জুয়েল বিন জহির
ভাষা মানব সভ্যতার বিবর্তনের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। মানুষের বাগযন্ত্র কর্তৃক উৎসারিত ধ্বণি অর্থময়তা লাভের মাধ্যমে সৃষ্টি করেছে ভাষার। ধ্বণির অর্থময়তা স্থান, কাল, জাতিভেদে বিভিন্ন হতে পারে। আর ধ্বণির এই বহুমাত্রিক অর্থময়তাই পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ভেতরে সৃষ্টি করেছে বিভিন্ন ভাষার। ভাষাভিত্তিক ঐক্যকে কাজে লাগিয়েই নিজস্ব যুগবাহিত সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, লোকায়ত জ্ঞানের আদান-প্রদানের মাধ্যমে কোন জনগোষ্ঠি গড়ে তোলে নিজস্ব স্বাজাত্যবোধ, স্বাতন্ত্র্যবোধের নিজ ভাষার মাধ্যমেই কোন জাতিসত্তার মধ্যকার সংস্কৃতিগত বিভিন্ন উপাদানগুলি তার আপন লয়ে প্রকাশিত, বিকশিত, ও সঞ্চালিত হয় যুগযুগান্ত ধরে নানান পরিবর্তন-পরিবর্ধন-পরিমার্জনের মধ্য দিয়ে। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের রাজনৈতিক সীমানার পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা। রক্তাক্ত সংগ্রামের পথ ধরে অর্জিত এই বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আজ বিশ্বব্যাপী। বাঙালি জাতির গৌরবের একুশে ফেব্রুয়ারি আজ পৃথিবীব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে মর্যাদা লাভ করেছে। বাংলাদেশের ১৪ কোটি মানুষের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মাতৃভাষা হল বাংলা; বাকি প্রায় ত্রিশ লক্ষ মানুষের মাতৃভাষায় রয়েছে ব্যাপক বৈচিত্র্যতা। এই ত্রিশ লক্ষ মানুষ প্রায় ৪৫টি পৃথক পৃথক জাতিসত্ত্বায় বিভক্ত। তাদের শারীরিক ও মানসিক গড়ন, সামাজিক, ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রতা বৃহত্তর বাঙালি জাতির জীবন-সংস্কৃতি থেকে সহজেই আলাদা করা যায়। এই ৪৫টি জাতিসত্ত্বাই আবার নিজেদের মধ্যে ভাষা, সমাজ-সংস্কৃতিতে একে অন্যের থেকে পৃথক এবং স্বাতন্ত্রতার অধিকারী। এই জাতিসত্তা গুলির নিজ নিজ ভাষা রয়েছে, রয়েছে তাদের বর্ণাঢ্য লোক সাহিত্য, লোক সংস্কৃতি; যা বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে করে তুলেছে অধিকতর সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়। ভাষার সংখ্যাগত দিক বিবেচনায় ক্ষুদ্রায়তনের এই বাংলাদেশ নামক ব-দ্বীপটিকে ভাষার জীবন্ত জাদুঘর বলা যেতে পারে। বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন জাতির ভাষা সমূহকে নিমো্নক্ত ভাবে শ্রেণীবদ্ধ করা যেতে পারে-
১. ভাষা পরিবার- অস্ট্রিক ভাষা সমূহ
১.১. মোন-খমের শাখা- খাসিয়া
১.২. মুন্ডারী শাখা- সাঁওতাল, মুন্ডা, সিং, বিন্ধ,হো ইত্যাদি।
২. ভাষা পরিবার- টিবেটো-চীন
২.১. বোডো শাখা- আচিক,ককবরক,হাজং,লালেং, পালিয়া ইত্যাদি।
২.২. কুকি-চীন শাখা- মৈতৈ মণিপুরী, খুমি, লাইমি, কুকি, ম্রো, পাংখো, ইত্যাদি।
২.৩. সাক্-লুই শাখা- চাক, থেক বা ঠেট বা থেক , লুসাই।
২.৪. বার্মীজ শাখা- রাখাইন বা ম্রাইনমা
৩. ভাষা পরিবার- দ্রাবিড় কুরুখ, পাহাড়িয়া, মাহালি ইত্যাদি।
৪. ভাষা পরিবার -ইন্দো-এরিয়ান বাংলা, চাকমা, তন্চংগা, রাজবংশী, কোচ, মাহাতো, বসাক,বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী,
বিহারী, ভূইমালি ইত্যাদি।
এবার বাংলাদেশে প্রচলিত বিভিন্ন ভাষা পরিবারের অন্তর্ভূক্ত কয়েকটি ভাষার সাধারণ পরিচয় তুলে ধরা যাক-
১. ভাষা পরিবার- অস্ট্রিকঃ ভাষা তাত্ত্বিকদের দীর্ঘপরিশ্রম লব্ধ গবেষণায় যতদুর জানা গেছে বাংলার সর্বপ্রাচীন ভাষা ছিল অস্ট্রিক ভাষা পরিবারের ভাষা। ভারতবর্ষে প্রচলিত এই ভাষা পরিবারের অন্তর্ভূক্ত ভাষা সমূহ অস্ট্রো-এশিয়াটিক শাখা--র ভাষা বলে পরিচিত। বাংলাদেশে প্রচলিত অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা সমূহ আবার দুইটি শাখায় বিভক্ত-মোন-খমের ও মুন্ডারী ।
১.১ মোন-খমের শাখাঃ বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় একশটিরও অধিক ভাষা মোন-খমের শাখা-র অন্তর্ভূক্ত। এই ভাষাগুলি পূর্ব ভারত থেকে ভিয়েতনাম এবং ইউনান (Yunnan) থেকে মালয়েশিয়া ও আন্দামান সাগরের নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে ছড়িয়ে রয়েছে। বাংলাদেশে এই শাখার ভাষার মধ্যে রয়েছে খাসিয়া ভাষা।
১.১.ক খাসিয়া ভাষাঃ বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে বসবাসকারী মঙ্গোলয়েড খাসিয়া জাতির ভাষা বর্তমানে প্রায় ১২,২৮০ জন লোকের মুখে প্রচলিত। ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্য মিলিয়ে প্রায় দশ লক্ষ লোক খাসিয়া ভাষায় কথা বলে। খাসিয়া ভাষার সাথে বার্মার মোঁয়ে (Mon), পলং (Palng) ভাষার এবং উপমহাদেশের তালাং, খেড়, সুক, আনাম, খামেন, চোয়েম, ক্ষং, লেমেত, ওয়া প্রভৃতি জাতিসত্বা সমূহের ভাষার মিল দেখিয়েছেন বিভিন্ন ভাষাতাত্ত্বিকরা। খাসিয়া ভাষা মৌখিক ভাষা। এই ভাষার কোন নিজস্ব বর্ণমালা নেই। তবে খাসিয়াদের মধ্যে খ্রীষ্টীয় ধর্ম অনুপ্রবেশের পর এই ভাষার লিখিত রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ১৮১২ খ্রীষ্টাব্দে কৃষ্ণচন্দ্র পাল নামক একজন ধর্মযাজক সর্বপ্রথম বাংলা বর্ণমালায় ও খাসিয়া ভাষায় নিউ টেস্টামেন্ট বাইবেল অনুবাদ করেন। ১৮৩৮ সালের পরে ওয়েল্স মিশনারী দলের টমাস জোন্স রোমান হরফে খাসিয়া ভাষা লেখার প্রচলন করেন। টমাস জোন্স কে এ জন্য খাসিয়া বর্ণমালার জনক বলা হয়। তখন থেকে অদ্যাবধি খাসিয়া ভাষা রোমান হরফেই লেখা হয়। খাসিয়া ভাষার উপভাষা রয়েছে। এদের মধ্যে পাঁড়, লিংগাম, ওয়ার উলেখযোগ্য।
১.২ মুন্ডারী শাখাঃ অধিকাংশ ভাষাতত্ত্ব্ববিদ মুন্ডারী শাখাকে অস্ট্রিক ভাষা গোষ্ঠীর মধ্যে বিবেচনা করলেও এর ভিন্ন মতও রয়েছে। Hevesy-i মতে এই Finno-Ugrian ভাষা গোষ্ঠীর কোন এক জাতি সুদূর অতীতে হয়ত ভারতবর্ষে চলে আসে এবং তাদের আনীত ভাষা পরবর্তীতে স্থানীয় অন্য কোন ভাষার প্রভাবে মুন্ডারী শাখার ভাষার সৃষ্টি করে। কিন্তু Finno-Ugrian ভাষা-ভাষীদের অতীতে ভারতবর্ষে আগমনের কোন হদিস এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তাই Hevesy-i মতামতকে নিশ্চিত বিবেচনায় না এনে আমাদের বাংলাদেশে প্রচলিত মুন্ডারী শাখার ভাষা সমূহের আলোচনা করা যাক-
১.২.ক সাঁওতালী ভাষাঃ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী, নওগাঁ, দিনাজপুর, বগুড়া, রংপুর, ঠাকুরগাঁ প্রভৃতি অঞ্চলে প্রায় দুই লক্ষের মত সাঁওতাল বসবাস করে। তবে ভারত ও বাংলাদেশ মিলিয়ে পৃথিবীতে প্রায় অর্ধকোটি লোক সাঁওতালী ভাষায় কথা বলে। ডঃ ক্ষুদিরাম বাংলা ভাষার শতকরা পঁয়তালিশ এবং সংস্কৃত ভাষার শতকরা চলিশ ভাগ শব্দই সাঁওতালী ভাষাজাত বলে উলেখ করেছেন। হাজার হাজার বছর ধরে বংশপরম্পরায় মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে আসা এই সাঁওতালী ভাষার কোন নিজস্ব বর্ণমালা নেই। তবে খ্রীষ্টান মিশনারীদের হাতে সর্বপ্রথম সাঁওতালী ভাষার লিখিত রূপ দেওয়া হয় রোমান হরফে। জানা যায়, ১৮৬৯ সালে ভারতের সাঁওতাল পরগনার লুথারিয়ান মিশনে স্থাপিত একটি ছাপাখানা থেকে সাঁওতাল ভাষার ব্যাকরণ ও অনেক বই প্রকাশিত হয়। পশ্চিমবঙ্গে রঘূনাথ মুর্মূ কতৃর্ক অলচিকি নামে সাঁওতালী বর্ণমালা তৈরী হয়েছিল এবং তার সরকারী স্বীকৃতিও মিলেছিল। তবে নানান কারনে তা টিকে থাকতে পারেনি। বাংলাদেশে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের উদ্যোগে ১৯৯৯ সালের ২০শে মার্চ রাজশাহী জেলার দেওপাড়া ইউনিয়নের বর্ষাপাড়া গ্রামে সাঁওতালী ভাষা শিক্ষাদানের জন্য একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরে সুন্দরপুর বিদ্যালয়, জয়কৃষ্ণপুর বিদ্যালয় এবং সোনাডাইং বিদ্যালয় নামে আরো তিনটি সাঁওতালী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিদ্যালয় গুলোতে মূলতঃ বাংলা হরফেই সাঁওতালী ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে। কুরকু ও নাহিলি নামে সাঁওতালী ভাষার দুটি উপভাষা রয়েছে।
১.২.খ মুন্ডা ভাষাঃ বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে প্রায় ২১৩২ জন মুন্ডা বসবাস করে। মুন্ডাদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। প্রায় তিন-চার হাজার বছর আগে পিজিন ভাষা হিসেবে মুন্ডা ভাষার প্রচলন হয়েছিল। মুন্ডা ভাষার কোন নিজস্ব হরফ নেই। ওরাল লিটারেচারের মাধ্যমেই এই ভাষা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে টিকে আছে।
১.২.গ. বিন্ধ ভাষাঃ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোবরাতলা ইউনিয়নে বিন্ধ-দের বাস। অস্ট্রালয়েড এই বিন্ধ-রা মধ্য-পশ্চিম ভারতের বিন্ধ্য পার্বত্য অঞ্চলের একটি বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী। রিজলী ও ডাল্টন- এর মতে, বিন্ধ-রা ভারতের ছোট বিহার ও ছোটনাগপুর এলাকায় বসবাস করার সময় যে ভাষায় কথা বলত তা ছিল মুন্ডারী শাখার। তবে বর্তমানে বাংলাদেশে বসবাসরত বিন্ধ-রা বাংলা, হিন্দি, মিশ্রিত ভাষা ব্যবহার করে। তাদের নিজস্ব ভাষা বিলুপ্ত প্রায় বলা চলে।
১.২.ঘ. সিং ভাষা ঃ সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, ইশ্বরদী, রাজশাহী জেলার বিভিন্ন গ্রামে প্রায় ৪০০০ জনের অধিক সিং রয়েছে। সিং জাতি আবার তিনটি শাখায় বিভক্ত-রওতিয়া সিং, গন্জু সিং, ও ভূমিজ সিং। এই তিনটি শাখার লোকজনের মুখের ভাষায় পার্থক্য রয়েছে। গন্জু সিং-দের ভাষার সাথে সাদৃশ্য রয়েছে মাহাতোদের ভাষার সাথে। অন্যদিকে রওতিয়া সিং ও ভূমিজ সিং-দের ভাষায় কিছু পার্থক্য থাকলেও তা মোটামুটি একই ধরনের। সিং জাতি ভারতের রাঁচীতে থাকাকালীন যে সিং ভাষা ব্যবহার করত তা আর এখন অবিমিশ্র রূপে নেই ; বাংলা, হিন্দি, বিহারী ভাষার বিভিন্ন উপাদান ঢুকে এক মিশ্র ভাষার রূপ ধারন করেছে । সিং ভাষা-র কোন নিজস্ব বর্ণমালা নেই।
২. ভাষা পরিবার টিবেটো-চীনঃ ভাষাতাত্ত্বিকরা টিবেটো-চীন পরিবারের ভাষা সমূহের বিস্তৃতি মধ্য এশিয়া থেকে দক্ষিণে বার্মা এবং বালিষ্টান থেকে পিকিং পর্যন্ত পূর্ব গোলার্ধের এক বির্স্তীণ অঞ্চল পর্যন্ত বলে উলেখ করেছেন। এই টিবেটো-চীন ভাষা পরিবার দুটি ভাগে বিভক্ত- শ্যামীজ-চাইনীজ, এবং টিবেটো-বর্মণ। টিবেটো-বর্মণ আবার দুইটি ভাগে বিভক্ত- একটি টিবেটো-হিমালয়ান ও অপরটি আসাম-বার্মীজ। আসাম-বার্মীজ আবার কয়েকটি শাখায় বিভক্ত। যেমন- বোডো, নাগা, কুকী-চীন, কাচীন, বার্মীজ, সাক ইত্যাদি।
২.১ বোডো শাখাঃ আচিক, ককবরক, হাজং প্রভৃতি ভাষা সমূহ এই শাখার অর্ন্তভূক্ত।
২.১.ক. আচিক ভাষাঃ বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, মধুপুর, সিলেট অঞ্চলে প্রচুর পরিমানে মান্দি (গারো) -দের বসবাস। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ধারক ও বাহক এই মান্দি জাতির স্বীকৃত ভাষার নাম ‘আচিক’ মান্দিদের মোট ১৩টি গোত্রের মধ্যে বাংলাদেশে ৭টি গোত্রের অবস্থান রয়েছে। গোত্র ভেদে মান্দিদের আলাদা আলাদা উপভাষার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। বর্তমানে আচিক ভাষার নিজস্ব কোন বর্ণমালা নেই। তবে অতীতে এদের বর্ণমালা ও পুস্তকাদি ছিল বলে এক লোককাহিনী প্রচলিত আছে। জন থুসিন রিছিল, ডানিয়েল আর রুরাম , মার্টিন রেমা, প্রদীপ সাংমা নামের চার গবেষক আলাদা আলাদা গবেষণার মাধ্যমে চার ধরনের বর্ণমালার উদ্ভাবন করেছেন। এগুলি নিয়ে এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। অদূর ভবিষ্যতে হয়ত মান্দিদের নিজস্ব সাহিত্য নিজস্ব বর্ণমালায় লিপিবদ্ধ সম্ভব হবে। তবে বর্তমানে রোমান এবং বাংলা হরফেই আচিক সাহিত্য লিপিবদ্ধ হচ্ছে। ভারতের মেঘালয় রাজ্যে বসবাসরত মান্দিরা আচিক ভাষাতেই পড়াশুনা ও সাহিত্য রচনা করে থাকে।
২.১.খ. ককবরক ভাষাঃ বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বসবাসরত প্রায় ত্রিশলক্ষ ত্রিপুরা এই ককবরক ভাষা-য় কথা বলে। মধ্যযুগে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী শাসিত পূর্ববঙ্গের এক বিশাল এলাকায় ককবরক ভাষা (= মানুষের ভাষা) প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্রগ্রাম, চট্রগ্রাম, সিলেট ও কুমিলায় এই ককবরক ভাষাভাষীদের বসবাসরত দেখা যায়। মান্দিদের মতন গোত্র ভেদে এদেরও উপভাষা রয়েছে। ত্রিপুরা জাতি মোট ৩৬টি দফায় বা গোত্রে বিভক্ত। তবে বাংলাদেশে ১৬ টি গোত্রের ১৬টি উপভাষার সন্ধান পাওয়া যায়। অতীতে ককবরক ভাষার নিজস্ব হরফ ছিল বলে লোককাহিনী প্রচলিত রয়েছে। তবে বর্তমানে এর কোন অস্তিত্ব নেই। অনেক আগে থেকেই ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ককবরক ভাষা বাংলা হরফেই লিখিত হয়ে আসছে। সেখানে ২০০০ সাল থেকে ককবরক ভাষায় মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা শুরু হলেও বাংলাদেশে এই ভাষার চর্চা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয়নি। তবে সামাজিক-ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে ককবরক ভাষার সাময়িকী সমূহ বাংলা হরফেই লেখা হয়। বর্তমানে কেউ কেউ রোমান হরফে ককবরক ভাষা চর্চার চেষ্টা করছেন। ককবরক ভাষার ব্যাকরণ অনেক পুরাতন। ধারনা করা হয় প্রায় একশ বছর পূর্বেই ককবরক ব্যাকরণ রচিত হয়েছিল।
২.১.গ. হাজং ভাষাঃ বাংলাদেশে ময়মনসিংহের বিরিশিরি, শ্রীবর্দী, হালুয়াঘাট, নালিতাবাড়ী, সুসং দুর্গাপুর, কলমাকান্দা প্রভৃতি অঞ্চলে প্রায় ১২০০০ হাজং তাদের নিজস্ব হাজং ভাষায় কথা বলে। ডঃ গ্রিয়ারসন হাজং ভাষাকে টিবেটো-বর্মন ভাষা হিসেবে দেখালেও ঐতিহাসিক হ্যামিল্টন-এর মতে হাজং-দের ভাষা বাংলা। হাজং ভাষায় অহমীয় ও কাছারী ভাষারও যথেষ্ট মিশ্রন ঘটেছে। হাজংদের ভাষার কোন নিজস্ব লিপি নেই। তবে বর্তমানে বাংলা বর্ণমালার সাথে একধরনের সাংকেতিক চিহ্ন প্রয়োগের মাধ্যমে হাজং ভাষার লিখিত রূপ দেওয়ার ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে বলে জানা যায়।
২.১.ঘ . লালেংঃ বাংলাদেশের সিলেট সদর থানা ও গোয়ানঘাট থানাদ্বয়ের অন্তর্ভূক্ত ২২/২৩ গ্রামে প্রায় ৪০২ টি পরিবারের ২০৩৩ জন আদিবাসী পাত্র সমপ্রদায়ের বসবাস। পাত্র-রা নিজেদের ভাষার নাম লালেং বলে এবং নিজেদের লালং জাতি বলে পরিচয় দিয়ে থাকে।
২.২. কুকি-চীন শাখাঃ
এই শাখার ভাষা গুলোর মধ্যে বাংলাদেশে প্রচলিত আছে মৈতৈ মণিপুরী, লুসাই, লাইমি , খ্যাং, খুমি, কুকি, পাংখো ইত্যাদি।
২.২.ক. মৈতৈ বা মণিপুরী ভাষাঃ বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলায় মণিপুরী জাতির বসবাস। ভাষাগত দিক থেকে বৃহত্তর মণিপুরী জাতি দুই ভাগে বিভক্ত - মৈতৈ মণিপুরী ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী। মৈতৈ মণিপুরীদের ভাষা হল মৈতৈ ভাষা যা টিবেটো-চীন ভাষা পরিবারের কুকি-চীন শাখার অর্ন্তভূক্ত। আতোম্বাপু শর্মার মতে, মৈতৈ ভাষা প্রায় ৩৪০০ বছরের পুরনো একটি ভাষা। পূর্বে মণিপুরী ভাষার নিজস্ব হরফ ছিল। অধিকাংশের মতে মৈতৈ লিপি ব্রাহ্মী লিপি থেকে উদ্ভূত। ভারতের মণিপুর রাজ্যে এই লিপির প্রথম প্রচলন হয় মহারাজ পাংখংবা-র (৩৩-১৫৪ খ্রীঃ) আমলে। তখন মৈতৈ ভাষার বর্ণমালা ছিল মোট ১৮টি, পরবর্তীতে মহারাজ খাগেম্বার (১৫৯৬-১৬৫১ খ্রীঃ) শাসনামলে আরো ৯টি বর্ণযুক্ত হয়ে মোট বর্ণ সংখ্যা হয় ২৭টি। কিন্তু অষ্টম শতাব্দীর এক কপার পেটের উপর মৈতৈ বর্ণমালার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কার এটাই প্রমান করে যে মৈতৈ বর্ণমালার প্রচলন হয়েছিল মহারাজ পাংখংবা-র অনেক আগে থেকেই। মৈতৈ বর্ণমালার বয়স অনেক পুরোনো হলেও এই বর্ণমালায় রচিত কোন প্রাচীন পুস্তকের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবে ধারনা করা হয় যে দশম শতাব্দীতে সর্বপ্রথম মণিপুরী ভাষায় যে হাতে লেখা পুস্তক বের হয়েছিল তা ছিল বাংলা হরফের। মৈতৈ ভাষায় এবং বাংলা হরফে লিখিত দুটি প্রাচীনতম পুস্তক হল পুইরেইতন খুন্থক (poireiton khunthok) এবং নুমিত কাপ্পা (Numit kappa) অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজা গরীবে নেওয়াজ এর সময়ে বৈষ্ণব ধর্ম রাষ্টীয় স্বীকৃতির পর থেকে মৈতৈ মণিপুরী ভাষা বাংলা লিপিতেই নিয়মিত ভাবে লিখিত হয়ে আসছে। বর্তমানে হারিয়ে যাওয়া লিপি পুনরুদ্ধার ও তা নিয়ে সাহিত্য-সাময়িকী রচনার চেষ্টা করা হচ্ছে। মণিপুরী লিপির একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল যে, এগুলি মানুষের একেকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নামানুযায়ী নামাঙ্কিত। যেমনঃ বাংলা ‘ক’ এর মণিপুরী প্রতিবর্ণ কোক, যার অর্থ মাথা ইত্যাদি।
২.২.খ. খুমি ভাষাঃ প্রায় দেড় হাজারেরও অধিক খুমি বান্দরবান জেলায় এবং থান্চি উপজেলায় বসবাস করে থাকে। খুমি-দের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। হাতে গোনা কয়েকজন বাদে খুমিদের প্রায় সবাই তাদের নিজস্ব ভাষা ব্যতীত অন্য ভাষায় কথা বলতে পারেননা।
২.৩ সাক-লুই শাখাঃ
২.৩.ক. চাক (Chak)t মঙ্গোলয়েড চাক-রা নিজেদেরকে পরিচয় দেয় আসাক্ (Asak) বলে। বর্মীরা চাকমা ও চাক উভয় জনগোষ্টীকেই সাক্ (Sak) বা থেক্ (Thak) বলে থাকে। তবে পার্বত্য চট্রগ্রামের দক্ষিণে বাইশারি, নাক্ষ্যংছড়ি, আলিখ্যং, কামিছড়া, কোয়াংঝিরি, ক্রোক্ষ্যং প্রভৃতি জায়গাতে প্রায় আড়াই হাজার চাক বাস করে যাদের ভাষা চাকমা ভাষার থেকে আলাদা। চাকমা ভাষা ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারের হলেও চাকদের ভাষা তিব্বতী-চীন পরিবারের। চাক বা আসাক্ (Asak) ভাষার সাথে উত্তর বার্মার কাডু (Kadu), গানান (Ganan) জনগোষ্ঠীর ভাষার মিল পাওয়া যায়। চাক ভাষার কোন বর্ণমালা নেই। তবে চাকদের লোক সংস্কৃতি বিভিন্ন লোকগাথাঁ, ধাঁধাঁ, লোকগীতি ইত্যাদি বেশ স্বযং সম্পূর্ন।
২.৩.খ. ঠার বা থেক বা ঠেট ভাষাঃ বর্তমানে বাংলাদেশে ঠার বা থেক বা ঠেট ভাষা-ভাষীর সংখ্যা প্রায় ৪০০০০। ১৬৩৮ খ্রীষ্টাব্দে শরনার্থী আরাকানরাজ বলালরাজার সাথে মনতং (Mon-Tong) জাতির যে ক্ষুদ্র অংশ বাংলাদেশে প্রবেশ করে তাদের আনীত ভাষার নাম ঠার বা ঠেট বা থেক ভাষা। লোকচিকিৎসা (ethno-medical) পেশার সাথে সম্পৃক্ততার দরুন কালক্রমে এরা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল এমনকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে ছড়িয়ে পড়ে এবং বাইদ্যা বা বেদে নামে পরিচিতি লাভ করে। এই মনতং বা বেদেরা নিজ জাতির লোকদের মধ্যে ঠার ভাষা ব্যবহার করলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে এরা বাংলা ভাষাতেই কথা বলে। ঠার ভাষা-র নিজস্ব কোন বর্ণমালা না থাকলেও এদের লোকসাহিত্য বেশ সমৃদ্ধ। ঠার বা থেক বা ঠেট ভাষা -র বার্মা, চীন, লাওসে প্রচলিত কাডু ভাষার সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। উত্তর বার্মায় থেক, সাক, আসাক ইত্যাদি সবগুলোকেই কাডু ভাষার অন্তর্গত বলে ধরা হয়।
২.৪.বার্মীজ শাখা ঃ
২.৪.ক . রাখাইন ভাষাঃ কক্সবাজার, বরগুনা, পটুয়াখালী, চট্রগ্রাম ও পার্বত্য চট্রগ্রামে প্রায় দেড়লক্ষেরও অধিক লোক রাখাইন ভাষায় কথা বলে। রাখাইন ভাষা অত্যন্ত প্রাচীন ও সমৃদ্ধ একটি ভাষা। জানা যায় খ্রীষ্ট পূর্ব ৩৩২৫ সাল হতে রাখাইন রাজা মারায়ু কর্তৃক রাখাইন প্রে বা রাখাইন রাজ্যে প্রতিষ্ঠার পর থেকে সুদীর্ঘ কাল পর্যন্ত রাখাইন ভাষা ছিল ঐ রাজ্যের একমাত্র জাতীয় ভাষা। রাখাইনদের নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। রাখাইন বর্ণমালায় স্বরবর্ণ বা ছারা হল ১২টি এবং ব্যাঞ্জনবর্ণ বা ব্যেঃ মোট ৩৩টি। রাখাইন ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রথমে স্বরবর্ণ এবং পরে ব্যাঞ্জন বর্ণ শেখানো হয়। নিকট অতীত কালেও ক্যং-এ রাখাইন ভাষা শেখানোর প্রথা প্রচলিত থাকলেও বর্তমানে তা কেবল পারিবারিক পর্যায়েই সীমাবদ্ধ। তারপরও বর্তমানে রাখাইনদের শতকরা প্রায় ৭০ জনেরও বেশী লোক নিজ ভাষায় লিখতে ও পড়তে সক্ষম।
৩. ভাষা পরিবার-দ্রাবিড়ঃ দ্রাবিড় শব্দটি প্রসারিত অর্থে দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতের এক বিশাল ভাষা পরিবার। আযর্-দের আগমনের বহু পূর্বেই এই দ্রাবিড় ভাষা সমূহ সমগ্র ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশে দ্রাবিড় ভাষা পরিবারের ভাষা সমূহের মধ্যে কুড়ুখ বা ওঁরাও, পাহাড়িয়া, মাহালি প্রভৃতি ভাষা প্রচলিত।
৩.ক. ওঁরাও বা কুড়ুখ ভাষাঃ লালমণিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও পাবনা ব্যতীত উত্তরবঙ্গের প্রায় সবকটি জেলাতেই ওঁরাও বা কুড়ুখ ভাষা-ভাষীদের বসবাস লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশ এদের মোট সংখ্যা প্রায় ৬৫০০০ জন। কুড়ুখ ভাষাটি আদি ও অবিমিশ্র এবং এটি দিনাজপুর ও নওগাঁ জেলায় বসবাসরত ওরাঁওরা ব্যবহার করলেও সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, বগুড়া, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা ও রংপুর অঞ্চলের ওঁরাওরা মূলত কুড়ুখ্, উড়িয়া, উর্দ্দূ, হিন্দী, ফার্সী ও বাংলা মিশ্রিত ভাষা ব্যবহার করে । কুড়ুখ ভাষা মূলত কথ্য ভাষা। এই ভাষার নিজস্ব কোন বর্ণমালা তৈরি হয়নি।
৩.খ. পাহাড়িয়া ভাষাঃ বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী, দিনাজপুরে প্রায় ৭৩৬১ জন পাহাড়িয়া জাতির লোক বাস করে। পাহাড়িয়া জাতির দুটি শাখা রয়েছে। এদের একটি শাওরিয়া পাহাড়িয়া বা মালের এবং অন্যটি মাল পাহাড়িয়া বা মালো। বাংলাদেশে মাল পাহাড়িয়া-দের সংখ্যা কম। সুনীতি কুমার চট্রোপাধ্যায়, অতীন্দ্র মজুমদার সহ অনেকেই মালপাহাড়িয়া-দের ভাষাকে মাল্তো বলে উলেখ করেছেন। তবে ডঃ শিবানী রায়ের মতে এদের ভাষার নাম বাড়লা, যা আসলে মিশ্র ভাষা এবং দীর্ঘদিন বাঙালিদের পাশাপাশি বসবাসের ফলে তা হয়েছে। আবার সুবোধ ঘোষ মাল পাহাড়িয়া-দের ভাষাকে বাংলা ভাষার অপভ্রংশ হিসেবে দেখিয়েছেন। শাওরিয়া পাহাড়িয়া-দের ভাষাকে কেউ কেউ পলী ভাষা হিসেবে দেখিয়েছেন যা কিনা শাদ্রি-র খুব কাছাকাছি। যা হোক শাওরিয়া ও মাল পাহাড়িয়া-দের ভাষার কোন নিজস্ব বর্ণমালা নেই। মূলত ওরাল লিটারেচারের মাধ্যমেই এই ভাষা তার অতীত ঐতিহ্যগাঁথা ধরে রাখতে পেরেছে।
৩.গ. মাহালি ভাষাঃ বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের মাহালি নামের জাতিগোষ্ঠির ভাষার নাম মাহালি ভাষা, যা দ্রাবিড় ভাষা পরিবার ভুক্ত। বর্তমানে এরা মূলতঃ বাংলা ভাষাতেই কথা বললেও এদের কথ্য ভাষায় আজও মূল মাহালি ভাষার কিছু কিছু শব্দাবলীর প্রচলন রয়ে গেছে। যেমন- দাস্ (পানি), দাকা (ভাত), গুড়া (ঘর), দানড়ী (গরু) ইত্যাদি।
৪. ভাষা পরিবার-ইন্দো-এরিয়ান ঃ নর্ডিক (Nordic) এবং আলপীয় (Alpine) নামের দুই ভিন্ন নরগোষ্ঠী ভারতবর্ষে আর্য ভাষার প্রবর্তন করেছিল। নর্ডিক-দের রচিত ঋগ্বেদের ভাষাই আর্য ভাষার প্রাচীন নিদর্শন। ঋগ্বেদের ভাষা তথা বৈদিক ভাষা পরবর্তিতে ব্যাকরণবিদদের হাত ধরে সংস্কৃত ভাষায় রূপান্তরিত হয়। কালক্রমে এই সংস্কৃত ভাষা লোক মুখে বিকৃত হতে হতে প্রাকৃত ভাষার রূপ নেয়। এই প্রাকৃত ভাষা থেকেই ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারের ভাষা সমূহের উৎপত্তি। বাংলাদেশে ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারভুক্ত কয়েকটি ভাষার পরিচয় নিম্নে দেওয়া হল-
৪.ক. চাকমা ভাষাঃ বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাগুলির মধ্যে চাকমা-রা সংখ্যায় সর্বাধিক (প্রায় তিন লক্ষ)। পার্বত্য চট্রগ্রামে বসবাসরত এই চাকমা জাতির নিজস্ব ভাষা ও সাহিত্য রয়েছে, রয়েছে তাদের নিজস্ব বর্ণমালা। এ বর্ণমালার সাথে সাদৃশ্য রয়েছে বর্মী ও অসমীয় বর্ণমালা। অতীতে চাকমা লিপিতেই চাকমা সাহিত্য রচিত হত। খ্রীষ্টান মিশনারিরাই সর্বপ্রথম ১৮৮৬ সালে ভারতের এলাহাবাদের এক ছাপাখানা হতে চাকমা লিপিতে ও চাকমা ভাষায় অনূদিত বাইবেল প্রকাশ করে। ত্রিশ বা চলিশের দশকে হরকিশোর চাকমা কর্তৃক চাকমা লেখা নামক বই চাকমা লিপিতে প্রকাশিত হয়।
৪.খ. রাজবংশী ভাষাঃ প্রায় সাড়ে সাত হাজারেরও অধিক রাজবংশী রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, বগুড়া, ময়মনসিংহ ও যশোরে বাস করে। ধারনা করা হয় রাজবংশী ভাষা একসময় বৃহত্তর বোডো (Bodo) ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। যদিও রাজবংশীরা বোডো ভাষা হারিয়ে বর্তমানে বাংলা ভাষাতেই কথা বলে; তবু এখনো রাজবংশী ভাষার ক্রিয়াপদ ও বিশেষ্য পদের শেষে ও মাঝে ঙ, ং এর উচ্চারণ, বোডো ভাষার উৎসজাত শব্দাবলী এবং বোডো ভাষার অপভ্রংশ লক্ষ্য করা যায়.
৪.গ. মাহাতো ভাষাঃ মাহাতো জাতির নিজস্ব মাহাতো ভাষা বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ হাজারেরও অধিক লোক ব্যবহার করে। এদের বসবাস সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ ও রায়গঞ্জ এবং বগুড়া জেলার শেরপুর থানার অর্ন্তগত গ্রাম গুলোতে। মাহাতোরা নিজেদের ভাষাকে নাগ্রী ভাষা বলে উলেখ করে। মাহাতোদের ভাষাকে কেউ কেউ শাদ্রি ভাষাও বলে থাকেন। মাহাতো ভাষায় হিন্দী, উর্দ্দূ, বাংলা, অহমীয়া ভাষার মিশ্রণ ঘটেছে। মাহাতো ভাষার নিজস্ব কোন হরফ নেই।
৪.ঘ. বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাঃ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী-দের বসবাস সিলেট বিভাগে। আগেই বলা হয়েছে জাতিগত ভাবে এক হলেও মণিপুরী জাতি ভাষাগত ভাবে দুই ভাগে বিভক্ত। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার দুটি উপভাষা রয়েছে- এদের একটি রাজার গাঙ (= রাজার গ্রাম) এবং অপরটি মাদাই গাঙ (= রানীর গ্রাম)। ডঃ কে পি সিন্হা-র মতে নব ইন্দো-আর্য ভাষার উৎপত্তি কালে বা সামান্য পরে অর্থাৎ ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতকে ইন্দো-আর্য ভাষার থেকে পৃথক বৈশিষ্ট্য নিয়ে স্বতন্ত্র্য ভাষা হিসেবে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা সর্বপ্রথম ভারতের মণিপুর রাজ্যে প্রচলিত হয়ে থাকে। এই নব্যপ্রচলিত বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় ষোড়শ শতাব্দীতে। ত্রয়োদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈ জনগোষ্ঠীর ঘনিষ্ট সংস্পর্শের কারনে এসময় বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষার ব্যাপক মৈতৈ শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটে। উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী-রা মণিপুর ছেড়ে ত্রিপুরা, আসাম ও বাংলাদেশের সিলেটে আশ্রয় গ্রহন করে। এসময় কালেই মূলতঃ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষায় ব্যাপক ভাবে ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারের শব্দাবলী প্রবেশ করে। অহমিয় ও বাংলা ভাষার সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যাবলীর মিল থাকার কারনে অনেকেই এই ভাষাকে অহমিয় ও বাংলা-র একটি উপভাষা হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করেন। ডঃ কে. পি. সিন্হার মতে এই বৈশিষ্ট্যগত মিল সম্ভব হয়েছে বাংলা, অহমিয় ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার উৎপত্তি একই উৎস থেকে (মাগ্দী প্রাকৃত) বলে।
বহুজাতিক ও বহুভাষিক রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বার ভাষা সমূহ সবসময় বৃহত্তর জাতির ভাষার চাপে কোনঠাসা হয়ে পড়ে। সেখানে বৃহত্তর জাতির ভাষা বা তাদের সুবিধা মতন অন্য কোন ভাষা প্রধান হয়ে উঠবার এবং জোড়পূর্বক একভাষিকতা চাপানোর একটা অসৎ প্রবনতা পরিলক্ষিত হয়। বুর্জোয়া রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এই প্রবনতার মাত্রা অত্যন্ত প্রকট ও খোলামেলা রূপেই দেখা যায়। যদিও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নেও রুশ ভাষার জৌলুস এবং আধিপত্যের কাছে লেট্, এস্তোনিয়া সহ অন্যান্য ভাষা গুলোর অবস্থা ছিলো অত্যন্ত ম্রিয়মান। আমাদের বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতেও বাঙালি ভিন্ন অন্যান্য জাতিসত্ত্বার ভাষা সমূহের অবস্থা অত্যন্ত কোনঠাসা। বাংলাদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা সমূহের সবগুলোই মূলতঃ দ্বি-ভাষী (Bilingual) নিজ পরিবার বা নিজ জাতিসত্ত্বার ভিতরে এরা নিজ মাতৃভাষায় কথা বললেও বাইরের কারো সাথে এরা বাংলাতেই কথা বলে। অনেক গুলি জাতিসত্ত্বা নানাবিধ কারনে আজ তাদের নিজ মাতৃভাষা হারিয়ে বাংলা ভাষাতেই কথা বলে। এদের মধ্যে বিন্ধ, কোচ, রাজবংশী, পাহাড়িয়া, হো, বর্মন, ইত্যাদি উলেখযোগ্য। সত্তরের দশকে চাকমা ও মারমা-রা ক্যং-এ তাদের নিজস্ব লিপিতে নিজ নিজ ভাষার চর্চা করত। বিভিন্ন কারনে আজ সেই ব্যবস্থাও বন্ধ। নতুন প্রজন্মের চাকমা-রা আজ আর তাদের নিজ বর্ণমালার সাথে পরিচিত নয়। মাহালি, বুনো, বাগদী জাতিসত্ত্বার লোকজন তাদের মাতৃভাষায় কথা বলতে অক্ষম। মনতং বা বেদে-দের ঠেট বা ঠার ভাষা তার নিজস্ব উপাদান হারাতে হারাতে রিক্ত হতে চলেছে। প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার অভাবে মণিপুরী, ককবরক, খাসিয়া, সাঁওতাল, ওঁরাও ভাষা গুলো ধীরে ধীরে বিলুপ্তির দিকে পা বাড়াচ্ছে। এই হচ্ছে আজ বাংলাদেশের ভাষা সমূহের সামগ্রিক চিত্র। এই যে ভাষা গুলির হারিয়ে যাওয়া বা ধ্বংসের প্রান্তিক সীমায় অগ্রসর হওয়া তা শুধু মাত্র একেকটি ভাষার হারিয়ে যাওয়া বা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পূর্ব চিহ্নমাত্র নয়; এই হারিয়ে যাওয়া হল একেকটি জাতিসত্তার নিজস্ব আবেগ, অনুভূতি, স্বপ্ন, লোকায়ত জ্ঞান, সংস্কৃতির হারিয়ে যাওয়া। আর কোন জাতির এগুলি হারানোর অর্থ হল পৃথিবীর বুক থেকে সেই জাতির অস্তিত্ব চিরতরে মুছে যাওয়া। ইউনেস্কো কর্তৃক একুশে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার মূল লক্ষ্য হল পৃথিবীতে ভাষার বহুত্ব, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও ভিন্নতাকে সংরক্ষণ ও উন্নয়ন। যে বাঙালি জাতিকে ১৯৫২ সালে চরম আত্মত্যাগ করতে হয়েছিল নিজ মায়ের ভাষা রক্ষার জন্য, সেই জাতির স্বাধীন রাষ্ট্রভূমিতে বসবাসরত অন্যান্য জাতিসত্ত্বা সমূহের ভাষা গুলোর যে করুন অবস্থা তা সত্যিই লজ্জাজনক, দুঃখজনক। স্বাধীনতার ৩৩ বছর পরেও এই বাংলাদেশ রাষ্ট্র বাঙালি ভিন্ন অপরাপর জাতিসত্ত্বার ভাষা সমূহের সংরক্ষণ, উন্নয়নের ব্যাপারে কোন কার্যকর পদক্ষেপ তো নেয়েইনি বরং এই সমস্ত ভাষা সমূহের অধিকারী বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার অস্তিত্বও স্বীকার করেনি। বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় এখানকার ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা সমূহের নিজ মাতৃভাষাতে লেখাপড়া করার কোন সুযোগ রাখা হয়নি। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেই মণিপুরী, খাসিয়া, মান্দি, সাঁওতাল সহ বিভিন্ন জাতিসত্ত্বা স্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও নিজ নিজ মাতৃভাষায় পড়াশোনা করছে। এখন ‘একুশে’-র অহংঙ্কার ধারনকারী এই বাংলাদেশ রাষ্ট্র কি পারবে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে উপস্থিত এই সমস্ত ভাষা গুলি রক্ষার কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ? তার বিশাল ভাষা জাদুঘরকে জীবন্ত রাখতে ? নাকি আগামী ৩০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যেই প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের অধিকারী এই বাংলাদেশ হারাবে তার ভাষার বৈচিত্র্যতাকে, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যতাকে ?
উলেখ্যপঞ্জি ঃ
গ্রন্থ সমূহঃ
১. Chittagonj Hill Tracts- R. H. Sneyd Hutchinson Vivek Publishing company, DelhiFirst Published 1901, Reprint 1978 .
২.The peoples of India- Anderson, J.DBimla pub. ।। First Published 1913.
৩. An Etymological Dictionary of Bishnupriya Manipuri- Dr. K. P. Sinha Puthi, Calcutta 1986.
৪. ভাষাতত্ত্ব - অতীন্দ্র মজুমদার।। নয়াপ্রকাশ, কলিকাতা।। ১৯৯৭।
৫.ভারতের ভাষা ও ভাষা সমস্যা- সুনীতকুমার চট্রোপাধ্যায়।। রূপা অ্যান্ড কোম্পানী, কলিকাতা, জানুয়ারী ১৯৯২।
৬. ভারত সংস্কৃতি- সুনীতকুমার চট্রোপাধ্যায়।। মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃলিঃ কলকাতা।। আষাঢ় ১৪০৪।
৭. ভারতের আদিবাসী- সুবোধ ঘোষ।। ন্যাশনাল বুক এজেন্সী প্রাঃ লিঃ, কলকাতা।। b‡f¤^i ২০০০।
৮.ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়- ডঃ অতুল সুর।। সাহিত্যলোক, কলকাতা।। জুলাই ১৯৮৮।
৯.ভাষা, দেশ, কাল- পবিত্র সরকার।। জি.এ.ই. পাবলিশার্স।। বৈশাখ ১৩৯২।
১০. উপভাষা চর্চার ভূমিকা- মনিরুজ্জামান।। বাংলা একাডেমী, ঢাকা।। মে, ১৯৯৪।
১১. ককবরক ভাষা ও সাহিত্য- কুমুদ কুন্ডু চৌধুরী।। অক্ষর পাবলিকেশান্স, আগরতলা।।
১২.পার্বত্য চট্রগ্রামের উপজাতীয় ভাষা- সুগত চাকমা।। উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনষ্টিটিউট।। রাঙ্গমাটি।। মার্চ ১৯৮৮।১৩ বাংলাদেশের ১৩. গারো সমপ্রদায়- সুভাষ জেংচাম।। বাংলা একাডেমী. ঢাকা।। ১৯৯৪।
১৪.চাকমা পরিচিতি- সুগত চাকমা।। বরগাঙ পাবলিকেশন্স, রাঙ্গামাটি।। অক্টোবর ১৯৮৩।
১৫. বাংলাদেশের সাঁওতালঃ জীবন ও সংস্কৃতি- আখতার উদ্দিন মানিক।। উত্তরা প্রকাশনা ,মোহাম্মদপুর,ঢাকা।। wW‡m¤^i ১৯৯৮ ১৬.উত্তরবঙ্গের আদিবাসীঃ লোকজীবন ও লোকসাহিত্যঃ ওঁরাও- ডঃ মুহাম্মদ আব্দুল জলিল।। বিশ্ব সাহিত্য ভবন, ঢাকা।। মে ২০০১।
১৭. আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতিঃ প্রসঙ্গ নদীয়া জেলা- ডঃ শিবানী রায় (মওল)।। পুস্তক বিপনি, বেনিয়াটোলা লেন, কলিকাতা।। অক্টোবর ২০০২।
১৮. সিলেটের নিঃস্ব আদিবাসী পাত্র- ডঃ রতন লাল চক্রবর্তী।। মওলা ব্রাদার্স, ঢাকা।। মে ২০০০।
১৯. বাংলাদেশের মণিপুরীঃ ত্রয়ী সংস্কৃতির ত্রিবেনী সঙ্গমে- এ কে শেরাম।। আগামী প্রকাশনী; ঢাকা।। ১৯৯৬।
২০. বাংলাদেশে রাখাইন সমপ্রদায়ঃ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও জীবনধারা-মং বা অং (মং বা)।।প্রকাশক-লেখক।।এপ্রিল ২০০৩ খ্রী.।
প্রবন্ধ/পত্রিকাঃ
১. হাজং জীবনের ইতিবৃত্ত- মুজিব মেহেদী।। বাংলাদেশের উপজাতি ও আদিবাসীঃ অংশীদারিত্বের নতুন দিগন্ত- সম্পাদনাঃ হাফিজ রশীদ খান।। পাঠক সমাবেশ, ঢাকা।। ১৯৯৩।
২. বরেন্দ্র অঞ্চলের বিন্ধ জাতিগোষ্ঠীঃ সামাজিক-রাজনৈতিক পরিচয় উদ্ঘাটন- ডঃ মোঃ আব্দুর রশীদ সিদ্দিকী।। আইবিএস জার্নাল।। ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।। ১০ম সংখ্যা ১৪০৯
৩. মানুষ- সম্পাদনাঃ মোহাম্মদ মহসীন।। এফআইভিডিবি, খাদিমনগর, সিলেট।। †m‡Þ¤^iÑ অক্টোবর ১৯৯৭।
(This article was published in `Mhrittika’-vol.-1, issue-1; editor-Jewel Bin Zahir, Parag Ritchil, Dopor Mitra; Dhaka, August 2004)
No comments:
Post a Comment