখুক না কেন তাদের কুরুখ,আচিক, ঠার, লালেং, নাগরী, ওঁরাও, খিয়াং, সান্তালী, সিং, ককবরক, মারমা, মৈতৈ, চাকমা, খুমী, ম্রো প্রভৃতি ভাষার প্রতিটি শব্দ, বাক্য একেকটি সংগ্রামী হাতিয়ার। আজও দকমান্দা, দকশাড়ি, পিনন, রিনাই, থামি, রিসা, কা জিমপিন, জৈনসেমের প্রতিটি বুননেই মান্দি-চাকমা-মারমা-ত্রিপুরা-মৈতৈ-খাসিয়া নারীরা গেঁথে চলেছেন আপন আপন সংস্কৃতির প্রতিরোধী বাঁধ। রাষ্ট্রীয় আস্কারায় কর্পোরেট পূঁজি দেশের আনাচে-কানাচে, রাজধানীতে আদিবাসীদের নিয়ে যতই নাটক, নাচ, গান মঞ্চায়ন করে নিজেদের জাহির করে বেড়াক না কেন, তিরেশ নকরেক-মাখন লাল বর্মণ-ভগবান সিং-লক্ষীন্দর সিং-বেহুলা সিং-জগদীশ সিং-খামাল কুনেন্দ্র Pv¤^yMs-Elv রাণী মাহাতোদের শেরেনজিং-আজিয়া-রেরে-হাস্তর-দিগ্গ্যিবান্দি-গেংখুলি-রাসলীলা-ঝুমুরের সংগ্রামী উপস্থাপন আকাঙ্খাকে কখনই দমিয়ে রাখতে পারেনি, পারবেও না। কেননা তিরেশ-মাখন-ভগবান-লক্ষীন্দর-বেহুলা-কুনেন্দ্র-ঊষা রানীরা কোন বাণিজ্যের আশায়, পদকের আশায় নিজেদের জাহির করেন না। এ তাদের অস্তিত্বের লড়াকু জানান। গুনীন-ওঝা-দেবর্ষি-পাহান-সেম্মা খামাল-মিদ্দি খামাল-নায়েকে-লাংদুহ-কার্বারি-নকমা-আতু মাঝি-দিশম মাঝি-পারগানা-পরধান-মাথা-মন্ত্রী-রাজা এখনো অকার্যকর হয়ে যায়নি। পরাক্রমশালী বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েইতো আপন বিশ্বাসের দ্রোহী অবগাহন নিরন্তর জারি রেখে চলেছেন রজনী কান্ত সাংমা, সতীশ চন্দ্র মাহাতো, জনিক নকরেক, অনিতা মৃ, মানিক চন্দ্র সিং, নরেন্দ্র মারাক, রাগেন নকমারা। এই বিশ্বাসী লড়াইয়ের কোন বিনাশ হতে পারে না। আপন বিশ্বাস আর সংগ্রামের যুথবদ্ধতার মধ্য দিয়েই এই ভূখণ্ডের বিপন্ন জাতির বিপন্ন মানুষেরা আপনার অস্তিত্বের জানান দিয়ে যাবেন নিরন্তর-এমন লড়াকু বিশ্বাসকে এই রাষ্ট্র, সাম্রাজ্যবাদী কর্পোরেট দুনিয়ার কোন কলাকৌশলই রুখতে পারে না। সিঁদু-কানু-বীরসা-রাশিমনি-আলফ্রেড-পীরেন-কল্পনা-গিদিতা-সেন্টু-অবিনাশদের উত্তরসূরীরা নিজেদের অস্তিত্বের জন্যই বারেবারে জেগে উঠবেন ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে, আঘাতে আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেবেন রাষ্ট্র-বিশ্ব-বহুজাতিক কোম্পানিসহ সকল আগ্রাসী-নিপীড়ক-দখলদারি মনস্তত্ত্বকে, আপন ভূমি-সংস্কৃতি-বিশ্বাসের আপন অধিকার ও চর্চার মধ্য দিয়েই প্রতিনিয়ত তাদের নিজস্ব অস্তিত্ত্বের লড়াকু জানান দিয়ে যাবেন ।
( লেখাটি রাঙামাটির জুম ঈসেথটিকস কাউন্সিল-জাক এর বৈসুক-সাংগ্রাই-বিঝু সংকলন ২০০৭ লামপুক (রনেল চাকমা সম্পাদিত) এ প্রকাশিত)
তারপরেও মাংতারা টিকে আছেন আপসহীন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে
জুয়েল বিন জহির
১.
!
দখল
নদী দখল, খাল দখল, বিল দখল
নদীর জল দখল, জলের মাছ দখল, শ্যাওলা দখল
ব্যাঙ দখল, পোক-মাকড় দখল, শামুক দখল, ঝিনুক দখল
ওছা দখল, বিণ দখল, ঝুড়ি দখল, শিং দখল, জুংলি দখল, ঝান্টা দখল
ঠার দখল, কিচ্ছা দখল, গীত দখল, খেলা দখল, নাম দখল,সমাজ দখল
দাড়াইস, কালিপানো, সুতানালি, দুধরাজ, জাইত, গোখরা, আলাজ, বীনরাজ দখল
পাতরাজ, টুনটুনি, গলাকাটি, লালটিঙি, পিরপিরে, টিয়াঠুটি, সুতাশঙ্খ, কালিনাগ, অজগর দখল
চারপাশের সব কিছুই দখল হয়ে যাচ্ছে। তাদের আবাসস্থল, নদী-নালা-খাল-বিল, জলের মাছ, সাপ, ব্যাঙ, কাকড়া, শামুক, ঝিনুক ইত্যাদি সব কিছুই। অথচ দখল করার মতন তারা নিজেরা কোন কিছুই খুঁজে পান না। একে তো তাদের পুস্তকি জানাশোনা নেই তার উপর জ্ঞান-গম্মিও বেজায় কম (!)। এত কম জ্ঞান নিয়ে তো আর দখলের মতন জটিল বিষয় মাথায় খেলানো চাট্টিখানি কথা নয়। জীবিকার জন্য বাপ-দাদারা যে সামান্য কিছু বিদ্যেটুকু শিখিয়ে দিয়ে গেছেন তাতে তো আর দখল জিনিসটাকে রপ্ত করার মতন কোন ব্যাপার ছিল না। কেবলমাত্র দাড়াইস, কালিপানো, খইয়াপানো, দুধরাজ, সুতানালি,জাইত, গোখরা, আলাজ, বীনরাজ, পাতরাজ, টুনটুনি, গলাকাটি, লালটিঙি, পিরপিরে, টিয়াঠুটি, সুতাশঙ্খ, কালিনাগ প্রভৃতি নানান জাতের বিষধর সাপ ধরা, বীণ বাজিয়ে সাপের খেলা, সাপের বিষ নামানো, বানরের নাচ ও যাদুর খেলা দেখানো; কাঁচের চুড়ি, কাপ-পিরিচ, মুক্তার মালা, কড়ির মালা বিক্রি; নানান জাতের লতা-পাতা, শিকড়-বাকর, মাছের কাটা, জীব-জানোয়ারের হাড়গোর দিয়ে বিভিন্ন রোগের ঔষধ বানানোর কায়দা-কানুন ও মন্ত্র-তন্ত্র, যাদু-টোনা; গরু-মহিষের শিং দিয়ে আপন কায়দায় দেহের বিষাক্ত রক্ত-পুঁজ বের করার মতন সামান্য বিদ্যে টুকুই আত্মস্থ করেছেন, চর্চা করে চলেছেন শত শত বছর ধরে। সভ্য,শিক্ষিত,আধুনিক মানুষেরা তাদের এই জানাশোনাকে নাকসিটকিয়ে উড়িয়ে দিলেও অন্যের জানাশোনার উপর তাদের কোন অবজ্ঞা নেই। বরং অন্যের বিদ্যা-বুদ্ধিকে তারা সম্মান জানিয়ে, সমীহ করেই চলেন। শিক্ষিত মানুষজনেরা তাদের আপন বিশ্বাসকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেও অপরের বিশ্বাসের সাথে তারা তাদের আপন বিশ্বাসের এক যোগসূত্র খুঁজে নিয়েছেন নিজস্ব কায়দাতেই। তাদের কাছে মনসা, খোয়াজ খিজির, গঙ্গা মা সবাই বিশেষ মর্যাদায় আসীন। যুগ যুগ ধরে নদী-নালা-খালের মধ্যে ভাসমান জীবন পার করলেও সেগুলোর উপর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা কখনো ক্যানভাস করে বেড়ান নি। তারা কখনো ভাবেন নি নদী-নালা-খাল এভাবে দখল হয়ে যেতে পারে, বদলে যেতে পারে নদীর-নালার পানির রং, হারিয়ে যেতে পারে নানান জাতের মাছ । তারা কখনো চিন্তাই করেন নি ডাঙ্গার শিক্ষিত, বুদ্ধিমান মানুষেরা এভাবে সাপ, ব্যাঙ, শামুক, ঝিনুক, ছাইপ্লা, পশু-পক্ষীর হাড়গোড়, মাছের ঠোঁট-কাটা সব বিনাশ করে ফেলবে, নাই করে ফেলবে। তাদের বিশ্বাসকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে মোটেই লজ্জিত নয় ডাঙ্গার মানুষ জনেরা, কোন কষ্টই অনুভুত হয় না মনে। এভাবে সবকিছু তছনছ করার মধ্যেই নাকি গিরস্ত (ঘরে বাস করা অর্থে) মানুষের বাহাদুরি (!) প্রকাশ পায়। কিন্তু নদী হারানো, খাল-বিল-নালা হারানো, হরকসম মাছ, সাপ, গাছ-গাছালি, পশু-পক্ষী, জীব-জানোয়ার হারানোর কষ্টতো বুকের গভীর থেকে কিছুতেই মুছতে পারেন না অশিক্ষিত, কম জ্ঞানওয়ালা মানুষেরা। ভুলতে পারেন না নিজেদের নাম-পরিচয় আড়াল হয়ে যাওয়ার বেদনা। কিন্তু তারপরেও এইসব অচ্ছুত, অশিক্ষিত, কম জ্ঞানওয়ালা মানুষেরা টিকে আছেন অবশিষ্ট নদী-নালা, জীব-জানোয়ার, পশু-পক্ষী নিয়ে, আজীবন চর্চিত সামান্য বিদ্যেটুকুকে পুঁজি করে; ডাঙ্গার মানুষজনের কাছে না হোক অন্তত নিজেদের আগামী প্রজন্মকে জানাতে তাদের নাম-পরিচয় আর জলের ঢেউয়ে ভাসমান জীবনের কথা।
২.
আমরা বাইদ্যা না, বেদে না; আমরা বাইদ্যা না, বেদে না; আমরা বাইদ্যা না, বেদে না;...
আমরা মাংতা, আমরা মাংতা, আমরা মাংতা, আমরা মাংতা, আমরা মাংতা, আমরা মাংতা, আমরা মাংতা...
...অন্ত্যজ বর্ণের... বেদে প্রভৃতিদেরই অন্যতম বৃত্তি ছিল সাপ-খেলানো, যাদুবিদ্যার নানা খেলা দেখানো ইত্যাদি।...রাজসভায় জাঙ্গলিক বা বিষবৈদ্য অন্যতম রাজপুরুষ ছিলেন...।
[বাঙ্গালীর ইতিহাস(আদি পর্ব), ড. নীহার রঞ্জন রায়]
আমরা সবাই বেদে,বাইদ্যাদের সাথে কম-বেশি পরিচিত। সংস্কৃত বৈদ্য থেকে বাইদিয়া বা বাইদ্যা শব্দের উৎপত্তি। বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা ভাষার অভিধানে বেদে, বেদিয়া, বাইদিয়া শব্দের অর্থ বলা হয়েছে যাযাবর, সাপুড়ে জাতি বিশেষ, বিষবৈদ্য । প্রাচীন বাংলায় লোকচিকিৎসা পেশায় জড়িত অন্ত্যজ বর্ণের একদল লোক কালক্রমে অন্যান্য উচ্চ বর্ণর লোকজনের কাছে বৈদ্য,বাইদ্যা,বেদে প্রভৃতি অভিধায় পরিচিত হয়ে ওঠে। উচ্চ বর্ণর দেয়া এইসব অভিধায় পরিচিত ওঠার পাশাপাশি আড়াল হয়ে যেতে থাকে অন্ত্যজ বর্ণর আপন জাতিগত পরিচয়। তাছাড়া উচ্চ বর্ণ কর্তৃক অন্ত্যজ বর্ণর নাম-পরিচয় আড়াল করে দেওয়ার পেছনে যে নিজের সাপেক্ষে অপরকে নিচু,নিকৃষ্ট,ঘৃণিত রূপে প্রতিপন্ন করার একটা প্রবণতা থেকে যায় তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু এইসব বর্ণ দেমাগি দৃষ্টিভঙ্গির সাথে কখনোই একাত্ম হতে পারেন নি সেই অন্ত্যজ বর্ণর লোকজনেরা; মেনে নেন নি অন্যের দ্বারা নিজেদের জাতিগত নাম-পরিচয় আড়াল হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটাকে। অধিপতি শ্রেণীর চাপিয়ে দেয় নানান অভিধার বিপরীতে সেই অন্ত্যজ বর্ণর লোকেরা আজও নিজেদের জাতিগত পরিচয় মাংতা হিসেবেই দেন; বাইদ্যা বেদে বা বেবাইজ্যা বলে নয়।
...এইযে বাইদ্যা কয়, আমাগো ভিতরে একটা খারাপ লাগে, কেন খারাপ লাগে; যে আমরা তো বাইদ্যা না। তোমরা এই যে একটা নাম রাখছ, বলতাছ-তোমরা এই নামটা পাইলা কোনথন। অহন তোমাগো জিগাইতে গেলে একটা ঝগড়া আসে। ...আমরাতো বাইদ্যা না। ...আমাগো জাতের নাম আছে, আমরা মাংতা।
[ মোন্তাজ মাতবর(৬০), রিকাবী বাজার বহর, মুন্সীগঞ্জ ]
মাংতাদের জাতিগত উৎপত্তি নিয়ে বেশ কয়েকটি অষ্পষ্ট মতভেদ প্রচলিত রয়েছে; যার কোনটিই তাদের জাতিগত উৎপত্তি বা অরিজিন নিয়ে পরিস্কার কোন ধারণা দিতে সক্ষম নয়। ড. শেখ মাকসুদ আলী সম্পাদিত বাংলাদেশ জেলা গেজেটিয়ার-বৃহত্তর ঢাকা তে উল্লেখ রয়েছে, বেদে সমপ্রদায় কতদিনের পুরনো তা বলা সম্ভব নয়। তবে এদেশের শহর-বন্দর ও গ্রামে এদের বিচরণ দীর্ঘদিনের। এরা আমাদের সামাজিক জীবনের সাথে মিশে আছে।
বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির বাংলা পিডিয়াতে মাংতাদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে, ১৬৩৮ সালে আরাকানের বল্লাল রাজার সাথে সেখানকার মনতং জাতিগোষ্ঠীর একটা অংশ বিতারিত হয়ে প্রথমে বঙ্গদেশের বিক্রমপুরে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং পরবর্তীতে এরা বঙ্গদেশ ও আসামের প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েন। এছাড়া মনতং জাতিগোষ্ঠীর থেট বা ঠেট ভাষার সাথে বেদে বা মাংতাদের ঠার ভাষার নাকি মিলও রয়েছে।
এই সূত্র মতে আরাকান থেকে মাংতাদের এতদাঞ্চলে প্রথম আগমনের সময় কাল ১৬৩৮ সাল উল্লেখ করা হলেও আরো অনেক থেকেই প্রাচীন বাংলায় মাংতাদের উপস্থিতি ও তাদের পেশাগত পরিচিতির প্রমাণ পাওয়া যায়। ড. নীহার রঞ্জন রায় তাঁর বাঙ্গালীর ইতিহাস গ্রন্থের আরেক জায়গায় উল্লেখ করেছেন,...অন্ত্যজ পর্যায়ের আর একটি বর্ণের খবর দিতেছেন বন্দ্যঘটীয় আর্তিহর পুত্র সর্বানন্দ (১১৬০)। ইহারা বেদে বা বাদিয়া; বাদিয়ারা সাপ খেলা দেখাইয়া বেড়াইত ( ভিক্ষার্থং সর্পধারিণি বাদিয়া ইতি খ্যাত)। এছাড়া যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত ১৩১৬ বঙ্গাব্দে তাঁর বিক্রমপুরের ইতিহাস প্রথম খণ্ডে মাংতাদেরকে হিন্দু সমাজেরই একটা বর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন-...বিক্রমপুরে বহুজাতীয় লোকের বাস। হিন্দুদের মধ্যেই বিভিন্ন জাতি ও তাহার শ্রেণীবিভাগ আছে। ... বৈদ্য, কায়স্থ, জেলে, কৈবর্ত, বৈষ্ণব, বারুই, বেদিয়া (বাইদা), বেলদার, ভূঁইমালি, ধোপা, গোপ (গোয়ালা), ঝাল-মাল, যুগী...।
অনেকের মতে মাংতারা দ্রাবিড় ভাষা-ভাষী কোন জাতি। এছাড়া নিজেদের জাতিগত উৎপত্তি নিয়ে মাংতাদের নিজস্ব কিছু ধারণা রয়ে যা মুখে মুখে বংশপরম্পরায় আজও টিকে আছে।
“... বিভিন্ন এলাকায় মাংতা আছে। কিন্তু অদের ভাষা আবার অন্য। ...আরবিয়ান মাংতা আছে আরবি ভাষা। আমরা বুঝব না। আমাগো ভাষা অরা বুঝে না। জাত সব একই, জাত সব মাংতা। ...আমাগো গোড়াটা ঐ আরব থেইকাই আইছে।”
[ মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন (৫২), মিরকাদিক পৌরভবন সংলগ্ন, মুন্সীগঞ্জ]
“...আগে মুরব্বিরা কইছে, নুহু নবীর কিস্তি আছিল। ... তয় নুহু নবীর ছিলছিলায় যেমুন আমরাও নৌকায় বসবাস করতাছি। ...ঐ আমল থেকাই। নুহু নবীর ছিলছিলাতেই আমরা আইছি...অখান থেনই আরকি আমাদের নৌকায় থাকা পড়তাছে...।”
[ মোন্তাজ মাতবর(৬০), রিকাবী বাজার বহর, মুন্সীগঞ্জ]
মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন ও মোন্তাজ মাতবরের ন্যায় মাংতাদের অনেকে মনে করেন যে, তাদের মাংতা জাতের উৎপত্তিস্থল আরবে বা তাদের নৌকায় বসবাসের শুরু হয়েছে নূহ্ নবীর সেই প্লাবনের সময় থেকেই। নিজেদেরকে মনে করেন নূহ্ নবীর বংশধর হিসেবে। সেই ছিলছিলাতেই তাদের নৌকায় বসবাস।
আমি নূহ্কে প্রেরণ করেছিলাম তাঁর সমপ্রদায়ের প্রতি একথা বলেঃ তুমি তোমার সমপ্রদায়কে সতর্ক কর, তাদের প্রতি মর্মন্তদ শাস্তি আসার আগে।
(সূরা নূহ্, আয়াত-১)
নিজ সমপ্রদায়ের লোকজন যখন বারে বারে হযরত নূহ্ নবীর প্রচারিত বাণীকে অস্বীকার করতে লাগল তখন তাদের উপর মহাপ্লাবন হিসেবে কঠিন শাস্তি নেমে এসেছিল। নূহ্ নবী তাঁর অনুসারীদের নিয়ে বিশালাকার কিস্তিতে চড়ে সেই প্লাবনে নিজেদের রক্ষা করেছিলেন। ছয় মাস আটদিন কিস্তিতে থাকার পর নূহ্ নবী তাঁর আশিজন অনুসারী নিয়ে জুদি পর্বতে ( খ্রিস্টানদের মতে নূহ নবীর কিস্তি এসে থেমেছিল আর্মেনিয়ার Mt. Ararat এ, যা থেকে জুদি পর্বত ১৮০ মাইল দূরে অবস্থিত ) এসে থামেন। পরবর্তীতে এই পর্বতের পাদদেশেই থামানিন (Thamanin) নামের এক জনপদ গড়ে ওঠে। এই জুদি পর্বতটি অবস্থিত বর্তমান তুরস্কে। প্লাবনের পর নূহ্ নবীর জীবিত তিন ছেলের মধ্যে হামের বংশধরদের পাক-ভারতের একাংশ, আফ্রিকা ও ইউরোপ; শামের বংধরদের দ্বারা আরব ও পার্শ্ববর্তী দেশ সমূহ; ইয়াসেফের বংশধরদের দ্বারা তুরস্ক, রোম প্রভৃতি অঞ্চল জনবসতিপূর্ণ হয়। জানা যায়- শাম, হাম ও ইয়াসেফের বংশধরদের মধ্যে যথাক্রমে ১৯, ১৮ ও ২৬ টি পৃথক ভাষার সৃষ্টি হয়। হাম ও শামের বংশধরদের ভাষাগুলোকে ভাষাতাত্ত্বিকেরা হেমিটিক-শেমিটিক ভাষাগোষ্ঠী ভূক্ত করেছেন। হেমিটিক-শেমিটিক ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত আরবি ভাষায় বাদিয়াহ্ বলে একটা শব্দ আছে যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় যাযাবর। তবে এই বাদিয়াহ্ বলতে যে মাংতাদেরই বুঝানো হয়েছে তা নিশ্চিত নয়। এখন মাংতা জাতিগোষ্ঠীটি ঠিক কখন কীভাবে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য পরিচয় নিয়ে নূহ নবীর কিস্তির ছিলছিলায় নিজেরা নৌকায় বসবাস ও যাযাবর জীবন শুরু করেন তা বের করা দীর্ঘ গবেষণা সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বর্তমানে মাংতাদের নিজস্ব ঠার ভাষার ধাতু ও ক্রিয়াপদ বাংলা তথা ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারের ন্যায়। তবে ঠার ভাষার বর্তমান এইরূপ দীর্ঘদিন বঙ্গদেশে অবস্থানের ফলে বাংলা বা ইন্দো-আর্য পরিবারের অন্যান্য ভাষা দ্বারা যে অনেক খানিই প্রভাবিত তা মোটামুটি নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়। মাংতাদের ঠার ভাষায় যে নিজস্ব কিছু শব্দ আছে যেমনঃ খাইপ্তা (বাবা), খাইপ্তানি (মা), খুপি (লবণ), ছাইম্লা (মাছ), ময়াল (সাপ), উড়ুম (চিড়া), বতুন (ভাত), লেবন (তরকারি), উজ্জালি (মাংস), ছোলতা /মইল্ত (ঔষধ), বেলং (তেল), আম (তুওম), দকলা (কলা), ডুওম (মাথা), গেসকই (চুল), গুন্কি/গুনারি (চোখ), বক (রক্ত) গেইত্লা (হাড়ি), দবলা (কুলা), পেছকো (দা), টোঙ্গা (জুতা), বুইত্কাল (কুকুর), নেওয়ারি (পানি), কাইকাল (পরিবার), বম্কই (মায়ের দুধ) ইত্যাদি ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে গণ্য হতে পারে।
৩.
চুড়ি লাগব নি চুড়ি...;লাগব নি কাঁচের কাপ-পিরিছ, প্লেট-বাটি... ;খেলা দেখাইগো খেলা, সাপের খেলা দেখাই...; রস টানি, বাত টানি, কোমড় টানি, মাঝা টানি, চোখের পোকা, দাঁতের পোকা ফালাই, শিঙ্গা লাগাই...; খা খা খা বক্ষিলেরে খা, কিরপিনেরে খা...
ক্ষুদ্রান্তে ভূজগাঃ শিরাংসি নময়ত্যাদায় যেষামিদং
ভ্রাতর্জাঙ্গালিক ত্বদাননমিলন্মন্ত্রানুবিন্ধং রজঃ।
জীর্ণস্তেষফণীন যস্য কিমপি ত্বাদৃগগুণীন্দ্রব্রজা-
কীর্ণক্ষ্মাতলধাবনাদপি ভজত্যানম্রভাবং শিরঃ।।
ভাই জাঙ্গালিক (সাপুড়ে), তোমার এই সাপগুলি ছোট ছোট; তোমার মুখের মন্ত্রপড়া ধূলি ইহাদের মাথা নমিত করিয়া দিতেছে। এই ফণাধারী সাপটি বোধ হয় জীর্ণ (অর্থাৎ প্রবীণ বা অভিজ্ঞ), কেননা তোমার মতো গুণী দ্বারা পূর্ণ মাটিতে ধাবন করিয়াও ইহার মাথা নম্রভাব হইতেছে না (অর্থাৎ নমিত ভাব হইতেছে না)।
উমাপতি ধরের এই সংস্কৃত শ্লোকের ন্যায় সাধারণের কাছে বেদে,বাইদ্যা শব্দের সাথে সাপ ধরা বা সাপের খেলা দেখানোর বৃত্তিটাই অধিকতর স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এছাড়া গল্প-উপন্যাস বা সিনেমাতেও বেদে বলতে কেবলমাত্র সাপুড়েরাই বারবার উপস্থাপিত হয়ে আসছেন। তবে এর বাইরেও যে মাংতাদের আরো পেশাগত বৈচিত্র্যতা রয়েছে এবং এই পেশাগত বৈচিত্র্যতার সাথে সাথে তারা বেশ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত তা, অনেকের কাছেই হয়ত স্পষ্ট নয়। ড. শেখ মাকসুদ আলী সম্পাদিত বাংলাদেশ জেলা গেজেটিয়ার-বৃহত্তর ঢাকা এর আরেক জায়গায় বলা হয়েছে- ...বেদে সমপ্রদাযের বেশ কটি জাত রয়েছে। ... এদের মধ্যে বৈদ্য, বৈরাল ও সাখার শ্রেণী প্রধান। এদের জীবন ও জীবিকা ভিন্নতর না হলেও রীতি-নীতি ও আকারে কিন্তু পার্থক্য রয়েছে।
মাংতাদের মতে, তাদের কয়েকটা জাত আছে। এক জাতের সাথে আরেক জাতের পেশাগত পার্থক্য ছাড়াও রীতিনীতে রয়েছে স্বাতন্ত্র্যতা বাংলাদেশের মাংতারা মালবৈদ্য, তৈল বা বান্দারিয়া, সাপুড়িয়া, মিসিগারি, বৈরাল, বাজিকর, শৈল, সওদাগর বা সান্দার বা লাইয়ো ইত্যাদি ভাগে বিভক্ত।
“...মাল মাংতা যারা, তারা নেয়ারবইনা করে। নেয়ারবইনা অইল ঐ যে শিঙ্গা লাগায়, পোকাটোকা ফেলায়...। তৈল মাংতা যাদের কয় ওরা বাঁদর লিয়া খেলায়। একপ্রকার আছে মিসিগারি মাংতা, অরা চহের (চোখের) পর্দা কাটে। তারপরে একপদের আছে লাইয়ো মাংতা, ...তারা ঐ কাপ-পিরিচ বেঁছে; আরেক পদের আছে বৈরাল মাংতা-মাছ ধরে, বড়শি বায়। আছে হাবুখেলা মাংতা-এইগুলি ইণ্ডিয়ায়। অরা হাবুখেলায়।...মানে ‘হাব হাবু হাবু কার বাড়ি যাবো ...’এরম কইরা মেয়েছেলে সবাই গেরাম করে। এমন কইরা সাইর গাইব আর টাকা উঠাইব। তারপরে আবার আছে লেল্লছ মাংতা। লেল্লছ মাংতা ওরা কী আবর্জনা খায়। যেমন-ব্যাঙ খায়, কুইছা খায়, সাপ খায় ওদের লেল্লছ বলা হয়। চাইয়া-চিন্তা খায় আরকি। বাংলাদেশে নাই, ওটা ভারতে। আরেকটা আছে ভাল্লুকধারী মাংতা। অরা ভাল্লুক লইয়া গেরাম করে। যারা ধামাধন্নি তারা ধামা (টুকরি) নিয়া ঘুইরা বেড়ায়, ... অনেক মালছামানা বেঁছে, অষুধঅ বেঁছে।...এই দুইটাঅ ভারতে। আরেক পদের আছে সাপুইড়া মাংতা। তারা সাপ খেলা দেখায়। মেয়ে-পুরুষ সবাই। ওদের সাপুইড়া বলা হয়। ঠিক আছে, আরেক পদের আছে বাজিকর, বাংলাদেশে আছে। যাদু দিয়া ময়নার ছাও, পুতুলের ছাও বানায়’, এইটার নাম ‘কতিখেলা’। ঐ গেলে বলে যাদুখেলা আর মাংতা বলে কতিখেলা।”
[ মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন (৫২), মিরকাদিক পৌরভবন সংলগ্ন, মুন্সীগঞ্জ]
মাংতাদের একজাতের সাথে আরেক জাতের রীতিনীতিতে যেমন পার্থক্য রয়েছে, রয়েছে আলাদা আলাদা
সমাজ ব্যবস্থাও। চারপাশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বৃত্তিগত বৈচিত্র্যতা ক্রমেই সংকীর্ণ হয়ে আসছে। নিজেদের একজাতের পেশাকে আরেক জাতের লোকজন যেমন গ্রহণ করছে তেমনি গ্রহণ করছেন অন্য পেশাও। তবে মাংতাদের সব জাতের মধ্যেই আপন চিকিৎসা পদ্ধতির দূর্দান্ত চর্চা রয়েছে।
মাংতাদের একজাতের সাথে আরেক জাতের বিবাহ সামাজিক ভাবে নিষিদ্ধ। তবে বর্তমানে কিছুটা হলেও এর ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। এখন মাংতাদের একজাতের সাথে আরেক জাতের ছাড়াও গিরস্ত বাঙালিদের
সাথেও বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে উঠছে, তবে এর সংখ্যা খুব একটা বেশী নয়।
৪.
গড়াইস, দাড়াইস, দুধরাজ, বেকরাজ, কালিপানো, খইয়াপানো, সুতানালি, বিণরাজ, কোবরা, অজগর, গরুর শিং, কাইক্যা মাছের ঠোট, বনরুইর আঁইশটা, সজারুর কাটা, ময়না-শালিকের ঠোট, কট মাছ, ওরাল মাছের কাটা, ঝিনুক, শামুক, পোকা-মাকড়, মনিরাজ, উলটচণ্ডাল, নিম, তুকমা হায়াত, ঘৃতকুমারি, সাদা তুলসী, অর্জুনবানের গোটা, নদী, খাল, বিল, মাটি...
... রোজার মাসে রাইতে এক মহিলারে লইয়া আইছে কয়জন। ... সাপে কামড় দিছে। ... মন্ত্র পইড়া রোগীরে একটা মইছ (মরিচ) গালে দিলাম, কইলাম-ধর এইটা চাবান দে। খাইল, ধাক অইছে। মইছ (মরিচ) দিয়া পরীক্ষা দিলাম, যদি ধাক না ধরে তয় জানব যে এই রোগী আর বাঁচব না... মাথায় বিষ ওইঠা গেছে।... হেরপর একটা মুরগী কিনা আনলে বেটির আতটা(হাতটা) একটু কাইটা মুরগীটার পুটকিটা ঐখানে লাগাইলাম; রক্তটা লাগাইলাম। লাগাইলাম যদি বিষাক্ত সাপে কামড় দিয়া থাকে লগে লগে মুরগীটা দাপাইয়া মইরা যাইব।..একদম মইরা যাইব। পরীক্ষা অইটাই। ... নতুন ব্লেড কিইন্যা আইনা এই বান্ধের গোড়া কেচা দিলাম।...কেইচা দিলাম নানান গাছগাছালির অষুধ লাগাইয়া। ... অষুধ লাগাই দিলাম মাগো বেটি চিক্কার দিয়া দাপড়ান। এরপর গরম পানি দিয়া ধুইয়া বান ছাইড়া দিলাম, রোগী পুরা সুস্থ।
[হাফিজা (৪৫), মিরকাদিম পৌরভবন সংলগ্ন, মুন্সীগঞ্জ]
যদি গেইজের ব্যারামের রোগীরে বনরুইত মাছের আঁইশটা দিয়া অষুধ বানাইয়া ব্যবহার করান যায় তাইলে গ্যারান্টি, রোগ ভালা অইয়া যাইব।... কট মাছের কাটা, অর্জুনবানের গোটা, আখরোটের ফল মাজা ব্যথার জইন্য উপকার দেয়, বাতের জন্য উপকার দেয়।
[আব্দুল কাদের (৫৫), মুক্তারপুর বহর, মুন্সীগঞ্জ]
অনেকদিনের পুরানি কাঁশির জন্য কুই মাছ খাওয়ানো গেলে কাঁশি ভালা অইয়া যাইব।
[পাগলনি খালা(৫০), কদম আলী গুদারা ঘাট, কাশীপুর নারায়ণগঞ্জ]
...আমি সাপ ধরছি, সাপ নাচাইছি। আমি সাপ ধরছি না-দাড়াইস ধরছি, গড়াইস ধরছি, দুধরাজ, বেকরাজ, জাইত, গোক্েখার, আলাজ, বীনরাজ, পাতরাজ, টুনটুনি, গলাকাটি, লালটিঙি, পিরপিরে, টিয়াঠুটি, সুতাশঙ্খ, কালিনাগ বহু ধরনের সাপ ধরছি।...এইগুলি বাংলাদেশেও ধরছি ভারতেও ধরছি...অনেক সাপ ধরছি আমি।...সাপ ধরা তো কোন ব্যাপার না। সাপ ধরাতো সাবাস। ... কোন কিছূ লাগে না। সাপ ধরা সাবাস আর হাতের ক্যাপাসিটি, চখ্যের নজর। ...তারপরেও সাথে গাছ রাহি, লাঠি রাহি।
[ কান্দার খান (৬৫),খরিয়া মালবৈদ্য বহর, মুন্সীগঞ্জ]
মাংতাদের আপন চিকিৎসা পদ্ধতি বা বৃত্তিগত উপকরণের সবকটিই উদ্ভিদ-প্রাণী বা পরিবেশীয় অন্যান্য উপাদানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট। মাংতাদের আপন চিকিৎসা পদ্ধতিতে তন্ত্র-মন্ত্রের এক অনিবার্য উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলেও পরিবেশীয় জীবীয় বা অজীবীয় উপাদানগুলোও প্রত্যক্ষভাবেই জড়িত। আর এইসমস্ত উপাদান সমূহের ব্যবহারাদির পুরোটাই যে মাংতাদের আপন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে তা বলাই বাহুল্য। মাংতাদের অন্যান্য বৃত্তিসহ নিজস্ব চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগ নির্ণয়ন কৌশল থেকে শুরু করে অষুধপাতি পর্যন্ত্ত পুরো প্রক্রিয়াতেই পরিবেশীয় উপাদানের অপরিহার্যতা লক্ষ্যণীয়।
পুস্তকি জ্ঞান না থাকলেও পূর্বপুরুষের জ্ঞান-অভিজ্ঞতার আলোকে মাংতারা চারপাশের পরিবেশকে অত্যন্ত নিবিড় ভাবে পাঠ করেন। ভৌগলিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের সকল উপাদানের সাথেই মাংতাদের রয়েছে এক সংহত সম্পর্কের; আর এই সংহত সম্পর্কের ভেতর দিয়েই তারা পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের নানা বিষয়াদি রপ্ত করে নেন। এখানে কোন দখল নেই, বিনাশ নেই, পাচার নেই, আছে, কেবল এক অকৃত্রিম বান্ধব সম্পর্কের। এই সম্পর্কই মাংতাদের শিখিয়ে দেয় কোন অসুখ-বিসুখে কখন, কোন সময়ে, কোন গাছের ফল-বাকল-পাতা-ফুল বা শিকড় কতটুকু পরিমানে সংগ্রহ করতে; কীভাবে জুনি পোকা, ইঁদুরের লেজ, কাইক্যা মাছের ঠোঁট, কুঁই মাছ, কোরাল মাছের কাটা, কট মাছের কাটা, ওরাল মাছের কাটা, ধনেশ পাখির ঠোঁট, গরু-ছাগল-মহিষের শিং, ময়না পাখির ঠোঁট, পোকা-মাকড়, বিভিন্ন জাতের সাপ, সাপের বিষ, কুমিরের মাংস, বনরুইয়ের আঁশটে বা প্রাণীর হাড়গোর সংগ্রহ করতে হবে প্রাণীকূল বা গাছ-গাছালির স্থায়ী কোন বিনাশ ছাড়াই। পরিবেশীয় এইসব নানান উপাদান দিয়েই তারা শত শত বছর ধরে দাঁতের পোকা, চোখের পোকা, চোখের ছানি, রস বাত, বিষ বাত, ওরশ্যের ব্যারাম, হাঁপানি, বিভিন্ন রকমের চর্মরোগ, যৌনরোগ, রক্তস্রাব, সাদাস্রাব, সাপের বিষ নামানো সহ নানান চিকিৎসা দিয়ে আসছেন ডাঙ্গার গৃহস্থ মানুষদের। শুধুমাত্র মানুষের চিকিৎসাতেই নয় গৃহপালিত পশুপাখির চিকিৎসা পদ্ধতিতেও তারা সিদ্ধহস্ত। যেমনঃ ভাদ্র-আশ্বিণ মসে গরুকে যদি কুমিরের মাংস খাওয়ানো যায় তাহলে গরু আর জ্বরতে (খুড়া রোগ) পারে না ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রাকৃতিক সম্পদের বিনাশকে তারা কখনোই প্রশ্রয় দেন না; কেননা এইসবের বিনাশকে তারা সার্বিক ভাবে নিজেদের বিনাশই মনে করেন। সভ্য মানুষেরা যখন আরাম-আয়েশ আর মুনাফার লোভে একের পর এক নদ-নদী, খাল-বিল ভরাট করে ফেলছেন, বন-জঙ্গল-পাহাড় সব দখল করে ফেলছেন তখন মাংতারা বাকরুদ্ধ হয়ে যান; এ যেন নদী বা খাল-বিলকে মেরে ফেলা নয়,বন-জঙ্গল ধ্বংস নয়; মাংতাদেরই গলা টিপে হত্যা করা। গৃহস্থ মানুষের কল-কারখানার বিষ দিয়ে পানিকে দূষিত করে হাজার হাজার জাতের জলজ জীবের বংশ নাশ করাকে মাংতারা নিজেদেরই বংশনাশ জ্ঞান করেন। কেননা এই নদ-নদী, খাল-বিলই তো অন্যান্য জলজ জীবের ন্যায় তাদেরও আবাসস্থল, বিচরণ ক্ষেত্র। উপযোগী পরিবেশীয় বিচরণক্ষেত্র ছাড়া কোন জীবই তো স্বাভাবিকভাবে টিকে থাকতে পারে না; মাংতারাও পারছেন না। গৃহস্থ মানুষেরা কীভাবে এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে জানা নেই মাংতাদের; জানা নেই এই ভাবে নদী-খাল-বিল হত্যার কোন বিচার আছে কী না বা থাকলেও কার কাছে তারা চাইবেন এইসব হত্যা, দখল আর বিনাশের। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নদ-নদী, খাল-বিলের পানিতে জীবন পার করলেও এবং ঝোপ-ঝাড়, বন-জঙ্গল থেকে তারা তাদের প্রয়োজনীয় সাপ, ব্যাঙ, পোকামাকড়, পাখি, গাছগাছালি সংগ্রহ করলেও কখনো একরত্তি জায়গাওতো নিজেদের দখলে রাখার কোন চেষ্টা করেন নি কিংবা সাপ, পোকামাকড়, জন্তু-জানোয়ার নির্বিচারে হত্যা করেন নি, পাচার করেন নি, দখল করার কথা ভাবেন নি নদী-খাল-বিল আর পাহাড়-জঙ্গলকে। কিন্তু তারপরেও একের পর এক নদ-নদী-নালা-বিল-খাল সব উধাও হয়ে যায়, জলের মাছ, পোকামাকড়সহ হাজার হাজার প্রজাতির জীব-জানোয়ার, ঝোপ-ঝাড়, বন-জঙ্গল সব উজার হয়ে যায়।
অষুধি গাছ পাইতেতো এহন অনেক সমস্যা। বছরে দুই-একবার ভারত যাইতে অয় গাছগাছন্ত আনতে। আগেতো মধুপুর জঙ্গল থিকা তারপরে রাঙ্গামাটি, বান্দরবন, খাগড়াছড়ি ও চিটাগাংএর পাহাড়ি বন থিকা আনতাম। এহনতো কিচ্ছু নাই, অনেক গাছপালা কাইটা হালাইছে। ...অষুধ পাইতে অনেক কষ্ট অয়।
[ মোঃ আলাউদ্দিন (৪৫),আমিন বাজার ব্রিজ বহর, ঢাকা]
...এইযে রঙের পানিটা, ডাইংয়ের পানিটা নদীর মইধ্যে যেইভাবে ছাড়তাছে -এভাবে মাছ সব মইরা যাইতাছে; আগে বড় বড় বোয়াল মাছ, আইড় মাছ, মিরকা মাছ, রুইত মাছ, বাউস মাছ, চেউয়া মাছ, চাপিলা মাছ, বাইল্যা মাছ, বাইম মাছ অইত, অহন যে কেন অয়না- এই রঙের পানির কারণে। ... বোয়াল মাছ এক ইসাবে নাইই, ... ডাইং মাছ- সেলুং মাছটা বড় অইলে ঐটারে আমরা ডাইং মাছ কই...ঐ জিনিসটাও নাই। ... ছাটা ইছা মাছটা থাকতই পারে না। ...আমারতো আধার দিয়া মাছটা মারতাছি।... কারেন জাল দিয়া মাছ মারতাছি না। ...গিরস্তরা কারেন জাল দিয়া মাছের বীজ শেষ কইরা হালাইছে।... এই রঙের পানিটা মুখে দেওয়া যাইতেছে না, পছা পানিটায় যে গোসল করে তাদেরও ক্ষতি অইতাছে,... শরীরে একটা গোটা অইতাছে। ....যারা পানির ভেতরে থাকে না তাগর খাওয়া পড়ে না।...আমাদের থাকতে অইতাছে, এই পছা পানিই খাইতে অইতাছে।
[মোন্তাজ মাতবর(৬০), রিকাবী বাজার বহর, মুন্সীগঞ্জ]
৫.
আল্লারে মানি, রসুলরে মানি, নবী মানি, মনসারে মানি, বাবা খোয়াজ খিজির মানি,মা গঙ্গীরে মানি, নামাজ পড়ি, রোজা রাহি, খোয়াজ খিজিররে খোদাই সিন্নি দেই, মা গঙ্গীর লাইগা সিন্নি ভাসাই, দেবী মনসারে ভোগ দেই, পৌষ সংক্রান্তির বুড়াবুড়ি পূজায় মানতি দেই...; আমরা মানুষ, আমাগো দেখলে পাপ অইব কেন?...
আদি বিশ্বাস যাই থাকুক না কেন বর্তমানে ধর্মীয় বিশ্বাসগত দিক থেকে মাংতারা ইসলাম ধর্মের অনুসারী।
আল্লাহ্, রাসুল সহ ইসলামের প্রধান পাঁচ স্তম্ভের উপর এদের বিশ্বাস রয়েছে। কিন্তু মুসলমান হলেও তাদের নিজস্ব কিছু বিশ্বাস ও লৌকিক সংস্কারের প্রচলন রয়েছে যা তাদের স্বতন্ত্র্য পরিচয় আমাদের সামনে হাজির করে। ইসলামের অনুসারী হলেও অন্য ধর্মের অনেক কিছুই তারা আত্মস্থ করেছেন নিজস্ব ঢঙে। পানির উপরে সারাজীবন বসবাসের দরুন পানির পীর হিসেবে খ্যাত বাবা খোয়াজ খিজিরের উপর মাংতাদের রয়েছে পরম আস্থা। প্রতিবছর অগ্রহায়ণ মাসে মাংতাদের প্রতিটি বহরেই বাবা খোয়াজ খিজিরের নামে করা হয় খোদাই সিন্নি। সকলের সম্মিলিত আয়োজনে খোদাই সিন্নি তৈরির পর প্রথমেই তা খোয়াজ খিজিরের নামে একটা কলাপাতায় করে ভাসিয়ে দেয়া হয় নদীর জলে। কিন্তু এই খোদাই সিন্নি খোয়াজ খিজিরের নামে ভাসানোর পাশাপাশি একইভাবে মা গঙ্গীর উদ্দেশ্যেও উৎসর্গ করেন মাংতারা। তাদের জলজ জীবনে খোয়াজ খিজির ও মা গঙ্গী দুজনের সমান গুরুত্বের। ঝড়-বাদল সহ সকল প্রকার বিপদে-আপদে তারা একই সাথে স্মরণ করেন মা গঙ্গী ও বাবা খোয়াজ খিজিরকে। জলের উপরে বসবাস, সাপের হাত থেকে নিজেদের রক্ষাসহ অন্যান্য দুঃখ-কষ্ট থেকে নিস্কৃতির জন্য সর্পদেবী মনসার শুভদৃষ্টি কামনায় মাংতারা দুধ, কলা, ধান,দূর্বা সহ ভোগ দেয় নানান কিছু। এছাড়া ছেলে-মেয়েদের অসুখ-বিসুখের হাত থেকে রক্ষার জন্য পৌষ সংক্রান্তিতে আয়োজিত বুড়াবুড়ির (শিব-পার্বতী) পূজায়ও মানত দিয়ে আসেন একান্ত বিশ্বাসের সাথে।
যাদুবিদ্যা,তন্ত্র-মন্ত্র মানুষের অতি পুরনো বিশ্বাসের ধারাটিকেই ঝিইয়ে রেখেছে। যাদুবিদ্যা এমন একটা কৌশল যা দিয়ে মানুষ অতিপ্রাকৃত শক্তিকে বশে এনে স্বীয় উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চায়। কল্পনার হাতিয়ার দিয়ে অজেয় প্রকৃতিকে বশীভূত করার একটা অনেক পুরনো প্রচেষ্টা। তন্ত্র-মন্ত্র, যাদুবিদ্যায় অগাধ বিশ্বাস ও তার নিয়মিত চর্চা রয়েছে মাংতা জীবনে। মাংতাদের সকল চিকিৎসা পদ্ধতিতে তন্ত্র-মন্ত্রের উপস্থিতি অণিবার্য। মাংতাদের তন্ত্র-মন্ত্রের সাথে প্রায় ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে আছে আসামের কামরূপ পাহাড়ের নাম। তাদের অনেকেই নিজেদের ও তাদের পূর্ব পুরুষদের আসামের কামরূপ পাহাড়ের কামাখ্যা মন্দিরে যাদুবিদ্যা শিখে আসার কথা মজমা সহ নানান জায়গায় বেশ গর্বের সাথে প্রচার করেন। সাথে থাকে সেখানকার নানান গল্প ও যাদুবিদ্যা শেখার বই লজ্জাতুন্নেছার নাম। তাদের বিশ্বাস মতে গাছ-গাছন্ত, জীব-জানোয়ারের দেহের বিভিন্নাংশের সাথে এই তন্ত্র-মন্ত্রের ব্যাপারটা যুক্ত হলে তা থেকে অতি সহজেই কাঙ্খিত ফল পাওয়া যায়। বিশেষায়িত দ্রব্যগুণের বিশাল কদর রয়েছে মাংতা জীবনে। অমাবস্যা-পূর্ণিমা রাতে জোয়ারের সময় কাটা পাটের আঁশের বিশেষ গুণ আছে বলে বিশ্বাস করেন। এই বিশেষ গুণ সম্পন্ন পাটের আঁশ দিয়ে ওঝা রোগীর যেখানে সাপে কামড়েছে তার উপরের দিকে বাঁধ দিয়ে দেন। এরপর হাতে কড়ি নিয়ে মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে ঝাড়ার পর কাইক্যা মাছের ঠোট বা ব্লেড দিয়ে ক্ষতস্থানের উপরে কেটে বিষ বের করে ফেলেন। এছাড়া অমাবস্যা রাতে কেউ যদি একাকী উলঙ্গ অবস্থায় নির্দিষ্ট স্থান থেকে সাদা তুলসির শিকড় তুলে আনতে পারে তাহলে তা দিয়ে যাদু-টোনা, বাণ সহ নানান কাজে লাগানো যায় ইত্যাদি অনেক বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে।
... মানুষ হইয়ে মানুষেরা ঘিন্না নাইকা-মহাপাপ। আমি যামু, আমারে দেইখা কেউ ঘিন্না করে করুক, আমি তারে ঘিন্না করলাম না। অর মন চায় আমার কাছে আহুক না চায় না আহুক; আমার কাম আমি কইরা আমু। গেরাম করতে গেলে কতকের গাইল-কনি খাওন লাগে, কতকের খিবুকসি (?) শুনন লাগে, কতকের... । গিরস্তের বাড়ি গেলে কউক, কাজ করতে গেলে কত কতাইতো হুনতে অয়, কতায় কয় না- নদী দিয়া গান গাইয়া গেলে নদীর জোয়ার যায় না, মুখের জোয়ার যায়।
[ হাফিজা বেগম(৪৫), মিরকাদিম পৌরসভা সংলগ্ন, মুন্সীগঞ্জ]
মাংতারা তাদের আপন বিশ্বাসে আর সংস্কারে গৃহস্থদের অনেক বিশ্বাস আর সংস্কারের সহাবস্থান ঘটালেও ডাঙ্গার মানুষদের কাছে তারা বরাবরই নিচু জাত,অচ্ছুত বা ঘৃণার পাত্র হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছেন। মাংতারা মুসলমান হওয়া সত্বেও এবং ইসলাম ধর্মে বর্ণবাদের কোন স্থান না থাকলেও তারা গৃহস্থ মুসলমানের বর্ণবিদ্বেষী আচরণের সম্মুখীন হন প্রতিনিয়তই। মাংতা পুরুষেরা সাধারণত হাটে-মাঠে-ঘাটে নিজের পেশাগত মজমা বসালেও মাংতা নারীরা গৃহস্থদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে যাদুখেলা, সাপের খেলা, চুড়ি বিক্রি, শিঙ্গা লাগানোর কাজ করে থাকেন। আর একারণে স্বভাবতই মাংতা পুরুষদের চেয়ে নারীরা বর্ণদাপটের চরিত্রকে টের পান হাড়ে হাড়ে। বাড়ির শূচিতা নষ্ট হবে বলে অনেক গৃহস্থ বাড়িতেই মাংতা নারীদের প্রবেশের কোন অনুমতি মেলে না। আর কোন রকমে অনুমতি মিললেও গৃহস্থের ঘরে ঢুকবার কোন সুযোগ থাকে না। কারো কারো মতে...বাইদ্যানিগো চেহারা দেখলে পাপ অয়, জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে অইব, মাংতাদের দিকে তাকালে নাকি কারো চল্লিশ দিনের জন্য পবিত্রতা থাকে না, কবুল হয় না কোন ইবাদত-বন্দেগি এমন বিশ্বাসও প্রচলিত রয়েছে অনেক গৃহস্থ মানুষের। মাংতা নারী বুঝে পায় না মানুষ মানুষের দিকে তাকালে কী ভাবে পাপ হয়, দেহের পবিত্রতা নষ্ট হয়, ইবাদত-বন্দেগি সব পানি হয়ে যায়। জাত-পাতের বিবেচনায় নিচু জাত বলে অবজ্ঞা করলেও সুযোগ পেলে গৃহস্থ পুরুষদের অনেকেই মাংতা নারীর দিকে লিঙ্গীয় আঘাত হানতে কার্পণ্য করেন না। এহেন বর্ণ আর পুরুষতান্ত্রিক দাপটের কাছে মাংতা নারী-পুরুষ কোণঠাসা হলেও কখনো দমে যান নি। আপন সংস্কার, বিশ্বাস, সহনশীলতা আর পেশাগত দক্ষতা আর জাতিগত সংহতিকে পুঁজি করে আজও মাংতারা মোকাবিলা করে চলেছেন সকল দাপটকে, নিজেদের টিকিয়ে রাখার এক অদম্য প্রত্যয়ে।
...একবার মুক্তাগাছায় গিরস্তরা আমাগো সাভারের এক মাইয়া তুইলা নিয়া গেছিল। পরে কেস কইরা দুই দিন পর মেয়ে ফেরত পাইছিল। এই রহম অয় অনেক জায়গায়। ...এইসব সমস্যা আমরা সবাই মিল্যা মীমাংসা করি। আর এইগুলি যেইখানে অয়, সেখানে আমরা সারাদেশের মাংতারা সবাই টেকা দেই সমাধানের লেইগা। আর আমগো সব দলের একজন কইরা মাতবর ওইহানে যাইব, যেইহানে এই ঘটনাটা হইল-মীমাংসার লেইগা।
[আব্দুল কাদের (৫৫), মুক্তারপুর বহর, মুন্সীগঞ্জ]
৬.
আমাগো বম্কই আমাগো নেমরা-নিমরির লেইগা...; আমাগো নৌকায় কুনোসুম ডিবির দুধ ঢুকে নাই...; রাজা, মায়া বড়ি,...কুনোসুম কিনি নাই, ব্যবহার করি নাই...
বাজারি অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পণ্যের অবাধ প্রবাহ আজ আছড়ে পড়ছে সর্বত্র। মুনাফা লোভীদের তাণ্ডবে বিধ্বস্ত আজ পাহাড়-জঙ্গল-সমতলের সকল জাতির মানুষের স্বাভাবিক জীবন-যাত্রা। পণ্যের বাঁধভাঙ্গা জোয়ারে বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার আপন প্রতিরোধী ব্যবস্থা আজ হুমকির সম্মুখীন। মাংতাদের জীবনও এর বাইরের কিছু নয়। সভ্য, শিক্ষিত মানুষের কাছে মাংতারা যতই অসভ্য,নিকৃষ্ট,অচ্ছুত হোক না কেন বাজারি দুনিয়ার দাপুটে ব্যবস্থায় উৎপাদিত পণ্যের ভোক্তা হিসেবে তারা মোটেই ‘অচ্ছুত’ নন। ভোক্তা হিসেবে সভ্য দুনিয়ার বিভিন্ন কোম্পানিগুলোর কাছে অন্যান্য সবার ন্যায় তারাও হয়ে ওঠেন কাঙ্খিতজন। দাপুটে বাজারি অর্থনীতির কাছে আত্মসমর্পিত রাষ্ট্রযন্ত্র তার নানান বিধিব্যবস্থার মাধ্যমে বেঁচে থাকবার নূন্যতম অধিকার থেকে মাংতাদের প্রতিনিয়ত দূরে ঠেলে রাখলেও পণ্যের বাহারি সব প্রচার-প্রচারণায় কাউকেই দূরে রাখতে বা বঞ্চিত করতে চায় না (!) ব্যবসায়িক দুনিয়া। সভ্য দুনিয়ার অর্থনৈতিক মারপ্যাঁচ না বুঝলেও চারপাশের নানান পরিবর্তন তাদের মানস চিন্তায় রেখে চলে অনেক প্রশ্নের ছায়াপাত; যে প্রশ্ন তাদেরকে শংকিত করে তুলে নিজেদের বিশ্বাস, আচার ও পেশাগত ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার বিষয়ে। কিন্তু তারপরেও মাংতারা আপন বিশ্বাস আর সংস্কারগত সংহতিকে অক্ষুণ্ন রাখার ভেতর দিয়েই গড়ে তোলেন তাদের আপন প্রতিরোধের ভিত্তি।
...বাইচ্চা না অওনের লেইগা আমাগোর পদ্ধতিই করি। ... ডাক্তারি অষুধে সাদা সেরাবের ব্যারাম অইয়া যায়, রক্ত সেরাবের ব্যারাম অইয়া যায়, কতকের ফুইলা যায়গা...। আর আমাগো গাছন্ত অষুধে শরীলে কোন সমস্যা অইব না। ...চাইরটা ট্যাবলেট বানাই দিমু খাইলে জীবন পার ...। তেরো জন ছেলে মেয়ে অইছে, আমার স্বামী একটু হাদিসের পদের তো হেই জন্য বাইচ্চা বন্ধ করতে দেয় নাই। ...আমার কোলের ছেলের পরেই আমি চাইরটা ট্যাবলেট খাইছি, আর চিন্তা নাই...; ... অল্প কয়েকদিনের জন্য বাইচ্চা হওন বন্ধ করার অষুধও আমাগো জানা আছে।
[ হাফিজা বেগম (৪৫), মিরকাদিম পৌরসভা সংলগ্ন, মুন্সীগঞ্জ]
মাংতা পরিবারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি হলেও তাদের রয়েছে নিজস্ব নিয়ন্ত্রন পদ্ধতি। বাজারি জন্ম নিয়ন্ত্রন সামগ্রী সমূহের উপর কোন আস্থা রাখতে পারে না মাংতা নারী। হাটে-বাজারে, রেডিও- টেলিভিশনে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর বাহারি সব বিজ্ঞাপণ দেখলে-শুনলেও সেদিকে তাদের কোন আকর্ষণ নেই। বহুজাতিক কোম্পানীগুলো তাদের কনডম, পিল ইত্যাদি দিয়ে সারা দুনিয়া দাঁপিয়ে বেড়ালেও মাংতা জীবনে কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। মাংতাদের দাবি, বাজারি এই সব জন্ম নিয়ন্ত্রন সামগ্রীতে নানান পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকলেও উদ্ভিজ্জ ও প্রাণীজ উপাদানে তাদের নিজেদের তৈরিকৃত ঔষধে কোনো শারিরীক ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। প্রকৃতি থেকে পরিমান মতন উদ্ভিজ্জ ও প্রাণীজ উপাদান নিয়ে আপন জ্ঞান আর অভিজ্ঞতার নির্যাস মিলিয়ে নিজেরাই তৈরি করে নিচ্ছেন নিজেদের শরীরবান্ধব জন্মনিয়ন্ত্রন সামগ্রী। এছাড়া মাংতা মায়েরা গৃহস্থ মায়েদের ন্যায় সন্তানের বেড়ে উঠার দায়দায়িত্ব ডানো, নিডো, এ্যাংকার বা অন্যান্য গুড়ো দুধের কৌটায় বন্দী রাখতে চান না মোটেও। মাংতা মায়ের বিশ্বাস বমকই বা বুকের দুধ পান করানোর সাথে সন্তানের স্বাস্থ্যগত ব্যাপারটা যেমন জড়িত তেমনি জড়িত সন্তানের সাথে মায়ের নিবিড় ভালোবাসার বাঁধনটাকে আরো পোক্ত করার। মাংতা মায়েরা তাদের সন্তানদের দেড়/দুই বছর পর্যন্ত বুকের দুধই পান করান। আলগা দুধ পান করানোর রীতি মোটেই পছন্দ নয় তাদের। তবে মায়ের স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণে বাচ্চাকে বুকের দুধ পান করানো না গেলে সেক্ষেত্রে গরুর দুধ বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে এর হারও খুবই কম। মাংতা মায়েরা সারাদিন কর্মব্যস্ত থাকলেও তাদের সন্তানের দেখাশুনার দায়িত্বটুকুও অন্যের হাতে ছাড়তে নারাজ। নিজের আঁচলে শিশু সন্তানকে পিঠে বেঁধে নিয়েই গ্রাম ঘুরতে তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
৭.
বামাদের যা কিছু খাছরে, তাই লিয়ে ঝেলের নতে লড়পাব... ;বামাদের যা কিছু খাছরে, তাই লিয়ে ঝেলের নতে লড়পাব...; বামাদের যা কিছু খাছরে, তাই লিয়ে ঝেলের নতে লড়পাব...
...এই রহম অইছে, আমরা এক জায়গায় গেছি দল লইয়া, ভালা সুন্দরী মাইয়া দেখলে ওরা (গৃহস্তরা) হামলা দিতে আইছে কিন্তু আমরা আবার রাত জাইগা ঐ সেখান থেইকা চইলা গেছিগা। আমাদের কাছও ঐ গুলিবাঁশ, গুলাইল থাকে; এগুলি লইয়া আমরা রাত জাগছি। এইগুলি দিয়া আমরা পাহারা দিছি। দেখছি ওহানে খারাপ ওখানে আর থাকি নাই চইলা গেছি গা। আবার কত জায়গায় হামলাও দিয়া হালাইছে, মারামারিও হইয়া গেছে; আমরা কেস-মামলা করছি।... এই ভাবেই আমরা টিক্যা আছি।
[আব্দুল কাদের (৫৫), মুক্তারপুর বহর, মুন্সীগঞ্জ]
অধিপতি শ্রেণীর নিত্য নতুন কৌশলের কাছে মাংতারা প্রতিনিয়ত কোণঠাসা হয়ে পড়লেও টিকে থাকার সংগ্রামে তারা আজও লড়াকু সৈনিক। সভ্য দুনিয়ার নানান সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত মাংতারা দমে যাবার পাত্র নন। তারা তাদের নিজস্ব জ্ঞান, বিশ্বাস আর প্রথাগত সংস্কারের সাহসী চর্চার মধ্য দিয়েই মোকাবিলা করে চলেছেন নানান প্রতিকুলতাকে। সভ্য সমাজের সুযোগ-সুবিধা থেকে অনেক পিছিয়ে থাকলেও মাংতারা হতাশ হতে নারাজ। হতাশ কেন হবেনই বা কেন- শিশু-বৃদ্ধ প্রতিটি মাংতাইতো আজও তাদের নিজস্ব জীবনাচার ধরে রাখছেন সাহসিকতার সাথে। তাদের চাঁন মিঞা সর্দার, পান্না মাতবর আর মোন্তাজ মাতবরেরা আজও বিচক্ষণতার সাথে মাংতা বহরের নিজস্ব রীতি-নীতি পালন করে চলেছেন; আমিন বাজারের আলাউদ্দিন মিয়া শহরে-বন্দরে বীন বাঁশিতে সুরের ঢেউ তুলে মুক্তারপুরের আব্দুল কাদেরের দক্ষ হাতে ধরা সুতানালি, পিলপিলে, জাইত, গোখরা, মাইটাপানস নাঁচিয়ে চলেছেন সমানে। কাশীপুরের পাগলনি খালা, মিরকাদিমের হাফিজা, আফুজারা তাদের জুংলি আজও বোঝাই রাখেন গাছগাছন্ত আর জীব-জানোয়ার দেহাংশ থেকে তৈরি নানা রোগের অষুধে, মহিষ-গরু আর ছাগলের শিং, কাইক্যা মাছের ঠোট আর কার্তিক অমাবস্যার পাটের দড়িতে; দক্ষ হাতের কৌশলে শিঙ্গা টেনে টেনে বের করে আনছেন গৃহস্থ মানুষের শরীরের বিষাক্ত রক্ত-পূঁজ। আর এই রক্ত-পূঁজের সাথেই হয়ত একদিন বের করে আনবেন গৃহস্থ মানুষের দেমাগি মনের সকল আবর্জনাকে -এমন স্বপ্নের ঝিলিকইতো খেলে যায় মাফুজাদের চোখে-মুখে। অধিপতি শ্রেণীর নানাবিধ কাঠামো তাদেরকে প্রতিনিয়ত আড়াল করে রাখতে চাইলেও আমিন বাজারের মান্নান সর্দারেরা নতুন প্রজন্মের মাংতাদের কাছে চান না কোন কিছু আড়াল করতে; মাংতাদের নিজস্ব রীতিনীতির কথা বলে যান বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে। রিকাবী বাজারের সোনিয়া, সালমারা গৃহস্থ পুরুষের নানা রকম হয়রানির মুখোমুখি হলেও কাপ-পিরিচের পাতিতো মাথা থেকে নামান নি; গৃহস্থ পুরুষের কুদৃষ্টির কাছে হার না মেনে মাথা উঁচু করেই তো গ্রামে গ্রামে ঘুরছেন। নদীতে মাছ না থাকলেও রমিজ মিয়ারা আজও তার বড়শিতে আধার গেঁথে চলেন ধলেশ্বরীর বুকে কারেন জালের কাছে আপোস না করার ব্রতটা জিঁইয়ে রেখেই। বিয়ান্যার শাজাহান মিয়া তালি-চাবি ঠিক করে দিয়ে অনেক সময় ন্যায্য পাওনা না পেলে গৃহস্থদের দুটো উচিৎ কথা শুনিয়ে দিতে তো ভয় করেন না কখনো। খরিয়া গ্রামের কান্দার খানেরা আজও জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ান অষুধি গাছের খোঁজে। লোকমান মিয়া আর মামুনেরা কড়িমালা, ঝিনুকমালা সহ নানান গাছন্ত তাবিজের ঝান্টা নিয়ে পাড়ি দেন শহর-বন্দর-গ্রাম। লুটপাট আর ছিনতাইয়ের দুনিয়ায় হানিফ মিয়া তার ওছা আর আছড়া নিয়ে হাঁক দিয়ে বেড়ান-পানিত পইড়া যাওয়া সোনা-রূপার জিনিস তুলি...। প্রাকৃতিক নানান উপাদানের মাধ্যমেই ওরশ্যের ব্যারাম, হাঁপানি, যৌনরোগ, বা জন্ম নিয়ন্ত্রণের অব্যর্থ অষুধ দিয়ে চলেছেন দেলোয়ার হোসেন। গৃহস্থদের প্রতিনিয়ত খালবিল ভরাটের বিপরীতেও আবু বকর, সালামেরা নতুন নতুন বিরকি (নৌকা) ভাসাচ্ছেন পানিতে। রোখসানা, রেহানারা তাদের সন্তানদের ঘুম পাড়াচ্ছেন ঠারে গান শুনিয়েই। গৃহস্থজনের সামপ্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিকে উপেক্ষা করেই পাগলনি খালারা একই সাথে খোয়াজ খিজির আর মা গঙ্গীর নামে পানিতে ক্ষীর ভাসাচ্ছেন, একই হাতে মিলাদের তবারক আর পূজার প্রসাদ গ্রহণ করছেন পরম বিশ্বাসের সাথে। পান্না আর শম্ভু মাতবরদের আহ্বানে পোড়াবাড়ি সহ বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানের ন্যায় খরিয়া গ্রামে এখনও সকল মাংতারা জড়ো হন কার্তিক মাসে, মেতে উঠেন উৎসবে-আমোদে। আর এই সমস্ত কিছুই মাংতাদের প্রেরণা যোগায় সকল দাপটের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়ে যাবার, শক্তি যোগায় সম্মিলিত কণ্ঠে উচ্চারণ করার-
আমাগো যত তন্ত্র-মন্ত্র, বিশ্বাস, বিরকি, বহর আছে তাই নিয়ে লড়ে যাব
আমাগো ঠারে যত শব্দ, গীত, রূপকথা, প্রবাদ, ডাকের কথা আছে তাই নিয়ে লড়ে যাব
আমাগো বহর যতগুলা নদী-নালা-খাল-বিল-জলাশয়-রাস্তার ধারে আছে তাই নিয়ে লড়ে যাব
আমাগো চেনা যত জাতের সাপ, পোকামাকড়, পশু-পাখি, জীব-জানোয়ার আছে তাই নিয়ে লড়ে যাব
আমাগো যত ওছা, আছড়া, বীন, ঝাপি, ঝুড়ি, জুংলি, ঝান্টা, গুলিবাঁশ, গুলাইল আছে তাই নিয়ে লড়ে যাব
আমাগো যত বনরুইর আঁইশটা,সজারুর কাটা, কুমিরের মাংস, কট মাছের কাটা আছে তাই নিয়ে লড়ে যাব।
(This article was published in `Mhrittika’-vol.-3, issue-3; editor-Jewel Bin Zahir, Parag Ritchil, Dhaka, August 2006)
১.
!
দখল
নদী দখল, খাল দখল, বিল দখল
নদীর জল দখল, জলের মাছ দখল, শ্যাওলা দখল
ব্যাঙ দখল, পোক-মাকড় দখল, শামুক দখল, ঝিনুক দখল
ওছা দখল, বিণ দখল, ঝুড়ি দখল, শিং দখল, জুংলি দখল, ঝান্টা দখল
ঠার দখল, কিচ্ছা দখল, গীত দখল, খেলা দখল, নাম দখল,সমাজ দখল
দাড়াইস, কালিপানো, সুতানালি, দুধরাজ, জাইত, গোখরা, আলাজ, বীনরাজ দখল
পাতরাজ, টুনটুনি, গলাকাটি, লালটিঙি, পিরপিরে, টিয়াঠুটি, সুতাশঙ্খ, কালিনাগ, অজগর দখল
চারপাশের সব কিছুই দখল হয়ে যাচ্ছে। তাদের আবাসস্থল, নদী-নালা-খাল-বিল, জলের মাছ, সাপ, ব্যাঙ, কাকড়া, শামুক, ঝিনুক ইত্যাদি সব কিছুই। অথচ দখল করার মতন তারা নিজেরা কোন কিছুই খুঁজে পান না। একে তো তাদের পুস্তকি জানাশোনা নেই তার উপর জ্ঞান-গম্মিও বেজায় কম (!)। এত কম জ্ঞান নিয়ে তো আর দখলের মতন জটিল বিষয় মাথায় খেলানো চাট্টিখানি কথা নয়। জীবিকার জন্য বাপ-দাদারা যে সামান্য কিছু বিদ্যেটুকু শিখিয়ে দিয়ে গেছেন তাতে তো আর দখল জিনিসটাকে রপ্ত করার মতন কোন ব্যাপার ছিল না। কেবলমাত্র দাড়াইস, কালিপানো, খইয়াপানো, দুধরাজ, সুতানালি,জাইত, গোখরা, আলাজ, বীনরাজ, পাতরাজ, টুনটুনি, গলাকাটি, লালটিঙি, পিরপিরে, টিয়াঠুটি, সুতাশঙ্খ, কালিনাগ প্রভৃতি নানান জাতের বিষধর সাপ ধরা, বীণ বাজিয়ে সাপের খেলা, সাপের বিষ নামানো, বানরের নাচ ও যাদুর খেলা দেখানো; কাঁচের চুড়ি, কাপ-পিরিচ, মুক্তার মালা, কড়ির মালা বিক্রি; নানান জাতের লতা-পাতা, শিকড়-বাকর, মাছের কাটা, জীব-জানোয়ারের হাড়গোর দিয়ে বিভিন্ন রোগের ঔষধ বানানোর কায়দা-কানুন ও মন্ত্র-তন্ত্র, যাদু-টোনা; গরু-মহিষের শিং দিয়ে আপন কায়দায় দেহের বিষাক্ত রক্ত-পুঁজ বের করার মতন সামান্য বিদ্যে টুকুই আত্মস্থ করেছেন, চর্চা করে চলেছেন শত শত বছর ধরে। সভ্য,শিক্ষিত,আধুনিক মানুষেরা তাদের এই জানাশোনাকে নাকসিটকিয়ে উড়িয়ে দিলেও অন্যের জানাশোনার উপর তাদের কোন অবজ্ঞা নেই। বরং অন্যের বিদ্যা-বুদ্ধিকে তারা সম্মান জানিয়ে, সমীহ করেই চলেন। শিক্ষিত মানুষজনেরা তাদের আপন বিশ্বাসকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেও অপরের বিশ্বাসের সাথে তারা তাদের আপন বিশ্বাসের এক যোগসূত্র খুঁজে নিয়েছেন নিজস্ব কায়দাতেই। তাদের কাছে মনসা, খোয়াজ খিজির, গঙ্গা মা সবাই বিশেষ মর্যাদায় আসীন। যুগ যুগ ধরে নদী-নালা-খালের মধ্যে ভাসমান জীবন পার করলেও সেগুলোর উপর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা কখনো ক্যানভাস করে বেড়ান নি। তারা কখনো ভাবেন নি নদী-নালা-খাল এভাবে দখল হয়ে যেতে পারে, বদলে যেতে পারে নদীর-নালার পানির রং, হারিয়ে যেতে পারে নানান জাতের মাছ । তারা কখনো চিন্তাই করেন নি ডাঙ্গার শিক্ষিত, বুদ্ধিমান মানুষেরা এভাবে সাপ, ব্যাঙ, শামুক, ঝিনুক, ছাইপ্লা, পশু-পক্ষীর হাড়গোড়, মাছের ঠোঁট-কাটা সব বিনাশ করে ফেলবে, নাই করে ফেলবে। তাদের বিশ্বাসকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে মোটেই লজ্জিত নয় ডাঙ্গার মানুষ জনেরা, কোন কষ্টই অনুভুত হয় না মনে। এভাবে সবকিছু তছনছ করার মধ্যেই নাকি গিরস্ত (ঘরে বাস করা অর্থে) মানুষের বাহাদুরি (!) প্রকাশ পায়। কিন্তু নদী হারানো, খাল-বিল-নালা হারানো, হরকসম মাছ, সাপ, গাছ-গাছালি, পশু-পক্ষী, জীব-জানোয়ার হারানোর কষ্টতো বুকের গভীর থেকে কিছুতেই মুছতে পারেন না অশিক্ষিত, কম জ্ঞানওয়ালা মানুষেরা। ভুলতে পারেন না নিজেদের নাম-পরিচয় আড়াল হয়ে যাওয়ার বেদনা। কিন্তু তারপরেও এইসব অচ্ছুত, অশিক্ষিত, কম জ্ঞানওয়ালা মানুষেরা টিকে আছেন অবশিষ্ট নদী-নালা, জীব-জানোয়ার, পশু-পক্ষী নিয়ে, আজীবন চর্চিত সামান্য বিদ্যেটুকুকে পুঁজি করে; ডাঙ্গার মানুষজনের কাছে না হোক অন্তত নিজেদের আগামী প্রজন্মকে জানাতে তাদের নাম-পরিচয় আর জলের ঢেউয়ে ভাসমান জীবনের কথা।
২.
আমরা বাইদ্যা না, বেদে না; আমরা বাইদ্যা না, বেদে না; আমরা বাইদ্যা না, বেদে না;...
আমরা মাংতা, আমরা মাংতা, আমরা মাংতা, আমরা মাংতা, আমরা মাংতা, আমরা মাংতা, আমরা মাংতা...
...অন্ত্যজ বর্ণের... বেদে প্রভৃতিদেরই অন্যতম বৃত্তি ছিল সাপ-খেলানো, যাদুবিদ্যার নানা খেলা দেখানো ইত্যাদি।...রাজসভায় জাঙ্গলিক বা বিষবৈদ্য অন্যতম রাজপুরুষ ছিলেন...।
[বাঙ্গালীর ইতিহাস(আদি পর্ব), ড. নীহার রঞ্জন রায়]
আমরা সবাই বেদে,বাইদ্যাদের সাথে কম-বেশি পরিচিত। সংস্কৃত বৈদ্য থেকে বাইদিয়া বা বাইদ্যা শব্দের উৎপত্তি। বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা ভাষার অভিধানে বেদে, বেদিয়া, বাইদিয়া শব্দের অর্থ বলা হয়েছে যাযাবর, সাপুড়ে জাতি বিশেষ, বিষবৈদ্য । প্রাচীন বাংলায় লোকচিকিৎসা পেশায় জড়িত অন্ত্যজ বর্ণের একদল লোক কালক্রমে অন্যান্য উচ্চ বর্ণর লোকজনের কাছে বৈদ্য,বাইদ্যা,বেদে প্রভৃতি অভিধায় পরিচিত হয়ে ওঠে। উচ্চ বর্ণর দেয়া এইসব অভিধায় পরিচিত ওঠার পাশাপাশি আড়াল হয়ে যেতে থাকে অন্ত্যজ বর্ণর আপন জাতিগত পরিচয়। তাছাড়া উচ্চ বর্ণ কর্তৃক অন্ত্যজ বর্ণর নাম-পরিচয় আড়াল করে দেওয়ার পেছনে যে নিজের সাপেক্ষে অপরকে নিচু,নিকৃষ্ট,ঘৃণিত রূপে প্রতিপন্ন করার একটা প্রবণতা থেকে যায় তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু এইসব বর্ণ দেমাগি দৃষ্টিভঙ্গির সাথে কখনোই একাত্ম হতে পারেন নি সেই অন্ত্যজ বর্ণর লোকজনেরা; মেনে নেন নি অন্যের দ্বারা নিজেদের জাতিগত নাম-পরিচয় আড়াল হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটাকে। অধিপতি শ্রেণীর চাপিয়ে দেয় নানান অভিধার বিপরীতে সেই অন্ত্যজ বর্ণর লোকেরা আজও নিজেদের জাতিগত পরিচয় মাংতা হিসেবেই দেন; বাইদ্যা বেদে বা বেবাইজ্যা বলে নয়।
...এইযে বাইদ্যা কয়, আমাগো ভিতরে একটা খারাপ লাগে, কেন খারাপ লাগে; যে আমরা তো বাইদ্যা না। তোমরা এই যে একটা নাম রাখছ, বলতাছ-তোমরা এই নামটা পাইলা কোনথন। অহন তোমাগো জিগাইতে গেলে একটা ঝগড়া আসে। ...আমরাতো বাইদ্যা না। ...আমাগো জাতের নাম আছে, আমরা মাংতা।
[ মোন্তাজ মাতবর(৬০), রিকাবী বাজার বহর, মুন্সীগঞ্জ ]
মাংতাদের জাতিগত উৎপত্তি নিয়ে বেশ কয়েকটি অষ্পষ্ট মতভেদ প্রচলিত রয়েছে; যার কোনটিই তাদের জাতিগত উৎপত্তি বা অরিজিন নিয়ে পরিস্কার কোন ধারণা দিতে সক্ষম নয়। ড. শেখ মাকসুদ আলী সম্পাদিত বাংলাদেশ জেলা গেজেটিয়ার-বৃহত্তর ঢাকা তে উল্লেখ রয়েছে, বেদে সমপ্রদায় কতদিনের পুরনো তা বলা সম্ভব নয়। তবে এদেশের শহর-বন্দর ও গ্রামে এদের বিচরণ দীর্ঘদিনের। এরা আমাদের সামাজিক জীবনের সাথে মিশে আছে।
বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির বাংলা পিডিয়াতে মাংতাদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে, ১৬৩৮ সালে আরাকানের বল্লাল রাজার সাথে সেখানকার মনতং জাতিগোষ্ঠীর একটা অংশ বিতারিত হয়ে প্রথমে বঙ্গদেশের বিক্রমপুরে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং পরবর্তীতে এরা বঙ্গদেশ ও আসামের প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েন। এছাড়া মনতং জাতিগোষ্ঠীর থেট বা ঠেট ভাষার সাথে বেদে বা মাংতাদের ঠার ভাষার নাকি মিলও রয়েছে।
এই সূত্র মতে আরাকান থেকে মাংতাদের এতদাঞ্চলে প্রথম আগমনের সময় কাল ১৬৩৮ সাল উল্লেখ করা হলেও আরো অনেক থেকেই প্রাচীন বাংলায় মাংতাদের উপস্থিতি ও তাদের পেশাগত পরিচিতির প্রমাণ পাওয়া যায়। ড. নীহার রঞ্জন রায় তাঁর বাঙ্গালীর ইতিহাস গ্রন্থের আরেক জায়গায় উল্লেখ করেছেন,...অন্ত্যজ পর্যায়ের আর একটি বর্ণের খবর দিতেছেন বন্দ্যঘটীয় আর্তিহর পুত্র সর্বানন্দ (১১৬০)। ইহারা বেদে বা বাদিয়া; বাদিয়ারা সাপ খেলা দেখাইয়া বেড়াইত ( ভিক্ষার্থং সর্পধারিণি বাদিয়া ইতি খ্যাত)। এছাড়া যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত ১৩১৬ বঙ্গাব্দে তাঁর বিক্রমপুরের ইতিহাস প্রথম খণ্ডে মাংতাদেরকে হিন্দু সমাজেরই একটা বর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন-...বিক্রমপুরে বহুজাতীয় লোকের বাস। হিন্দুদের মধ্যেই বিভিন্ন জাতি ও তাহার শ্রেণীবিভাগ আছে। ... বৈদ্য, কায়স্থ, জেলে, কৈবর্ত, বৈষ্ণব, বারুই, বেদিয়া (বাইদা), বেলদার, ভূঁইমালি, ধোপা, গোপ (গোয়ালা), ঝাল-মাল, যুগী...।
অনেকের মতে মাংতারা দ্রাবিড় ভাষা-ভাষী কোন জাতি। এছাড়া নিজেদের জাতিগত উৎপত্তি নিয়ে মাংতাদের নিজস্ব কিছু ধারণা রয়ে যা মুখে মুখে বংশপরম্পরায় আজও টিকে আছে।
“... বিভিন্ন এলাকায় মাংতা আছে। কিন্তু অদের ভাষা আবার অন্য। ...আরবিয়ান মাংতা আছে আরবি ভাষা। আমরা বুঝব না। আমাগো ভাষা অরা বুঝে না। জাত সব একই, জাত সব মাংতা। ...আমাগো গোড়াটা ঐ আরব থেইকাই আইছে।”
[ মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন (৫২), মিরকাদিক পৌরভবন সংলগ্ন, মুন্সীগঞ্জ]
“...আগে মুরব্বিরা কইছে, নুহু নবীর কিস্তি আছিল। ... তয় নুহু নবীর ছিলছিলায় যেমুন আমরাও নৌকায় বসবাস করতাছি। ...ঐ আমল থেকাই। নুহু নবীর ছিলছিলাতেই আমরা আইছি...অখান থেনই আরকি আমাদের নৌকায় থাকা পড়তাছে...।”
[ মোন্তাজ মাতবর(৬০), রিকাবী বাজার বহর, মুন্সীগঞ্জ]
মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন ও মোন্তাজ মাতবরের ন্যায় মাংতাদের অনেকে মনে করেন যে, তাদের মাংতা জাতের উৎপত্তিস্থল আরবে বা তাদের নৌকায় বসবাসের শুরু হয়েছে নূহ্ নবীর সেই প্লাবনের সময় থেকেই। নিজেদেরকে মনে করেন নূহ্ নবীর বংশধর হিসেবে। সেই ছিলছিলাতেই তাদের নৌকায় বসবাস।
আমি নূহ্কে প্রেরণ করেছিলাম তাঁর সমপ্রদায়ের প্রতি একথা বলেঃ তুমি তোমার সমপ্রদায়কে সতর্ক কর, তাদের প্রতি মর্মন্তদ শাস্তি আসার আগে।
(সূরা নূহ্, আয়াত-১)
নিজ সমপ্রদায়ের লোকজন যখন বারে বারে হযরত নূহ্ নবীর প্রচারিত বাণীকে অস্বীকার করতে লাগল তখন তাদের উপর মহাপ্লাবন হিসেবে কঠিন শাস্তি নেমে এসেছিল। নূহ্ নবী তাঁর অনুসারীদের নিয়ে বিশালাকার কিস্তিতে চড়ে সেই প্লাবনে নিজেদের রক্ষা করেছিলেন। ছয় মাস আটদিন কিস্তিতে থাকার পর নূহ্ নবী তাঁর আশিজন অনুসারী নিয়ে জুদি পর্বতে ( খ্রিস্টানদের মতে নূহ নবীর কিস্তি এসে থেমেছিল আর্মেনিয়ার Mt. Ararat এ, যা থেকে জুদি পর্বত ১৮০ মাইল দূরে অবস্থিত ) এসে থামেন। পরবর্তীতে এই পর্বতের পাদদেশেই থামানিন (Thamanin) নামের এক জনপদ গড়ে ওঠে। এই জুদি পর্বতটি অবস্থিত বর্তমান তুরস্কে। প্লাবনের পর নূহ্ নবীর জীবিত তিন ছেলের মধ্যে হামের বংশধরদের পাক-ভারতের একাংশ, আফ্রিকা ও ইউরোপ; শামের বংধরদের দ্বারা আরব ও পার্শ্ববর্তী দেশ সমূহ; ইয়াসেফের বংশধরদের দ্বারা তুরস্ক, রোম প্রভৃতি অঞ্চল জনবসতিপূর্ণ হয়। জানা যায়- শাম, হাম ও ইয়াসেফের বংশধরদের মধ্যে যথাক্রমে ১৯, ১৮ ও ২৬ টি পৃথক ভাষার সৃষ্টি হয়। হাম ও শামের বংশধরদের ভাষাগুলোকে ভাষাতাত্ত্বিকেরা হেমিটিক-শেমিটিক ভাষাগোষ্ঠী ভূক্ত করেছেন। হেমিটিক-শেমিটিক ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত আরবি ভাষায় বাদিয়াহ্ বলে একটা শব্দ আছে যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় যাযাবর। তবে এই বাদিয়াহ্ বলতে যে মাংতাদেরই বুঝানো হয়েছে তা নিশ্চিত নয়। এখন মাংতা জাতিগোষ্ঠীটি ঠিক কখন কীভাবে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য পরিচয় নিয়ে নূহ নবীর কিস্তির ছিলছিলায় নিজেরা নৌকায় বসবাস ও যাযাবর জীবন শুরু করেন তা বের করা দীর্ঘ গবেষণা সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বর্তমানে মাংতাদের নিজস্ব ঠার ভাষার ধাতু ও ক্রিয়াপদ বাংলা তথা ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারের ন্যায়। তবে ঠার ভাষার বর্তমান এইরূপ দীর্ঘদিন বঙ্গদেশে অবস্থানের ফলে বাংলা বা ইন্দো-আর্য পরিবারের অন্যান্য ভাষা দ্বারা যে অনেক খানিই প্রভাবিত তা মোটামুটি নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়। মাংতাদের ঠার ভাষায় যে নিজস্ব কিছু শব্দ আছে যেমনঃ খাইপ্তা (বাবা), খাইপ্তানি (মা), খুপি (লবণ), ছাইম্লা (মাছ), ময়াল (সাপ), উড়ুম (চিড়া), বতুন (ভাত), লেবন (তরকারি), উজ্জালি (মাংস), ছোলতা /মইল্ত (ঔষধ), বেলং (তেল), আম (তুওম), দকলা (কলা), ডুওম (মাথা), গেসকই (চুল), গুন্কি/গুনারি (চোখ), বক (রক্ত) গেইত্লা (হাড়ি), দবলা (কুলা), পেছকো (দা), টোঙ্গা (জুতা), বুইত্কাল (কুকুর), নেওয়ারি (পানি), কাইকাল (পরিবার), বম্কই (মায়ের দুধ) ইত্যাদি ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে গণ্য হতে পারে।
৩.
চুড়ি লাগব নি চুড়ি...;লাগব নি কাঁচের কাপ-পিরিছ, প্লেট-বাটি... ;খেলা দেখাইগো খেলা, সাপের খেলা দেখাই...; রস টানি, বাত টানি, কোমড় টানি, মাঝা টানি, চোখের পোকা, দাঁতের পোকা ফালাই, শিঙ্গা লাগাই...; খা খা খা বক্ষিলেরে খা, কিরপিনেরে খা...
ক্ষুদ্রান্তে ভূজগাঃ শিরাংসি নময়ত্যাদায় যেষামিদং
ভ্রাতর্জাঙ্গালিক ত্বদাননমিলন্মন্ত্রানুবিন্ধং রজঃ।
জীর্ণস্তেষফণীন যস্য কিমপি ত্বাদৃগগুণীন্দ্রব্রজা-
কীর্ণক্ষ্মাতলধাবনাদপি ভজত্যানম্রভাবং শিরঃ।।
ভাই জাঙ্গালিক (সাপুড়ে), তোমার এই সাপগুলি ছোট ছোট; তোমার মুখের মন্ত্রপড়া ধূলি ইহাদের মাথা নমিত করিয়া দিতেছে। এই ফণাধারী সাপটি বোধ হয় জীর্ণ (অর্থাৎ প্রবীণ বা অভিজ্ঞ), কেননা তোমার মতো গুণী দ্বারা পূর্ণ মাটিতে ধাবন করিয়াও ইহার মাথা নম্রভাব হইতেছে না (অর্থাৎ নমিত ভাব হইতেছে না)।
উমাপতি ধরের এই সংস্কৃত শ্লোকের ন্যায় সাধারণের কাছে বেদে,বাইদ্যা শব্দের সাথে সাপ ধরা বা সাপের খেলা দেখানোর বৃত্তিটাই অধিকতর স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এছাড়া গল্প-উপন্যাস বা সিনেমাতেও বেদে বলতে কেবলমাত্র সাপুড়েরাই বারবার উপস্থাপিত হয়ে আসছেন। তবে এর বাইরেও যে মাংতাদের আরো পেশাগত বৈচিত্র্যতা রয়েছে এবং এই পেশাগত বৈচিত্র্যতার সাথে সাথে তারা বেশ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত তা, অনেকের কাছেই হয়ত স্পষ্ট নয়। ড. শেখ মাকসুদ আলী সম্পাদিত বাংলাদেশ জেলা গেজেটিয়ার-বৃহত্তর ঢাকা এর আরেক জায়গায় বলা হয়েছে- ...বেদে সমপ্রদাযের বেশ কটি জাত রয়েছে। ... এদের মধ্যে বৈদ্য, বৈরাল ও সাখার শ্রেণী প্রধান। এদের জীবন ও জীবিকা ভিন্নতর না হলেও রীতি-নীতি ও আকারে কিন্তু পার্থক্য রয়েছে।
মাংতাদের মতে, তাদের কয়েকটা জাত আছে। এক জাতের সাথে আরেক জাতের পেশাগত পার্থক্য ছাড়াও রীতিনীতে রয়েছে স্বাতন্ত্র্যতা বাংলাদেশের মাংতারা মালবৈদ্য, তৈল বা বান্দারিয়া, সাপুড়িয়া, মিসিগারি, বৈরাল, বাজিকর, শৈল, সওদাগর বা সান্দার বা লাইয়ো ইত্যাদি ভাগে বিভক্ত।
“...মাল মাংতা যারা, তারা নেয়ারবইনা করে। নেয়ারবইনা অইল ঐ যে শিঙ্গা লাগায়, পোকাটোকা ফেলায়...। তৈল মাংতা যাদের কয় ওরা বাঁদর লিয়া খেলায়। একপ্রকার আছে মিসিগারি মাংতা, অরা চহের (চোখের) পর্দা কাটে। তারপরে একপদের আছে লাইয়ো মাংতা, ...তারা ঐ কাপ-পিরিচ বেঁছে; আরেক পদের আছে বৈরাল মাংতা-মাছ ধরে, বড়শি বায়। আছে হাবুখেলা মাংতা-এইগুলি ইণ্ডিয়ায়। অরা হাবুখেলায়।...মানে ‘হাব হাবু হাবু কার বাড়ি যাবো ...’এরম কইরা মেয়েছেলে সবাই গেরাম করে। এমন কইরা সাইর গাইব আর টাকা উঠাইব। তারপরে আবার আছে লেল্লছ মাংতা। লেল্লছ মাংতা ওরা কী আবর্জনা খায়। যেমন-ব্যাঙ খায়, কুইছা খায়, সাপ খায় ওদের লেল্লছ বলা হয়। চাইয়া-চিন্তা খায় আরকি। বাংলাদেশে নাই, ওটা ভারতে। আরেকটা আছে ভাল্লুকধারী মাংতা। অরা ভাল্লুক লইয়া গেরাম করে। যারা ধামাধন্নি তারা ধামা (টুকরি) নিয়া ঘুইরা বেড়ায়, ... অনেক মালছামানা বেঁছে, অষুধঅ বেঁছে।...এই দুইটাঅ ভারতে। আরেক পদের আছে সাপুইড়া মাংতা। তারা সাপ খেলা দেখায়। মেয়ে-পুরুষ সবাই। ওদের সাপুইড়া বলা হয়। ঠিক আছে, আরেক পদের আছে বাজিকর, বাংলাদেশে আছে। যাদু দিয়া ময়নার ছাও, পুতুলের ছাও বানায়’, এইটার নাম ‘কতিখেলা’। ঐ গেলে বলে যাদুখেলা আর মাংতা বলে কতিখেলা।”
[ মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন (৫২), মিরকাদিক পৌরভবন সংলগ্ন, মুন্সীগঞ্জ]
মাংতাদের একজাতের সাথে আরেক জাতের রীতিনীতিতে যেমন পার্থক্য রয়েছে, রয়েছে আলাদা আলাদা
সমাজ ব্যবস্থাও। চারপাশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বৃত্তিগত বৈচিত্র্যতা ক্রমেই সংকীর্ণ হয়ে আসছে। নিজেদের একজাতের পেশাকে আরেক জাতের লোকজন যেমন গ্রহণ করছে তেমনি গ্রহণ করছেন অন্য পেশাও। তবে মাংতাদের সব জাতের মধ্যেই আপন চিকিৎসা পদ্ধতির দূর্দান্ত চর্চা রয়েছে।
মাংতাদের একজাতের সাথে আরেক জাতের বিবাহ সামাজিক ভাবে নিষিদ্ধ। তবে বর্তমানে কিছুটা হলেও এর ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। এখন মাংতাদের একজাতের সাথে আরেক জাতের ছাড়াও গিরস্ত বাঙালিদের
সাথেও বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে উঠছে, তবে এর সংখ্যা খুব একটা বেশী নয়।
৪.
গড়াইস, দাড়াইস, দুধরাজ, বেকরাজ, কালিপানো, খইয়াপানো, সুতানালি, বিণরাজ, কোবরা, অজগর, গরুর শিং, কাইক্যা মাছের ঠোট, বনরুইর আঁইশটা, সজারুর কাটা, ময়না-শালিকের ঠোট, কট মাছ, ওরাল মাছের কাটা, ঝিনুক, শামুক, পোকা-মাকড়, মনিরাজ, উলটচণ্ডাল, নিম, তুকমা হায়াত, ঘৃতকুমারি, সাদা তুলসী, অর্জুনবানের গোটা, নদী, খাল, বিল, মাটি...
... রোজার মাসে রাইতে এক মহিলারে লইয়া আইছে কয়জন। ... সাপে কামড় দিছে। ... মন্ত্র পইড়া রোগীরে একটা মইছ (মরিচ) গালে দিলাম, কইলাম-ধর এইটা চাবান দে। খাইল, ধাক অইছে। মইছ (মরিচ) দিয়া পরীক্ষা দিলাম, যদি ধাক না ধরে তয় জানব যে এই রোগী আর বাঁচব না... মাথায় বিষ ওইঠা গেছে।... হেরপর একটা মুরগী কিনা আনলে বেটির আতটা(হাতটা) একটু কাইটা মুরগীটার পুটকিটা ঐখানে লাগাইলাম; রক্তটা লাগাইলাম। লাগাইলাম যদি বিষাক্ত সাপে কামড় দিয়া থাকে লগে লগে মুরগীটা দাপাইয়া মইরা যাইব।..একদম মইরা যাইব। পরীক্ষা অইটাই। ... নতুন ব্লেড কিইন্যা আইনা এই বান্ধের গোড়া কেচা দিলাম।...কেইচা দিলাম নানান গাছগাছালির অষুধ লাগাইয়া। ... অষুধ লাগাই দিলাম মাগো বেটি চিক্কার দিয়া দাপড়ান। এরপর গরম পানি দিয়া ধুইয়া বান ছাইড়া দিলাম, রোগী পুরা সুস্থ।
[হাফিজা (৪৫), মিরকাদিম পৌরভবন সংলগ্ন, মুন্সীগঞ্জ]
যদি গেইজের ব্যারামের রোগীরে বনরুইত মাছের আঁইশটা দিয়া অষুধ বানাইয়া ব্যবহার করান যায় তাইলে গ্যারান্টি, রোগ ভালা অইয়া যাইব।... কট মাছের কাটা, অর্জুনবানের গোটা, আখরোটের ফল মাজা ব্যথার জইন্য উপকার দেয়, বাতের জন্য উপকার দেয়।
[আব্দুল কাদের (৫৫), মুক্তারপুর বহর, মুন্সীগঞ্জ]
অনেকদিনের পুরানি কাঁশির জন্য কুই মাছ খাওয়ানো গেলে কাঁশি ভালা অইয়া যাইব।
[পাগলনি খালা(৫০), কদম আলী গুদারা ঘাট, কাশীপুর নারায়ণগঞ্জ]
...আমি সাপ ধরছি, সাপ নাচাইছি। আমি সাপ ধরছি না-দাড়াইস ধরছি, গড়াইস ধরছি, দুধরাজ, বেকরাজ, জাইত, গোক্েখার, আলাজ, বীনরাজ, পাতরাজ, টুনটুনি, গলাকাটি, লালটিঙি, পিরপিরে, টিয়াঠুটি, সুতাশঙ্খ, কালিনাগ বহু ধরনের সাপ ধরছি।...এইগুলি বাংলাদেশেও ধরছি ভারতেও ধরছি...অনেক সাপ ধরছি আমি।...সাপ ধরা তো কোন ব্যাপার না। সাপ ধরাতো সাবাস। ... কোন কিছূ লাগে না। সাপ ধরা সাবাস আর হাতের ক্যাপাসিটি, চখ্যের নজর। ...তারপরেও সাথে গাছ রাহি, লাঠি রাহি।
[ কান্দার খান (৬৫),খরিয়া মালবৈদ্য বহর, মুন্সীগঞ্জ]
মাংতাদের আপন চিকিৎসা পদ্ধতি বা বৃত্তিগত উপকরণের সবকটিই উদ্ভিদ-প্রাণী বা পরিবেশীয় অন্যান্য উপাদানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট। মাংতাদের আপন চিকিৎসা পদ্ধতিতে তন্ত্র-মন্ত্রের এক অনিবার্য উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলেও পরিবেশীয় জীবীয় বা অজীবীয় উপাদানগুলোও প্রত্যক্ষভাবেই জড়িত। আর এইসমস্ত উপাদান সমূহের ব্যবহারাদির পুরোটাই যে মাংতাদের আপন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে তা বলাই বাহুল্য। মাংতাদের অন্যান্য বৃত্তিসহ নিজস্ব চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগ নির্ণয়ন কৌশল থেকে শুরু করে অষুধপাতি পর্যন্ত্ত পুরো প্রক্রিয়াতেই পরিবেশীয় উপাদানের অপরিহার্যতা লক্ষ্যণীয়।
পুস্তকি জ্ঞান না থাকলেও পূর্বপুরুষের জ্ঞান-অভিজ্ঞতার আলোকে মাংতারা চারপাশের পরিবেশকে অত্যন্ত নিবিড় ভাবে পাঠ করেন। ভৌগলিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের সকল উপাদানের সাথেই মাংতাদের রয়েছে এক সংহত সম্পর্কের; আর এই সংহত সম্পর্কের ভেতর দিয়েই তারা পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের নানা বিষয়াদি রপ্ত করে নেন। এখানে কোন দখল নেই, বিনাশ নেই, পাচার নেই, আছে, কেবল এক অকৃত্রিম বান্ধব সম্পর্কের। এই সম্পর্কই মাংতাদের শিখিয়ে দেয় কোন অসুখ-বিসুখে কখন, কোন সময়ে, কোন গাছের ফল-বাকল-পাতা-ফুল বা শিকড় কতটুকু পরিমানে সংগ্রহ করতে; কীভাবে জুনি পোকা, ইঁদুরের লেজ, কাইক্যা মাছের ঠোঁট, কুঁই মাছ, কোরাল মাছের কাটা, কট মাছের কাটা, ওরাল মাছের কাটা, ধনেশ পাখির ঠোঁট, গরু-ছাগল-মহিষের শিং, ময়না পাখির ঠোঁট, পোকা-মাকড়, বিভিন্ন জাতের সাপ, সাপের বিষ, কুমিরের মাংস, বনরুইয়ের আঁশটে বা প্রাণীর হাড়গোর সংগ্রহ করতে হবে প্রাণীকূল বা গাছ-গাছালির স্থায়ী কোন বিনাশ ছাড়াই। পরিবেশীয় এইসব নানান উপাদান দিয়েই তারা শত শত বছর ধরে দাঁতের পোকা, চোখের পোকা, চোখের ছানি, রস বাত, বিষ বাত, ওরশ্যের ব্যারাম, হাঁপানি, বিভিন্ন রকমের চর্মরোগ, যৌনরোগ, রক্তস্রাব, সাদাস্রাব, সাপের বিষ নামানো সহ নানান চিকিৎসা দিয়ে আসছেন ডাঙ্গার গৃহস্থ মানুষদের। শুধুমাত্র মানুষের চিকিৎসাতেই নয় গৃহপালিত পশুপাখির চিকিৎসা পদ্ধতিতেও তারা সিদ্ধহস্ত। যেমনঃ ভাদ্র-আশ্বিণ মসে গরুকে যদি কুমিরের মাংস খাওয়ানো যায় তাহলে গরু আর জ্বরতে (খুড়া রোগ) পারে না ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রাকৃতিক সম্পদের বিনাশকে তারা কখনোই প্রশ্রয় দেন না; কেননা এইসবের বিনাশকে তারা সার্বিক ভাবে নিজেদের বিনাশই মনে করেন। সভ্য মানুষেরা যখন আরাম-আয়েশ আর মুনাফার লোভে একের পর এক নদ-নদী, খাল-বিল ভরাট করে ফেলছেন, বন-জঙ্গল-পাহাড় সব দখল করে ফেলছেন তখন মাংতারা বাকরুদ্ধ হয়ে যান; এ যেন নদী বা খাল-বিলকে মেরে ফেলা নয়,বন-জঙ্গল ধ্বংস নয়; মাংতাদেরই গলা টিপে হত্যা করা। গৃহস্থ মানুষের কল-কারখানার বিষ দিয়ে পানিকে দূষিত করে হাজার হাজার জাতের জলজ জীবের বংশ নাশ করাকে মাংতারা নিজেদেরই বংশনাশ জ্ঞান করেন। কেননা এই নদ-নদী, খাল-বিলই তো অন্যান্য জলজ জীবের ন্যায় তাদেরও আবাসস্থল, বিচরণ ক্ষেত্র। উপযোগী পরিবেশীয় বিচরণক্ষেত্র ছাড়া কোন জীবই তো স্বাভাবিকভাবে টিকে থাকতে পারে না; মাংতারাও পারছেন না। গৃহস্থ মানুষেরা কীভাবে এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে জানা নেই মাংতাদের; জানা নেই এই ভাবে নদী-খাল-বিল হত্যার কোন বিচার আছে কী না বা থাকলেও কার কাছে তারা চাইবেন এইসব হত্যা, দখল আর বিনাশের। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নদ-নদী, খাল-বিলের পানিতে জীবন পার করলেও এবং ঝোপ-ঝাড়, বন-জঙ্গল থেকে তারা তাদের প্রয়োজনীয় সাপ, ব্যাঙ, পোকামাকড়, পাখি, গাছগাছালি সংগ্রহ করলেও কখনো একরত্তি জায়গাওতো নিজেদের দখলে রাখার কোন চেষ্টা করেন নি কিংবা সাপ, পোকামাকড়, জন্তু-জানোয়ার নির্বিচারে হত্যা করেন নি, পাচার করেন নি, দখল করার কথা ভাবেন নি নদী-খাল-বিল আর পাহাড়-জঙ্গলকে। কিন্তু তারপরেও একের পর এক নদ-নদী-নালা-বিল-খাল সব উধাও হয়ে যায়, জলের মাছ, পোকামাকড়সহ হাজার হাজার প্রজাতির জীব-জানোয়ার, ঝোপ-ঝাড়, বন-জঙ্গল সব উজার হয়ে যায়।
অষুধি গাছ পাইতেতো এহন অনেক সমস্যা। বছরে দুই-একবার ভারত যাইতে অয় গাছগাছন্ত আনতে। আগেতো মধুপুর জঙ্গল থিকা তারপরে রাঙ্গামাটি, বান্দরবন, খাগড়াছড়ি ও চিটাগাংএর পাহাড়ি বন থিকা আনতাম। এহনতো কিচ্ছু নাই, অনেক গাছপালা কাইটা হালাইছে। ...অষুধ পাইতে অনেক কষ্ট অয়।
[ মোঃ আলাউদ্দিন (৪৫),আমিন বাজার ব্রিজ বহর, ঢাকা]
...এইযে রঙের পানিটা, ডাইংয়ের পানিটা নদীর মইধ্যে যেইভাবে ছাড়তাছে -এভাবে মাছ সব মইরা যাইতাছে; আগে বড় বড় বোয়াল মাছ, আইড় মাছ, মিরকা মাছ, রুইত মাছ, বাউস মাছ, চেউয়া মাছ, চাপিলা মাছ, বাইল্যা মাছ, বাইম মাছ অইত, অহন যে কেন অয়না- এই রঙের পানির কারণে। ... বোয়াল মাছ এক ইসাবে নাইই, ... ডাইং মাছ- সেলুং মাছটা বড় অইলে ঐটারে আমরা ডাইং মাছ কই...ঐ জিনিসটাও নাই। ... ছাটা ইছা মাছটা থাকতই পারে না। ...আমারতো আধার দিয়া মাছটা মারতাছি।... কারেন জাল দিয়া মাছ মারতাছি না। ...গিরস্তরা কারেন জাল দিয়া মাছের বীজ শেষ কইরা হালাইছে।... এই রঙের পানিটা মুখে দেওয়া যাইতেছে না, পছা পানিটায় যে গোসল করে তাদেরও ক্ষতি অইতাছে,... শরীরে একটা গোটা অইতাছে। ....যারা পানির ভেতরে থাকে না তাগর খাওয়া পড়ে না।...আমাদের থাকতে অইতাছে, এই পছা পানিই খাইতে অইতাছে।
[মোন্তাজ মাতবর(৬০), রিকাবী বাজার বহর, মুন্সীগঞ্জ]
৫.
আল্লারে মানি, রসুলরে মানি, নবী মানি, মনসারে মানি, বাবা খোয়াজ খিজির মানি,মা গঙ্গীরে মানি, নামাজ পড়ি, রোজা রাহি, খোয়াজ খিজিররে খোদাই সিন্নি দেই, মা গঙ্গীর লাইগা সিন্নি ভাসাই, দেবী মনসারে ভোগ দেই, পৌষ সংক্রান্তির বুড়াবুড়ি পূজায় মানতি দেই...; আমরা মানুষ, আমাগো দেখলে পাপ অইব কেন?...
আদি বিশ্বাস যাই থাকুক না কেন বর্তমানে ধর্মীয় বিশ্বাসগত দিক থেকে মাংতারা ইসলাম ধর্মের অনুসারী।
আল্লাহ্, রাসুল সহ ইসলামের প্রধান পাঁচ স্তম্ভের উপর এদের বিশ্বাস রয়েছে। কিন্তু মুসলমান হলেও তাদের নিজস্ব কিছু বিশ্বাস ও লৌকিক সংস্কারের প্রচলন রয়েছে যা তাদের স্বতন্ত্র্য পরিচয় আমাদের সামনে হাজির করে। ইসলামের অনুসারী হলেও অন্য ধর্মের অনেক কিছুই তারা আত্মস্থ করেছেন নিজস্ব ঢঙে। পানির উপরে সারাজীবন বসবাসের দরুন পানির পীর হিসেবে খ্যাত বাবা খোয়াজ খিজিরের উপর মাংতাদের রয়েছে পরম আস্থা। প্রতিবছর অগ্রহায়ণ মাসে মাংতাদের প্রতিটি বহরেই বাবা খোয়াজ খিজিরের নামে করা হয় খোদাই সিন্নি। সকলের সম্মিলিত আয়োজনে খোদাই সিন্নি তৈরির পর প্রথমেই তা খোয়াজ খিজিরের নামে একটা কলাপাতায় করে ভাসিয়ে দেয়া হয় নদীর জলে। কিন্তু এই খোদাই সিন্নি খোয়াজ খিজিরের নামে ভাসানোর পাশাপাশি একইভাবে মা গঙ্গীর উদ্দেশ্যেও উৎসর্গ করেন মাংতারা। তাদের জলজ জীবনে খোয়াজ খিজির ও মা গঙ্গী দুজনের সমান গুরুত্বের। ঝড়-বাদল সহ সকল প্রকার বিপদে-আপদে তারা একই সাথে স্মরণ করেন মা গঙ্গী ও বাবা খোয়াজ খিজিরকে। জলের উপরে বসবাস, সাপের হাত থেকে নিজেদের রক্ষাসহ অন্যান্য দুঃখ-কষ্ট থেকে নিস্কৃতির জন্য সর্পদেবী মনসার শুভদৃষ্টি কামনায় মাংতারা দুধ, কলা, ধান,দূর্বা সহ ভোগ দেয় নানান কিছু। এছাড়া ছেলে-মেয়েদের অসুখ-বিসুখের হাত থেকে রক্ষার জন্য পৌষ সংক্রান্তিতে আয়োজিত বুড়াবুড়ির (শিব-পার্বতী) পূজায়ও মানত দিয়ে আসেন একান্ত বিশ্বাসের সাথে।
যাদুবিদ্যা,তন্ত্র-মন্ত্র মানুষের অতি পুরনো বিশ্বাসের ধারাটিকেই ঝিইয়ে রেখেছে। যাদুবিদ্যা এমন একটা কৌশল যা দিয়ে মানুষ অতিপ্রাকৃত শক্তিকে বশে এনে স্বীয় উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চায়। কল্পনার হাতিয়ার দিয়ে অজেয় প্রকৃতিকে বশীভূত করার একটা অনেক পুরনো প্রচেষ্টা। তন্ত্র-মন্ত্র, যাদুবিদ্যায় অগাধ বিশ্বাস ও তার নিয়মিত চর্চা রয়েছে মাংতা জীবনে। মাংতাদের সকল চিকিৎসা পদ্ধতিতে তন্ত্র-মন্ত্রের উপস্থিতি অণিবার্য। মাংতাদের তন্ত্র-মন্ত্রের সাথে প্রায় ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে আছে আসামের কামরূপ পাহাড়ের নাম। তাদের অনেকেই নিজেদের ও তাদের পূর্ব পুরুষদের আসামের কামরূপ পাহাড়ের কামাখ্যা মন্দিরে যাদুবিদ্যা শিখে আসার কথা মজমা সহ নানান জায়গায় বেশ গর্বের সাথে প্রচার করেন। সাথে থাকে সেখানকার নানান গল্প ও যাদুবিদ্যা শেখার বই লজ্জাতুন্নেছার নাম। তাদের বিশ্বাস মতে গাছ-গাছন্ত, জীব-জানোয়ারের দেহের বিভিন্নাংশের সাথে এই তন্ত্র-মন্ত্রের ব্যাপারটা যুক্ত হলে তা থেকে অতি সহজেই কাঙ্খিত ফল পাওয়া যায়। বিশেষায়িত দ্রব্যগুণের বিশাল কদর রয়েছে মাংতা জীবনে। অমাবস্যা-পূর্ণিমা রাতে জোয়ারের সময় কাটা পাটের আঁশের বিশেষ গুণ আছে বলে বিশ্বাস করেন। এই বিশেষ গুণ সম্পন্ন পাটের আঁশ দিয়ে ওঝা রোগীর যেখানে সাপে কামড়েছে তার উপরের দিকে বাঁধ দিয়ে দেন। এরপর হাতে কড়ি নিয়ে মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে ঝাড়ার পর কাইক্যা মাছের ঠোট বা ব্লেড দিয়ে ক্ষতস্থানের উপরে কেটে বিষ বের করে ফেলেন। এছাড়া অমাবস্যা রাতে কেউ যদি একাকী উলঙ্গ অবস্থায় নির্দিষ্ট স্থান থেকে সাদা তুলসির শিকড় তুলে আনতে পারে তাহলে তা দিয়ে যাদু-টোনা, বাণ সহ নানান কাজে লাগানো যায় ইত্যাদি অনেক বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে।
... মানুষ হইয়ে মানুষেরা ঘিন্না নাইকা-মহাপাপ। আমি যামু, আমারে দেইখা কেউ ঘিন্না করে করুক, আমি তারে ঘিন্না করলাম না। অর মন চায় আমার কাছে আহুক না চায় না আহুক; আমার কাম আমি কইরা আমু। গেরাম করতে গেলে কতকের গাইল-কনি খাওন লাগে, কতকের খিবুকসি (?) শুনন লাগে, কতকের... । গিরস্তের বাড়ি গেলে কউক, কাজ করতে গেলে কত কতাইতো হুনতে অয়, কতায় কয় না- নদী দিয়া গান গাইয়া গেলে নদীর জোয়ার যায় না, মুখের জোয়ার যায়।
[ হাফিজা বেগম(৪৫), মিরকাদিম পৌরসভা সংলগ্ন, মুন্সীগঞ্জ]
মাংতারা তাদের আপন বিশ্বাসে আর সংস্কারে গৃহস্থদের অনেক বিশ্বাস আর সংস্কারের সহাবস্থান ঘটালেও ডাঙ্গার মানুষদের কাছে তারা বরাবরই নিচু জাত,অচ্ছুত বা ঘৃণার পাত্র হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছেন। মাংতারা মুসলমান হওয়া সত্বেও এবং ইসলাম ধর্মে বর্ণবাদের কোন স্থান না থাকলেও তারা গৃহস্থ মুসলমানের বর্ণবিদ্বেষী আচরণের সম্মুখীন হন প্রতিনিয়তই। মাংতা পুরুষেরা সাধারণত হাটে-মাঠে-ঘাটে নিজের পেশাগত মজমা বসালেও মাংতা নারীরা গৃহস্থদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে যাদুখেলা, সাপের খেলা, চুড়ি বিক্রি, শিঙ্গা লাগানোর কাজ করে থাকেন। আর একারণে স্বভাবতই মাংতা পুরুষদের চেয়ে নারীরা বর্ণদাপটের চরিত্রকে টের পান হাড়ে হাড়ে। বাড়ির শূচিতা নষ্ট হবে বলে অনেক গৃহস্থ বাড়িতেই মাংতা নারীদের প্রবেশের কোন অনুমতি মেলে না। আর কোন রকমে অনুমতি মিললেও গৃহস্থের ঘরে ঢুকবার কোন সুযোগ থাকে না। কারো কারো মতে...বাইদ্যানিগো চেহারা দেখলে পাপ অয়, জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে অইব, মাংতাদের দিকে তাকালে নাকি কারো চল্লিশ দিনের জন্য পবিত্রতা থাকে না, কবুল হয় না কোন ইবাদত-বন্দেগি এমন বিশ্বাসও প্রচলিত রয়েছে অনেক গৃহস্থ মানুষের। মাংতা নারী বুঝে পায় না মানুষ মানুষের দিকে তাকালে কী ভাবে পাপ হয়, দেহের পবিত্রতা নষ্ট হয়, ইবাদত-বন্দেগি সব পানি হয়ে যায়। জাত-পাতের বিবেচনায় নিচু জাত বলে অবজ্ঞা করলেও সুযোগ পেলে গৃহস্থ পুরুষদের অনেকেই মাংতা নারীর দিকে লিঙ্গীয় আঘাত হানতে কার্পণ্য করেন না। এহেন বর্ণ আর পুরুষতান্ত্রিক দাপটের কাছে মাংতা নারী-পুরুষ কোণঠাসা হলেও কখনো দমে যান নি। আপন সংস্কার, বিশ্বাস, সহনশীলতা আর পেশাগত দক্ষতা আর জাতিগত সংহতিকে পুঁজি করে আজও মাংতারা মোকাবিলা করে চলেছেন সকল দাপটকে, নিজেদের টিকিয়ে রাখার এক অদম্য প্রত্যয়ে।
...একবার মুক্তাগাছায় গিরস্তরা আমাগো সাভারের এক মাইয়া তুইলা নিয়া গেছিল। পরে কেস কইরা দুই দিন পর মেয়ে ফেরত পাইছিল। এই রহম অয় অনেক জায়গায়। ...এইসব সমস্যা আমরা সবাই মিল্যা মীমাংসা করি। আর এইগুলি যেইখানে অয়, সেখানে আমরা সারাদেশের মাংতারা সবাই টেকা দেই সমাধানের লেইগা। আর আমগো সব দলের একজন কইরা মাতবর ওইহানে যাইব, যেইহানে এই ঘটনাটা হইল-মীমাংসার লেইগা।
[আব্দুল কাদের (৫৫), মুক্তারপুর বহর, মুন্সীগঞ্জ]
৬.
আমাগো বম্কই আমাগো নেমরা-নিমরির লেইগা...; আমাগো নৌকায় কুনোসুম ডিবির দুধ ঢুকে নাই...; রাজা, মায়া বড়ি,...কুনোসুম কিনি নাই, ব্যবহার করি নাই...
বাজারি অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পণ্যের অবাধ প্রবাহ আজ আছড়ে পড়ছে সর্বত্র। মুনাফা লোভীদের তাণ্ডবে বিধ্বস্ত আজ পাহাড়-জঙ্গল-সমতলের সকল জাতির মানুষের স্বাভাবিক জীবন-যাত্রা। পণ্যের বাঁধভাঙ্গা জোয়ারে বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার আপন প্রতিরোধী ব্যবস্থা আজ হুমকির সম্মুখীন। মাংতাদের জীবনও এর বাইরের কিছু নয়। সভ্য, শিক্ষিত মানুষের কাছে মাংতারা যতই অসভ্য,নিকৃষ্ট,অচ্ছুত হোক না কেন বাজারি দুনিয়ার দাপুটে ব্যবস্থায় উৎপাদিত পণ্যের ভোক্তা হিসেবে তারা মোটেই ‘অচ্ছুত’ নন। ভোক্তা হিসেবে সভ্য দুনিয়ার বিভিন্ন কোম্পানিগুলোর কাছে অন্যান্য সবার ন্যায় তারাও হয়ে ওঠেন কাঙ্খিতজন। দাপুটে বাজারি অর্থনীতির কাছে আত্মসমর্পিত রাষ্ট্রযন্ত্র তার নানান বিধিব্যবস্থার মাধ্যমে বেঁচে থাকবার নূন্যতম অধিকার থেকে মাংতাদের প্রতিনিয়ত দূরে ঠেলে রাখলেও পণ্যের বাহারি সব প্রচার-প্রচারণায় কাউকেই দূরে রাখতে বা বঞ্চিত করতে চায় না (!) ব্যবসায়িক দুনিয়া। সভ্য দুনিয়ার অর্থনৈতিক মারপ্যাঁচ না বুঝলেও চারপাশের নানান পরিবর্তন তাদের মানস চিন্তায় রেখে চলে অনেক প্রশ্নের ছায়াপাত; যে প্রশ্ন তাদেরকে শংকিত করে তুলে নিজেদের বিশ্বাস, আচার ও পেশাগত ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার বিষয়ে। কিন্তু তারপরেও মাংতারা আপন বিশ্বাস আর সংস্কারগত সংহতিকে অক্ষুণ্ন রাখার ভেতর দিয়েই গড়ে তোলেন তাদের আপন প্রতিরোধের ভিত্তি।
...বাইচ্চা না অওনের লেইগা আমাগোর পদ্ধতিই করি। ... ডাক্তারি অষুধে সাদা সেরাবের ব্যারাম অইয়া যায়, রক্ত সেরাবের ব্যারাম অইয়া যায়, কতকের ফুইলা যায়গা...। আর আমাগো গাছন্ত অষুধে শরীলে কোন সমস্যা অইব না। ...চাইরটা ট্যাবলেট বানাই দিমু খাইলে জীবন পার ...। তেরো জন ছেলে মেয়ে অইছে, আমার স্বামী একটু হাদিসের পদের তো হেই জন্য বাইচ্চা বন্ধ করতে দেয় নাই। ...আমার কোলের ছেলের পরেই আমি চাইরটা ট্যাবলেট খাইছি, আর চিন্তা নাই...; ... অল্প কয়েকদিনের জন্য বাইচ্চা হওন বন্ধ করার অষুধও আমাগো জানা আছে।
[ হাফিজা বেগম (৪৫), মিরকাদিম পৌরসভা সংলগ্ন, মুন্সীগঞ্জ]
মাংতা পরিবারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি হলেও তাদের রয়েছে নিজস্ব নিয়ন্ত্রন পদ্ধতি। বাজারি জন্ম নিয়ন্ত্রন সামগ্রী সমূহের উপর কোন আস্থা রাখতে পারে না মাংতা নারী। হাটে-বাজারে, রেডিও- টেলিভিশনে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর বাহারি সব বিজ্ঞাপণ দেখলে-শুনলেও সেদিকে তাদের কোন আকর্ষণ নেই। বহুজাতিক কোম্পানীগুলো তাদের কনডম, পিল ইত্যাদি দিয়ে সারা দুনিয়া দাঁপিয়ে বেড়ালেও মাংতা জীবনে কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। মাংতাদের দাবি, বাজারি এই সব জন্ম নিয়ন্ত্রন সামগ্রীতে নানান পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকলেও উদ্ভিজ্জ ও প্রাণীজ উপাদানে তাদের নিজেদের তৈরিকৃত ঔষধে কোনো শারিরীক ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। প্রকৃতি থেকে পরিমান মতন উদ্ভিজ্জ ও প্রাণীজ উপাদান নিয়ে আপন জ্ঞান আর অভিজ্ঞতার নির্যাস মিলিয়ে নিজেরাই তৈরি করে নিচ্ছেন নিজেদের শরীরবান্ধব জন্মনিয়ন্ত্রন সামগ্রী। এছাড়া মাংতা মায়েরা গৃহস্থ মায়েদের ন্যায় সন্তানের বেড়ে উঠার দায়দায়িত্ব ডানো, নিডো, এ্যাংকার বা অন্যান্য গুড়ো দুধের কৌটায় বন্দী রাখতে চান না মোটেও। মাংতা মায়ের বিশ্বাস বমকই বা বুকের দুধ পান করানোর সাথে সন্তানের স্বাস্থ্যগত ব্যাপারটা যেমন জড়িত তেমনি জড়িত সন্তানের সাথে মায়ের নিবিড় ভালোবাসার বাঁধনটাকে আরো পোক্ত করার। মাংতা মায়েরা তাদের সন্তানদের দেড়/দুই বছর পর্যন্ত বুকের দুধই পান করান। আলগা দুধ পান করানোর রীতি মোটেই পছন্দ নয় তাদের। তবে মায়ের স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণে বাচ্চাকে বুকের দুধ পান করানো না গেলে সেক্ষেত্রে গরুর দুধ বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে এর হারও খুবই কম। মাংতা মায়েরা সারাদিন কর্মব্যস্ত থাকলেও তাদের সন্তানের দেখাশুনার দায়িত্বটুকুও অন্যের হাতে ছাড়তে নারাজ। নিজের আঁচলে শিশু সন্তানকে পিঠে বেঁধে নিয়েই গ্রাম ঘুরতে তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
৭.
বামাদের যা কিছু খাছরে, তাই লিয়ে ঝেলের নতে লড়পাব... ;বামাদের যা কিছু খাছরে, তাই লিয়ে ঝেলের নতে লড়পাব...; বামাদের যা কিছু খাছরে, তাই লিয়ে ঝেলের নতে লড়পাব...
...এই রহম অইছে, আমরা এক জায়গায় গেছি দল লইয়া, ভালা সুন্দরী মাইয়া দেখলে ওরা (গৃহস্তরা) হামলা দিতে আইছে কিন্তু আমরা আবার রাত জাইগা ঐ সেখান থেইকা চইলা গেছিগা। আমাদের কাছও ঐ গুলিবাঁশ, গুলাইল থাকে; এগুলি লইয়া আমরা রাত জাগছি। এইগুলি দিয়া আমরা পাহারা দিছি। দেখছি ওহানে খারাপ ওখানে আর থাকি নাই চইলা গেছি গা। আবার কত জায়গায় হামলাও দিয়া হালাইছে, মারামারিও হইয়া গেছে; আমরা কেস-মামলা করছি।... এই ভাবেই আমরা টিক্যা আছি।
[আব্দুল কাদের (৫৫), মুক্তারপুর বহর, মুন্সীগঞ্জ]
অধিপতি শ্রেণীর নিত্য নতুন কৌশলের কাছে মাংতারা প্রতিনিয়ত কোণঠাসা হয়ে পড়লেও টিকে থাকার সংগ্রামে তারা আজও লড়াকু সৈনিক। সভ্য দুনিয়ার নানান সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত মাংতারা দমে যাবার পাত্র নন। তারা তাদের নিজস্ব জ্ঞান, বিশ্বাস আর প্রথাগত সংস্কারের সাহসী চর্চার মধ্য দিয়েই মোকাবিলা করে চলেছেন নানান প্রতিকুলতাকে। সভ্য সমাজের সুযোগ-সুবিধা থেকে অনেক পিছিয়ে থাকলেও মাংতারা হতাশ হতে নারাজ। হতাশ কেন হবেনই বা কেন- শিশু-বৃদ্ধ প্রতিটি মাংতাইতো আজও তাদের নিজস্ব জীবনাচার ধরে রাখছেন সাহসিকতার সাথে। তাদের চাঁন মিঞা সর্দার, পান্না মাতবর আর মোন্তাজ মাতবরেরা আজও বিচক্ষণতার সাথে মাংতা বহরের নিজস্ব রীতি-নীতি পালন করে চলেছেন; আমিন বাজারের আলাউদ্দিন মিয়া শহরে-বন্দরে বীন বাঁশিতে সুরের ঢেউ তুলে মুক্তারপুরের আব্দুল কাদেরের দক্ষ হাতে ধরা সুতানালি, পিলপিলে, জাইত, গোখরা, মাইটাপানস নাঁচিয়ে চলেছেন সমানে। কাশীপুরের পাগলনি খালা, মিরকাদিমের হাফিজা, আফুজারা তাদের জুংলি আজও বোঝাই রাখেন গাছগাছন্ত আর জীব-জানোয়ার দেহাংশ থেকে তৈরি নানা রোগের অষুধে, মহিষ-গরু আর ছাগলের শিং, কাইক্যা মাছের ঠোট আর কার্তিক অমাবস্যার পাটের দড়িতে; দক্ষ হাতের কৌশলে শিঙ্গা টেনে টেনে বের করে আনছেন গৃহস্থ মানুষের শরীরের বিষাক্ত রক্ত-পূঁজ। আর এই রক্ত-পূঁজের সাথেই হয়ত একদিন বের করে আনবেন গৃহস্থ মানুষের দেমাগি মনের সকল আবর্জনাকে -এমন স্বপ্নের ঝিলিকইতো খেলে যায় মাফুজাদের চোখে-মুখে। অধিপতি শ্রেণীর নানাবিধ কাঠামো তাদেরকে প্রতিনিয়ত আড়াল করে রাখতে চাইলেও আমিন বাজারের মান্নান সর্দারেরা নতুন প্রজন্মের মাংতাদের কাছে চান না কোন কিছু আড়াল করতে; মাংতাদের নিজস্ব রীতিনীতির কথা বলে যান বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে। রিকাবী বাজারের সোনিয়া, সালমারা গৃহস্থ পুরুষের নানা রকম হয়রানির মুখোমুখি হলেও কাপ-পিরিচের পাতিতো মাথা থেকে নামান নি; গৃহস্থ পুরুষের কুদৃষ্টির কাছে হার না মেনে মাথা উঁচু করেই তো গ্রামে গ্রামে ঘুরছেন। নদীতে মাছ না থাকলেও রমিজ মিয়ারা আজও তার বড়শিতে আধার গেঁথে চলেন ধলেশ্বরীর বুকে কারেন জালের কাছে আপোস না করার ব্রতটা জিঁইয়ে রেখেই। বিয়ান্যার শাজাহান মিয়া তালি-চাবি ঠিক করে দিয়ে অনেক সময় ন্যায্য পাওনা না পেলে গৃহস্থদের দুটো উচিৎ কথা শুনিয়ে দিতে তো ভয় করেন না কখনো। খরিয়া গ্রামের কান্দার খানেরা আজও জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ান অষুধি গাছের খোঁজে। লোকমান মিয়া আর মামুনেরা কড়িমালা, ঝিনুকমালা সহ নানান গাছন্ত তাবিজের ঝান্টা নিয়ে পাড়ি দেন শহর-বন্দর-গ্রাম। লুটপাট আর ছিনতাইয়ের দুনিয়ায় হানিফ মিয়া তার ওছা আর আছড়া নিয়ে হাঁক দিয়ে বেড়ান-পানিত পইড়া যাওয়া সোনা-রূপার জিনিস তুলি...। প্রাকৃতিক নানান উপাদানের মাধ্যমেই ওরশ্যের ব্যারাম, হাঁপানি, যৌনরোগ, বা জন্ম নিয়ন্ত্রণের অব্যর্থ অষুধ দিয়ে চলেছেন দেলোয়ার হোসেন। গৃহস্থদের প্রতিনিয়ত খালবিল ভরাটের বিপরীতেও আবু বকর, সালামেরা নতুন নতুন বিরকি (নৌকা) ভাসাচ্ছেন পানিতে। রোখসানা, রেহানারা তাদের সন্তানদের ঘুম পাড়াচ্ছেন ঠারে গান শুনিয়েই। গৃহস্থজনের সামপ্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিকে উপেক্ষা করেই পাগলনি খালারা একই সাথে খোয়াজ খিজির আর মা গঙ্গীর নামে পানিতে ক্ষীর ভাসাচ্ছেন, একই হাতে মিলাদের তবারক আর পূজার প্রসাদ গ্রহণ করছেন পরম বিশ্বাসের সাথে। পান্না আর শম্ভু মাতবরদের আহ্বানে পোড়াবাড়ি সহ বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানের ন্যায় খরিয়া গ্রামে এখনও সকল মাংতারা জড়ো হন কার্তিক মাসে, মেতে উঠেন উৎসবে-আমোদে। আর এই সমস্ত কিছুই মাংতাদের প্রেরণা যোগায় সকল দাপটের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়ে যাবার, শক্তি যোগায় সম্মিলিত কণ্ঠে উচ্চারণ করার-
আমাগো যত তন্ত্র-মন্ত্র, বিশ্বাস, বিরকি, বহর আছে তাই নিয়ে লড়ে যাব
আমাগো ঠারে যত শব্দ, গীত, রূপকথা, প্রবাদ, ডাকের কথা আছে তাই নিয়ে লড়ে যাব
আমাগো বহর যতগুলা নদী-নালা-খাল-বিল-জলাশয়-রাস্তার ধারে আছে তাই নিয়ে লড়ে যাব
আমাগো চেনা যত জাতের সাপ, পোকামাকড়, পশু-পাখি, জীব-জানোয়ার আছে তাই নিয়ে লড়ে যাব
আমাগো যত ওছা, আছড়া, বীন, ঝাপি, ঝুড়ি, জুংলি, ঝান্টা, গুলিবাঁশ, গুলাইল আছে তাই নিয়ে লড়ে যাব
আমাগো যত বনরুইর আঁইশটা,সজারুর কাটা, কুমিরের মাংস, কট মাছের কাটা আছে তাই নিয়ে লড়ে যাব।
(This article was published in `Mhrittika’-vol.-3, issue-3; editor-Jewel Bin Zahir, Parag Ritchil, Dhaka, August 2006)
শাল বন্দনাঃ বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার কৃত্য আচারে, বিশ্বাসে এবং সংগ্রামে
জুয়েল বিন জহির
১.
শাল একটি বহুবর্ষজীবি বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ। Dipterocarpaceae পরিবার ভূক্ত শালগাছের বৈজ্ঞানিক নাম Shorea robusta । এক সময় বাংলাদেশ সহ অবিভক্ত ভারতবর্ষের মোট বনভূমির এক বিশাল অংশ জুড়ে ছিল শালবনে আচ্ছাদিত। বাংলাদেশের মধুপুর গড়, রাজশাহী, দিনাজপুর, গাজীপুর অঞ্চলে ছিল শালবনের বিস্তৃতি। আর সুদূর অতীতকাল থেকেই এই শালবন বা তার আশেপাশে বসবাসকারী মান্দি, কোচ, বর্মণ, ডালু, হদি, সাঁওতাল, ওরাওঁ, মাহাতো, সিং প্রভৃতি বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার বর্ণাঢ্য জীবন-সংস্কৃতিতে শাল কেন্দ্রিক আপন আচার, আপন বিশ্বাস গড়ে উঠেছে। প্রাচীন কাল থেকেই প্রচলিত এই বিশ্বাস আর কৃত্য আচারাদির সাথে শালগাছ বা শালবনের নিবিড় যোগসূত্রতার দরুন বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর জীবন-সংস্কৃতিতে শালগাছ বা পুরো শালবন স্থান করে নিয়েছে পবিত্র উদ্ভিদ (Sacred Plant) বা পবিত্র স্থানের (Sacred Place) মর্যাদা। শুধুমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাস বা আচারাদির মধ্যেই নয় কখনো কখনো এই শালগাছ বা শালবন হয়ে উঠেছে লড়াই-সংগ্রামের আহবান, ক্ষেত্র বা হাতিয়ার হিসেবে।
২.
বাংলাদেশে তথা পৃথিবীতে বসবাসরত বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মধ্যে অধিকাংশের ধর্মই কোনো পুঁথিভিত্তিক ধর্ম নয়। এদের যুগলালিত আপন বিশ্বাসে, আপন আচারে জড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন দেব-দেবতার অস্তিত্ত্ব। প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে থাকবার দরুন জাতিসত্ত্বাসমূহের এই সব নানান দেব-দেবতারা স্বভাবতই প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান গাছ-পালা,পশু-পাখি ইত্যাদি নানান কিছুর মাধ্যমে মূর্ত হয়ে উঠেছে তাদের মানস চিন্তায়। যেমন সাঁওতাল এবং ওরাওঁদের প্রধান গৃহস্থ্য দেবতার নাম বোঙ্গা। সাঁওতাল, ওরাওঁরা যখন এই বোঙ্গার আরাধনা করে তখন বোঙ্গা দেবতার প্রতীক হিসেবে তারা ব্যবহার করেন শালগাছের ডাল। শুধুমাত্র দেবতার প্রতীক রূপেই নয়, ওরাওঁরা নিজেদের আদি ধর্মীয় বিশ্বাসকে পরিচয় দেয় শারণা বলে; আর কুরুখ ভাষায় এই শারণা মানে হলো শালগাছ। ওরাওঁরা শালগাছকে শারণা দেবী রূপেও পূজো করে থাকে। চৈত্র মাসের প্রতিপদ থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত যেকোন নির্দিষ্ট একটা দিনে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে এই শারণা পূজা।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মধ্যে নানান কামনা-বাসনাকে সামনে রেখে বিভিন্ন ধরনের ব্রতানুষ্ঠানের বেশ প্রচলন রয়েছে। আগেরকার গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজ ব্যবস্থার প্রাচীন যাদুবিশ্বাস ও ধ্যান-ধারনার বিভিন্ন উপাদান আজও পরিলক্ষিত হয় জাতিসত্ত্বা সমূহের নৃত্য-গীত সমৃদ্ধ এইসব বৈচিত্র্যময় ব্রতানুষ্ঠানে। এইসমস্ত ব্রতের বিভিন্ন উপকরনের মাঝে শালগাছ তার স্বাতন্ত্র্য উপস্থিতিকে বজায় রাখতে পেরেছে। ইঁদপরবের ব্রত নামে সাঁওতালরা ভাদ্র মাসের শুক্লাদ্বাদশী তিথিতে ঐশ্বর্য্যলাভ, শস্যবৃদ্ধি এবং সর্বকাজে সাফল্য লাভের উদ্দেশ্যে পালন করে থাকে। ব্রতের দিন গ্রামের মাঝখানে বিশ থেকে পঁচিশ হাত লম্বা শালগাছ পুঁতে তার উপরে লাল শালু কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। নানান উপাচার সহযোগে শালগাছকে পূজা আর মাদল, ধামাসা, বাঁশি বাজিয়ে নাচ-গানের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গতা পায় ইঁদপরব ব্রতের সামগ্রিক আয়োজন।
কার্তিক মাসে কালীপূজার ঠিক আগের দিন গৃহপালিত পশুর সুস্বাস্থ্য ও মঙ্গল কামনায় সিরাজগঞ্জ, বগুড়া অঞ্চলে বসবাসকারী সিং জাতিসত্ত্বার লোকজন গড়াই ঠাকুরের পূজা করেন। গো সম্পদ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে আয়োজিত এই পূজার নাম গোয়ালপূজা বা সোহরাই পূজা। সোহরাই পূজার প্রচলন অবশ্য সাঁওতাল, ওরাওঁ, মাহাতো, মুন্ডা প্রভৃতি জাতিসত্ত্বাসমূহের মধ্যেও বেশ প্রচলিত। সিং জাতিসত্ত্বার লোকজন গোয়াল পূজার সাতদিন আগে থেকেই গবাদি পশুর শিং-এ তেল মাখানো শুরু করেন। পূজার আগের দিন সন্ধ্যায় গ্রামের প্রতিটি গৃহস্তের গোয়ালঘরে জ্বালিয়ে রাখা হয় মাটির প্রদীপ। গোয়ালপূজার দিন গোয়াল ঘরের ভেতর গড়াই ঠাকুরের কাঠামো হিসেবে দেড় থেকে দুই ফুট লম্বা একটা শালগাছের খুঁটি গেঁড়ে নিয়ে তার সামনে সাজিয়ে রাখা হয় বিভিন্ন ভোগ সামগ্রী। এর আগে সকালবেলাতেই গোয়ালের সমস্ত ছাগল,মহিষ, গরুকে গোসল করিয়ে তাদের শিং এ তেল সিদুঁর মাখিয়ে দেন এবং গবাদি পশুকে খাওয়ানো হয় বিভিন্ন ধরনের পিঠা। লাঙ্গল, জোয়াল ও অন্যান্য কৃষি যন্ত্রপাতিতেও একই ভাবে তেল-সিদুঁর মাখানো হয়। মাটিতে চালের গুড়ির গোলায় আঁকা হয় নানান আলপনা। পূজার আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি সম্পন্ন শেষে গৃহকর্তা শালগাছের খুঁটি তথা গড়াই ঠাকুরের কাছে গৃহপালিত পশুর সুস্বাস্থ্য ও মঙ্গল কামনা করে থাকেন ব্রত কথার মাধ্যমে। এরপর চলে খাওয়া দাওয়া, পুরো সিং জাতি মেতে উঠে নাচ-গান আর আনন্দ-উৎসবে।
ফাল্গুন মাসে যখন শালগাছের নতুন ফুলের সুভাসে চারপাশ মগ্ন তখন সাঁওতাল, ওরাওঁরা পালন করে ঐতিহ্যবাহী বাহা পরব বা শারহূল পরব। পরবের দিন পাহান বা পুরোহিত পূজোর উদ্দেশ্যে ঘরের ভেতর প্রবেশ করে নির্দিষ্ট স্থানে বসেন। তাঁর পাশে সিঁদুর, ধূপ, আতপ চাল, ফুল সহ শালগাছের শাখা ভর্তি কুলো হাতে বসেন পাহান স্ত্রী বা গৃহকর্তী। বৃষ্টির কামনা, ফসলের উন্নতি এবং সমাজের মঙ্গল কামনা করে পাহান পূজো শেষ করে শাল গাছের ডাল থেকে একটা ফুল নিয়ে নিজ স্ত্রী বা গৃহকর্তীর খোপায় গুঁজে দেন। পূজোর আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে পাহান ঘর থেকে বের হন। বের হওয়ার সময় ঘরের সম্মুখস্থ চালে শাল ফুল বেধে দিয়ে উঠোনে চলে আসেন। এর পর পাহানের সাথে করে লোকজন পুস্পসমেত শাল গাছের ডাল নিয়ে গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরতে থাকেন। সাঁওতাল, ওরাওঁরা শারহূল ফাল্গুন মাসে পালন করলেও অসুর, সিং জাতির লোকজনেরা করে বৈশাখ মাসে। মালপাহাড়িয়ারাও দেবতাকে উদ্দেশ্য করে শাল ফুল নিবেদনের এই উৎসব ফাল্গুন মাসেই পালন করে তবে তা ভিন্ন নামে; মালপাহাড়িদের এই পরবের নাম ফাগুয়া। মাহালি, মুন্ডারাও এই শারহুল পরব বেশ জাঁকজমকের সাথে পালন করে থাকেন। এই শারহুল পরবেই মেয়েরা বছরের নতুন শাল ফুল মাথায় পড়ার অনুমতি লাভ করে। শারহুল বা বাহা হওয়ার আগ পর্যন্ত সাঁওতাল, ওরাওঁ, মুন্ডা, সিং, মাহালি, মালপাহাড়িয়া রমনীদের জন্য শালফুল মাথায় গুজে রাখা ধর্মীয় ভাবে নিষিদ্ধ।
মধুপুর গড় অঞ্চলে যুগ-যুগান্তর ধরে বসবাসরত কোচ, বর্মণ, মান্দিদের জীবন,ধর্মীয় রীতিনীতি,সংস্কারের সাথে বলশাল ব্রিং জড়িয়ে রয়েছে ওতপ্রোতভাবে। বলশাল ব্রিং বা শালবন মান্দি জাতির হা.বিমা (জননী ভূমি)। তাদের খাদ্যাভ্যাস, নৃত্য, গীত ,পালাসহ বিভিন্ন আমুয়াতে শাল গাছের ফুল-ফল, ডাল-পালার রয়েছে বর্ণাঢ্য ব্যবহার। মান্দি জাতির জীবন-জীবিকা, আচার, বিশ্বাস থেকে বলশাল ব্রিং কে পৃথক করে দেখবার জো নেই। সাংসারেক মান্দিরা সালজং, মিসি, সুসিমি, চুরাবুদি, গুয়েরা, রাক্কাশি সহ বিভিন্ন মিদ্দির (দেবতার) আমুয়া(পূজো) করে থাকেন। প্রতিটি আমুয়াই উদ্দেশ্য এবং কৃত্য নিয়ম-কানুনে স্বাতন্ত্র্য হলেও পূজোর প্রয়োজনীয় উপকরন হিসেবে সাসাৎ এর ব্যবহার লক্ষণীয়। আর এই সাসাৎ তৈরীতে তারা ব্যবহার করেন শালগাছের বাঁকল। সাসাৎসুয়া করলে দেবতারা সন্তুষ্ট হন বলে মান্দিরা তাদের প্রায় প্রত্যেক আমুয়াতেই সাসাৎ ব্যবহার করে থাকেন। কেননা সাংসারেক মান্দিরা বিশ্বাস করেন যে, একদা মান্দি মিদ্দি (দেবতা) মিসি আর সালজং দুই ভাই এই শালগাছের বাঁকল থেকে তৈরী সাসাৎ পোড়া ধোঁয়া পান করেই সন্তুষ্ট হয়েছিলেন রাংদি বিমা রাই মিচ্চিক নাম্নী এক বিধবা বৃদ্বার উপর। সন্তুষ্টির ফল স্বরূপ ঐ বৃদ্বার ঘরেই সর্বপ্রথম জন্ম দিয়ে গিয়েছিলেন মি.নিমা (ধানের মা) কে। সেই মি.নিমা থেকেই পরবর্তীতে জন্ম নেয় মি.মিদ্দিম, মি.সারাং, মি.খচ্চু, মি.মা, মি.নেংগেল, মি.মাথেক, মি.জেংগেম সহ হাজার হাজার প্রজাতির মি (ধান)।
হা.বিমা সাংসারেক মান্দিদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত, আর তাই হা.বিমার জীববৈচিত্র্য যাতে অক্ষুন্ন থাকে সেজন্য মান্দিরা আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে আয়োজন করেন আসংদেনা আমুয়ার। বর্ষাকালে বৃষ্টি স্নাত হা.বিমা তথা শালবনের নরম মাটি ভেদ করে গজিয়ে উঠে নানান প্রজাতির উদ্ভিদরাজি, তখন নিদ্দ্র্ষ্িট দিনে খামালের নেতৃত্বে নতুন গাছের চারা হাতে মান্দিরা সবাই প্রবেশ করেন বলশাল ব্রিং (শালবন) এর গহীনে। নির্ধারিত স্থানে খামাল কর্তৃক খ্রিতা (মন্ত্র) পাঠ ও অন্যান্য নিয়ম-কানুন পালন শেষে সেখানে সবাই নতুন গাছের চারা লাগিয়ে দেন। আর এভাবেই বছর বছর আসংদেনা সহ বিভন্ন আমুয়ার মাধ্যমে সাংসারেক মান্দিরা শালবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে চলেছেন প্রথাগত ভাবেই।
আদিবাসী জাতিসত্ত্বা সমূহের গোত্র প্রতীক বা টোটেম প্রথা আজও বর্তমান। একেকটি জাতি বেশ কয়েকটি গোত্রে বিভক্ত হলেও প্রতিটি গোত্রেরই রয়েছে আলাদা আলাদা টোটেম বা গোত্র প্রতীক। একেকটি গোত্রের টোটেম সেই গোত্রের পরিচয়কে সমষ্টিগতভাবে বহন করে। আর যে বস্তুগুলো টোটেম হিসেবে ব্যবহৃত হয় সেগুলো সাধারণত উদ্ভিদ বা প্রাণিজগতেরই কোন গণ বা প্রজাতি হয়ে থাকে। যে গোত্রের যে টোটেম তারা সেই টোটেম কে রক্ষা করে থাকেন পরম বিশ্বাসে। ভুমিজ সিং এবং খাড়িয়াদের গুলগু গোত্রের টোটেম হলো শালগাছ। গুলগু গোত্রের লোকদের জন্য শালগাছের কোনরূপ ক্ষতিসাধন তাই ধর্মীয় ভাবেই নিষিদ্ধ।
পূর্ব পুরুষদের পূজা, সম্মান করা বা স্মৃতি ধরে রাখার রীতি পৃথিবীর প্রায় সব জাতিরসত্ত্বার মধ্যেই প্রচলিত রয়েছে। পাত্রদের থিবাম, চাকমাদের ভাতদ্যা পূজা, সাঁওতালদের তেলনাহান, ওরাওঁদের পিতৃতর্পণ, খাসিয়দের ইয়াওহে, থাউলাং, উ সুইডানিয়া -দের উদ্দেশ্যে কৃত্য প্রস্তর পূজা কিংবা বাঙালি মুসলমানদের কুলখানি ইত্যাদি সবগুলোই পূর্ব পুরুষদের আত্মার উদ্দেশ্যে কৃত্য আচার। পুর্ব পুরুষের প্রতীক হিসেবে বাড়ির একপাশে খি.ম্মা গেড়ে রাখার রীতি রয়েছে মান্দি সমাজে। আর প্রাচীন কাল থেকেই মান্দিরা এই খি.ম্মা তৈরীর উপকরন হিসেবে বেছে নিয়েছিল বলশাল ফাং (শালগাছ) এর ডাল। মান্দিদের মধ্যে কেউ মারা গেলে তার পরদিনই মৃত ব্যক্তির স্মৃতি ধরে রাখার জন্য খি.ম্মা গাড়তে হয়। যে বাড়িতে যত জন মারা যাবে তাদের প্রত্যেকের জন্যই আলাদা আলাদা খি.ম্মা গাড়তে হয়। বলশাল ফাং এর ডাল থেকে বাকল ছাড়িয়ে নিয়ে তাতে খোদাই করে কারুকার্যময় খি.ম্মা তৈরী করেন মান্দিরা। খোদাই করা কারুকার্য দেখেই বোঝা যাবে যার উদ্দেশ্যে খি.ম্মা গাড়া হয়েছে সে পুরুষ না মহিলা বা সে কত বছর বয়সে মারা গেছেন ইত্যাদি।
সাঁওতাল গ্রামে কোন অঘটন ঘটলে তার ন্যায় বিচারের ব্যবস্থা করেন পাহান। নির্দিষ্ট দিনে গ্রামের সবাইকে সালিশের জন্য আহবান করা হয়। সালিশের দিনে পাহানসহ সবাই এসে জড়ো হন জাহের থানে বা শালগাছের তলাতে। কেননা পূর্বপুরুষদের আত্মা জাহের থানে বা শালগাছের তলাতে অবস্থান করেন; আর পূর্ব পুরুষদের আত্মার উপস্থিতিতে ন্যায় বিচারের কখনো লংগিত হবেনা এমনটই বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে সাঁওতাল সমাজে।
বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে একেক জাতির ভিতর একেক ধরনের নিজস্ব নিয়ম বা প্রথা রয়েছে। সিং জাতির মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের পরিমান খুব কম। তবে উপযুক্ত কারন থাকা সাপেক্ষে পাহান বিচ্ছেদ কার্য সম্পাদনে সম্মতি দেন। সালিশের দিন গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সামনে স্ত্রীর হাতের নোয়া নিজ হাতে খুলে নেন। এরপর একটি শাল পাতায় পানি ছিটিয়ে স্বামী সেই পাতাটি ছিঁড়ে ফেলে। আর এভাবে শাল পাতা ছিঁেড় ফেলার সাথে সাথেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্ক ছিন্ন হলো বলে ধরে নেয়া হয়।
৩.
শুধুমাত্র আপন বিশ্বাস বা আপন আপন সংস্কারেই নয় শালগাছ বা শালবন কখনো কখনো বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মাঝে দেখা দেয় লড়াই-সংগ্রামের এক ঐতিহাসিক উপাদান হয়ে। আপন অধিকার আদায়ের সংগ্রামে শালগাছের ডাল একসময় হয়ে উঠেছিল সংগ্রামী আহবানের প্রতীক হিসাবে। ১৮৫৫ সাল । ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য আখ্যান রচিত হয়েছিল সিধুঁ, কানু, চাঁদ ও ভৈরব মাঝির নেতৃত্বে। ইংরেজ রাজের অবাধ শোষণ-উৎপীড়ন এবং জমিদার-মহাজনদের সীমাহীন অত্যচারের বিরুদ্ধে সাঁওতাল হুলের ডাক দিয়েছিল সিধুঁ-কানু। এই সংগ্রামে সমস্ত সাঁওতালদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য সিধুঁ- কানু ঠাকুরের নির্দেশ লাভের কথা প্রচার করেছিলেন। বিদ্রোহ শুরুর আগে ১৮৫৫ সালের ১৫ জুন সিধুঁ-কানু গ্রামে গ্রামে শালগাছের ডাল গিরা পাঠিয়েছিলেন। অরণ্যভূমির সমস্ত গ্রামে গ্রামে, বনে বনে, পাহাড়ে পাহাড়ে, মাঠে ঘাটে ছড়িয়ে পড়েছিল গিরার আহবান- দেলা দোমেল দোমেল, দেলা লগন লগন ।পবিত্র শাল ডালের গিরার আহবানে মাত্র ১৫ দিনের মাথায় ৩০ জুন সংগ্রামী চেতনায় টগবগে প্রায় দশ হাজার সাঁওতাল নারী-পুরুষ তীর-ধনুক, টাঙ্গি-কুড়াল,ধামসা, মাদল, বাঁশী সহকারে জমায়েত হন ঐতিহাসিক ভগনাডিহি গ্রামে। উল্লেখ যে, শাল গিরার সাথে সাথে সিদুঁ-কানু প্রেরিত আতপ চাল, তেল, সিন্দুর শালপাতার তৈরী বাটিতে করে গ্রামের পর গ্রাম ঘুরতে থাকে এবং প্রচার করা হতে থাকে যে, দেবতারা লড়াইয়ে সাঁওতালদের শক্তি বৃদ্ধি করবেন। সেদিন ভগনাডিহি গ্রামে সিধুঁ-কানুর কন্ঠে মুক্তির ডাক শুনে হাজার হাজার অরণ্য সন্তানের কন্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে “দেলায়া বিরিদ্ পে, দেলায়া তিঙ্গুন পে” (জাগো, ওঠো, সাঁওতালরাজ কায়েম করো)। হাজার হাজার সাঁওতাল শপথ নেয় ইংরেজরাজ,জমিদার-মহাজনদের দুঃশাসনের নিঙর ভাঙ্গার। এরপর ইতিহাস সৃষ্টির পালা; বাঙলা ও বিহারের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত জমিদার-মহাজন-ইংরেজ বিরোধী সংগ্রামের ধ্বনিতে কাঁপিয়ে দেবার, সিধুঁ-কানুর সাহসী নেতৃত্বে শাল গিরার আহবানে বুকের রক্ত ঢেলে দেবার। হাজার হাজার সাঁওতাল নারী-পুরুষ নিজেদের তাঁজা রক্তে রচনা করেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মত্যাগের মহান ঐতিহ্যগাঁথা ।
শালকেন্দ্রিক লড়াই-সংগ্রামের জীবন্ত দৃষ্টান্ত রয়েছে মধুপুর গড়ের মান্দি,কোচ,বর্মণ প্রভৃতি জাতিসত্ত্বা সমূহের মধ্যেও। মান্দি জাতি শালবনকে কেন্দ্র লড়াই সংগ্রাম করে চলেছে যুগ যুগ ধরে। আগেই বলা হয়েছে শালবন হলো মধুপুর গড়ের মান্দিদের হা.বিমা (জননী ভূমি)। মধুপর গড়ে মান্দি ছাড়াও রয়েছে কোচ, বর্মণ জাতিসত্ত্বার বসবাস। নিজ হা.বিমাতে হাজার হাজার বছর ধরে বসবাসরত মান্দিদের জীবন-জীবিকা, ধর্ম-সংস্কৃতি সবকিছুর সাথেই বলশাল ব্রিং বা শালবন অঙ্গাঅঙ্গী ভাবে জড়িত। নিজ জননী ভূমিকে রক্ষার জন্য সেই ১৯৪৭ সালের পর থেকেই রচনা করে চলেছিল একের পর এক প্রতিরোধের। ১৯৫৬ সালের উচ্ছেদ নোটিশ, ১৯৬২সালের মধুপর বনে ৪০ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে ন্যাশনাল পার্ক প্রতিষ্ঠার প্রকাশ্য ঘোষণা, ১৯৬৮ সালে গভর্ণর ও বনমন্ত্রীর উচ্ছেদ নির্দেশ, ১৯৬৯ সালের উচ্ছেদ নোটিশ, ১৯৭৪ সালে বনকর্মকর্তা কর্তৃক লুটপাটের তান্ডব, ১৯৭৭ সালে বনবিভাগ কর্তৃক শালবনের ভিতর কৃত্রিম লেক তৈরীর নামে কোচ-মান্দিদের উচ্ছেদ প্রক্রিয়া, ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ন্যাশনাল পার্ক প্রকল্পের আওতাধীন এলাকার হাজার হাজার বছর ধরে বসবাসরত কোচ, মান্দি, বর্মণদের উচ্ছেদ নোটিশ জারি, ১৯৭৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কর্তৃক ভেড়া চড়ানোর নাম করে শালবন এলাকায় আদিবাসীদের ভূমি দখল, ১৯৭৯ সালে বনায়নের নামে মান্দিদের উপর নির্যাতন, ১৯৮১ সালে ময়মনসিংহ বিভাগীয় বনকর্মকর্তার বিট অফিস প্রতিষ্ঠা ও তুঁত গাছ রোপনের নামে মান্দিদের বৈধ ভোগ দখলকৃত শালবনের ১০৮ একর জমি দখল, ১৯৮৪ সালে টেলকীপাড়া ও নয়াপাড়া গ্রামে শালবন কে ধ্বংস করে মান্দিদের নিজ জমিতে বিমান বাহিনীর জন্য ফায়ারিং রেঞ্জ প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে। আর এই প্রতিরোধ-সংগ্রামের ধারাবাহিকতাতেই ২০০৪ সালের ৩ জানুয়ারি মান্দি-কোচ-বর্মণেরা মধুপুরের শালবনে জড়ো হয়েছিল রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য ইকোপার্কের নামে হা.বিমাকে দেয়াল দিয়ে ঘেরার প্রতিবাদ জানাতে, হা.বিমার জীববৈচিত্র্য ও নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে। খা সাংমা খা মারাক ধ্বণিতে হাজার হাজার বনবাসীদের দৃপ্ত শ্লোগানে যখন মুখরিত হচ্ছিল পুরো শালবন এলাকা তখনই নেমে আসে রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠীর ভয়াবহ নিপীড়ন। বনবাসিন্দাদের সেই মিছিলের উপর বনবিভাগের বনরক্ষী ও পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন জয়নাগাছা গ্রামের বীর যুবক পীরেন স্নাল; আহত হন উৎপল নকরেক, এপিল সিমসাং, শ্যামল চিরান ও রীতা নকরেক সহ আরো অনেকেই। শালবন তথা হা.বিমাকে রক্ষার জন্য সেদিন বনবাসীদের যে তেজদীপ্ত প্রতিরোধ-সংগ্রামের নতুন অধ্যায় রচিত হয়েছিল পীরেন স্নালের রক্তে, সেই সংগ্রামী চেতনাকে আজও অক্ষুন্ন রেখেছে হা.বিমার সন্তানেরা। তারা নিরন্তর লড়াই করে চলেছেন তাদের পবিত্র হা.বিমাকে রক্ষার জন্য, নিজেদের জীবন-সংস্কৃতি ও অস্তিত্ত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য।
৪.
শালবন বা তার আশপাশে বসবাসরত বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার যে নানান লোকাচার-বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে তার অনেকটাই শালবনের উপর যে কতটা নির্ভরশীল তা সহজেই অনুমেয়। এই শালবন একদিকে যেমন তাদের বিশ্বাসে, কৃত্য আচারাদির সাথে ঘনিষ্ঠ, তেমনি একইভাবে ঘনিষ্ট তাদের অস্তিত্ত্বের সাথেও। শালগাছ বা শালবনকে কোনভাবেই বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার চলমান জীবন-সংস্কৃতি থেকে পৃথক করে দেখবার উপায় নেই। শালগাছ বা শালবন হয়ে উঠেছে বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার বর্ণাঢ্য জীবন-সংস্কৃতির বা তাদের অস্তিত্ব নির্ণয়ের এক মূর্ত প্রতীক হিসেবে। এই যখন সাঁওতাল, ওরাওঁ, মাহাতো, সিং, বসাক, কোচ, বর্মণ, মান্দি, হদি, ডালুদের সাথে শালবৃক্ষের সম্পর্কের ধরন-ধারন তখন এর বিপরীতেই আমরা দেখতে পাই স্বয়ং রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক এই নিবিড় সম্পর্কের ভিত্তিমূলে আঘাত হানার নানান ধরনের ধারাবাহিক সব আয়োজনের। বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের পরও যেখানে ঢাকা, রংপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, দিনাজপুর, এবং রাজশাহী জেলার মোট ১,২০,০০০ হেক্টর ভূমিতে শালবন ছিল বর্তমানে সেখানে তার ( ১,২০,০০০ হেক্টরের) ১০% এলাকায় শালবনের অস্তিত্ব রয়েছে। শুধুমাত্র টাঙ্গাইল জেলাতেই ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৯০ সাল এই বিশ বছরে শালবনের আয়তন কমেছে ২০,০০০ হেক্টর থেকে ১,০০০ হেক্টরে। আর এই সংকোচনের মাত্রা দিনে দিনে আরো অধিক থেকে অধিকতর হচ্ছে। এই যে শালবন এলাকার দ্রুত সংকুচিত হয়ে যাওয়া এর জন্য অনেক কারনই দায়ী। তবে শালবনের এই দ্রুত সংকোচনের পেছনে বনবিভাগ বা রাষ্ট্র কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে গৃহীত নানান অবৈজ্ঞানিক প্রকল্পসমূহ অনেকাংশেই দায়ী। রাষ্ট্রের গৃহীত ন্যাশনাল পার্ক উন্ন্য়ন প্রকল্প, রাবার বাগান উন্নয়ন প্রকল্প, উডলট প্রকল্প, ইকোপার্ক প্রকল্প, সোস্যাল ফরেষ্ট্রি ইত্যাদির সব গুলোই ছিল শালবন কে ধ্বংস করে দেয়ার বাহারি সব আয়োজন। যেখানে প্রাকৃতিক শালবনকে বনবিভাগ সিলভিকালচারের মাধ্যমে সহজেই টিকিয়ে রাখতে পারতো সেখানে সিলভিকালচার না করে উডলট, রাবার বাগান বা ইকোপার্কের মতন প্রাকৃতিক বন বিধ্বংসী সব আয়োজনের সার্থক বাস্তবায়নে ব্যস্ত; বনকর্তারা ব্যস্ত কালোবাজারে শালবনের সম্পদ পাচারে। এই যে শালবনকে ধ্বংস করে দেওয়ার নানান আয়োজন তা তো শুধুমাত্র শালবনকেই ধ্বংস করছে না; তা আসলে প্রত্যক্ষ ভাবেই শালবনের সাথে যাদের রয়েছে অকৃত্রিম যোগসূত্র সেই সমসত কোচ, মান্দি, হদি, বর্মণ, সাঁওতাল, ওরাওঁ, সিং, মাহাতো, বসাক, মুন্ডা জাতিসত্ত্বাসমূহের বর্ণাঢ্য জীবন-সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দিচেছ- বিপন্ন করে দিচ্ছে তাদের অস্তিত্বকে। আর রাষ্ট্রের এইসব বাহারি আয়োজন দেখে মনে হয়-
এই রাষ্ট্র চায় না সোহরাই, দেনমারাং.আ, বাহা, সারহুল, আসংদেনা, ওয়ান্না, গালমাকদু.আ, হাবা আমুয়া, ফাগুয়া, বড়াপাহাড় পূজা, ইঁদপরবের উৎসব মুখর কোন পবিত্রতা।
এই রাষ্ট্র চায় না আ.দুরি, দামা, রাং, ধামসা, সানাই, বাঁশি, মাদলের কোন সুর।
এই রাষ্ট্র চায় না হাস্তর, ঝুমুর, দিগ্গ্যিবান্দি, শেরেনজিং, রেরে, আজিয়ার কোন গীতি-কথা, পালা।
এই রাষ্ট্র চায় না দুখ্রো সুয়া, নুমিল মিসায়া কিংবা ঝুমুরের কোন ছন্দ-হিল্লোল।
এই রাষ্ট্র চায় না ধুমকুড়িয়া, নকমান্দি, আখড়া, নকপান্থে, দেল্লাং থে.ক্কা,মিজামের মতন কোন কাঠামো।
এই রাষ্ট্র চায় না দকমান্দা,দকশাড়ির নিপুন কারুকাজ।
এই রাষ্ট্র চায় না দিখ্যা, দিকথম, খ্যাংগ্রেং, রাও, ফং।
কিন্তু এই রাষ্ট্র চাক বা না চাক এই রাষ্ট্রের আদিবাসীরা , যাদের জীবন-সংস্কৃতি শালবন বা শালগাছের নিবিড় আলিঙ্গনে বেড়ে উঠেছে তারা তাকে ধ্বংস হতে দিতে পারে না। তারা তাদের সোহরাই, ফাগুয়া, বাহা, সারহুল, ওয়ান্না, গালমাকদু.আ, আসংদেনা, ইঁদপরব কোন কিছুকেই হারাতে দিতে চান না। নিজেদের হাবা, বসত, ক্ষেত, জমিন কোন কিছুই হাতছাড়া করতে চান না। এজন্য তারা যুগে যুগে লড়াই করেছেন, করছেন এবং করে চলবেন আজীবন নিজেদের অস্তিত্ত্ব রক্ষার জন্য, শালবনের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য, শালকেন্দ্রিক জীবন-সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য।
সূত্রঃ
সাক্ষাতকারঃ
১.জনিক নকরেক(৯৪)-গ্রাম-চুনিয়া, ডাক-পীরগাছা,থানা-মধুপুর,জেলা-টাঙ্গাইল।
২.জগদীশ চন্দ্র সিং (৬০)-গ্রাম-সরাবপুর,ডাক-আমশড়া,থানা-তাড়াশ,জেলা-সিরাজগঞ্জ।
৩. মানিক চন্দ্র সিং(৯৫)-গ্রাম-সাহাপাড়া,ডাক-আমশড়া, থানা-তাড়াশ,জেলা-সিরাজগঞ্জ।
৪.সমের চন্দ্র মাহাতো(৫০)-গ্রাম-শ্যামেরঘন, ডাক-আমশড়া, থানা-রায়গঞ্জ, জেলা-সিরাজগঞ্জ।
৫.স্বপন কুমার ওরাওঁ(২৮)-গ্রাম-খোদমাধাইনগর, ডাক-আমশড়া,থান-তাড়াশ, জেলা-সিরাজগঞ্জ।
বইপত্রঃ
৬.সাঁওতাল গণসংগ্রামের ইতিহাস-ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে।। পার্ল পাবলিশার্স; ২০৬,বিধান সরনী, কলিকাতা।। ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬।
৭.উত্তরবঙ্গের আদিবাসী লোকজীবন ও লোকসাহিত্যঃ ওরাওঁ- ডঃ মুহম্মদ আবদুল জলিল।। বিশ্বসাহিত্য ভবন; বাংলাবাজার, ঢাকা।। wW‡m¤^i ১৯৯৯।
৮. বাংলার ব্রতপার্বণ-ডঃ শীলা বসাক।। পুস্তক বিপনি; কলিকাতা।। মে ১৯৯৮।
৯.আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতিঃ প্রসঙ্গ নদীয়া জেলা-ডঃ শিবানী রায় (মন্ডল)।। পুস্তক বিপনি; কলিকাতা।। অক্টোবর ২০০২।
১০.বিপন্ন ভূমিজঃ অস্তিত্বের সংকটে আদিবাসী সমাজ-বাংলাদেশ ও পূর্বভারতের প্রতিচিত্র-সম্পাদনা-মেসবাহ কামাল, আরিফাতুল কিবরিয়া।। গবেষণা ওনন্নয়ন কালেকটিভ; এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।। এপ্রিল ২০০৩
১.
শাল একটি বহুবর্ষজীবি বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ। Dipterocarpaceae পরিবার ভূক্ত শালগাছের বৈজ্ঞানিক নাম Shorea robusta । এক সময় বাংলাদেশ সহ অবিভক্ত ভারতবর্ষের মোট বনভূমির এক বিশাল অংশ জুড়ে ছিল শালবনে আচ্ছাদিত। বাংলাদেশের মধুপুর গড়, রাজশাহী, দিনাজপুর, গাজীপুর অঞ্চলে ছিল শালবনের বিস্তৃতি। আর সুদূর অতীতকাল থেকেই এই শালবন বা তার আশেপাশে বসবাসকারী মান্দি, কোচ, বর্মণ, ডালু, হদি, সাঁওতাল, ওরাওঁ, মাহাতো, সিং প্রভৃতি বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার বর্ণাঢ্য জীবন-সংস্কৃতিতে শাল কেন্দ্রিক আপন আচার, আপন বিশ্বাস গড়ে উঠেছে। প্রাচীন কাল থেকেই প্রচলিত এই বিশ্বাস আর কৃত্য আচারাদির সাথে শালগাছ বা শালবনের নিবিড় যোগসূত্রতার দরুন বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর জীবন-সংস্কৃতিতে শালগাছ বা পুরো শালবন স্থান করে নিয়েছে পবিত্র উদ্ভিদ (Sacred Plant) বা পবিত্র স্থানের (Sacred Place) মর্যাদা। শুধুমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাস বা আচারাদির মধ্যেই নয় কখনো কখনো এই শালগাছ বা শালবন হয়ে উঠেছে লড়াই-সংগ্রামের আহবান, ক্ষেত্র বা হাতিয়ার হিসেবে।
২.
বাংলাদেশে তথা পৃথিবীতে বসবাসরত বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মধ্যে অধিকাংশের ধর্মই কোনো পুঁথিভিত্তিক ধর্ম নয়। এদের যুগলালিত আপন বিশ্বাসে, আপন আচারে জড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন দেব-দেবতার অস্তিত্ত্ব। প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে থাকবার দরুন জাতিসত্ত্বাসমূহের এই সব নানান দেব-দেবতারা স্বভাবতই প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান গাছ-পালা,পশু-পাখি ইত্যাদি নানান কিছুর মাধ্যমে মূর্ত হয়ে উঠেছে তাদের মানস চিন্তায়। যেমন সাঁওতাল এবং ওরাওঁদের প্রধান গৃহস্থ্য দেবতার নাম বোঙ্গা। সাঁওতাল, ওরাওঁরা যখন এই বোঙ্গার আরাধনা করে তখন বোঙ্গা দেবতার প্রতীক হিসেবে তারা ব্যবহার করেন শালগাছের ডাল। শুধুমাত্র দেবতার প্রতীক রূপেই নয়, ওরাওঁরা নিজেদের আদি ধর্মীয় বিশ্বাসকে পরিচয় দেয় শারণা বলে; আর কুরুখ ভাষায় এই শারণা মানে হলো শালগাছ। ওরাওঁরা শালগাছকে শারণা দেবী রূপেও পূজো করে থাকে। চৈত্র মাসের প্রতিপদ থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত যেকোন নির্দিষ্ট একটা দিনে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে এই শারণা পূজা।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মধ্যে নানান কামনা-বাসনাকে সামনে রেখে বিভিন্ন ধরনের ব্রতানুষ্ঠানের বেশ প্রচলন রয়েছে। আগেরকার গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজ ব্যবস্থার প্রাচীন যাদুবিশ্বাস ও ধ্যান-ধারনার বিভিন্ন উপাদান আজও পরিলক্ষিত হয় জাতিসত্ত্বা সমূহের নৃত্য-গীত সমৃদ্ধ এইসব বৈচিত্র্যময় ব্রতানুষ্ঠানে। এইসমস্ত ব্রতের বিভিন্ন উপকরনের মাঝে শালগাছ তার স্বাতন্ত্র্য উপস্থিতিকে বজায় রাখতে পেরেছে। ইঁদপরবের ব্রত নামে সাঁওতালরা ভাদ্র মাসের শুক্লাদ্বাদশী তিথিতে ঐশ্বর্য্যলাভ, শস্যবৃদ্ধি এবং সর্বকাজে সাফল্য লাভের উদ্দেশ্যে পালন করে থাকে। ব্রতের দিন গ্রামের মাঝখানে বিশ থেকে পঁচিশ হাত লম্বা শালগাছ পুঁতে তার উপরে লাল শালু কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। নানান উপাচার সহযোগে শালগাছকে পূজা আর মাদল, ধামাসা, বাঁশি বাজিয়ে নাচ-গানের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গতা পায় ইঁদপরব ব্রতের সামগ্রিক আয়োজন।
কার্তিক মাসে কালীপূজার ঠিক আগের দিন গৃহপালিত পশুর সুস্বাস্থ্য ও মঙ্গল কামনায় সিরাজগঞ্জ, বগুড়া অঞ্চলে বসবাসকারী সিং জাতিসত্ত্বার লোকজন গড়াই ঠাকুরের পূজা করেন। গো সম্পদ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে আয়োজিত এই পূজার নাম গোয়ালপূজা বা সোহরাই পূজা। সোহরাই পূজার প্রচলন অবশ্য সাঁওতাল, ওরাওঁ, মাহাতো, মুন্ডা প্রভৃতি জাতিসত্ত্বাসমূহের মধ্যেও বেশ প্রচলিত। সিং জাতিসত্ত্বার লোকজন গোয়াল পূজার সাতদিন আগে থেকেই গবাদি পশুর শিং-এ তেল মাখানো শুরু করেন। পূজার আগের দিন সন্ধ্যায় গ্রামের প্রতিটি গৃহস্তের গোয়ালঘরে জ্বালিয়ে রাখা হয় মাটির প্রদীপ। গোয়ালপূজার দিন গোয়াল ঘরের ভেতর গড়াই ঠাকুরের কাঠামো হিসেবে দেড় থেকে দুই ফুট লম্বা একটা শালগাছের খুঁটি গেঁড়ে নিয়ে তার সামনে সাজিয়ে রাখা হয় বিভিন্ন ভোগ সামগ্রী। এর আগে সকালবেলাতেই গোয়ালের সমস্ত ছাগল,মহিষ, গরুকে গোসল করিয়ে তাদের শিং এ তেল সিদুঁর মাখিয়ে দেন এবং গবাদি পশুকে খাওয়ানো হয় বিভিন্ন ধরনের পিঠা। লাঙ্গল, জোয়াল ও অন্যান্য কৃষি যন্ত্রপাতিতেও একই ভাবে তেল-সিদুঁর মাখানো হয়। মাটিতে চালের গুড়ির গোলায় আঁকা হয় নানান আলপনা। পূজার আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি সম্পন্ন শেষে গৃহকর্তা শালগাছের খুঁটি তথা গড়াই ঠাকুরের কাছে গৃহপালিত পশুর সুস্বাস্থ্য ও মঙ্গল কামনা করে থাকেন ব্রত কথার মাধ্যমে। এরপর চলে খাওয়া দাওয়া, পুরো সিং জাতি মেতে উঠে নাচ-গান আর আনন্দ-উৎসবে।
ফাল্গুন মাসে যখন শালগাছের নতুন ফুলের সুভাসে চারপাশ মগ্ন তখন সাঁওতাল, ওরাওঁরা পালন করে ঐতিহ্যবাহী বাহা পরব বা শারহূল পরব। পরবের দিন পাহান বা পুরোহিত পূজোর উদ্দেশ্যে ঘরের ভেতর প্রবেশ করে নির্দিষ্ট স্থানে বসেন। তাঁর পাশে সিঁদুর, ধূপ, আতপ চাল, ফুল সহ শালগাছের শাখা ভর্তি কুলো হাতে বসেন পাহান স্ত্রী বা গৃহকর্তী। বৃষ্টির কামনা, ফসলের উন্নতি এবং সমাজের মঙ্গল কামনা করে পাহান পূজো শেষ করে শাল গাছের ডাল থেকে একটা ফুল নিয়ে নিজ স্ত্রী বা গৃহকর্তীর খোপায় গুঁজে দেন। পূজোর আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে পাহান ঘর থেকে বের হন। বের হওয়ার সময় ঘরের সম্মুখস্থ চালে শাল ফুল বেধে দিয়ে উঠোনে চলে আসেন। এর পর পাহানের সাথে করে লোকজন পুস্পসমেত শাল গাছের ডাল নিয়ে গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরতে থাকেন। সাঁওতাল, ওরাওঁরা শারহূল ফাল্গুন মাসে পালন করলেও অসুর, সিং জাতির লোকজনেরা করে বৈশাখ মাসে। মালপাহাড়িয়ারাও দেবতাকে উদ্দেশ্য করে শাল ফুল নিবেদনের এই উৎসব ফাল্গুন মাসেই পালন করে তবে তা ভিন্ন নামে; মালপাহাড়িদের এই পরবের নাম ফাগুয়া। মাহালি, মুন্ডারাও এই শারহুল পরব বেশ জাঁকজমকের সাথে পালন করে থাকেন। এই শারহুল পরবেই মেয়েরা বছরের নতুন শাল ফুল মাথায় পড়ার অনুমতি লাভ করে। শারহুল বা বাহা হওয়ার আগ পর্যন্ত সাঁওতাল, ওরাওঁ, মুন্ডা, সিং, মাহালি, মালপাহাড়িয়া রমনীদের জন্য শালফুল মাথায় গুজে রাখা ধর্মীয় ভাবে নিষিদ্ধ।
মধুপুর গড় অঞ্চলে যুগ-যুগান্তর ধরে বসবাসরত কোচ, বর্মণ, মান্দিদের জীবন,ধর্মীয় রীতিনীতি,সংস্কারের সাথে বলশাল ব্রিং জড়িয়ে রয়েছে ওতপ্রোতভাবে। বলশাল ব্রিং বা শালবন মান্দি জাতির হা.বিমা (জননী ভূমি)। তাদের খাদ্যাভ্যাস, নৃত্য, গীত ,পালাসহ বিভিন্ন আমুয়াতে শাল গাছের ফুল-ফল, ডাল-পালার রয়েছে বর্ণাঢ্য ব্যবহার। মান্দি জাতির জীবন-জীবিকা, আচার, বিশ্বাস থেকে বলশাল ব্রিং কে পৃথক করে দেখবার জো নেই। সাংসারেক মান্দিরা সালজং, মিসি, সুসিমি, চুরাবুদি, গুয়েরা, রাক্কাশি সহ বিভিন্ন মিদ্দির (দেবতার) আমুয়া(পূজো) করে থাকেন। প্রতিটি আমুয়াই উদ্দেশ্য এবং কৃত্য নিয়ম-কানুনে স্বাতন্ত্র্য হলেও পূজোর প্রয়োজনীয় উপকরন হিসেবে সাসাৎ এর ব্যবহার লক্ষণীয়। আর এই সাসাৎ তৈরীতে তারা ব্যবহার করেন শালগাছের বাঁকল। সাসাৎসুয়া করলে দেবতারা সন্তুষ্ট হন বলে মান্দিরা তাদের প্রায় প্রত্যেক আমুয়াতেই সাসাৎ ব্যবহার করে থাকেন। কেননা সাংসারেক মান্দিরা বিশ্বাস করেন যে, একদা মান্দি মিদ্দি (দেবতা) মিসি আর সালজং দুই ভাই এই শালগাছের বাঁকল থেকে তৈরী সাসাৎ পোড়া ধোঁয়া পান করেই সন্তুষ্ট হয়েছিলেন রাংদি বিমা রাই মিচ্চিক নাম্নী এক বিধবা বৃদ্বার উপর। সন্তুষ্টির ফল স্বরূপ ঐ বৃদ্বার ঘরেই সর্বপ্রথম জন্ম দিয়ে গিয়েছিলেন মি.নিমা (ধানের মা) কে। সেই মি.নিমা থেকেই পরবর্তীতে জন্ম নেয় মি.মিদ্দিম, মি.সারাং, মি.খচ্চু, মি.মা, মি.নেংগেল, মি.মাথেক, মি.জেংগেম সহ হাজার হাজার প্রজাতির মি (ধান)।
হা.বিমা সাংসারেক মান্দিদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত, আর তাই হা.বিমার জীববৈচিত্র্য যাতে অক্ষুন্ন থাকে সেজন্য মান্দিরা আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে আয়োজন করেন আসংদেনা আমুয়ার। বর্ষাকালে বৃষ্টি স্নাত হা.বিমা তথা শালবনের নরম মাটি ভেদ করে গজিয়ে উঠে নানান প্রজাতির উদ্ভিদরাজি, তখন নিদ্দ্র্ষ্িট দিনে খামালের নেতৃত্বে নতুন গাছের চারা হাতে মান্দিরা সবাই প্রবেশ করেন বলশাল ব্রিং (শালবন) এর গহীনে। নির্ধারিত স্থানে খামাল কর্তৃক খ্রিতা (মন্ত্র) পাঠ ও অন্যান্য নিয়ম-কানুন পালন শেষে সেখানে সবাই নতুন গাছের চারা লাগিয়ে দেন। আর এভাবেই বছর বছর আসংদেনা সহ বিভন্ন আমুয়ার মাধ্যমে সাংসারেক মান্দিরা শালবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে চলেছেন প্রথাগত ভাবেই।
আদিবাসী জাতিসত্ত্বা সমূহের গোত্র প্রতীক বা টোটেম প্রথা আজও বর্তমান। একেকটি জাতি বেশ কয়েকটি গোত্রে বিভক্ত হলেও প্রতিটি গোত্রেরই রয়েছে আলাদা আলাদা টোটেম বা গোত্র প্রতীক। একেকটি গোত্রের টোটেম সেই গোত্রের পরিচয়কে সমষ্টিগতভাবে বহন করে। আর যে বস্তুগুলো টোটেম হিসেবে ব্যবহৃত হয় সেগুলো সাধারণত উদ্ভিদ বা প্রাণিজগতেরই কোন গণ বা প্রজাতি হয়ে থাকে। যে গোত্রের যে টোটেম তারা সেই টোটেম কে রক্ষা করে থাকেন পরম বিশ্বাসে। ভুমিজ সিং এবং খাড়িয়াদের গুলগু গোত্রের টোটেম হলো শালগাছ। গুলগু গোত্রের লোকদের জন্য শালগাছের কোনরূপ ক্ষতিসাধন তাই ধর্মীয় ভাবেই নিষিদ্ধ।
পূর্ব পুরুষদের পূজা, সম্মান করা বা স্মৃতি ধরে রাখার রীতি পৃথিবীর প্রায় সব জাতিরসত্ত্বার মধ্যেই প্রচলিত রয়েছে। পাত্রদের থিবাম, চাকমাদের ভাতদ্যা পূজা, সাঁওতালদের তেলনাহান, ওরাওঁদের পিতৃতর্পণ, খাসিয়দের ইয়াওহে, থাউলাং, উ সুইডানিয়া -দের উদ্দেশ্যে কৃত্য প্রস্তর পূজা কিংবা বাঙালি মুসলমানদের কুলখানি ইত্যাদি সবগুলোই পূর্ব পুরুষদের আত্মার উদ্দেশ্যে কৃত্য আচার। পুর্ব পুরুষের প্রতীক হিসেবে বাড়ির একপাশে খি.ম্মা গেড়ে রাখার রীতি রয়েছে মান্দি সমাজে। আর প্রাচীন কাল থেকেই মান্দিরা এই খি.ম্মা তৈরীর উপকরন হিসেবে বেছে নিয়েছিল বলশাল ফাং (শালগাছ) এর ডাল। মান্দিদের মধ্যে কেউ মারা গেলে তার পরদিনই মৃত ব্যক্তির স্মৃতি ধরে রাখার জন্য খি.ম্মা গাড়তে হয়। যে বাড়িতে যত জন মারা যাবে তাদের প্রত্যেকের জন্যই আলাদা আলাদা খি.ম্মা গাড়তে হয়। বলশাল ফাং এর ডাল থেকে বাকল ছাড়িয়ে নিয়ে তাতে খোদাই করে কারুকার্যময় খি.ম্মা তৈরী করেন মান্দিরা। খোদাই করা কারুকার্য দেখেই বোঝা যাবে যার উদ্দেশ্যে খি.ম্মা গাড়া হয়েছে সে পুরুষ না মহিলা বা সে কত বছর বয়সে মারা গেছেন ইত্যাদি।
সাঁওতাল গ্রামে কোন অঘটন ঘটলে তার ন্যায় বিচারের ব্যবস্থা করেন পাহান। নির্দিষ্ট দিনে গ্রামের সবাইকে সালিশের জন্য আহবান করা হয়। সালিশের দিনে পাহানসহ সবাই এসে জড়ো হন জাহের থানে বা শালগাছের তলাতে। কেননা পূর্বপুরুষদের আত্মা জাহের থানে বা শালগাছের তলাতে অবস্থান করেন; আর পূর্ব পুরুষদের আত্মার উপস্থিতিতে ন্যায় বিচারের কখনো লংগিত হবেনা এমনটই বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে সাঁওতাল সমাজে।
বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে একেক জাতির ভিতর একেক ধরনের নিজস্ব নিয়ম বা প্রথা রয়েছে। সিং জাতির মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের পরিমান খুব কম। তবে উপযুক্ত কারন থাকা সাপেক্ষে পাহান বিচ্ছেদ কার্য সম্পাদনে সম্মতি দেন। সালিশের দিন গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সামনে স্ত্রীর হাতের নোয়া নিজ হাতে খুলে নেন। এরপর একটি শাল পাতায় পানি ছিটিয়ে স্বামী সেই পাতাটি ছিঁড়ে ফেলে। আর এভাবে শাল পাতা ছিঁেড় ফেলার সাথে সাথেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্ক ছিন্ন হলো বলে ধরে নেয়া হয়।
৩.
শুধুমাত্র আপন বিশ্বাস বা আপন আপন সংস্কারেই নয় শালগাছ বা শালবন কখনো কখনো বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মাঝে দেখা দেয় লড়াই-সংগ্রামের এক ঐতিহাসিক উপাদান হয়ে। আপন অধিকার আদায়ের সংগ্রামে শালগাছের ডাল একসময় হয়ে উঠেছিল সংগ্রামী আহবানের প্রতীক হিসাবে। ১৮৫৫ সাল । ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য আখ্যান রচিত হয়েছিল সিধুঁ, কানু, চাঁদ ও ভৈরব মাঝির নেতৃত্বে। ইংরেজ রাজের অবাধ শোষণ-উৎপীড়ন এবং জমিদার-মহাজনদের সীমাহীন অত্যচারের বিরুদ্ধে সাঁওতাল হুলের ডাক দিয়েছিল সিধুঁ-কানু। এই সংগ্রামে সমস্ত সাঁওতালদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য সিধুঁ- কানু ঠাকুরের নির্দেশ লাভের কথা প্রচার করেছিলেন। বিদ্রোহ শুরুর আগে ১৮৫৫ সালের ১৫ জুন সিধুঁ-কানু গ্রামে গ্রামে শালগাছের ডাল গিরা পাঠিয়েছিলেন। অরণ্যভূমির সমস্ত গ্রামে গ্রামে, বনে বনে, পাহাড়ে পাহাড়ে, মাঠে ঘাটে ছড়িয়ে পড়েছিল গিরার আহবান- দেলা দোমেল দোমেল, দেলা লগন লগন ।পবিত্র শাল ডালের গিরার আহবানে মাত্র ১৫ দিনের মাথায় ৩০ জুন সংগ্রামী চেতনায় টগবগে প্রায় দশ হাজার সাঁওতাল নারী-পুরুষ তীর-ধনুক, টাঙ্গি-কুড়াল,ধামসা, মাদল, বাঁশী সহকারে জমায়েত হন ঐতিহাসিক ভগনাডিহি গ্রামে। উল্লেখ যে, শাল গিরার সাথে সাথে সিদুঁ-কানু প্রেরিত আতপ চাল, তেল, সিন্দুর শালপাতার তৈরী বাটিতে করে গ্রামের পর গ্রাম ঘুরতে থাকে এবং প্রচার করা হতে থাকে যে, দেবতারা লড়াইয়ে সাঁওতালদের শক্তি বৃদ্ধি করবেন। সেদিন ভগনাডিহি গ্রামে সিধুঁ-কানুর কন্ঠে মুক্তির ডাক শুনে হাজার হাজার অরণ্য সন্তানের কন্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে “দেলায়া বিরিদ্ পে, দেলায়া তিঙ্গুন পে” (জাগো, ওঠো, সাঁওতালরাজ কায়েম করো)। হাজার হাজার সাঁওতাল শপথ নেয় ইংরেজরাজ,জমিদার-মহাজনদের দুঃশাসনের নিঙর ভাঙ্গার। এরপর ইতিহাস সৃষ্টির পালা; বাঙলা ও বিহারের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত জমিদার-মহাজন-ইংরেজ বিরোধী সংগ্রামের ধ্বনিতে কাঁপিয়ে দেবার, সিধুঁ-কানুর সাহসী নেতৃত্বে শাল গিরার আহবানে বুকের রক্ত ঢেলে দেবার। হাজার হাজার সাঁওতাল নারী-পুরুষ নিজেদের তাঁজা রক্তে রচনা করেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মত্যাগের মহান ঐতিহ্যগাঁথা ।
শালকেন্দ্রিক লড়াই-সংগ্রামের জীবন্ত দৃষ্টান্ত রয়েছে মধুপুর গড়ের মান্দি,কোচ,বর্মণ প্রভৃতি জাতিসত্ত্বা সমূহের মধ্যেও। মান্দি জাতি শালবনকে কেন্দ্র লড়াই সংগ্রাম করে চলেছে যুগ যুগ ধরে। আগেই বলা হয়েছে শালবন হলো মধুপুর গড়ের মান্দিদের হা.বিমা (জননী ভূমি)। মধুপর গড়ে মান্দি ছাড়াও রয়েছে কোচ, বর্মণ জাতিসত্ত্বার বসবাস। নিজ হা.বিমাতে হাজার হাজার বছর ধরে বসবাসরত মান্দিদের জীবন-জীবিকা, ধর্ম-সংস্কৃতি সবকিছুর সাথেই বলশাল ব্রিং বা শালবন অঙ্গাঅঙ্গী ভাবে জড়িত। নিজ জননী ভূমিকে রক্ষার জন্য সেই ১৯৪৭ সালের পর থেকেই রচনা করে চলেছিল একের পর এক প্রতিরোধের। ১৯৫৬ সালের উচ্ছেদ নোটিশ, ১৯৬২সালের মধুপর বনে ৪০ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে ন্যাশনাল পার্ক প্রতিষ্ঠার প্রকাশ্য ঘোষণা, ১৯৬৮ সালে গভর্ণর ও বনমন্ত্রীর উচ্ছেদ নির্দেশ, ১৯৬৯ সালের উচ্ছেদ নোটিশ, ১৯৭৪ সালে বনকর্মকর্তা কর্তৃক লুটপাটের তান্ডব, ১৯৭৭ সালে বনবিভাগ কর্তৃক শালবনের ভিতর কৃত্রিম লেক তৈরীর নামে কোচ-মান্দিদের উচ্ছেদ প্রক্রিয়া, ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ন্যাশনাল পার্ক প্রকল্পের আওতাধীন এলাকার হাজার হাজার বছর ধরে বসবাসরত কোচ, মান্দি, বর্মণদের উচ্ছেদ নোটিশ জারি, ১৯৭৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কর্তৃক ভেড়া চড়ানোর নাম করে শালবন এলাকায় আদিবাসীদের ভূমি দখল, ১৯৭৯ সালে বনায়নের নামে মান্দিদের উপর নির্যাতন, ১৯৮১ সালে ময়মনসিংহ বিভাগীয় বনকর্মকর্তার বিট অফিস প্রতিষ্ঠা ও তুঁত গাছ রোপনের নামে মান্দিদের বৈধ ভোগ দখলকৃত শালবনের ১০৮ একর জমি দখল, ১৯৮৪ সালে টেলকীপাড়া ও নয়াপাড়া গ্রামে শালবন কে ধ্বংস করে মান্দিদের নিজ জমিতে বিমান বাহিনীর জন্য ফায়ারিং রেঞ্জ প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে। আর এই প্রতিরোধ-সংগ্রামের ধারাবাহিকতাতেই ২০০৪ সালের ৩ জানুয়ারি মান্দি-কোচ-বর্মণেরা মধুপুরের শালবনে জড়ো হয়েছিল রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য ইকোপার্কের নামে হা.বিমাকে দেয়াল দিয়ে ঘেরার প্রতিবাদ জানাতে, হা.বিমার জীববৈচিত্র্য ও নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে। খা সাংমা খা মারাক ধ্বণিতে হাজার হাজার বনবাসীদের দৃপ্ত শ্লোগানে যখন মুখরিত হচ্ছিল পুরো শালবন এলাকা তখনই নেমে আসে রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠীর ভয়াবহ নিপীড়ন। বনবাসিন্দাদের সেই মিছিলের উপর বনবিভাগের বনরক্ষী ও পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন জয়নাগাছা গ্রামের বীর যুবক পীরেন স্নাল; আহত হন উৎপল নকরেক, এপিল সিমসাং, শ্যামল চিরান ও রীতা নকরেক সহ আরো অনেকেই। শালবন তথা হা.বিমাকে রক্ষার জন্য সেদিন বনবাসীদের যে তেজদীপ্ত প্রতিরোধ-সংগ্রামের নতুন অধ্যায় রচিত হয়েছিল পীরেন স্নালের রক্তে, সেই সংগ্রামী চেতনাকে আজও অক্ষুন্ন রেখেছে হা.বিমার সন্তানেরা। তারা নিরন্তর লড়াই করে চলেছেন তাদের পবিত্র হা.বিমাকে রক্ষার জন্য, নিজেদের জীবন-সংস্কৃতি ও অস্তিত্ত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য।
৪.
শালবন বা তার আশপাশে বসবাসরত বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার যে নানান লোকাচার-বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে তার অনেকটাই শালবনের উপর যে কতটা নির্ভরশীল তা সহজেই অনুমেয়। এই শালবন একদিকে যেমন তাদের বিশ্বাসে, কৃত্য আচারাদির সাথে ঘনিষ্ঠ, তেমনি একইভাবে ঘনিষ্ট তাদের অস্তিত্ত্বের সাথেও। শালগাছ বা শালবনকে কোনভাবেই বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার চলমান জীবন-সংস্কৃতি থেকে পৃথক করে দেখবার উপায় নেই। শালগাছ বা শালবন হয়ে উঠেছে বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার বর্ণাঢ্য জীবন-সংস্কৃতির বা তাদের অস্তিত্ব নির্ণয়ের এক মূর্ত প্রতীক হিসেবে। এই যখন সাঁওতাল, ওরাওঁ, মাহাতো, সিং, বসাক, কোচ, বর্মণ, মান্দি, হদি, ডালুদের সাথে শালবৃক্ষের সম্পর্কের ধরন-ধারন তখন এর বিপরীতেই আমরা দেখতে পাই স্বয়ং রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক এই নিবিড় সম্পর্কের ভিত্তিমূলে আঘাত হানার নানান ধরনের ধারাবাহিক সব আয়োজনের। বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের পরও যেখানে ঢাকা, রংপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, দিনাজপুর, এবং রাজশাহী জেলার মোট ১,২০,০০০ হেক্টর ভূমিতে শালবন ছিল বর্তমানে সেখানে তার ( ১,২০,০০০ হেক্টরের) ১০% এলাকায় শালবনের অস্তিত্ব রয়েছে। শুধুমাত্র টাঙ্গাইল জেলাতেই ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৯০ সাল এই বিশ বছরে শালবনের আয়তন কমেছে ২০,০০০ হেক্টর থেকে ১,০০০ হেক্টরে। আর এই সংকোচনের মাত্রা দিনে দিনে আরো অধিক থেকে অধিকতর হচ্ছে। এই যে শালবন এলাকার দ্রুত সংকুচিত হয়ে যাওয়া এর জন্য অনেক কারনই দায়ী। তবে শালবনের এই দ্রুত সংকোচনের পেছনে বনবিভাগ বা রাষ্ট্র কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে গৃহীত নানান অবৈজ্ঞানিক প্রকল্পসমূহ অনেকাংশেই দায়ী। রাষ্ট্রের গৃহীত ন্যাশনাল পার্ক উন্ন্য়ন প্রকল্প, রাবার বাগান উন্নয়ন প্রকল্প, উডলট প্রকল্প, ইকোপার্ক প্রকল্প, সোস্যাল ফরেষ্ট্রি ইত্যাদির সব গুলোই ছিল শালবন কে ধ্বংস করে দেয়ার বাহারি সব আয়োজন। যেখানে প্রাকৃতিক শালবনকে বনবিভাগ সিলভিকালচারের মাধ্যমে সহজেই টিকিয়ে রাখতে পারতো সেখানে সিলভিকালচার না করে উডলট, রাবার বাগান বা ইকোপার্কের মতন প্রাকৃতিক বন বিধ্বংসী সব আয়োজনের সার্থক বাস্তবায়নে ব্যস্ত; বনকর্তারা ব্যস্ত কালোবাজারে শালবনের সম্পদ পাচারে। এই যে শালবনকে ধ্বংস করে দেওয়ার নানান আয়োজন তা তো শুধুমাত্র শালবনকেই ধ্বংস করছে না; তা আসলে প্রত্যক্ষ ভাবেই শালবনের সাথে যাদের রয়েছে অকৃত্রিম যোগসূত্র সেই সমসত কোচ, মান্দি, হদি, বর্মণ, সাঁওতাল, ওরাওঁ, সিং, মাহাতো, বসাক, মুন্ডা জাতিসত্ত্বাসমূহের বর্ণাঢ্য জীবন-সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দিচেছ- বিপন্ন করে দিচ্ছে তাদের অস্তিত্বকে। আর রাষ্ট্রের এইসব বাহারি আয়োজন দেখে মনে হয়-
এই রাষ্ট্র চায় না সোহরাই, দেনমারাং.আ, বাহা, সারহুল, আসংদেনা, ওয়ান্না, গালমাকদু.আ, হাবা আমুয়া, ফাগুয়া, বড়াপাহাড় পূজা, ইঁদপরবের উৎসব মুখর কোন পবিত্রতা।
এই রাষ্ট্র চায় না আ.দুরি, দামা, রাং, ধামসা, সানাই, বাঁশি, মাদলের কোন সুর।
এই রাষ্ট্র চায় না হাস্তর, ঝুমুর, দিগ্গ্যিবান্দি, শেরেনজিং, রেরে, আজিয়ার কোন গীতি-কথা, পালা।
এই রাষ্ট্র চায় না দুখ্রো সুয়া, নুমিল মিসায়া কিংবা ঝুমুরের কোন ছন্দ-হিল্লোল।
এই রাষ্ট্র চায় না ধুমকুড়িয়া, নকমান্দি, আখড়া, নকপান্থে, দেল্লাং থে.ক্কা,মিজামের মতন কোন কাঠামো।
এই রাষ্ট্র চায় না দকমান্দা,দকশাড়ির নিপুন কারুকাজ।
এই রাষ্ট্র চায় না দিখ্যা, দিকথম, খ্যাংগ্রেং, রাও, ফং।
কিন্তু এই রাষ্ট্র চাক বা না চাক এই রাষ্ট্রের আদিবাসীরা , যাদের জীবন-সংস্কৃতি শালবন বা শালগাছের নিবিড় আলিঙ্গনে বেড়ে উঠেছে তারা তাকে ধ্বংস হতে দিতে পারে না। তারা তাদের সোহরাই, ফাগুয়া, বাহা, সারহুল, ওয়ান্না, গালমাকদু.আ, আসংদেনা, ইঁদপরব কোন কিছুকেই হারাতে দিতে চান না। নিজেদের হাবা, বসত, ক্ষেত, জমিন কোন কিছুই হাতছাড়া করতে চান না। এজন্য তারা যুগে যুগে লড়াই করেছেন, করছেন এবং করে চলবেন আজীবন নিজেদের অস্তিত্ত্ব রক্ষার জন্য, শালবনের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য, শালকেন্দ্রিক জীবন-সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য।
সূত্রঃ
সাক্ষাতকারঃ
১.জনিক নকরেক(৯৪)-গ্রাম-চুনিয়া, ডাক-পীরগাছা,থানা-মধুপুর,জেলা-টাঙ্গাইল।
২.জগদীশ চন্দ্র সিং (৬০)-গ্রাম-সরাবপুর,ডাক-আমশড়া,থানা-তাড়াশ,জেলা-সিরাজগঞ্জ।
৩. মানিক চন্দ্র সিং(৯৫)-গ্রাম-সাহাপাড়া,ডাক-আমশড়া, থানা-তাড়াশ,জেলা-সিরাজগঞ্জ।
৪.সমের চন্দ্র মাহাতো(৫০)-গ্রাম-শ্যামেরঘন, ডাক-আমশড়া, থানা-রায়গঞ্জ, জেলা-সিরাজগঞ্জ।
৫.স্বপন কুমার ওরাওঁ(২৮)-গ্রাম-খোদমাধাইনগর, ডাক-আমশড়া,থান-তাড়াশ, জেলা-সিরাজগঞ্জ।
বইপত্রঃ
৬.সাঁওতাল গণসংগ্রামের ইতিহাস-ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে।। পার্ল পাবলিশার্স; ২০৬,বিধান সরনী, কলিকাতা।। ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬।
৭.উত্তরবঙ্গের আদিবাসী লোকজীবন ও লোকসাহিত্যঃ ওরাওঁ- ডঃ মুহম্মদ আবদুল জলিল।। বিশ্বসাহিত্য ভবন; বাংলাবাজার, ঢাকা।। wW‡m¤^i ১৯৯৯।
৮. বাংলার ব্রতপার্বণ-ডঃ শীলা বসাক।। পুস্তক বিপনি; কলিকাতা।। মে ১৯৯৮।
৯.আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতিঃ প্রসঙ্গ নদীয়া জেলা-ডঃ শিবানী রায় (মন্ডল)।। পুস্তক বিপনি; কলিকাতা।। অক্টোবর ২০০২।
১০.বিপন্ন ভূমিজঃ অস্তিত্বের সংকটে আদিবাসী সমাজ-বাংলাদেশ ও পূর্বভারতের প্রতিচিত্র-সম্পাদনা-মেসবাহ কামাল, আরিফাতুল কিবরিয়া।। গবেষণা ওনন্নয়ন কালেকটিভ; এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫।। এপ্রিল ২০০৩
(This article was published on Special publication on 25 years completion of JAC-Jhum Aesthetics Council, editor-Sisir Chakma; published by- JAC-Jhum Aesthetics Council, Rangamati, February 2005)
বাংলাদেশের ভাষাঃ ‘বাংলা’ ভিন্ন অন্যান্য ভাষার কথা
জুয়েল বিন জহির
ভাষা মানব সভ্যতার বিবর্তনের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। মানুষের বাগযন্ত্র কর্তৃক উৎসারিত ধ্বণি অর্থময়তা লাভের মাধ্যমে সৃষ্টি করেছে ভাষার। ধ্বণির অর্থময়তা স্থান, কাল, জাতিভেদে বিভিন্ন হতে পারে। আর ধ্বণির এই বহুমাত্রিক অর্থময়তাই পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ভেতরে সৃষ্টি করেছে বিভিন্ন ভাষার। ভাষাভিত্তিক ঐক্যকে কাজে লাগিয়েই নিজস্ব যুগবাহিত সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, লোকায়ত জ্ঞানের আদান-প্রদানের মাধ্যমে কোন জনগোষ্ঠি গড়ে তোলে নিজস্ব স্বাজাত্যবোধ, স্বাতন্ত্র্যবোধের নিজ ভাষার মাধ্যমেই কোন জাতিসত্তার মধ্যকার সংস্কৃতিগত বিভিন্ন উপাদানগুলি তার আপন লয়ে প্রকাশিত, বিকশিত, ও সঞ্চালিত হয় যুগযুগান্ত ধরে নানান পরিবর্তন-পরিবর্ধন-পরিমার্জনের মধ্য দিয়ে। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের রাজনৈতিক সীমানার পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা। রক্তাক্ত সংগ্রামের পথ ধরে অর্জিত এই বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আজ বিশ্বব্যাপী। বাঙালি জাতির গৌরবের একুশে ফেব্রুয়ারি আজ পৃথিবীব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে মর্যাদা লাভ করেছে। বাংলাদেশের ১৪ কোটি মানুষের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মাতৃভাষা হল বাংলা; বাকি প্রায় ত্রিশ লক্ষ মানুষের মাতৃভাষায় রয়েছে ব্যাপক বৈচিত্র্যতা। এই ত্রিশ লক্ষ মানুষ প্রায় ৪৫টি পৃথক পৃথক জাতিসত্ত্বায় বিভক্ত। তাদের শারীরিক ও মানসিক গড়ন, সামাজিক, ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রতা বৃহত্তর বাঙালি জাতির জীবন-সংস্কৃতি থেকে সহজেই আলাদা করা যায়। এই ৪৫টি জাতিসত্ত্বাই আবার নিজেদের মধ্যে ভাষা, সমাজ-সংস্কৃতিতে একে অন্যের থেকে পৃথক এবং স্বাতন্ত্রতার অধিকারী। এই জাতিসত্তা গুলির নিজ নিজ ভাষা রয়েছে, রয়েছে তাদের বর্ণাঢ্য লোক সাহিত্য, লোক সংস্কৃতি; যা বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে করে তুলেছে অধিকতর সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়। ভাষার সংখ্যাগত দিক বিবেচনায় ক্ষুদ্রায়তনের এই বাংলাদেশ নামক ব-দ্বীপটিকে ভাষার জীবন্ত জাদুঘর বলা যেতে পারে। বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন জাতির ভাষা সমূহকে নিমো্নক্ত ভাবে শ্রেণীবদ্ধ করা যেতে পারে-
১. ভাষা পরিবার- অস্ট্রিক ভাষা সমূহ
১.১. মোন-খমের শাখা- খাসিয়া
১.২. মুন্ডারী শাখা- সাঁওতাল, মুন্ডা, সিং, বিন্ধ,হো ইত্যাদি।
২. ভাষা পরিবার- টিবেটো-চীন
২.১. বোডো শাখা- আচিক,ককবরক,হাজং,লালেং, পালিয়া ইত্যাদি।
২.২. কুকি-চীন শাখা- মৈতৈ মণিপুরী, খুমি, লাইমি, কুকি, ম্রো, পাংখো, ইত্যাদি।
২.৩. সাক্-লুই শাখা- চাক, থেক বা ঠেট বা থেক , লুসাই।
২.৪. বার্মীজ শাখা- রাখাইন বা ম্রাইনমা
৩. ভাষা পরিবার- দ্রাবিড় কুরুখ, পাহাড়িয়া, মাহালি ইত্যাদি।
৪. ভাষা পরিবার -ইন্দো-এরিয়ান বাংলা, চাকমা, তন্চংগা, রাজবংশী, কোচ, মাহাতো, বসাক,বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী,
বিহারী, ভূইমালি ইত্যাদি।
এবার বাংলাদেশে প্রচলিত বিভিন্ন ভাষা পরিবারের অন্তর্ভূক্ত কয়েকটি ভাষার সাধারণ পরিচয় তুলে ধরা যাক-
১. ভাষা পরিবার- অস্ট্রিকঃ ভাষা তাত্ত্বিকদের দীর্ঘপরিশ্রম লব্ধ গবেষণায় যতদুর জানা গেছে বাংলার সর্বপ্রাচীন ভাষা ছিল অস্ট্রিক ভাষা পরিবারের ভাষা। ভারতবর্ষে প্রচলিত এই ভাষা পরিবারের অন্তর্ভূক্ত ভাষা সমূহ অস্ট্রো-এশিয়াটিক শাখা--র ভাষা বলে পরিচিত। বাংলাদেশে প্রচলিত অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা সমূহ আবার দুইটি শাখায় বিভক্ত-মোন-খমের ও মুন্ডারী ।
১.১ মোন-খমের শাখাঃ বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় একশটিরও অধিক ভাষা মোন-খমের শাখা-র অন্তর্ভূক্ত। এই ভাষাগুলি পূর্ব ভারত থেকে ভিয়েতনাম এবং ইউনান (Yunnan) থেকে মালয়েশিয়া ও আন্দামান সাগরের নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে ছড়িয়ে রয়েছে। বাংলাদেশে এই শাখার ভাষার মধ্যে রয়েছে খাসিয়া ভাষা।
১.১.ক খাসিয়া ভাষাঃ বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে বসবাসকারী মঙ্গোলয়েড খাসিয়া জাতির ভাষা বর্তমানে প্রায় ১২,২৮০ জন লোকের মুখে প্রচলিত। ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্য মিলিয়ে প্রায় দশ লক্ষ লোক খাসিয়া ভাষায় কথা বলে। খাসিয়া ভাষার সাথে বার্মার মোঁয়ে (Mon), পলং (Palng) ভাষার এবং উপমহাদেশের তালাং, খেড়, সুক, আনাম, খামেন, চোয়েম, ক্ষং, লেমেত, ওয়া প্রভৃতি জাতিসত্বা সমূহের ভাষার মিল দেখিয়েছেন বিভিন্ন ভাষাতাত্ত্বিকরা। খাসিয়া ভাষা মৌখিক ভাষা। এই ভাষার কোন নিজস্ব বর্ণমালা নেই। তবে খাসিয়াদের মধ্যে খ্রীষ্টীয় ধর্ম অনুপ্রবেশের পর এই ভাষার লিখিত রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ১৮১২ খ্রীষ্টাব্দে কৃষ্ণচন্দ্র পাল নামক একজন ধর্মযাজক সর্বপ্রথম বাংলা বর্ণমালায় ও খাসিয়া ভাষায় নিউ টেস্টামেন্ট বাইবেল অনুবাদ করেন। ১৮৩৮ সালের পরে ওয়েল্স মিশনারী দলের টমাস জোন্স রোমান হরফে খাসিয়া ভাষা লেখার প্রচলন করেন। টমাস জোন্স কে এ জন্য খাসিয়া বর্ণমালার জনক বলা হয়। তখন থেকে অদ্যাবধি খাসিয়া ভাষা রোমান হরফেই লেখা হয়। খাসিয়া ভাষার উপভাষা রয়েছে। এদের মধ্যে পাঁড়, লিংগাম, ওয়ার উলেখযোগ্য।
১.২ মুন্ডারী শাখাঃ অধিকাংশ ভাষাতত্ত্ব্ববিদ মুন্ডারী শাখাকে অস্ট্রিক ভাষা গোষ্ঠীর মধ্যে বিবেচনা করলেও এর ভিন্ন মতও রয়েছে। Hevesy-i মতে এই Finno-Ugrian ভাষা গোষ্ঠীর কোন এক জাতি সুদূর অতীতে হয়ত ভারতবর্ষে চলে আসে এবং তাদের আনীত ভাষা পরবর্তীতে স্থানীয় অন্য কোন ভাষার প্রভাবে মুন্ডারী শাখার ভাষার সৃষ্টি করে। কিন্তু Finno-Ugrian ভাষা-ভাষীদের অতীতে ভারতবর্ষে আগমনের কোন হদিস এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তাই Hevesy-i মতামতকে নিশ্চিত বিবেচনায় না এনে আমাদের বাংলাদেশে প্রচলিত মুন্ডারী শাখার ভাষা সমূহের আলোচনা করা যাক-
১.২.ক সাঁওতালী ভাষাঃ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী, নওগাঁ, দিনাজপুর, বগুড়া, রংপুর, ঠাকুরগাঁ প্রভৃতি অঞ্চলে প্রায় দুই লক্ষের মত সাঁওতাল বসবাস করে। তবে ভারত ও বাংলাদেশ মিলিয়ে পৃথিবীতে প্রায় অর্ধকোটি লোক সাঁওতালী ভাষায় কথা বলে। ডঃ ক্ষুদিরাম বাংলা ভাষার শতকরা পঁয়তালিশ এবং সংস্কৃত ভাষার শতকরা চলিশ ভাগ শব্দই সাঁওতালী ভাষাজাত বলে উলেখ করেছেন। হাজার হাজার বছর ধরে বংশপরম্পরায় মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে আসা এই সাঁওতালী ভাষার কোন নিজস্ব বর্ণমালা নেই। তবে খ্রীষ্টান মিশনারীদের হাতে সর্বপ্রথম সাঁওতালী ভাষার লিখিত রূপ দেওয়া হয় রোমান হরফে। জানা যায়, ১৮৬৯ সালে ভারতের সাঁওতাল পরগনার লুথারিয়ান মিশনে স্থাপিত একটি ছাপাখানা থেকে সাঁওতাল ভাষার ব্যাকরণ ও অনেক বই প্রকাশিত হয়। পশ্চিমবঙ্গে রঘূনাথ মুর্মূ কতৃর্ক অলচিকি নামে সাঁওতালী বর্ণমালা তৈরী হয়েছিল এবং তার সরকারী স্বীকৃতিও মিলেছিল। তবে নানান কারনে তা টিকে থাকতে পারেনি। বাংলাদেশে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের উদ্যোগে ১৯৯৯ সালের ২০শে মার্চ রাজশাহী জেলার দেওপাড়া ইউনিয়নের বর্ষাপাড়া গ্রামে সাঁওতালী ভাষা শিক্ষাদানের জন্য একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরে সুন্দরপুর বিদ্যালয়, জয়কৃষ্ণপুর বিদ্যালয় এবং সোনাডাইং বিদ্যালয় নামে আরো তিনটি সাঁওতালী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিদ্যালয় গুলোতে মূলতঃ বাংলা হরফেই সাঁওতালী ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে। কুরকু ও নাহিলি নামে সাঁওতালী ভাষার দুটি উপভাষা রয়েছে।
১.২.খ মুন্ডা ভাষাঃ বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে প্রায় ২১৩২ জন মুন্ডা বসবাস করে। মুন্ডাদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। প্রায় তিন-চার হাজার বছর আগে পিজিন ভাষা হিসেবে মুন্ডা ভাষার প্রচলন হয়েছিল। মুন্ডা ভাষার কোন নিজস্ব হরফ নেই। ওরাল লিটারেচারের মাধ্যমেই এই ভাষা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে টিকে আছে।
১.২.গ. বিন্ধ ভাষাঃ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোবরাতলা ইউনিয়নে বিন্ধ-দের বাস। অস্ট্রালয়েড এই বিন্ধ-রা মধ্য-পশ্চিম ভারতের বিন্ধ্য পার্বত্য অঞ্চলের একটি বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী। রিজলী ও ডাল্টন- এর মতে, বিন্ধ-রা ভারতের ছোট বিহার ও ছোটনাগপুর এলাকায় বসবাস করার সময় যে ভাষায় কথা বলত তা ছিল মুন্ডারী শাখার। তবে বর্তমানে বাংলাদেশে বসবাসরত বিন্ধ-রা বাংলা, হিন্দি, মিশ্রিত ভাষা ব্যবহার করে। তাদের নিজস্ব ভাষা বিলুপ্ত প্রায় বলা চলে।
১.২.ঘ. সিং ভাষা ঃ সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, ইশ্বরদী, রাজশাহী জেলার বিভিন্ন গ্রামে প্রায় ৪০০০ জনের অধিক সিং রয়েছে। সিং জাতি আবার তিনটি শাখায় বিভক্ত-রওতিয়া সিং, গন্জু সিং, ও ভূমিজ সিং। এই তিনটি শাখার লোকজনের মুখের ভাষায় পার্থক্য রয়েছে। গন্জু সিং-দের ভাষার সাথে সাদৃশ্য রয়েছে মাহাতোদের ভাষার সাথে। অন্যদিকে রওতিয়া সিং ও ভূমিজ সিং-দের ভাষায় কিছু পার্থক্য থাকলেও তা মোটামুটি একই ধরনের। সিং জাতি ভারতের রাঁচীতে থাকাকালীন যে সিং ভাষা ব্যবহার করত তা আর এখন অবিমিশ্র রূপে নেই ; বাংলা, হিন্দি, বিহারী ভাষার বিভিন্ন উপাদান ঢুকে এক মিশ্র ভাষার রূপ ধারন করেছে । সিং ভাষা-র কোন নিজস্ব বর্ণমালা নেই।
২. ভাষা পরিবার টিবেটো-চীনঃ ভাষাতাত্ত্বিকরা টিবেটো-চীন পরিবারের ভাষা সমূহের বিস্তৃতি মধ্য এশিয়া থেকে দক্ষিণে বার্মা এবং বালিষ্টান থেকে পিকিং পর্যন্ত পূর্ব গোলার্ধের এক বির্স্তীণ অঞ্চল পর্যন্ত বলে উলেখ করেছেন। এই টিবেটো-চীন ভাষা পরিবার দুটি ভাগে বিভক্ত- শ্যামীজ-চাইনীজ, এবং টিবেটো-বর্মণ। টিবেটো-বর্মণ আবার দুইটি ভাগে বিভক্ত- একটি টিবেটো-হিমালয়ান ও অপরটি আসাম-বার্মীজ। আসাম-বার্মীজ আবার কয়েকটি শাখায় বিভক্ত। যেমন- বোডো, নাগা, কুকী-চীন, কাচীন, বার্মীজ, সাক ইত্যাদি।
২.১ বোডো শাখাঃ আচিক, ককবরক, হাজং প্রভৃতি ভাষা সমূহ এই শাখার অর্ন্তভূক্ত।
২.১.ক. আচিক ভাষাঃ বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, মধুপুর, সিলেট অঞ্চলে প্রচুর পরিমানে মান্দি (গারো) -দের বসবাস। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ধারক ও বাহক এই মান্দি জাতির স্বীকৃত ভাষার নাম ‘আচিক’ মান্দিদের মোট ১৩টি গোত্রের মধ্যে বাংলাদেশে ৭টি গোত্রের অবস্থান রয়েছে। গোত্র ভেদে মান্দিদের আলাদা আলাদা উপভাষার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। বর্তমানে আচিক ভাষার নিজস্ব কোন বর্ণমালা নেই। তবে অতীতে এদের বর্ণমালা ও পুস্তকাদি ছিল বলে এক লোককাহিনী প্রচলিত আছে। জন থুসিন রিছিল, ডানিয়েল আর রুরাম , মার্টিন রেমা, প্রদীপ সাংমা নামের চার গবেষক আলাদা আলাদা গবেষণার মাধ্যমে চার ধরনের বর্ণমালার উদ্ভাবন করেছেন। এগুলি নিয়ে এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। অদূর ভবিষ্যতে হয়ত মান্দিদের নিজস্ব সাহিত্য নিজস্ব বর্ণমালায় লিপিবদ্ধ সম্ভব হবে। তবে বর্তমানে রোমান এবং বাংলা হরফেই আচিক সাহিত্য লিপিবদ্ধ হচ্ছে। ভারতের মেঘালয় রাজ্যে বসবাসরত মান্দিরা আচিক ভাষাতেই পড়াশুনা ও সাহিত্য রচনা করে থাকে।
২.১.খ. ককবরক ভাষাঃ বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বসবাসরত প্রায় ত্রিশলক্ষ ত্রিপুরা এই ককবরক ভাষা-য় কথা বলে। মধ্যযুগে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী শাসিত পূর্ববঙ্গের এক বিশাল এলাকায় ককবরক ভাষা (= মানুষের ভাষা) প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্রগ্রাম, চট্রগ্রাম, সিলেট ও কুমিলায় এই ককবরক ভাষাভাষীদের বসবাসরত দেখা যায়। মান্দিদের মতন গোত্র ভেদে এদেরও উপভাষা রয়েছে। ত্রিপুরা জাতি মোট ৩৬টি দফায় বা গোত্রে বিভক্ত। তবে বাংলাদেশে ১৬ টি গোত্রের ১৬টি উপভাষার সন্ধান পাওয়া যায়। অতীতে ককবরক ভাষার নিজস্ব হরফ ছিল বলে লোককাহিনী প্রচলিত রয়েছে। তবে বর্তমানে এর কোন অস্তিত্ব নেই। অনেক আগে থেকেই ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ককবরক ভাষা বাংলা হরফেই লিখিত হয়ে আসছে। সেখানে ২০০০ সাল থেকে ককবরক ভাষায় মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা শুরু হলেও বাংলাদেশে এই ভাষার চর্চা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয়নি। তবে সামাজিক-ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে ককবরক ভাষার সাময়িকী সমূহ বাংলা হরফেই লেখা হয়। বর্তমানে কেউ কেউ রোমান হরফে ককবরক ভাষা চর্চার চেষ্টা করছেন। ককবরক ভাষার ব্যাকরণ অনেক পুরাতন। ধারনা করা হয় প্রায় একশ বছর পূর্বেই ককবরক ব্যাকরণ রচিত হয়েছিল।
২.১.গ. হাজং ভাষাঃ বাংলাদেশে ময়মনসিংহের বিরিশিরি, শ্রীবর্দী, হালুয়াঘাট, নালিতাবাড়ী, সুসং দুর্গাপুর, কলমাকান্দা প্রভৃতি অঞ্চলে প্রায় ১২০০০ হাজং তাদের নিজস্ব হাজং ভাষায় কথা বলে। ডঃ গ্রিয়ারসন হাজং ভাষাকে টিবেটো-বর্মন ভাষা হিসেবে দেখালেও ঐতিহাসিক হ্যামিল্টন-এর মতে হাজং-দের ভাষা বাংলা। হাজং ভাষায় অহমীয় ও কাছারী ভাষারও যথেষ্ট মিশ্রন ঘটেছে। হাজংদের ভাষার কোন নিজস্ব লিপি নেই। তবে বর্তমানে বাংলা বর্ণমালার সাথে একধরনের সাংকেতিক চিহ্ন প্রয়োগের মাধ্যমে হাজং ভাষার লিখিত রূপ দেওয়ার ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে বলে জানা যায়।
২.১.ঘ . লালেংঃ বাংলাদেশের সিলেট সদর থানা ও গোয়ানঘাট থানাদ্বয়ের অন্তর্ভূক্ত ২২/২৩ গ্রামে প্রায় ৪০২ টি পরিবারের ২০৩৩ জন আদিবাসী পাত্র সমপ্রদায়ের বসবাস। পাত্র-রা নিজেদের ভাষার নাম লালেং বলে এবং নিজেদের লালং জাতি বলে পরিচয় দিয়ে থাকে।
২.২. কুকি-চীন শাখাঃ
এই শাখার ভাষা গুলোর মধ্যে বাংলাদেশে প্রচলিত আছে মৈতৈ মণিপুরী, লুসাই, লাইমি , খ্যাং, খুমি, কুকি, পাংখো ইত্যাদি।
২.২.ক. মৈতৈ বা মণিপুরী ভাষাঃ বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলায় মণিপুরী জাতির বসবাস। ভাষাগত দিক থেকে বৃহত্তর মণিপুরী জাতি দুই ভাগে বিভক্ত - মৈতৈ মণিপুরী ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী। মৈতৈ মণিপুরীদের ভাষা হল মৈতৈ ভাষা যা টিবেটো-চীন ভাষা পরিবারের কুকি-চীন শাখার অর্ন্তভূক্ত। আতোম্বাপু শর্মার মতে, মৈতৈ ভাষা প্রায় ৩৪০০ বছরের পুরনো একটি ভাষা। পূর্বে মণিপুরী ভাষার নিজস্ব হরফ ছিল। অধিকাংশের মতে মৈতৈ লিপি ব্রাহ্মী লিপি থেকে উদ্ভূত। ভারতের মণিপুর রাজ্যে এই লিপির প্রথম প্রচলন হয় মহারাজ পাংখংবা-র (৩৩-১৫৪ খ্রীঃ) আমলে। তখন মৈতৈ ভাষার বর্ণমালা ছিল মোট ১৮টি, পরবর্তীতে মহারাজ খাগেম্বার (১৫৯৬-১৬৫১ খ্রীঃ) শাসনামলে আরো ৯টি বর্ণযুক্ত হয়ে মোট বর্ণ সংখ্যা হয় ২৭টি। কিন্তু অষ্টম শতাব্দীর এক কপার পেটের উপর মৈতৈ বর্ণমালার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কার এটাই প্রমান করে যে মৈতৈ বর্ণমালার প্রচলন হয়েছিল মহারাজ পাংখংবা-র অনেক আগে থেকেই। মৈতৈ বর্ণমালার বয়স অনেক পুরোনো হলেও এই বর্ণমালায় রচিত কোন প্রাচীন পুস্তকের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবে ধারনা করা হয় যে দশম শতাব্দীতে সর্বপ্রথম মণিপুরী ভাষায় যে হাতে লেখা পুস্তক বের হয়েছিল তা ছিল বাংলা হরফের। মৈতৈ ভাষায় এবং বাংলা হরফে লিখিত দুটি প্রাচীনতম পুস্তক হল পুইরেইতন খুন্থক (poireiton khunthok) এবং নুমিত কাপ্পা (Numit kappa) অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজা গরীবে নেওয়াজ এর সময়ে বৈষ্ণব ধর্ম রাষ্টীয় স্বীকৃতির পর থেকে মৈতৈ মণিপুরী ভাষা বাংলা লিপিতেই নিয়মিত ভাবে লিখিত হয়ে আসছে। বর্তমানে হারিয়ে যাওয়া লিপি পুনরুদ্ধার ও তা নিয়ে সাহিত্য-সাময়িকী রচনার চেষ্টা করা হচ্ছে। মণিপুরী লিপির একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল যে, এগুলি মানুষের একেকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নামানুযায়ী নামাঙ্কিত। যেমনঃ বাংলা ‘ক’ এর মণিপুরী প্রতিবর্ণ কোক, যার অর্থ মাথা ইত্যাদি।
২.২.খ. খুমি ভাষাঃ প্রায় দেড় হাজারেরও অধিক খুমি বান্দরবান জেলায় এবং থান্চি উপজেলায় বসবাস করে থাকে। খুমি-দের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। হাতে গোনা কয়েকজন বাদে খুমিদের প্রায় সবাই তাদের নিজস্ব ভাষা ব্যতীত অন্য ভাষায় কথা বলতে পারেননা।
২.৩ সাক-লুই শাখাঃ
২.৩.ক. চাক (Chak)t মঙ্গোলয়েড চাক-রা নিজেদেরকে পরিচয় দেয় আসাক্ (Asak) বলে। বর্মীরা চাকমা ও চাক উভয় জনগোষ্টীকেই সাক্ (Sak) বা থেক্ (Thak) বলে থাকে। তবে পার্বত্য চট্রগ্রামের দক্ষিণে বাইশারি, নাক্ষ্যংছড়ি, আলিখ্যং, কামিছড়া, কোয়াংঝিরি, ক্রোক্ষ্যং প্রভৃতি জায়গাতে প্রায় আড়াই হাজার চাক বাস করে যাদের ভাষা চাকমা ভাষার থেকে আলাদা। চাকমা ভাষা ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারের হলেও চাকদের ভাষা তিব্বতী-চীন পরিবারের। চাক বা আসাক্ (Asak) ভাষার সাথে উত্তর বার্মার কাডু (Kadu), গানান (Ganan) জনগোষ্ঠীর ভাষার মিল পাওয়া যায়। চাক ভাষার কোন বর্ণমালা নেই। তবে চাকদের লোক সংস্কৃতি বিভিন্ন লোকগাথাঁ, ধাঁধাঁ, লোকগীতি ইত্যাদি বেশ স্বযং সম্পূর্ন।
২.৩.খ. ঠার বা থেক বা ঠেট ভাষাঃ বর্তমানে বাংলাদেশে ঠার বা থেক বা ঠেট ভাষা-ভাষীর সংখ্যা প্রায় ৪০০০০। ১৬৩৮ খ্রীষ্টাব্দে শরনার্থী আরাকানরাজ বলালরাজার সাথে মনতং (Mon-Tong) জাতির যে ক্ষুদ্র অংশ বাংলাদেশে প্রবেশ করে তাদের আনীত ভাষার নাম ঠার বা ঠেট বা থেক ভাষা। লোকচিকিৎসা (ethno-medical) পেশার সাথে সম্পৃক্ততার দরুন কালক্রমে এরা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল এমনকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে ছড়িয়ে পড়ে এবং বাইদ্যা বা বেদে নামে পরিচিতি লাভ করে। এই মনতং বা বেদেরা নিজ জাতির লোকদের মধ্যে ঠার ভাষা ব্যবহার করলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে এরা বাংলা ভাষাতেই কথা বলে। ঠার ভাষা-র নিজস্ব কোন বর্ণমালা না থাকলেও এদের লোকসাহিত্য বেশ সমৃদ্ধ। ঠার বা থেক বা ঠেট ভাষা -র বার্মা, চীন, লাওসে প্রচলিত কাডু ভাষার সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। উত্তর বার্মায় থেক, সাক, আসাক ইত্যাদি সবগুলোকেই কাডু ভাষার অন্তর্গত বলে ধরা হয়।
২.৪.বার্মীজ শাখা ঃ
২.৪.ক . রাখাইন ভাষাঃ কক্সবাজার, বরগুনা, পটুয়াখালী, চট্রগ্রাম ও পার্বত্য চট্রগ্রামে প্রায় দেড়লক্ষেরও অধিক লোক রাখাইন ভাষায় কথা বলে। রাখাইন ভাষা অত্যন্ত প্রাচীন ও সমৃদ্ধ একটি ভাষা। জানা যায় খ্রীষ্ট পূর্ব ৩৩২৫ সাল হতে রাখাইন রাজা মারায়ু কর্তৃক রাখাইন প্রে বা রাখাইন রাজ্যে প্রতিষ্ঠার পর থেকে সুদীর্ঘ কাল পর্যন্ত রাখাইন ভাষা ছিল ঐ রাজ্যের একমাত্র জাতীয় ভাষা। রাখাইনদের নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। রাখাইন বর্ণমালায় স্বরবর্ণ বা ছারা হল ১২টি এবং ব্যাঞ্জনবর্ণ বা ব্যেঃ মোট ৩৩টি। রাখাইন ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রথমে স্বরবর্ণ এবং পরে ব্যাঞ্জন বর্ণ শেখানো হয়। নিকট অতীত কালেও ক্যং-এ রাখাইন ভাষা শেখানোর প্রথা প্রচলিত থাকলেও বর্তমানে তা কেবল পারিবারিক পর্যায়েই সীমাবদ্ধ। তারপরও বর্তমানে রাখাইনদের শতকরা প্রায় ৭০ জনেরও বেশী লোক নিজ ভাষায় লিখতে ও পড়তে সক্ষম।
৩. ভাষা পরিবার-দ্রাবিড়ঃ দ্রাবিড় শব্দটি প্রসারিত অর্থে দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতের এক বিশাল ভাষা পরিবার। আযর্-দের আগমনের বহু পূর্বেই এই দ্রাবিড় ভাষা সমূহ সমগ্র ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশে দ্রাবিড় ভাষা পরিবারের ভাষা সমূহের মধ্যে কুড়ুখ বা ওঁরাও, পাহাড়িয়া, মাহালি প্রভৃতি ভাষা প্রচলিত।
৩.ক. ওঁরাও বা কুড়ুখ ভাষাঃ লালমণিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও পাবনা ব্যতীত উত্তরবঙ্গের প্রায় সবকটি জেলাতেই ওঁরাও বা কুড়ুখ ভাষা-ভাষীদের বসবাস লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশ এদের মোট সংখ্যা প্রায় ৬৫০০০ জন। কুড়ুখ ভাষাটি আদি ও অবিমিশ্র এবং এটি দিনাজপুর ও নওগাঁ জেলায় বসবাসরত ওরাঁওরা ব্যবহার করলেও সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, বগুড়া, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা ও রংপুর অঞ্চলের ওঁরাওরা মূলত কুড়ুখ্, উড়িয়া, উর্দ্দূ, হিন্দী, ফার্সী ও বাংলা মিশ্রিত ভাষা ব্যবহার করে । কুড়ুখ ভাষা মূলত কথ্য ভাষা। এই ভাষার নিজস্ব কোন বর্ণমালা তৈরি হয়নি।
৩.খ. পাহাড়িয়া ভাষাঃ বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী, দিনাজপুরে প্রায় ৭৩৬১ জন পাহাড়িয়া জাতির লোক বাস করে। পাহাড়িয়া জাতির দুটি শাখা রয়েছে। এদের একটি শাওরিয়া পাহাড়িয়া বা মালের এবং অন্যটি মাল পাহাড়িয়া বা মালো। বাংলাদেশে মাল পাহাড়িয়া-দের সংখ্যা কম। সুনীতি কুমার চট্রোপাধ্যায়, অতীন্দ্র মজুমদার সহ অনেকেই মালপাহাড়িয়া-দের ভাষাকে মাল্তো বলে উলেখ করেছেন। তবে ডঃ শিবানী রায়ের মতে এদের ভাষার নাম বাড়লা, যা আসলে মিশ্র ভাষা এবং দীর্ঘদিন বাঙালিদের পাশাপাশি বসবাসের ফলে তা হয়েছে। আবার সুবোধ ঘোষ মাল পাহাড়িয়া-দের ভাষাকে বাংলা ভাষার অপভ্রংশ হিসেবে দেখিয়েছেন। শাওরিয়া পাহাড়িয়া-দের ভাষাকে কেউ কেউ পলী ভাষা হিসেবে দেখিয়েছেন যা কিনা শাদ্রি-র খুব কাছাকাছি। যা হোক শাওরিয়া ও মাল পাহাড়িয়া-দের ভাষার কোন নিজস্ব বর্ণমালা নেই। মূলত ওরাল লিটারেচারের মাধ্যমেই এই ভাষা তার অতীত ঐতিহ্যগাঁথা ধরে রাখতে পেরেছে।
৩.গ. মাহালি ভাষাঃ বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের মাহালি নামের জাতিগোষ্ঠির ভাষার নাম মাহালি ভাষা, যা দ্রাবিড় ভাষা পরিবার ভুক্ত। বর্তমানে এরা মূলতঃ বাংলা ভাষাতেই কথা বললেও এদের কথ্য ভাষায় আজও মূল মাহালি ভাষার কিছু কিছু শব্দাবলীর প্রচলন রয়ে গেছে। যেমন- দাস্ (পানি), দাকা (ভাত), গুড়া (ঘর), দানড়ী (গরু) ইত্যাদি।
৪. ভাষা পরিবার-ইন্দো-এরিয়ান ঃ নর্ডিক (Nordic) এবং আলপীয় (Alpine) নামের দুই ভিন্ন নরগোষ্ঠী ভারতবর্ষে আর্য ভাষার প্রবর্তন করেছিল। নর্ডিক-দের রচিত ঋগ্বেদের ভাষাই আর্য ভাষার প্রাচীন নিদর্শন। ঋগ্বেদের ভাষা তথা বৈদিক ভাষা পরবর্তিতে ব্যাকরণবিদদের হাত ধরে সংস্কৃত ভাষায় রূপান্তরিত হয়। কালক্রমে এই সংস্কৃত ভাষা লোক মুখে বিকৃত হতে হতে প্রাকৃত ভাষার রূপ নেয়। এই প্রাকৃত ভাষা থেকেই ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারের ভাষা সমূহের উৎপত্তি। বাংলাদেশে ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারভুক্ত কয়েকটি ভাষার পরিচয় নিম্নে দেওয়া হল-
৪.ক. চাকমা ভাষাঃ বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাগুলির মধ্যে চাকমা-রা সংখ্যায় সর্বাধিক (প্রায় তিন লক্ষ)। পার্বত্য চট্রগ্রামে বসবাসরত এই চাকমা জাতির নিজস্ব ভাষা ও সাহিত্য রয়েছে, রয়েছে তাদের নিজস্ব বর্ণমালা। এ বর্ণমালার সাথে সাদৃশ্য রয়েছে বর্মী ও অসমীয় বর্ণমালা। অতীতে চাকমা লিপিতেই চাকমা সাহিত্য রচিত হত। খ্রীষ্টান মিশনারিরাই সর্বপ্রথম ১৮৮৬ সালে ভারতের এলাহাবাদের এক ছাপাখানা হতে চাকমা লিপিতে ও চাকমা ভাষায় অনূদিত বাইবেল প্রকাশ করে। ত্রিশ বা চলিশের দশকে হরকিশোর চাকমা কর্তৃক চাকমা লেখা নামক বই চাকমা লিপিতে প্রকাশিত হয়।
৪.খ. রাজবংশী ভাষাঃ প্রায় সাড়ে সাত হাজারেরও অধিক রাজবংশী রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, বগুড়া, ময়মনসিংহ ও যশোরে বাস করে। ধারনা করা হয় রাজবংশী ভাষা একসময় বৃহত্তর বোডো (Bodo) ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। যদিও রাজবংশীরা বোডো ভাষা হারিয়ে বর্তমানে বাংলা ভাষাতেই কথা বলে; তবু এখনো রাজবংশী ভাষার ক্রিয়াপদ ও বিশেষ্য পদের শেষে ও মাঝে ঙ, ং এর উচ্চারণ, বোডো ভাষার উৎসজাত শব্দাবলী এবং বোডো ভাষার অপভ্রংশ লক্ষ্য করা যায়.
৪.গ. মাহাতো ভাষাঃ মাহাতো জাতির নিজস্ব মাহাতো ভাষা বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ হাজারেরও অধিক লোক ব্যবহার করে। এদের বসবাস সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ ও রায়গঞ্জ এবং বগুড়া জেলার শেরপুর থানার অর্ন্তগত গ্রাম গুলোতে। মাহাতোরা নিজেদের ভাষাকে নাগ্রী ভাষা বলে উলেখ করে। মাহাতোদের ভাষাকে কেউ কেউ শাদ্রি ভাষাও বলে থাকেন। মাহাতো ভাষায় হিন্দী, উর্দ্দূ, বাংলা, অহমীয়া ভাষার মিশ্রণ ঘটেছে। মাহাতো ভাষার নিজস্ব কোন হরফ নেই।
৪.ঘ. বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাঃ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী-দের বসবাস সিলেট বিভাগে। আগেই বলা হয়েছে জাতিগত ভাবে এক হলেও মণিপুরী জাতি ভাষাগত ভাবে দুই ভাগে বিভক্ত। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার দুটি উপভাষা রয়েছে- এদের একটি রাজার গাঙ (= রাজার গ্রাম) এবং অপরটি মাদাই গাঙ (= রানীর গ্রাম)। ডঃ কে পি সিন্হা-র মতে নব ইন্দো-আর্য ভাষার উৎপত্তি কালে বা সামান্য পরে অর্থাৎ ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতকে ইন্দো-আর্য ভাষার থেকে পৃথক বৈশিষ্ট্য নিয়ে স্বতন্ত্র্য ভাষা হিসেবে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা সর্বপ্রথম ভারতের মণিপুর রাজ্যে প্রচলিত হয়ে থাকে। এই নব্যপ্রচলিত বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় ষোড়শ শতাব্দীতে। ত্রয়োদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈ জনগোষ্ঠীর ঘনিষ্ট সংস্পর্শের কারনে এসময় বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষার ব্যাপক মৈতৈ শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটে। উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী-রা মণিপুর ছেড়ে ত্রিপুরা, আসাম ও বাংলাদেশের সিলেটে আশ্রয় গ্রহন করে। এসময় কালেই মূলতঃ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষায় ব্যাপক ভাবে ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারের শব্দাবলী প্রবেশ করে। অহমিয় ও বাংলা ভাষার সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যাবলীর মিল থাকার কারনে অনেকেই এই ভাষাকে অহমিয় ও বাংলা-র একটি উপভাষা হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করেন। ডঃ কে. পি. সিন্হার মতে এই বৈশিষ্ট্যগত মিল সম্ভব হয়েছে বাংলা, অহমিয় ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার উৎপত্তি একই উৎস থেকে (মাগ্দী প্রাকৃত) বলে।
বহুজাতিক ও বহুভাষিক রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বার ভাষা সমূহ সবসময় বৃহত্তর জাতির ভাষার চাপে কোনঠাসা হয়ে পড়ে। সেখানে বৃহত্তর জাতির ভাষা বা তাদের সুবিধা মতন অন্য কোন ভাষা প্রধান হয়ে উঠবার এবং জোড়পূর্বক একভাষিকতা চাপানোর একটা অসৎ প্রবনতা পরিলক্ষিত হয়। বুর্জোয়া রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এই প্রবনতার মাত্রা অত্যন্ত প্রকট ও খোলামেলা রূপেই দেখা যায়। যদিও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নেও রুশ ভাষার জৌলুস এবং আধিপত্যের কাছে লেট্, এস্তোনিয়া সহ অন্যান্য ভাষা গুলোর অবস্থা ছিলো অত্যন্ত ম্রিয়মান। আমাদের বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতেও বাঙালি ভিন্ন অন্যান্য জাতিসত্ত্বার ভাষা সমূহের অবস্থা অত্যন্ত কোনঠাসা। বাংলাদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা সমূহের সবগুলোই মূলতঃ দ্বি-ভাষী (Bilingual) নিজ পরিবার বা নিজ জাতিসত্ত্বার ভিতরে এরা নিজ মাতৃভাষায় কথা বললেও বাইরের কারো সাথে এরা বাংলাতেই কথা বলে। অনেক গুলি জাতিসত্ত্বা নানাবিধ কারনে আজ তাদের নিজ মাতৃভাষা হারিয়ে বাংলা ভাষাতেই কথা বলে। এদের মধ্যে বিন্ধ, কোচ, রাজবংশী, পাহাড়িয়া, হো, বর্মন, ইত্যাদি উলেখযোগ্য। সত্তরের দশকে চাকমা ও মারমা-রা ক্যং-এ তাদের নিজস্ব লিপিতে নিজ নিজ ভাষার চর্চা করত। বিভিন্ন কারনে আজ সেই ব্যবস্থাও বন্ধ। নতুন প্রজন্মের চাকমা-রা আজ আর তাদের নিজ বর্ণমালার সাথে পরিচিত নয়। মাহালি, বুনো, বাগদী জাতিসত্ত্বার লোকজন তাদের মাতৃভাষায় কথা বলতে অক্ষম। মনতং বা বেদে-দের ঠেট বা ঠার ভাষা তার নিজস্ব উপাদান হারাতে হারাতে রিক্ত হতে চলেছে। প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার অভাবে মণিপুরী, ককবরক, খাসিয়া, সাঁওতাল, ওঁরাও ভাষা গুলো ধীরে ধীরে বিলুপ্তির দিকে পা বাড়াচ্ছে। এই হচ্ছে আজ বাংলাদেশের ভাষা সমূহের সামগ্রিক চিত্র। এই যে ভাষা গুলির হারিয়ে যাওয়া বা ধ্বংসের প্রান্তিক সীমায় অগ্রসর হওয়া তা শুধু মাত্র একেকটি ভাষার হারিয়ে যাওয়া বা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পূর্ব চিহ্নমাত্র নয়; এই হারিয়ে যাওয়া হল একেকটি জাতিসত্তার নিজস্ব আবেগ, অনুভূতি, স্বপ্ন, লোকায়ত জ্ঞান, সংস্কৃতির হারিয়ে যাওয়া। আর কোন জাতির এগুলি হারানোর অর্থ হল পৃথিবীর বুক থেকে সেই জাতির অস্তিত্ব চিরতরে মুছে যাওয়া। ইউনেস্কো কর্তৃক একুশে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার মূল লক্ষ্য হল পৃথিবীতে ভাষার বহুত্ব, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও ভিন্নতাকে সংরক্ষণ ও উন্নয়ন। যে বাঙালি জাতিকে ১৯৫২ সালে চরম আত্মত্যাগ করতে হয়েছিল নিজ মায়ের ভাষা রক্ষার জন্য, সেই জাতির স্বাধীন রাষ্ট্রভূমিতে বসবাসরত অন্যান্য জাতিসত্ত্বা সমূহের ভাষা গুলোর যে করুন অবস্থা তা সত্যিই লজ্জাজনক, দুঃখজনক। স্বাধীনতার ৩৩ বছর পরেও এই বাংলাদেশ রাষ্ট্র বাঙালি ভিন্ন অপরাপর জাতিসত্ত্বার ভাষা সমূহের সংরক্ষণ, উন্নয়নের ব্যাপারে কোন কার্যকর পদক্ষেপ তো নেয়েইনি বরং এই সমস্ত ভাষা সমূহের অধিকারী বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার অস্তিত্বও স্বীকার করেনি। বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় এখানকার ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা সমূহের নিজ মাতৃভাষাতে লেখাপড়া করার কোন সুযোগ রাখা হয়নি। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেই মণিপুরী, খাসিয়া, মান্দি, সাঁওতাল সহ বিভিন্ন জাতিসত্ত্বা স্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও নিজ নিজ মাতৃভাষায় পড়াশোনা করছে। এখন ‘একুশে’-র অহংঙ্কার ধারনকারী এই বাংলাদেশ রাষ্ট্র কি পারবে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে উপস্থিত এই সমস্ত ভাষা গুলি রক্ষার কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ? তার বিশাল ভাষা জাদুঘরকে জীবন্ত রাখতে ? নাকি আগামী ৩০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যেই প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের অধিকারী এই বাংলাদেশ হারাবে তার ভাষার বৈচিত্র্যতাকে, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যতাকে ?
উলেখ্যপঞ্জি ঃ
গ্রন্থ সমূহঃ
১. Chittagonj Hill Tracts- R. H. Sneyd Hutchinson Vivek Publishing company, DelhiFirst Published 1901, Reprint 1978 .
২.The peoples of India- Anderson, J.DBimla pub. ।। First Published 1913.
৩. An Etymological Dictionary of Bishnupriya Manipuri- Dr. K. P. Sinha Puthi, Calcutta 1986.
৪. ভাষাতত্ত্ব - অতীন্দ্র মজুমদার।। নয়াপ্রকাশ, কলিকাতা।। ১৯৯৭।
৫.ভারতের ভাষা ও ভাষা সমস্যা- সুনীতকুমার চট্রোপাধ্যায়।। রূপা অ্যান্ড কোম্পানী, কলিকাতা, জানুয়ারী ১৯৯২।
৬. ভারত সংস্কৃতি- সুনীতকুমার চট্রোপাধ্যায়।। মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃলিঃ কলকাতা।। আষাঢ় ১৪০৪।
৭. ভারতের আদিবাসী- সুবোধ ঘোষ।। ন্যাশনাল বুক এজেন্সী প্রাঃ লিঃ, কলকাতা।। b‡f¤^i ২০০০।
৮.ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়- ডঃ অতুল সুর।। সাহিত্যলোক, কলকাতা।। জুলাই ১৯৮৮।
৯.ভাষা, দেশ, কাল- পবিত্র সরকার।। জি.এ.ই. পাবলিশার্স।। বৈশাখ ১৩৯২।
১০. উপভাষা চর্চার ভূমিকা- মনিরুজ্জামান।। বাংলা একাডেমী, ঢাকা।। মে, ১৯৯৪।
১১. ককবরক ভাষা ও সাহিত্য- কুমুদ কুন্ডু চৌধুরী।। অক্ষর পাবলিকেশান্স, আগরতলা।।
১২.পার্বত্য চট্রগ্রামের উপজাতীয় ভাষা- সুগত চাকমা।। উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনষ্টিটিউট।। রাঙ্গমাটি।। মার্চ ১৯৮৮।১৩ বাংলাদেশের ১৩. গারো সমপ্রদায়- সুভাষ জেংচাম।। বাংলা একাডেমী. ঢাকা।। ১৯৯৪।
১৪.চাকমা পরিচিতি- সুগত চাকমা।। বরগাঙ পাবলিকেশন্স, রাঙ্গামাটি।। অক্টোবর ১৯৮৩।
১৫. বাংলাদেশের সাঁওতালঃ জীবন ও সংস্কৃতি- আখতার উদ্দিন মানিক।। উত্তরা প্রকাশনা ,মোহাম্মদপুর,ঢাকা।। wW‡m¤^i ১৯৯৮ ১৬.উত্তরবঙ্গের আদিবাসীঃ লোকজীবন ও লোকসাহিত্যঃ ওঁরাও- ডঃ মুহাম্মদ আব্দুল জলিল।। বিশ্ব সাহিত্য ভবন, ঢাকা।। মে ২০০১।
১৭. আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতিঃ প্রসঙ্গ নদীয়া জেলা- ডঃ শিবানী রায় (মওল)।। পুস্তক বিপনি, বেনিয়াটোলা লেন, কলিকাতা।। অক্টোবর ২০০২।
১৮. সিলেটের নিঃস্ব আদিবাসী পাত্র- ডঃ রতন লাল চক্রবর্তী।। মওলা ব্রাদার্স, ঢাকা।। মে ২০০০।
১৯. বাংলাদেশের মণিপুরীঃ ত্রয়ী সংস্কৃতির ত্রিবেনী সঙ্গমে- এ কে শেরাম।। আগামী প্রকাশনী; ঢাকা।। ১৯৯৬।
২০. বাংলাদেশে রাখাইন সমপ্রদায়ঃ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও জীবনধারা-মং বা অং (মং বা)।।প্রকাশক-লেখক।।এপ্রিল ২০০৩ খ্রী.।
প্রবন্ধ/পত্রিকাঃ
১. হাজং জীবনের ইতিবৃত্ত- মুজিব মেহেদী।। বাংলাদেশের উপজাতি ও আদিবাসীঃ অংশীদারিত্বের নতুন দিগন্ত- সম্পাদনাঃ হাফিজ রশীদ খান।। পাঠক সমাবেশ, ঢাকা।। ১৯৯৩।
২. বরেন্দ্র অঞ্চলের বিন্ধ জাতিগোষ্ঠীঃ সামাজিক-রাজনৈতিক পরিচয় উদ্ঘাটন- ডঃ মোঃ আব্দুর রশীদ সিদ্দিকী।। আইবিএস জার্নাল।। ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।। ১০ম সংখ্যা ১৪০৯
৩. মানুষ- সম্পাদনাঃ মোহাম্মদ মহসীন।। এফআইভিডিবি, খাদিমনগর, সিলেট।। †m‡Þ¤^iÑ অক্টোবর ১৯৯৭।
(This article was published in `Mhrittika’-vol.-1, issue-1; editor-Jewel Bin Zahir, Parag Ritchil, Dopor Mitra; Dhaka, August 2004)
ভাষা মানব সভ্যতার বিবর্তনের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। মানুষের বাগযন্ত্র কর্তৃক উৎসারিত ধ্বণি অর্থময়তা লাভের মাধ্যমে সৃষ্টি করেছে ভাষার। ধ্বণির অর্থময়তা স্থান, কাল, জাতিভেদে বিভিন্ন হতে পারে। আর ধ্বণির এই বহুমাত্রিক অর্থময়তাই পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ভেতরে সৃষ্টি করেছে বিভিন্ন ভাষার। ভাষাভিত্তিক ঐক্যকে কাজে লাগিয়েই নিজস্ব যুগবাহিত সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, লোকায়ত জ্ঞানের আদান-প্রদানের মাধ্যমে কোন জনগোষ্ঠি গড়ে তোলে নিজস্ব স্বাজাত্যবোধ, স্বাতন্ত্র্যবোধের নিজ ভাষার মাধ্যমেই কোন জাতিসত্তার মধ্যকার সংস্কৃতিগত বিভিন্ন উপাদানগুলি তার আপন লয়ে প্রকাশিত, বিকশিত, ও সঞ্চালিত হয় যুগযুগান্ত ধরে নানান পরিবর্তন-পরিবর্ধন-পরিমার্জনের মধ্য দিয়ে। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের রাজনৈতিক সীমানার পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা। রক্তাক্ত সংগ্রামের পথ ধরে অর্জিত এই বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আজ বিশ্বব্যাপী। বাঙালি জাতির গৌরবের একুশে ফেব্রুয়ারি আজ পৃথিবীব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে মর্যাদা লাভ করেছে। বাংলাদেশের ১৪ কোটি মানুষের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মাতৃভাষা হল বাংলা; বাকি প্রায় ত্রিশ লক্ষ মানুষের মাতৃভাষায় রয়েছে ব্যাপক বৈচিত্র্যতা। এই ত্রিশ লক্ষ মানুষ প্রায় ৪৫টি পৃথক পৃথক জাতিসত্ত্বায় বিভক্ত। তাদের শারীরিক ও মানসিক গড়ন, সামাজিক, ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রতা বৃহত্তর বাঙালি জাতির জীবন-সংস্কৃতি থেকে সহজেই আলাদা করা যায়। এই ৪৫টি জাতিসত্ত্বাই আবার নিজেদের মধ্যে ভাষা, সমাজ-সংস্কৃতিতে একে অন্যের থেকে পৃথক এবং স্বাতন্ত্রতার অধিকারী। এই জাতিসত্তা গুলির নিজ নিজ ভাষা রয়েছে, রয়েছে তাদের বর্ণাঢ্য লোক সাহিত্য, লোক সংস্কৃতি; যা বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে করে তুলেছে অধিকতর সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়। ভাষার সংখ্যাগত দিক বিবেচনায় ক্ষুদ্রায়তনের এই বাংলাদেশ নামক ব-দ্বীপটিকে ভাষার জীবন্ত জাদুঘর বলা যেতে পারে। বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন জাতির ভাষা সমূহকে নিমো্নক্ত ভাবে শ্রেণীবদ্ধ করা যেতে পারে-
১. ভাষা পরিবার- অস্ট্রিক ভাষা সমূহ
১.১. মোন-খমের শাখা- খাসিয়া
১.২. মুন্ডারী শাখা- সাঁওতাল, মুন্ডা, সিং, বিন্ধ,হো ইত্যাদি।
২. ভাষা পরিবার- টিবেটো-চীন
২.১. বোডো শাখা- আচিক,ককবরক,হাজং,লালেং, পালিয়া ইত্যাদি।
২.২. কুকি-চীন শাখা- মৈতৈ মণিপুরী, খুমি, লাইমি, কুকি, ম্রো, পাংখো, ইত্যাদি।
২.৩. সাক্-লুই শাখা- চাক, থেক বা ঠেট বা থেক , লুসাই।
২.৪. বার্মীজ শাখা- রাখাইন বা ম্রাইনমা
৩. ভাষা পরিবার- দ্রাবিড় কুরুখ, পাহাড়িয়া, মাহালি ইত্যাদি।
৪. ভাষা পরিবার -ইন্দো-এরিয়ান বাংলা, চাকমা, তন্চংগা, রাজবংশী, কোচ, মাহাতো, বসাক,বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী,
বিহারী, ভূইমালি ইত্যাদি।
এবার বাংলাদেশে প্রচলিত বিভিন্ন ভাষা পরিবারের অন্তর্ভূক্ত কয়েকটি ভাষার সাধারণ পরিচয় তুলে ধরা যাক-
১. ভাষা পরিবার- অস্ট্রিকঃ ভাষা তাত্ত্বিকদের দীর্ঘপরিশ্রম লব্ধ গবেষণায় যতদুর জানা গেছে বাংলার সর্বপ্রাচীন ভাষা ছিল অস্ট্রিক ভাষা পরিবারের ভাষা। ভারতবর্ষে প্রচলিত এই ভাষা পরিবারের অন্তর্ভূক্ত ভাষা সমূহ অস্ট্রো-এশিয়াটিক শাখা--র ভাষা বলে পরিচিত। বাংলাদেশে প্রচলিত অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা সমূহ আবার দুইটি শাখায় বিভক্ত-মোন-খমের ও মুন্ডারী ।
১.১ মোন-খমের শাখাঃ বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় একশটিরও অধিক ভাষা মোন-খমের শাখা-র অন্তর্ভূক্ত। এই ভাষাগুলি পূর্ব ভারত থেকে ভিয়েতনাম এবং ইউনান (Yunnan) থেকে মালয়েশিয়া ও আন্দামান সাগরের নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে ছড়িয়ে রয়েছে। বাংলাদেশে এই শাখার ভাষার মধ্যে রয়েছে খাসিয়া ভাষা।
১.১.ক খাসিয়া ভাষাঃ বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে বসবাসকারী মঙ্গোলয়েড খাসিয়া জাতির ভাষা বর্তমানে প্রায় ১২,২৮০ জন লোকের মুখে প্রচলিত। ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্য মিলিয়ে প্রায় দশ লক্ষ লোক খাসিয়া ভাষায় কথা বলে। খাসিয়া ভাষার সাথে বার্মার মোঁয়ে (Mon), পলং (Palng) ভাষার এবং উপমহাদেশের তালাং, খেড়, সুক, আনাম, খামেন, চোয়েম, ক্ষং, লেমেত, ওয়া প্রভৃতি জাতিসত্বা সমূহের ভাষার মিল দেখিয়েছেন বিভিন্ন ভাষাতাত্ত্বিকরা। খাসিয়া ভাষা মৌখিক ভাষা। এই ভাষার কোন নিজস্ব বর্ণমালা নেই। তবে খাসিয়াদের মধ্যে খ্রীষ্টীয় ধর্ম অনুপ্রবেশের পর এই ভাষার লিখিত রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ১৮১২ খ্রীষ্টাব্দে কৃষ্ণচন্দ্র পাল নামক একজন ধর্মযাজক সর্বপ্রথম বাংলা বর্ণমালায় ও খাসিয়া ভাষায় নিউ টেস্টামেন্ট বাইবেল অনুবাদ করেন। ১৮৩৮ সালের পরে ওয়েল্স মিশনারী দলের টমাস জোন্স রোমান হরফে খাসিয়া ভাষা লেখার প্রচলন করেন। টমাস জোন্স কে এ জন্য খাসিয়া বর্ণমালার জনক বলা হয়। তখন থেকে অদ্যাবধি খাসিয়া ভাষা রোমান হরফেই লেখা হয়। খাসিয়া ভাষার উপভাষা রয়েছে। এদের মধ্যে পাঁড়, লিংগাম, ওয়ার উলেখযোগ্য।
১.২ মুন্ডারী শাখাঃ অধিকাংশ ভাষাতত্ত্ব্ববিদ মুন্ডারী শাখাকে অস্ট্রিক ভাষা গোষ্ঠীর মধ্যে বিবেচনা করলেও এর ভিন্ন মতও রয়েছে। Hevesy-i মতে এই Finno-Ugrian ভাষা গোষ্ঠীর কোন এক জাতি সুদূর অতীতে হয়ত ভারতবর্ষে চলে আসে এবং তাদের আনীত ভাষা পরবর্তীতে স্থানীয় অন্য কোন ভাষার প্রভাবে মুন্ডারী শাখার ভাষার সৃষ্টি করে। কিন্তু Finno-Ugrian ভাষা-ভাষীদের অতীতে ভারতবর্ষে আগমনের কোন হদিস এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তাই Hevesy-i মতামতকে নিশ্চিত বিবেচনায় না এনে আমাদের বাংলাদেশে প্রচলিত মুন্ডারী শাখার ভাষা সমূহের আলোচনা করা যাক-
১.২.ক সাঁওতালী ভাষাঃ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী, নওগাঁ, দিনাজপুর, বগুড়া, রংপুর, ঠাকুরগাঁ প্রভৃতি অঞ্চলে প্রায় দুই লক্ষের মত সাঁওতাল বসবাস করে। তবে ভারত ও বাংলাদেশ মিলিয়ে পৃথিবীতে প্রায় অর্ধকোটি লোক সাঁওতালী ভাষায় কথা বলে। ডঃ ক্ষুদিরাম বাংলা ভাষার শতকরা পঁয়তালিশ এবং সংস্কৃত ভাষার শতকরা চলিশ ভাগ শব্দই সাঁওতালী ভাষাজাত বলে উলেখ করেছেন। হাজার হাজার বছর ধরে বংশপরম্পরায় মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে আসা এই সাঁওতালী ভাষার কোন নিজস্ব বর্ণমালা নেই। তবে খ্রীষ্টান মিশনারীদের হাতে সর্বপ্রথম সাঁওতালী ভাষার লিখিত রূপ দেওয়া হয় রোমান হরফে। জানা যায়, ১৮৬৯ সালে ভারতের সাঁওতাল পরগনার লুথারিয়ান মিশনে স্থাপিত একটি ছাপাখানা থেকে সাঁওতাল ভাষার ব্যাকরণ ও অনেক বই প্রকাশিত হয়। পশ্চিমবঙ্গে রঘূনাথ মুর্মূ কতৃর্ক অলচিকি নামে সাঁওতালী বর্ণমালা তৈরী হয়েছিল এবং তার সরকারী স্বীকৃতিও মিলেছিল। তবে নানান কারনে তা টিকে থাকতে পারেনি। বাংলাদেশে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের উদ্যোগে ১৯৯৯ সালের ২০শে মার্চ রাজশাহী জেলার দেওপাড়া ইউনিয়নের বর্ষাপাড়া গ্রামে সাঁওতালী ভাষা শিক্ষাদানের জন্য একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরে সুন্দরপুর বিদ্যালয়, জয়কৃষ্ণপুর বিদ্যালয় এবং সোনাডাইং বিদ্যালয় নামে আরো তিনটি সাঁওতালী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিদ্যালয় গুলোতে মূলতঃ বাংলা হরফেই সাঁওতালী ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে। কুরকু ও নাহিলি নামে সাঁওতালী ভাষার দুটি উপভাষা রয়েছে।
১.২.খ মুন্ডা ভাষাঃ বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে প্রায় ২১৩২ জন মুন্ডা বসবাস করে। মুন্ডাদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। প্রায় তিন-চার হাজার বছর আগে পিজিন ভাষা হিসেবে মুন্ডা ভাষার প্রচলন হয়েছিল। মুন্ডা ভাষার কোন নিজস্ব হরফ নেই। ওরাল লিটারেচারের মাধ্যমেই এই ভাষা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে টিকে আছে।
১.২.গ. বিন্ধ ভাষাঃ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোবরাতলা ইউনিয়নে বিন্ধ-দের বাস। অস্ট্রালয়েড এই বিন্ধ-রা মধ্য-পশ্চিম ভারতের বিন্ধ্য পার্বত্য অঞ্চলের একটি বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী। রিজলী ও ডাল্টন- এর মতে, বিন্ধ-রা ভারতের ছোট বিহার ও ছোটনাগপুর এলাকায় বসবাস করার সময় যে ভাষায় কথা বলত তা ছিল মুন্ডারী শাখার। তবে বর্তমানে বাংলাদেশে বসবাসরত বিন্ধ-রা বাংলা, হিন্দি, মিশ্রিত ভাষা ব্যবহার করে। তাদের নিজস্ব ভাষা বিলুপ্ত প্রায় বলা চলে।
১.২.ঘ. সিং ভাষা ঃ সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, ইশ্বরদী, রাজশাহী জেলার বিভিন্ন গ্রামে প্রায় ৪০০০ জনের অধিক সিং রয়েছে। সিং জাতি আবার তিনটি শাখায় বিভক্ত-রওতিয়া সিং, গন্জু সিং, ও ভূমিজ সিং। এই তিনটি শাখার লোকজনের মুখের ভাষায় পার্থক্য রয়েছে। গন্জু সিং-দের ভাষার সাথে সাদৃশ্য রয়েছে মাহাতোদের ভাষার সাথে। অন্যদিকে রওতিয়া সিং ও ভূমিজ সিং-দের ভাষায় কিছু পার্থক্য থাকলেও তা মোটামুটি একই ধরনের। সিং জাতি ভারতের রাঁচীতে থাকাকালীন যে সিং ভাষা ব্যবহার করত তা আর এখন অবিমিশ্র রূপে নেই ; বাংলা, হিন্দি, বিহারী ভাষার বিভিন্ন উপাদান ঢুকে এক মিশ্র ভাষার রূপ ধারন করেছে । সিং ভাষা-র কোন নিজস্ব বর্ণমালা নেই।
২. ভাষা পরিবার টিবেটো-চীনঃ ভাষাতাত্ত্বিকরা টিবেটো-চীন পরিবারের ভাষা সমূহের বিস্তৃতি মধ্য এশিয়া থেকে দক্ষিণে বার্মা এবং বালিষ্টান থেকে পিকিং পর্যন্ত পূর্ব গোলার্ধের এক বির্স্তীণ অঞ্চল পর্যন্ত বলে উলেখ করেছেন। এই টিবেটো-চীন ভাষা পরিবার দুটি ভাগে বিভক্ত- শ্যামীজ-চাইনীজ, এবং টিবেটো-বর্মণ। টিবেটো-বর্মণ আবার দুইটি ভাগে বিভক্ত- একটি টিবেটো-হিমালয়ান ও অপরটি আসাম-বার্মীজ। আসাম-বার্মীজ আবার কয়েকটি শাখায় বিভক্ত। যেমন- বোডো, নাগা, কুকী-চীন, কাচীন, বার্মীজ, সাক ইত্যাদি।
২.১ বোডো শাখাঃ আচিক, ককবরক, হাজং প্রভৃতি ভাষা সমূহ এই শাখার অর্ন্তভূক্ত।
২.১.ক. আচিক ভাষাঃ বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, মধুপুর, সিলেট অঞ্চলে প্রচুর পরিমানে মান্দি (গারো) -দের বসবাস। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ধারক ও বাহক এই মান্দি জাতির স্বীকৃত ভাষার নাম ‘আচিক’ মান্দিদের মোট ১৩টি গোত্রের মধ্যে বাংলাদেশে ৭টি গোত্রের অবস্থান রয়েছে। গোত্র ভেদে মান্দিদের আলাদা আলাদা উপভাষার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। বর্তমানে আচিক ভাষার নিজস্ব কোন বর্ণমালা নেই। তবে অতীতে এদের বর্ণমালা ও পুস্তকাদি ছিল বলে এক লোককাহিনী প্রচলিত আছে। জন থুসিন রিছিল, ডানিয়েল আর রুরাম , মার্টিন রেমা, প্রদীপ সাংমা নামের চার গবেষক আলাদা আলাদা গবেষণার মাধ্যমে চার ধরনের বর্ণমালার উদ্ভাবন করেছেন। এগুলি নিয়ে এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। অদূর ভবিষ্যতে হয়ত মান্দিদের নিজস্ব সাহিত্য নিজস্ব বর্ণমালায় লিপিবদ্ধ সম্ভব হবে। তবে বর্তমানে রোমান এবং বাংলা হরফেই আচিক সাহিত্য লিপিবদ্ধ হচ্ছে। ভারতের মেঘালয় রাজ্যে বসবাসরত মান্দিরা আচিক ভাষাতেই পড়াশুনা ও সাহিত্য রচনা করে থাকে।
২.১.খ. ককবরক ভাষাঃ বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বসবাসরত প্রায় ত্রিশলক্ষ ত্রিপুরা এই ককবরক ভাষা-য় কথা বলে। মধ্যযুগে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী শাসিত পূর্ববঙ্গের এক বিশাল এলাকায় ককবরক ভাষা (= মানুষের ভাষা) প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্রগ্রাম, চট্রগ্রাম, সিলেট ও কুমিলায় এই ককবরক ভাষাভাষীদের বসবাসরত দেখা যায়। মান্দিদের মতন গোত্র ভেদে এদেরও উপভাষা রয়েছে। ত্রিপুরা জাতি মোট ৩৬টি দফায় বা গোত্রে বিভক্ত। তবে বাংলাদেশে ১৬ টি গোত্রের ১৬টি উপভাষার সন্ধান পাওয়া যায়। অতীতে ককবরক ভাষার নিজস্ব হরফ ছিল বলে লোককাহিনী প্রচলিত রয়েছে। তবে বর্তমানে এর কোন অস্তিত্ব নেই। অনেক আগে থেকেই ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ককবরক ভাষা বাংলা হরফেই লিখিত হয়ে আসছে। সেখানে ২০০০ সাল থেকে ককবরক ভাষায় মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা শুরু হলেও বাংলাদেশে এই ভাষার চর্চা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয়নি। তবে সামাজিক-ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে ককবরক ভাষার সাময়িকী সমূহ বাংলা হরফেই লেখা হয়। বর্তমানে কেউ কেউ রোমান হরফে ককবরক ভাষা চর্চার চেষ্টা করছেন। ককবরক ভাষার ব্যাকরণ অনেক পুরাতন। ধারনা করা হয় প্রায় একশ বছর পূর্বেই ককবরক ব্যাকরণ রচিত হয়েছিল।
২.১.গ. হাজং ভাষাঃ বাংলাদেশে ময়মনসিংহের বিরিশিরি, শ্রীবর্দী, হালুয়াঘাট, নালিতাবাড়ী, সুসং দুর্গাপুর, কলমাকান্দা প্রভৃতি অঞ্চলে প্রায় ১২০০০ হাজং তাদের নিজস্ব হাজং ভাষায় কথা বলে। ডঃ গ্রিয়ারসন হাজং ভাষাকে টিবেটো-বর্মন ভাষা হিসেবে দেখালেও ঐতিহাসিক হ্যামিল্টন-এর মতে হাজং-দের ভাষা বাংলা। হাজং ভাষায় অহমীয় ও কাছারী ভাষারও যথেষ্ট মিশ্রন ঘটেছে। হাজংদের ভাষার কোন নিজস্ব লিপি নেই। তবে বর্তমানে বাংলা বর্ণমালার সাথে একধরনের সাংকেতিক চিহ্ন প্রয়োগের মাধ্যমে হাজং ভাষার লিখিত রূপ দেওয়ার ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে বলে জানা যায়।
২.১.ঘ . লালেংঃ বাংলাদেশের সিলেট সদর থানা ও গোয়ানঘাট থানাদ্বয়ের অন্তর্ভূক্ত ২২/২৩ গ্রামে প্রায় ৪০২ টি পরিবারের ২০৩৩ জন আদিবাসী পাত্র সমপ্রদায়ের বসবাস। পাত্র-রা নিজেদের ভাষার নাম লালেং বলে এবং নিজেদের লালং জাতি বলে পরিচয় দিয়ে থাকে।
২.২. কুকি-চীন শাখাঃ
এই শাখার ভাষা গুলোর মধ্যে বাংলাদেশে প্রচলিত আছে মৈতৈ মণিপুরী, লুসাই, লাইমি , খ্যাং, খুমি, কুকি, পাংখো ইত্যাদি।
২.২.ক. মৈতৈ বা মণিপুরী ভাষাঃ বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলায় মণিপুরী জাতির বসবাস। ভাষাগত দিক থেকে বৃহত্তর মণিপুরী জাতি দুই ভাগে বিভক্ত - মৈতৈ মণিপুরী ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী। মৈতৈ মণিপুরীদের ভাষা হল মৈতৈ ভাষা যা টিবেটো-চীন ভাষা পরিবারের কুকি-চীন শাখার অর্ন্তভূক্ত। আতোম্বাপু শর্মার মতে, মৈতৈ ভাষা প্রায় ৩৪০০ বছরের পুরনো একটি ভাষা। পূর্বে মণিপুরী ভাষার নিজস্ব হরফ ছিল। অধিকাংশের মতে মৈতৈ লিপি ব্রাহ্মী লিপি থেকে উদ্ভূত। ভারতের মণিপুর রাজ্যে এই লিপির প্রথম প্রচলন হয় মহারাজ পাংখংবা-র (৩৩-১৫৪ খ্রীঃ) আমলে। তখন মৈতৈ ভাষার বর্ণমালা ছিল মোট ১৮টি, পরবর্তীতে মহারাজ খাগেম্বার (১৫৯৬-১৬৫১ খ্রীঃ) শাসনামলে আরো ৯টি বর্ণযুক্ত হয়ে মোট বর্ণ সংখ্যা হয় ২৭টি। কিন্তু অষ্টম শতাব্দীর এক কপার পেটের উপর মৈতৈ বর্ণমালার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কার এটাই প্রমান করে যে মৈতৈ বর্ণমালার প্রচলন হয়েছিল মহারাজ পাংখংবা-র অনেক আগে থেকেই। মৈতৈ বর্ণমালার বয়স অনেক পুরোনো হলেও এই বর্ণমালায় রচিত কোন প্রাচীন পুস্তকের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবে ধারনা করা হয় যে দশম শতাব্দীতে সর্বপ্রথম মণিপুরী ভাষায় যে হাতে লেখা পুস্তক বের হয়েছিল তা ছিল বাংলা হরফের। মৈতৈ ভাষায় এবং বাংলা হরফে লিখিত দুটি প্রাচীনতম পুস্তক হল পুইরেইতন খুন্থক (poireiton khunthok) এবং নুমিত কাপ্পা (Numit kappa) অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজা গরীবে নেওয়াজ এর সময়ে বৈষ্ণব ধর্ম রাষ্টীয় স্বীকৃতির পর থেকে মৈতৈ মণিপুরী ভাষা বাংলা লিপিতেই নিয়মিত ভাবে লিখিত হয়ে আসছে। বর্তমানে হারিয়ে যাওয়া লিপি পুনরুদ্ধার ও তা নিয়ে সাহিত্য-সাময়িকী রচনার চেষ্টা করা হচ্ছে। মণিপুরী লিপির একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল যে, এগুলি মানুষের একেকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নামানুযায়ী নামাঙ্কিত। যেমনঃ বাংলা ‘ক’ এর মণিপুরী প্রতিবর্ণ কোক, যার অর্থ মাথা ইত্যাদি।
২.২.খ. খুমি ভাষাঃ প্রায় দেড় হাজারেরও অধিক খুমি বান্দরবান জেলায় এবং থান্চি উপজেলায় বসবাস করে থাকে। খুমি-দের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। হাতে গোনা কয়েকজন বাদে খুমিদের প্রায় সবাই তাদের নিজস্ব ভাষা ব্যতীত অন্য ভাষায় কথা বলতে পারেননা।
২.৩ সাক-লুই শাখাঃ
২.৩.ক. চাক (Chak)t মঙ্গোলয়েড চাক-রা নিজেদেরকে পরিচয় দেয় আসাক্ (Asak) বলে। বর্মীরা চাকমা ও চাক উভয় জনগোষ্টীকেই সাক্ (Sak) বা থেক্ (Thak) বলে থাকে। তবে পার্বত্য চট্রগ্রামের দক্ষিণে বাইশারি, নাক্ষ্যংছড়ি, আলিখ্যং, কামিছড়া, কোয়াংঝিরি, ক্রোক্ষ্যং প্রভৃতি জায়গাতে প্রায় আড়াই হাজার চাক বাস করে যাদের ভাষা চাকমা ভাষার থেকে আলাদা। চাকমা ভাষা ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারের হলেও চাকদের ভাষা তিব্বতী-চীন পরিবারের। চাক বা আসাক্ (Asak) ভাষার সাথে উত্তর বার্মার কাডু (Kadu), গানান (Ganan) জনগোষ্ঠীর ভাষার মিল পাওয়া যায়। চাক ভাষার কোন বর্ণমালা নেই। তবে চাকদের লোক সংস্কৃতি বিভিন্ন লোকগাথাঁ, ধাঁধাঁ, লোকগীতি ইত্যাদি বেশ স্বযং সম্পূর্ন।
২.৩.খ. ঠার বা থেক বা ঠেট ভাষাঃ বর্তমানে বাংলাদেশে ঠার বা থেক বা ঠেট ভাষা-ভাষীর সংখ্যা প্রায় ৪০০০০। ১৬৩৮ খ্রীষ্টাব্দে শরনার্থী আরাকানরাজ বলালরাজার সাথে মনতং (Mon-Tong) জাতির যে ক্ষুদ্র অংশ বাংলাদেশে প্রবেশ করে তাদের আনীত ভাষার নাম ঠার বা ঠেট বা থেক ভাষা। লোকচিকিৎসা (ethno-medical) পেশার সাথে সম্পৃক্ততার দরুন কালক্রমে এরা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল এমনকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে ছড়িয়ে পড়ে এবং বাইদ্যা বা বেদে নামে পরিচিতি লাভ করে। এই মনতং বা বেদেরা নিজ জাতির লোকদের মধ্যে ঠার ভাষা ব্যবহার করলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে এরা বাংলা ভাষাতেই কথা বলে। ঠার ভাষা-র নিজস্ব কোন বর্ণমালা না থাকলেও এদের লোকসাহিত্য বেশ সমৃদ্ধ। ঠার বা থেক বা ঠেট ভাষা -র বার্মা, চীন, লাওসে প্রচলিত কাডু ভাষার সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। উত্তর বার্মায় থেক, সাক, আসাক ইত্যাদি সবগুলোকেই কাডু ভাষার অন্তর্গত বলে ধরা হয়।
২.৪.বার্মীজ শাখা ঃ
২.৪.ক . রাখাইন ভাষাঃ কক্সবাজার, বরগুনা, পটুয়াখালী, চট্রগ্রাম ও পার্বত্য চট্রগ্রামে প্রায় দেড়লক্ষেরও অধিক লোক রাখাইন ভাষায় কথা বলে। রাখাইন ভাষা অত্যন্ত প্রাচীন ও সমৃদ্ধ একটি ভাষা। জানা যায় খ্রীষ্ট পূর্ব ৩৩২৫ সাল হতে রাখাইন রাজা মারায়ু কর্তৃক রাখাইন প্রে বা রাখাইন রাজ্যে প্রতিষ্ঠার পর থেকে সুদীর্ঘ কাল পর্যন্ত রাখাইন ভাষা ছিল ঐ রাজ্যের একমাত্র জাতীয় ভাষা। রাখাইনদের নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। রাখাইন বর্ণমালায় স্বরবর্ণ বা ছারা হল ১২টি এবং ব্যাঞ্জনবর্ণ বা ব্যেঃ মোট ৩৩টি। রাখাইন ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রথমে স্বরবর্ণ এবং পরে ব্যাঞ্জন বর্ণ শেখানো হয়। নিকট অতীত কালেও ক্যং-এ রাখাইন ভাষা শেখানোর প্রথা প্রচলিত থাকলেও বর্তমানে তা কেবল পারিবারিক পর্যায়েই সীমাবদ্ধ। তারপরও বর্তমানে রাখাইনদের শতকরা প্রায় ৭০ জনেরও বেশী লোক নিজ ভাষায় লিখতে ও পড়তে সক্ষম।
৩. ভাষা পরিবার-দ্রাবিড়ঃ দ্রাবিড় শব্দটি প্রসারিত অর্থে দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতের এক বিশাল ভাষা পরিবার। আযর্-দের আগমনের বহু পূর্বেই এই দ্রাবিড় ভাষা সমূহ সমগ্র ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশে দ্রাবিড় ভাষা পরিবারের ভাষা সমূহের মধ্যে কুড়ুখ বা ওঁরাও, পাহাড়িয়া, মাহালি প্রভৃতি ভাষা প্রচলিত।
৩.ক. ওঁরাও বা কুড়ুখ ভাষাঃ লালমণিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও পাবনা ব্যতীত উত্তরবঙ্গের প্রায় সবকটি জেলাতেই ওঁরাও বা কুড়ুখ ভাষা-ভাষীদের বসবাস লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশ এদের মোট সংখ্যা প্রায় ৬৫০০০ জন। কুড়ুখ ভাষাটি আদি ও অবিমিশ্র এবং এটি দিনাজপুর ও নওগাঁ জেলায় বসবাসরত ওরাঁওরা ব্যবহার করলেও সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, বগুড়া, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা ও রংপুর অঞ্চলের ওঁরাওরা মূলত কুড়ুখ্, উড়িয়া, উর্দ্দূ, হিন্দী, ফার্সী ও বাংলা মিশ্রিত ভাষা ব্যবহার করে । কুড়ুখ ভাষা মূলত কথ্য ভাষা। এই ভাষার নিজস্ব কোন বর্ণমালা তৈরি হয়নি।
৩.খ. পাহাড়িয়া ভাষাঃ বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী, দিনাজপুরে প্রায় ৭৩৬১ জন পাহাড়িয়া জাতির লোক বাস করে। পাহাড়িয়া জাতির দুটি শাখা রয়েছে। এদের একটি শাওরিয়া পাহাড়িয়া বা মালের এবং অন্যটি মাল পাহাড়িয়া বা মালো। বাংলাদেশে মাল পাহাড়িয়া-দের সংখ্যা কম। সুনীতি কুমার চট্রোপাধ্যায়, অতীন্দ্র মজুমদার সহ অনেকেই মালপাহাড়িয়া-দের ভাষাকে মাল্তো বলে উলেখ করেছেন। তবে ডঃ শিবানী রায়ের মতে এদের ভাষার নাম বাড়লা, যা আসলে মিশ্র ভাষা এবং দীর্ঘদিন বাঙালিদের পাশাপাশি বসবাসের ফলে তা হয়েছে। আবার সুবোধ ঘোষ মাল পাহাড়িয়া-দের ভাষাকে বাংলা ভাষার অপভ্রংশ হিসেবে দেখিয়েছেন। শাওরিয়া পাহাড়িয়া-দের ভাষাকে কেউ কেউ পলী ভাষা হিসেবে দেখিয়েছেন যা কিনা শাদ্রি-র খুব কাছাকাছি। যা হোক শাওরিয়া ও মাল পাহাড়িয়া-দের ভাষার কোন নিজস্ব বর্ণমালা নেই। মূলত ওরাল লিটারেচারের মাধ্যমেই এই ভাষা তার অতীত ঐতিহ্যগাঁথা ধরে রাখতে পেরেছে।
৩.গ. মাহালি ভাষাঃ বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের মাহালি নামের জাতিগোষ্ঠির ভাষার নাম মাহালি ভাষা, যা দ্রাবিড় ভাষা পরিবার ভুক্ত। বর্তমানে এরা মূলতঃ বাংলা ভাষাতেই কথা বললেও এদের কথ্য ভাষায় আজও মূল মাহালি ভাষার কিছু কিছু শব্দাবলীর প্রচলন রয়ে গেছে। যেমন- দাস্ (পানি), দাকা (ভাত), গুড়া (ঘর), দানড়ী (গরু) ইত্যাদি।
৪. ভাষা পরিবার-ইন্দো-এরিয়ান ঃ নর্ডিক (Nordic) এবং আলপীয় (Alpine) নামের দুই ভিন্ন নরগোষ্ঠী ভারতবর্ষে আর্য ভাষার প্রবর্তন করেছিল। নর্ডিক-দের রচিত ঋগ্বেদের ভাষাই আর্য ভাষার প্রাচীন নিদর্শন। ঋগ্বেদের ভাষা তথা বৈদিক ভাষা পরবর্তিতে ব্যাকরণবিদদের হাত ধরে সংস্কৃত ভাষায় রূপান্তরিত হয়। কালক্রমে এই সংস্কৃত ভাষা লোক মুখে বিকৃত হতে হতে প্রাকৃত ভাষার রূপ নেয়। এই প্রাকৃত ভাষা থেকেই ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারের ভাষা সমূহের উৎপত্তি। বাংলাদেশে ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারভুক্ত কয়েকটি ভাষার পরিচয় নিম্নে দেওয়া হল-
৪.ক. চাকমা ভাষাঃ বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাগুলির মধ্যে চাকমা-রা সংখ্যায় সর্বাধিক (প্রায় তিন লক্ষ)। পার্বত্য চট্রগ্রামে বসবাসরত এই চাকমা জাতির নিজস্ব ভাষা ও সাহিত্য রয়েছে, রয়েছে তাদের নিজস্ব বর্ণমালা। এ বর্ণমালার সাথে সাদৃশ্য রয়েছে বর্মী ও অসমীয় বর্ণমালা। অতীতে চাকমা লিপিতেই চাকমা সাহিত্য রচিত হত। খ্রীষ্টান মিশনারিরাই সর্বপ্রথম ১৮৮৬ সালে ভারতের এলাহাবাদের এক ছাপাখানা হতে চাকমা লিপিতে ও চাকমা ভাষায় অনূদিত বাইবেল প্রকাশ করে। ত্রিশ বা চলিশের দশকে হরকিশোর চাকমা কর্তৃক চাকমা লেখা নামক বই চাকমা লিপিতে প্রকাশিত হয়।
৪.খ. রাজবংশী ভাষাঃ প্রায় সাড়ে সাত হাজারেরও অধিক রাজবংশী রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, বগুড়া, ময়মনসিংহ ও যশোরে বাস করে। ধারনা করা হয় রাজবংশী ভাষা একসময় বৃহত্তর বোডো (Bodo) ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। যদিও রাজবংশীরা বোডো ভাষা হারিয়ে বর্তমানে বাংলা ভাষাতেই কথা বলে; তবু এখনো রাজবংশী ভাষার ক্রিয়াপদ ও বিশেষ্য পদের শেষে ও মাঝে ঙ, ং এর উচ্চারণ, বোডো ভাষার উৎসজাত শব্দাবলী এবং বোডো ভাষার অপভ্রংশ লক্ষ্য করা যায়.
৪.গ. মাহাতো ভাষাঃ মাহাতো জাতির নিজস্ব মাহাতো ভাষা বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ হাজারেরও অধিক লোক ব্যবহার করে। এদের বসবাস সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ ও রায়গঞ্জ এবং বগুড়া জেলার শেরপুর থানার অর্ন্তগত গ্রাম গুলোতে। মাহাতোরা নিজেদের ভাষাকে নাগ্রী ভাষা বলে উলেখ করে। মাহাতোদের ভাষাকে কেউ কেউ শাদ্রি ভাষাও বলে থাকেন। মাহাতো ভাষায় হিন্দী, উর্দ্দূ, বাংলা, অহমীয়া ভাষার মিশ্রণ ঘটেছে। মাহাতো ভাষার নিজস্ব কোন হরফ নেই।
৪.ঘ. বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাঃ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী-দের বসবাস সিলেট বিভাগে। আগেই বলা হয়েছে জাতিগত ভাবে এক হলেও মণিপুরী জাতি ভাষাগত ভাবে দুই ভাগে বিভক্ত। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার দুটি উপভাষা রয়েছে- এদের একটি রাজার গাঙ (= রাজার গ্রাম) এবং অপরটি মাদাই গাঙ (= রানীর গ্রাম)। ডঃ কে পি সিন্হা-র মতে নব ইন্দো-আর্য ভাষার উৎপত্তি কালে বা সামান্য পরে অর্থাৎ ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতকে ইন্দো-আর্য ভাষার থেকে পৃথক বৈশিষ্ট্য নিয়ে স্বতন্ত্র্য ভাষা হিসেবে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা সর্বপ্রথম ভারতের মণিপুর রাজ্যে প্রচলিত হয়ে থাকে। এই নব্যপ্রচলিত বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় ষোড়শ শতাব্দীতে। ত্রয়োদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈ জনগোষ্ঠীর ঘনিষ্ট সংস্পর্শের কারনে এসময় বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষার ব্যাপক মৈতৈ শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটে। উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী-রা মণিপুর ছেড়ে ত্রিপুরা, আসাম ও বাংলাদেশের সিলেটে আশ্রয় গ্রহন করে। এসময় কালেই মূলতঃ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষায় ব্যাপক ভাবে ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারের শব্দাবলী প্রবেশ করে। অহমিয় ও বাংলা ভাষার সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যাবলীর মিল থাকার কারনে অনেকেই এই ভাষাকে অহমিয় ও বাংলা-র একটি উপভাষা হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করেন। ডঃ কে. পি. সিন্হার মতে এই বৈশিষ্ট্যগত মিল সম্ভব হয়েছে বাংলা, অহমিয় ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার উৎপত্তি একই উৎস থেকে (মাগ্দী প্রাকৃত) বলে।
বহুজাতিক ও বহুভাষিক রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বার ভাষা সমূহ সবসময় বৃহত্তর জাতির ভাষার চাপে কোনঠাসা হয়ে পড়ে। সেখানে বৃহত্তর জাতির ভাষা বা তাদের সুবিধা মতন অন্য কোন ভাষা প্রধান হয়ে উঠবার এবং জোড়পূর্বক একভাষিকতা চাপানোর একটা অসৎ প্রবনতা পরিলক্ষিত হয়। বুর্জোয়া রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এই প্রবনতার মাত্রা অত্যন্ত প্রকট ও খোলামেলা রূপেই দেখা যায়। যদিও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নেও রুশ ভাষার জৌলুস এবং আধিপত্যের কাছে লেট্, এস্তোনিয়া সহ অন্যান্য ভাষা গুলোর অবস্থা ছিলো অত্যন্ত ম্রিয়মান। আমাদের বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতেও বাঙালি ভিন্ন অন্যান্য জাতিসত্ত্বার ভাষা সমূহের অবস্থা অত্যন্ত কোনঠাসা। বাংলাদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা সমূহের সবগুলোই মূলতঃ দ্বি-ভাষী (Bilingual) নিজ পরিবার বা নিজ জাতিসত্ত্বার ভিতরে এরা নিজ মাতৃভাষায় কথা বললেও বাইরের কারো সাথে এরা বাংলাতেই কথা বলে। অনেক গুলি জাতিসত্ত্বা নানাবিধ কারনে আজ তাদের নিজ মাতৃভাষা হারিয়ে বাংলা ভাষাতেই কথা বলে। এদের মধ্যে বিন্ধ, কোচ, রাজবংশী, পাহাড়িয়া, হো, বর্মন, ইত্যাদি উলেখযোগ্য। সত্তরের দশকে চাকমা ও মারমা-রা ক্যং-এ তাদের নিজস্ব লিপিতে নিজ নিজ ভাষার চর্চা করত। বিভিন্ন কারনে আজ সেই ব্যবস্থাও বন্ধ। নতুন প্রজন্মের চাকমা-রা আজ আর তাদের নিজ বর্ণমালার সাথে পরিচিত নয়। মাহালি, বুনো, বাগদী জাতিসত্ত্বার লোকজন তাদের মাতৃভাষায় কথা বলতে অক্ষম। মনতং বা বেদে-দের ঠেট বা ঠার ভাষা তার নিজস্ব উপাদান হারাতে হারাতে রিক্ত হতে চলেছে। প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার অভাবে মণিপুরী, ককবরক, খাসিয়া, সাঁওতাল, ওঁরাও ভাষা গুলো ধীরে ধীরে বিলুপ্তির দিকে পা বাড়াচ্ছে। এই হচ্ছে আজ বাংলাদেশের ভাষা সমূহের সামগ্রিক চিত্র। এই যে ভাষা গুলির হারিয়ে যাওয়া বা ধ্বংসের প্রান্তিক সীমায় অগ্রসর হওয়া তা শুধু মাত্র একেকটি ভাষার হারিয়ে যাওয়া বা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পূর্ব চিহ্নমাত্র নয়; এই হারিয়ে যাওয়া হল একেকটি জাতিসত্তার নিজস্ব আবেগ, অনুভূতি, স্বপ্ন, লোকায়ত জ্ঞান, সংস্কৃতির হারিয়ে যাওয়া। আর কোন জাতির এগুলি হারানোর অর্থ হল পৃথিবীর বুক থেকে সেই জাতির অস্তিত্ব চিরতরে মুছে যাওয়া। ইউনেস্কো কর্তৃক একুশে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার মূল লক্ষ্য হল পৃথিবীতে ভাষার বহুত্ব, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও ভিন্নতাকে সংরক্ষণ ও উন্নয়ন। যে বাঙালি জাতিকে ১৯৫২ সালে চরম আত্মত্যাগ করতে হয়েছিল নিজ মায়ের ভাষা রক্ষার জন্য, সেই জাতির স্বাধীন রাষ্ট্রভূমিতে বসবাসরত অন্যান্য জাতিসত্ত্বা সমূহের ভাষা গুলোর যে করুন অবস্থা তা সত্যিই লজ্জাজনক, দুঃখজনক। স্বাধীনতার ৩৩ বছর পরেও এই বাংলাদেশ রাষ্ট্র বাঙালি ভিন্ন অপরাপর জাতিসত্ত্বার ভাষা সমূহের সংরক্ষণ, উন্নয়নের ব্যাপারে কোন কার্যকর পদক্ষেপ তো নেয়েইনি বরং এই সমস্ত ভাষা সমূহের অধিকারী বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার অস্তিত্বও স্বীকার করেনি। বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় এখানকার ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা সমূহের নিজ মাতৃভাষাতে লেখাপড়া করার কোন সুযোগ রাখা হয়নি। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেই মণিপুরী, খাসিয়া, মান্দি, সাঁওতাল সহ বিভিন্ন জাতিসত্ত্বা স্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও নিজ নিজ মাতৃভাষায় পড়াশোনা করছে। এখন ‘একুশে’-র অহংঙ্কার ধারনকারী এই বাংলাদেশ রাষ্ট্র কি পারবে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে উপস্থিত এই সমস্ত ভাষা গুলি রক্ষার কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ? তার বিশাল ভাষা জাদুঘরকে জীবন্ত রাখতে ? নাকি আগামী ৩০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যেই প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের অধিকারী এই বাংলাদেশ হারাবে তার ভাষার বৈচিত্র্যতাকে, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যতাকে ?
উলেখ্যপঞ্জি ঃ
গ্রন্থ সমূহঃ
১. Chittagonj Hill Tracts- R. H. Sneyd Hutchinson Vivek Publishing company, DelhiFirst Published 1901, Reprint 1978 .
২.The peoples of India- Anderson, J.DBimla pub. ।। First Published 1913.
৩. An Etymological Dictionary of Bishnupriya Manipuri- Dr. K. P. Sinha Puthi, Calcutta 1986.
৪. ভাষাতত্ত্ব - অতীন্দ্র মজুমদার।। নয়াপ্রকাশ, কলিকাতা।। ১৯৯৭।
৫.ভারতের ভাষা ও ভাষা সমস্যা- সুনীতকুমার চট্রোপাধ্যায়।। রূপা অ্যান্ড কোম্পানী, কলিকাতা, জানুয়ারী ১৯৯২।
৬. ভারত সংস্কৃতি- সুনীতকুমার চট্রোপাধ্যায়।। মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃলিঃ কলকাতা।। আষাঢ় ১৪০৪।
৭. ভারতের আদিবাসী- সুবোধ ঘোষ।। ন্যাশনাল বুক এজেন্সী প্রাঃ লিঃ, কলকাতা।। b‡f¤^i ২০০০।
৮.ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়- ডঃ অতুল সুর।। সাহিত্যলোক, কলকাতা।। জুলাই ১৯৮৮।
৯.ভাষা, দেশ, কাল- পবিত্র সরকার।। জি.এ.ই. পাবলিশার্স।। বৈশাখ ১৩৯২।
১০. উপভাষা চর্চার ভূমিকা- মনিরুজ্জামান।। বাংলা একাডেমী, ঢাকা।। মে, ১৯৯৪।
১১. ককবরক ভাষা ও সাহিত্য- কুমুদ কুন্ডু চৌধুরী।। অক্ষর পাবলিকেশান্স, আগরতলা।।
১২.পার্বত্য চট্রগ্রামের উপজাতীয় ভাষা- সুগত চাকমা।। উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনষ্টিটিউট।। রাঙ্গমাটি।। মার্চ ১৯৮৮।১৩ বাংলাদেশের ১৩. গারো সমপ্রদায়- সুভাষ জেংচাম।। বাংলা একাডেমী. ঢাকা।। ১৯৯৪।
১৪.চাকমা পরিচিতি- সুগত চাকমা।। বরগাঙ পাবলিকেশন্স, রাঙ্গামাটি।। অক্টোবর ১৯৮৩।
১৫. বাংলাদেশের সাঁওতালঃ জীবন ও সংস্কৃতি- আখতার উদ্দিন মানিক।। উত্তরা প্রকাশনা ,মোহাম্মদপুর,ঢাকা।। wW‡m¤^i ১৯৯৮ ১৬.উত্তরবঙ্গের আদিবাসীঃ লোকজীবন ও লোকসাহিত্যঃ ওঁরাও- ডঃ মুহাম্মদ আব্দুল জলিল।। বিশ্ব সাহিত্য ভবন, ঢাকা।। মে ২০০১।
১৭. আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতিঃ প্রসঙ্গ নদীয়া জেলা- ডঃ শিবানী রায় (মওল)।। পুস্তক বিপনি, বেনিয়াটোলা লেন, কলিকাতা।। অক্টোবর ২০০২।
১৮. সিলেটের নিঃস্ব আদিবাসী পাত্র- ডঃ রতন লাল চক্রবর্তী।। মওলা ব্রাদার্স, ঢাকা।। মে ২০০০।
১৯. বাংলাদেশের মণিপুরীঃ ত্রয়ী সংস্কৃতির ত্রিবেনী সঙ্গমে- এ কে শেরাম।। আগামী প্রকাশনী; ঢাকা।। ১৯৯৬।
২০. বাংলাদেশে রাখাইন সমপ্রদায়ঃ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও জীবনধারা-মং বা অং (মং বা)।।প্রকাশক-লেখক।।এপ্রিল ২০০৩ খ্রী.।
প্রবন্ধ/পত্রিকাঃ
১. হাজং জীবনের ইতিবৃত্ত- মুজিব মেহেদী।। বাংলাদেশের উপজাতি ও আদিবাসীঃ অংশীদারিত্বের নতুন দিগন্ত- সম্পাদনাঃ হাফিজ রশীদ খান।। পাঠক সমাবেশ, ঢাকা।। ১৯৯৩।
২. বরেন্দ্র অঞ্চলের বিন্ধ জাতিগোষ্ঠীঃ সামাজিক-রাজনৈতিক পরিচয় উদ্ঘাটন- ডঃ মোঃ আব্দুর রশীদ সিদ্দিকী।। আইবিএস জার্নাল।। ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।। ১০ম সংখ্যা ১৪০৯
৩. মানুষ- সম্পাদনাঃ মোহাম্মদ মহসীন।। এফআইভিডিবি, খাদিমনগর, সিলেট।। †m‡Þ¤^iÑ অক্টোবর ১৯৯৭।
(This article was published in `Mhrittika’-vol.-1, issue-1; editor-Jewel Bin Zahir, Parag Ritchil, Dopor Mitra; Dhaka, August 2004)
Subscribe to:
Posts (Atom)